You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.12 | রতনপুর যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ - সংগ্রামের নোটবুক

রতনপুর যুদ্ধ, মুন্সিগঞ্জ

মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর থানার পঞ্চসার ইউনিয়নের রতনপুরে ভট্টচার্যেরবাগ বর্তমান দেওয়ান বাজারের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধা সামসুল হুদা মতিন স্মৃতিচারণ করে বলেন-৪ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় শহিদুল আলম সাঈদের নেতৃত্বে ১৬ জনের একটি গ্রুপ দুটি রাস্তায় এ্যাম্বুশ করলো। একটি গ্রুপ পঞ্চসার দিয়ে বাইন্যা বাড়ির দিকে থাকবে এবং অপর গ্রুপটি চাপাতলি থেকে দেওয়ান বাজারের দিকে অ্যাম্বুশ করবে। চর্তুরিকে কো-অর্ডিনেশন চলে থাকলো। সবাইকে সতর্কবাণী পৌঁছানো হলো। সর্দার পাড়ার রাস্তায়-যে পথে আর্মিরা মুভ করবে সেখানে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩ পয়েন্টে রাখা হলো। আর্মি দেখলেই যেন দৌড়ে এসে খবর দেয় ঘাঁটিতে। দূরত্ব ভাগ করে ৩ জনকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কারণ একজনের পক্ষে কে.কে স্কুল থেকে রামপাল এসে খবর দেয়া সম্ভব নয়। পাকবাহিনীরা যে বাইন্যা বাড়ির রাস্তা দিয়ে আসতে না পারে সেজন্য ৩ ডিসেম্বর রাতের বেলা আনোয়ার হোসেন অনুর নেতৃত্ব বাইন্যা বাড়ির উত্তর ব্রিজটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। অনু ভাইর গ্রুপটি ছিল সবচেয়ে চৌকশ এবং শক্তিশালী। তাদের সাথে ভারী অস্ত্র ছিল। আনোয়ার হোসেন অনুর কাছে ছিল ২টি এস এল আর এবং আনিসুজ্জামানের কাছে এলএমজি। খালেকুজ্জামান খোকা, মহসীন বাবু তাদের গ্রুপে ছিলেন। আমাদের গ্রুপের কাছে ভারী অস্ত্র ছিল না। কিন্তু ছিল অদম্য মনোবল। সকাল ৭টায় শহিদুল আলম সাঈদের নেতৃত্ব সিজার এ্যাম্বুশ করা হলো। সিজার অ্যাম্বুশে আমাদের মধ্যে যে প্রথমে থাকবে সে শেষের আর্মিকে গুলি করবে আর যে শেষে থাকবে সে প্রথম আর্মিকে গুলি করবে। প্রথম জন যদি প্রথমেই গুলি করে তাহলে তো সবাই পালিয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রথমে নলের মাথায় আনতে হবে পরে গুলি করতে হবে। তখন সবাই পাক আর্মিদের অপেক্ষায় জঙ্গলে ওঁৎ পেতে বসে আছি। এদিকে খবর পেলাম আর্মির গ্রুপটি রামপালের দিকে আসতে শুরু করেছে। দূর থেকে দেখলাম আর্মিরা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু হঠাৎ আর্মির গ্রুপটি আনোয়ার দেওয়ানের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে শুরু করলো। বুঝতে পারলাম বাইন্যা বাড়ির ব্রিজটি দেখার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আমাদের কমান্ডার শহিদুল আলম সাঈদের অজান্তে অ্যাম্বুশ থেকে বেরিয়ে এসে ৬ জনকে নিয়ে পাক সেনাদের পিছু নিলাম। আমার সাথে ছিল ইকবাল, হাবলু, বাদল এবং আরো দু’জন। তাদের নাম মনে করতে পারছি না। মোট ৬ জনকে তিনভাগে ভাগ করলাম। আমার রাইফেলে ১০টি বুলেট লোড করে নিলাম। আমার সাথে প্রায় ১০০ গুলি ছিল। একটি সুরক্ষিত জায়গা দেখে ইকবালকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। দুই জন কমপক্ষে দুই জনকে খতম করবো। ওদের সংখ্যা ছিল ৮৫ জন। কিন্তু প্রথমে ওদের সংখ্যা হিসেব করতে পারিনি।
আনোয়ার দেওয়ানের বাড়িতে প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা মকবুল মিয়া ও সুলতান মিয়া আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের সাথে রাস্তায় আমাদের দেখা হয়। তাঁরা আমাদের এগিয়ে যেতে মানা করেন। কিন্তু আমরা তাদের কথা না শুনে এগিয়ে যাই। আমি ও ইকবাল একটি নিরাপদ জায়গায় এসে অ্যাম্বুশ করি। তখন আমি ইকবালকে বললাম, আমি ওই মোছওয়ালা আর্মিকে প্রথম গুলি করবো। আর তুমি পিছনের কালো মোটা রাজাকারটাকে গুলি করবে। আমরা চিন্তা করলাম আমাদের গুলির শব্দ শুনে সাঈদ ভাই এবং আনু ভাইর গ্রুপ দ্রুত চলে আসবে এবং আমাদের সাহায্য করতে পারবে। দু’জনেই এক সাথে গুলি চালালাম। দু’জন আর্মি গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। আমাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকবাহিনী হতভম্ব হয়ে পিছনে ফিরে যায়। আমি দেখলাম দুটি অস্ত্র পড়ে আছে। আমি অস্ত্রটির লোভ সামলাতে পারছিলাম না। এমতাবস্থায় একটি গাছের আড়াল থেকে অস্ত্র দুটি উদ্ধারের জন্য আমি যখন এগিয়ে যাই হঠাৎ আনোয়ার দেওয়ান এসে আমাকে বাধা দিলেন এবং বললেন যে, আর্মিরা শুয়ে আছে। অমনি পলকের মধ্যে কয়েক গুলি এসে পার্শ্ববর্তী একটি ঘর ঝাঁঝরা করে দিল। ঐ সময় আনোয়ার দেওয়ান বাধা না দিলে হয়তো সেইদিন আমরা মারা যেতাম। আর্মিরা কৌশল নিয়েছিল অস্ত্রের অন্য এগুতে চেষ্টা করলেই গুলি করবে।
আমাদের গুলির অবস্থা দেখে আর্মিরা চিন্তা করলো আমরা অস্ত্রে খুবই দুর্বল। তাই ওরা গুলি করছে আর এগিয়ে আসছে। আমরা পিছনের দিকে যাচ্ছি। আমি একটি মোটা আম গাছের আড়ালে এসে ম্যাগাজিন পরিবর্তন করলাম। ইকবালকে বললাম, আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত। সুতরাং মরবো যখন-লড়াই করেই মরবো। হঠাৎ দেখি অনু ভাই এসে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, কোন দিকে আমি বললাম, উত্তর আর দক্ষিণ দিকে। আমরা যখন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন অনু ভাই তাঁর গ্রুপ নিয়ে আমাদের পাশাপাশি ছলে আসছিলেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারছিলেন না পাকবাহিনী কোন দিকে ২/১ মিনিটের মধ্যে অনু ভাই দুই গ্রুপে তার কোর্স ভাগ করে এলএমজি উঁচিয়ে ফায়ার করতে লাগলেন। ব্রিটিশ এলএমজি দেখে তখন পাকবাহিনীরা ভয় পেয়ে গেল। তারা বুঝলো মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বেড়ে গেছে। আমি আর ইকবাল তখন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে অস্ত্র বুকে নিয়ে গাছের সাথে হেলান দিলাম। তখন আমারা বড্ড ক্লান্ত। তাছাড়া অনু ভাইর দল ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য তাঁর সাথে ছিল। এদিকে আমার কমান্ডার শহিদুল আলিম সাঈদ আমাকে না পেয়ে কাঁদছিলেন। আমাকে জীবিত বা মৃত হাজির করার জন্য অন্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ কমান্ডারের নির্দেশ ছাড়াই আমি এ্যাম্বুশ স্থান ছেড়ে সরে গিয়েছিলাম, তারপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ৪ জন রাজাকারের লাশ পাকবাহিনীরা কচুরির নিচে ফেলে ছলে যায়। আর রতনপুর ও সর্দারপাড়া বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে মাচা বানিয়ে ৮ জন আর্মির লাশ নিয়ে যায়। ওরা এমন জায়গায় আটকে গিয়েছিল, সে জায়গা ক্রস করার সময় বেশি মরেছে। কারণ সেখানে আমাদের একটি এলএমজি ছিল। ওরা একটু বেশি মাত্রায় এগিয়েছিল। তখন ওরা চিন্তাও করেনি এ পথেই ওদেরকে ফিরে আসতে হবে। সে যুদ্ধে পাক বাহিনী পরাস্ত হয়ে পালিয়ে যায়’।
টঙ্গীবাড়ী থানার অন্তর্গত যশলং ইউনিয়নস্থ রাখিয়া গ্রামের পাল বাড়িতে সেন্টার নেয়া একটি মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সদস্য আ. রশীদ তাদের ৮/১০ যুদ্ধের একটি উল্লেখযোগ্য ১২ নভেম্বর রতনপুর যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় লিখেছেন-আমাদের গ্রুপ কমান্ডার মো. হোসেন বাবুল, ব্যান্ড লিডার খালেকুজ্জামান সন্ধ্যা ৭:০০ টার দিকে সবার উদ্দেশ্যে বললেন তোমরা এখনি খেয়ে নাও তারপরে যার যার অস্ত্র নিয়ে তৈরী হয়ে যাও, সময় মার ১৫ মিনিট, অপারেশনে যেতে হবে মুন্সিগঞ্জ এলাকায়। কোন রকমে কিছু মুখে দিয়ে পোশাক পরে অস্ত্র কাঁধে তৈরী হয়ে বীর বিক্রমে রওয়ানা দিলাম পথিমধ্যে জানতে পারলাম ঐদিন ভোরে মুন্সিগঞ্জের রতনপুর মানিকপুরে পাকবাহিনী, রাজাকার বাহিনী গ্রামের, কয়েকজনকে মুন্সিবাহিনী সন্দেহ করে গুলি করে হত্যা করেছে। গ্রাম থেকে হাঁস, মুরগী গরু ছাগল, এমনকি ৮/১০ জন যুবতী মেয়কে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। বলে গিয়েছে মুক্তিবাহিনী ধরে না দিলে আবার গ্রামে হামলা দিবে।
যা হোক, আমরা রাত প্রায় ৯টার দিকে রামপাল রতনপুরে ১৪৪ ধারা বলবৎ করে জনসাধারণের যাতায়াত নিষেধ করে আমরা যার যার সুবিধা মতো ওঁৎ পেতে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করলাম। আমার সাথে ছিল মুন্সিগঞ্জের আনিস ভাই আর আমাদের অ্যাম্বুশের জায়গাটি ছিল একটি বাড়ির পিছনে খিরাই ক্ষেতে। সময় ও সুযোগ মতো দুই/একটা খিরাইও খেলাম, রাত প্রায় ৩টার দিকে খোকা ভাই রেকি করতে আসলেন। কিছু কথাবার্তা হলে আবার তিনি চলে গেলেন এক হিজল গাছের ধারে। বাড়ির মানুষ টের পেয়ে গেলো এবং ভয়ে আর্তনাদ করে উঠলো। আমি বাড়িতে পরিচয় দিলাম আমরা মুক্তবাহিনী, পাকবাহিনীদের খতম করার জন্য এসেছি। আপনাদের কোন ভয় নেই। বাড়ির মহিলা ও পুরুষরা যে কিন আনন্দ পেলো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এক মহিলা এক ডালা মুড়ি ও গুড় নিয়ে আসলো এবং বললো আপনারা কতজন? আমি বললাম, এতেই আমাদের চলবে। জানালাম, সংখ্যায় অনেক, তবে আপনাদের কাছাকাছি আছি আমরা দুইজন। কিছুক্ষণ পরে আযানের ধ্বনি নিকটবর্তী মসজিদ থেকে ভেসে এলো, কেউ কেউ স্থানীয় মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করলো। কেউ কেউ জমিনেই ফজরের নামাজ সেরে নিলো। আমরা পুনরায় এ্যাম্বুশ নিয়ে ধৈয্য ধরে থাকলাম, দেখতে দেখতে ভোর সাতটা বেজে গেলো। দেখতে পেলাম লংমার্চ করে পাকসেনার একটি দল সাথে রাজাকার নিয়ে গ্রামের পথে এগুচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা প্রায় ১০০ গজের মধ্যে এসে গেল। আমরা অস্ত্রের সেফটি কেইস অন করে ট্রিগারে হাত নিয়ে রাখলাম। অপেক্ষা করছিলাম ওপেনিং ব্রাশ ফায়ারের জন্য। আশ্রাফ ভাই ওপেনিং ব্রাশ ফায়ার করে ধরাশায়ী করে ফেললো কয়েকজনকে, আমরাও আরম্ভ করলাম। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে রণে ভঙ্গ দিল। আমরা কাছাকাছি গিয়ে দেখি ওরা আহত হয়ে কাতরাচ্ছে পাঁচজন আর নিহত হয়েছে ৩ জন।
আমরা বিজয়ে আত্মহারা হয়ে জয়ের নেশায় জয়বাংলা শ্লোগান দিতে লাগলাম। গ্রামের মা বোনেরা মনে হয় আমাদের জন্য আঁচল পেতে দোয়া করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে বহু লোক গ্রাম গঞ্জ থেকে ছুটে আসলেন। আহত পাঁচজনের সবাই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। চলে আসলাম রামপাল হাই স্কুলে। বেলা তখন ৯টা। যথেষ্ট ক্ষুধাও পেয়েছিল। দেখলাম অনেক লোক আমাদের জন্য রুটি, কলা, বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, নিয়ে হাজির হলো। আমরা বেলা ১১টার দিকে বাখিয়া পালের বাড়ি চলে আসলাম’।
[৮৮],[৬২৯] হাসিনা আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত