লালমোহন ও অন্যান্য থানা দখল, ভোলা
[অংশগ্রহনকারীর বর্ণনা]
লালমোহন থানার সবচেয়ে কাছে পোস্ট অফিস বিল্ডিং। পোস্ট মাস্টার সাহেব বেশ সহযোগিতা করলেন এবং থানার দিকের দেয়াল ভেঙে সেখান থেকে থানা আক্রমণের পরামর্শ দিলেন। পোস্টমাস্টার সাহেব কোথা থেকে শাবল এনে দিলেন, দেয়াল ভেঙে গোটা চারেক ইট সরিয়ে সেখানে আচমতকে বসিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকেরা যে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করলেন। থানায় ততক্ষণে নিশ্চয়ই খবর পৌঁছে গেছে। তবে থানার ভিতর থেকে কোন আক্রমণ হলনা। এভাবে সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে বেলা ১১ টার দিকে আমরা থানা আক্রমণ শুরু করি। মোতাহার মাস্টার এমসিএ, ফারুক মিয়াসহ ৮/১০ জন ইতিমধ্যে আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। প্রথম দিকে ৫/৬ রাউন্ড গুলি করা হয়। গোটা চারেক হাতবোমা ফাটানো হয়। এর কিছু পরেই থানার ভিতর থেকে গুলি শুরু হল। থানার ভেতর থেকে অনবরত গুলি এলেও আমরা ধীরে সুস্থে গুলি ছুড়তে থাকি। এভাবে প্রায় দুই ঘন্টা পেরিয়ে যায়। আমরা আশা করেছিলাম, রাজাকার আর পুলিশ প্রথমেই আত্মসমর্পন করবে, বাস্তবে তা হচ্ছে না। আমরা ক্রমাগত চিন্তিত হয়ে উঠলাম। এরপর লালমোহন বাজার থেকে মেইল আনা হল এবং মাইকে পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পন করতে অনুরোধ করলাম। এটাও ঘোষণা করলাম যে, তারা আত্মসমর্পন করলে কাউকে আমরা হত্যা করব না। তারা যার যার বাড়িতে চলে যেতে পারবে। কিন্তু মাইকিংয়ে এই অনুরোধে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা। থানার ভিতর থেকে অনবরত গুলি আসতেই লাগল। তবে একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় ওরা নির্দিষ্ট টার্গেট করে গুলি ছুড়ছিল না। সব গুলিই বাড়িঘরের ওপর দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছিল। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, আত্মসমর্পনের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছেনা। ওদিকে বাজারসহ আশেপাশে শত শত মানুষ এসে আমাদের পাশে ভিড় জমিয়েছে। আর মাঝে মাঝে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছে। এর মধ্যে লালমোহনের খান বাহাদুর সাহেব, লাল০মোহন মাদ্রাসার মোদাচ্ছের এক এক করে নিজ পরিচয় দিয়ে রাজাকার, পুলিশদের আত্মসমর্পনের অনুরোধ জানান। বেশ কয়েকজন রাজাকারের নিকটাত্মীয়রাও মাইকে মাইকে রাজাকারদের নাম ধরে আত্মসমর্পনের অনুরোধ জানায়। গোলাগুলি বন্ধ করতে বলে। এরপর আমরা ওদের আবার মাইকে নিশ্চয়তা দিলাম, তোমাদের কোন ক্ষতি করা হবেনা, তোমরা আত্মসমর্পন কর। সময় গড়িয়ে তখন বিকেল সাড়ে তিনটার মত হবে। হোসেন চৌধুরীর পরামর্শে বাজার থেকে স্থানীয় লোকের সহযোগিতায় চটের রোল আর চার টিন কেরোসিন আনা হল। বিকেল ৪ টার রাজাকারদের শেষবারের মত বলা হল, তোমরা আত্মসমর্পন কর, নইলে তোমাদের পুড়িয়ে মারা হবে। এদিকে এক এক করে অনেক রাজাকারের আত্মীয় স্বজন মাইকে রাজাকারদের নাম ধরে কান্নাকাটি শুরু করল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেপায়ে ধরে রাজাকারদের আত্মীয় স্বজন কান্নাকাটি শুরু করল , যাতে রাজাকারদের না মারা হয়। আমরা শেষ ওয়ার্নিং দিয়ে পরিকল্পিতভাবে একসঙ্গে সবকটি রাইফেল দিয়ে গুলি শুরু করলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে প্রায় ১০০ রাউন্ড গুলি শেষ করে আমরা গুলি বন্ধ করে দিলাম। এখন অপেক্ষার পালা। থানার ভিতর থেকেও গুলি আসছেনা। এরপর থানার ভিতর থেকে একজন হাত উঁচিয়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, আমাদের জীবন ভিক্ষা দিলে আমরা অস্ত্র সমর্পন করব। উত্তরে মকছু ভাই তৎক্ষণাৎ তাদের মারা হবেনা এবং তারা যার যার বাড়ি চলে যেতে পারবে বলে নিশ্চয়তা দিলেন। অবশেষে রাজাকার ও পুলিশ মিলে ৪৫ জন হাত উঁচিয়ে অস্ত্র রেখে একে একে থানা থেকে বেরিয়ে এলো। ল্যান্স নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, হাবিলদার শামসুদ্দিন, আচমতসহ ১০/১২ জন দৌড়ে থানার ভিতর ঢুকে গেল। মুচু সিদ্দিক, অহিদ সহ ১০/১২ জন রাজাকার কর্ডন করে রাখল। আমরা থানার মধ্যে সব জিনিসপত্র বিশৃঙ্খল অবস্থায় পেলাম। সবমিলিয়ে ৬০ টি ৩০৩ রাইফেল পাওয়া গেল। গুলি পাওয়া গেল ১০০০ রাউন্ডের মত। চার বাক্স গুলি সহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সকালে থানা আক্রমনের আগেই থানা থেকে পালিয়ে যায়। লালমোহন থানা দখলের মধ্যে দিয়ে যেসব আগ্রহী যোদ্ধা, যাদের কাছে অস্ত্র ছিলনা তাদের রাইফেল বন্টন করে দেওয়া হয়। ছিদ্দিকুর রহমানকে তাদের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। থানা দখলের কিছু পরেই এমসিএ মোতাহার মাস্টার আর সঙ্গের লোকজন নিয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যার পর তখনো বাজারের শত শত মানুষ। জয়বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে বাতাস মুখরিত করে রাখে। আমরা হালকা চা নাশতা করে দেউলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে আসি। মকছু ভাই চলে গেলেন লিয়াকতদের সঙ্গে চরফ্যাশনের দিকে। লালমোহন থানা দখলের পর হাবিলদার আজিজুল হক, হাবিলদার হযরত আলী, রেজাই করিম এমসিএ, শামছু মিয়া এবং নাজিমউদ্দিন মিয়া বোরহানউদ্দিন থানা দখলের একটি পরিকল্পনায় এক গোপন মিটিং করেন সুদ্রকান্তি হাওলাদার বাড়িতে। শামছু মিয়ার সঙ্গে তৎকালীন বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিশেষ সখ্য ছিল। ঐ মিটিংয়ে শামছু মিয়া আশ্বাস দেন, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বাধীনতার সপক্ষের লোক। এমন একটি অবস্থা তৈরি করতে হবে যাতে পাক বাহিনী ভবিষ্যতে জবাবিদিহি করলে যাতে তিনি বলতে পারেন মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই থানা লুট হয়ে যায়। তবে রাজাকারদের ব্যাপারটা কি করা যায় সেটাই চিন্তার ব্যাপার। হাবিলদার আজিজুল হক তখন একটি গোপনীয় সংবাদ সবাইকে জানাল। দেউলা যুদ্ধের পর থেকেই মোবাশ্বের উল্লাহ (বর্তমানে সাংবাদিক) বোরহানউদ্দিন থানা রাজাকার কমান্ডারের (বাড়ি গঙ্গাপুরে) সঙ্গে যোগাযোগ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের পরামর্শ দিয়েছে। না হলে মুক্তিযোদ্ধারা যে কোন মুহুর্তে তাদের খতম করে দিতে পারে-এরকম ভয় প্রদর্শন করেন। যেহেতু মোবাশ্বেরের ঐ রাজাকার কমান্ডারটি পূর্ব পরিচিত ছিল। মোবাশ্বেরের পরামর্শে সে রাজি হয়ে যায় এবং জানায়, আমি যদি অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে অন্য রাজাকারদের বলি তাহলে অনেকে রাজি হলেও যদি দুইচারজন রাজি না হয় তাহলে আমি ভীষণ অসুবিধায় পড়ে যাব। তবে মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করলে কমান্ডার হিসেবে তখন সবাইকে নিষ্ক্রিয় করেতে পারব। মোবাশ্বের উল্লাহ এই খবর ইতিমধ্যে হাবিলদার আজিজুল হককে জানিয়ে দেন। আলোচনার ফলাফলে দেখা যায়, পুলিশ এবং রাজাকার কোন গ্রুপই থানা দখলে প্রতিরোধ করবে না। তাহলে দেখা যায়, থানা দখলে তেমন কোন বেগ পেতে হচ্ছে না। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেদিনই শামছু মিয়া থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে পরদিন জানাবে। অন্যদিকে হাবিলদার আজিজুল হক ছুটল মোবাশ্বের উল্লাহর খোঁজে। তাকে পাওয়া গেল বাড়িতে। তখন তাকে পাঠানো হল রাজাকার কমান্ডারের সঙ্গে চূড়ান্ত কথা বলে কী মতামত জানায় তা জানার জন্য। সেদিন রাতে মোবাশ্বের উল্লাহ হাবিলদার আজিজুল হককে জানিয়ে গেলেন রাজাকার কমান্ডার কোন প্রতিরোধ করবেনা। অন্যদিকে শামছু মিয়া পরদিন সকালে আজিজুল হককে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সবুজ সংকেতের কথা জানিয়ে দিল। তখন বোরহানউদ্দিন বাজার এ রকম বিদ্যুতে আলোকিত ছিলনা। সন্ধ্যার পর উত্তর বাজার ও পশ্চিম বাজারে দোকানপাট খোলা থাকলেও থানার ভোদিকে এরকম দোকানপাট তখন ছিলনা। ফলে মোটামুটি অন্ধকারই থাকত। ২৯ সেপ্টেম্বর আজিজুল হক ও হযরত আলীর গ্রুপ সন্ধ্যার পর নিঃশব্দে থানার তিনদিকেই ঘেরাও করে বসে থাকে। তাদের সঙ্গে সেদিন ২০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা। সন্ধ্যা আটটার দিকে হাবিলদার হযরত আলী ও আজিজুল হক ত্বরিতগতিতে থানায় ঢুকে পড়ে থানার ওসি এবং ডিউটি অফিসারকে অস্ত্রের মুখে আত্মসমর্পন করায়। অন্যদিকে ডা. মমিনুল হক ও মান্নান আত্মসমর্পন করায় রাজাকারদের। তারা ভেতরে ঢোকার মুহুর্তে অস্ত্রের মুখে ত্বড়িৎগতিতে পুলিশ ও রাজাকার সেন্ট্রিকে আত্মসমর্পন করায় ছালে আহমদ খাঁ ও নায়েক শামসুল হক। তাদের পিছনে অস্ত্র হাতে কভারে থাকে নায়েক ওয়ালী, নায়েক নুরুজ্জামান ও কাঞ্চন মিয়া। ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় নিশঃব্দে ৪২ টি রাইফেল ও ১২০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে থানা থেকে বের হয়ে জয়বাংলা শ্লোগান দেয় এবং ২০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এভাবে হাবিলদার আজিজুল হক গ্রুপ বিনা বাধায় বোরহানউদ্দিন থানা দখল করে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতেই দেউলা ক্যাম্পে খবর পৌঁছে যায় যে, হাবিলদার আজিজুল হক ও হযরত আলী গ্রুপ বোরহানউদ্দিন থানা দখল করে নেয়। পরদিন দেউলা ক্যাম্পে বসে আমরা চরফ্যাশন থানা দখলের পরিকল্পনা করি এবং চর ফ্যাশনে মকছু ভাইয়ের ক্যাম্পে খবর পাঠাই। ১ অক্টোবর দেউলা থেকে বিকেলে রওনা হয়ে সেদিন রাতে চরফ্যাশনের ভদ্রপাড়ায় উপস্থিত হই। পরদিন প্রায় ১০০ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা থানা ঘেরাও করার পর ৪ টি হাতবোমা একসঙ্গে থানার সামনে নিক্ষেপ করে। এতে চরফ্যাশন বাজার কেঁপে ওঠে। এরপর কোনরকম বাধা ছাড়াই চরফ্যাশন থানার পুলিশ ও রাজাকাররা ২ অক্টোবর আত্মসমর্পন করে। চরফ্যাশন থানা থেকে পাওয়া যায় ৫০ টি রাইফেল ও ১৮০০ রাউন্ড গুলি। এই অঞ্চলে তখন বাকি থাকে শুধু তজুমদ্দিন থানা। ৫ অক্টোবর সিদ্দিক ও আচমতের নেতৃত্বে প্রায় ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা তজুমদ্দিন থানা ঘেরাও করে। সেখানেও বিনা বাধায় পুলিশ ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে এবং সেখান থেকে সংগৃহীত হয় ৪০ টি রাইফেল ও ৮০০ রাউন্ড গুলি। ভোলা মহকুমার মূল ভূখন্ডের ৬ টি থানার চারটি দখল হয়ে যায় ৫ অক্টোবরের মধ্যে। দৌলতখান ও ভোলা সদর ছাড়া পুরো এলাকা মুক্ত অঞ্চলে পরিণত হয়। সম্পূর্ণ খালি হাতে শুরু করে সাংগঠনিক তৎপরতাতেবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের অকৃপণ সাহায্যে জুন মাসের শেষ থেকে শুরু করে ৬ অক্টোবরের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে ২০৪ টির মত ৩০০৩ রাইফেল, ৫০০০ রাউন্ড গুলি ও তিনটি চায়নিজ রাইফেল।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত