You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.14 | মুন্সিগঞ্জ থানা অপারেশন, মুন্সিগঞ্জ - সংগ্রামের নোটবুক

মুন্সিগঞ্জ থানা অপারেশন, মুন্সিগঞ্জ

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণ করে অস্ত্র গোলাবারুদ লুট করে থানা আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর বিকেলে মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রামপাল উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হচ্ছিল। মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণের অভিযানে প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছিল। আক্রমণ অভিযানটি বি.এল..এফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) এর নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও এতে এফ.এফ. (ফ্রিডম ফাইটার) এর সদস্য মুক্তিযোদ্ধারাও অংশ নিয়েছিল। থানা আক্রমণের পরিকল্পনা ছক তৈরি করেছিলেন ভারতের দেরাদুনে ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আশ্রাফাউজ্জামান (বি.এল.এফ) মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণের নেতৃত্ব ছিলেন। মুন্সিগঞ্জ টঙ্গীবাড়ী ও গজারিয়া থানা অঞ্চলের বি.এল.এফ এর যৌথ কমান্ডারের প্রধান মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, তাঁকে সহযোগীতা করেন মুক্তিযোদ্ধা আনিসুজ্জামান আনিস, খালেকুজ্জামান খোকা, কলিমউল্লাহ (এফ.এফ), মোফাচ্ছেল, এনামুল হক, আশ্রাফুউজ্জামান, তোফাজ্জল হোসেন সহ আরও অনেক। মুন্সিগঞ্জ শহরকে ৭টি অঞ্চলে ভাগ করে এদের দায়িত্ব দেয়া হয়, আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নেতারা তাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পর থেকে একে একে নিজ নিজ অবস্থানে গিয়ে আক্রমণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এর আগে উজির আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে মুন্সিগঞ্জ শহরে পাঠানো হয়েছিল পাক আর্মিদের অবস্থান জেনে আসার জন্য। সময়টা ছিল রোজার মাস, সেহরীর সময় মুন্সিগঞ্জ শহরে সাইরেন বাজনো হতো। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেহরীর প্রথম সাইরেন বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে একযোগে থানার উপর আক্রমণ চালানো হবে। পরিকল্পনা মত দলনেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল থানার পূর্ব পাশে পুকুর পাড়ে। (মোহাম্মদ হোসেন বাবুলের বাড়ির নিকটে) একটি মেশিনগান নিয়ে থানার দিকে লক্ষ্য করে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধা কলিমউল্লা মালপাড়া গোয়ালপাড়ায় তাঁর দল সহ অবস্থান গ্রহণ করে লঞ্চঘাটের রাস্তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আনিসুজ্জামান আনিস মাঠপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে হরগঙ্গা কলেজের পাক আর্মি ক্যাম্পের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। খালিকুজ্জামান খোকা কোটগাঁও অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে।
মোফাজ্জেল হোসেন জমিদার পাড়া, পোষ্ট অফিসঃ এবং ডাকবাংলার কাছে অবস্থান নেয় করে। সেহরীর প্রথম সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে দলনেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুলের অবস্থান থেকে থানার উপর মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করা হয়। গুলির শব্দ শুনে অন্যান্য গ্রুপের মুক্তিযোদ্দারাও গুলি করতে করতে থানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অনেকক্ষণ গোলাগুলির পরে থানা থেকে প্রতিরোধের কোন চেষ্টা করা হয়নি। থানায় অফিসারসহ পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ জন, এদের ভিতর ১০ জন মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে, বাকিরা পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী থানা দখলের পর অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে থানা ভবনটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। কলেজে অবস্থানরত পাক আর্মিদের দলটি গুলি বর্ষণ করতে করতে কলেজের পূর্বদিকে ধানক্ষেতের উপর দিয়ে নদীর দিকে পালিয়ে যায়। থানা দখলের পর মুক্তিবাহিনী স্লোগান দিতে দিতে শহর প্রদক্ষিণ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর একটি দল যখন ডাকবাংলা পাশ দিয়ে মিছিল করে যাচ্ছিল তখন ডাকবাংলায় অবস্থানকারী মুন্সিগঞ্জ সার্কেলের পুলিশ ইন্সপেক্টর ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। ইন্সপেক্টরকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা মুক্তিবাহিনীর ছিল না, তাকে পাক আর্মি মনে করে ভুলে গুলি করা হয়েছিল। ভোর ৬টার দিকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা মুন্সিগঞ্জ শহর ছেড়ে চলে যায়। মুক্তিবাহিনী শহর ছেড়ে যাবার দুদিন পর পাকবাহিনী আবার মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণের খবরটি পরের দিন ১৫ নভেম্বর ঢাকায় বি.বি.সির প্রধান সংবাদদাতা মুন্সিগঞ্জের কৃতী সন্তান নিজাম উদ্দিন আহমদের বরাতে বিস্তারিত ভাবে প্রচার করা হয়েছিল। সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমদকে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার দুইদিনে পূর্বে তার ঢাকার বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
[৬২৪] হাসিনা আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ অষ্টম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত