You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.13 | বেলাবোর যুদ্ধ, নরসিংদী - সংগ্রামের নোটবুক

বেলাবোর যুদ্ধ, নরসিংদী

বেলাবোর যুদ্ধ সংগঠিত হয় বেলাবো বাজার সংলগ্ন থানা সদর থেকে চার পাঁচশত গজ উত্তরে নীলকুটি নামক স্থানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৩নং সেক্টর সদর দপ্ত থেকে বেলাবো-রায়পুরা এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সুবেদার আবুল বাশার জুন মাসে ঐ এলাকায় আসেন।
১৩ জুলাই বিকালে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পান যে,১৪ জুলাই ভোরে দোমরকান্দা বাজার থেকে পাকবাহিনীর চারটি লঞ্চ পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদীপথে বেলাবো বাজারের দিকে অগ্রসর হতে পারে। সুবেদার বাশারসহ মুক্তিযোদ্ধাগন সিদ্ধান্ত নেন যে পাকিস্থানী বেলাবোর দিকে অগ্রসর হলে যে কোনো মূল্যে বাঁধা দিবে এবং বেলাবো বাজারের উত্তর দিকে বড়ৈবাড়ি নীলকুঠি থেকে নদীতে অ্যামবুশ করা হবে। সুবেদার বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাগন সারারাত সতরকতা ও উতকন্ঠার মধ্যে কাতিয়ে খুব ভোরে আনোয়ার আলী গুদাড়াঘাট,কুটিবাড়ি এবং ভাঙ্গার ঘাটে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় সংলগ্ন রাস্থা বরাবর অ্যামবুশ অবস্থানে যলে যায় এবং পাক বাহিনীর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু পাকিস্থানিদের কিছু বাঙ্গালী দোসর সুবেদার বাশারের গতিবিধি এবং অবস্থান পূর্ব থেকেই পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পাকিস্থানিদের জানিয়ে দেয়।
পুলিশ,আনসার ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাস্যসহ ৪০-৫০জন মুক্তিযোদ্ধার দলটি ৩তি সেকশনে বিভক্ত হয়ে আড়িয়াল খাঁ নদী বরারবর অবস্থান গ্রহণ করে। অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল ১টি এল এমজি,২তি ব্রিটিশ এল এম জি,২টি চায়না রকেট লাঞ্চার,১টি ২ ইঞ্চি মরটার। পক্ষান্তরে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে পাকবাহিনীর সেনা ছিলো সংখ্যায় দুই শতাধিক। ডোমরাকান্দা থেকে পাক বাহিনীর ভারী ও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত লঞ্চগুলো পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নদী বরাবর আসতে থাকে। সকাল ৯টায় ধীরে ধীরে লঞ্চগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে আসতে থাকে। ইতোমধ্যে দক্ষিনে পজিশনে থাকা অগ্রসরমান লঞ্চের সামনে একটি ছৈওয়ালা নৌকাকে দ্রুত গতিতে ঘাটের দিকে যেতে দেখা যায়,আনসার কমান্ডার মমতাজ নৌকার গতিবিধি সন্দেহ করে নৌকার মাঝিকে শাসিয়ে বলে যে ঘাটের দিকে আসবে না গুলি করব আসলে। এই কথা বলার সাথে সাথেই নৌকয়া থেকে গুলি বর্ষণে মমতাজ গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। লঞ্চগুলোর জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিরাজ পুনঃপুন চেষ্টা করেও রকেট লাঞ্চার ফায়ার করতে পারেনি। যার ফলে পরবর্তীতে গোয়া দলের উপর নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়। নৌকাটির ছৈয়ের ভেতর আত্নগোপনকারী পাকসেনারা ঘাটে ভীড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের বাম দিকে দ্রুত স্থলভাগে উঠে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদেকে ঘিরে ফেলে। তারা ভারী ভারি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। দলনেতা সুবেদার বাশার বুঝতে পারেন তাঁর দলকে শত্রুবাহিনী চারিদিকে ঘিরে ফেলছে এবং অনেক দেরী হয়ে গেছে তিনি শেষ ব্যাক্তি শেষ গুলি পর্যন্ত লড়বার মনস্থির করেন।
রক্তিক্ষয়ী এ যুদ্ধ কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হয়। সঠিক ভাবে নিরুপ্ন করা না গেলেও শত্রুর সমুহ ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর চাপে নিশ্চিত পরাজয় এড়াতে বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চাদসরন করে। পাশেই হলুদের ক্ষেতে পড়ে থাকে বিদ্রোহী নির্ভীক যোদ্ধা বশারের প্রানহীন দেহ। নিথর হাত তখনও প্রিয় এস এম জির উপর। পেটে গুলির আঘাতের স্থানে মৃত্যুর পূর্বে বাশার তাঁর গায়ের জামা খুলে বেধে যুদ্ধ চালিয়ে যা যথক্ষন তাঁর শরীর অসাড় না হয়ে পড়ে। পাশে পড়ে ছিল কুচি কুচি করে ছেড়া কাগজ। মৃত্যুর পূর্বে বাশার সব ধরনের গোপ্ন কাগজ নষ্ট করে দেন। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা বেলাবো থেকে তিন মেইল দূরে বটেশ্বর স্কুল ঘরে সে সম্বেত হয় দুপুর ১২টায়। শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝ থেকে কারো কারো লাশ স্ব স্ব আত্মীয়রা নিয়ে যান।
প্রায় মাসখানেক পর আবার একই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধদের সাথে পাকবাহিনীর মোকাবেলা হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন, পাকিস্থানি ছিল শতাধিক। তারা কুলিয়ারচর থেকে মনোহরদী যাচ্ছিল। পাকিস্থানিরা আনোয়ার আলী গুদামঘাটে এসে পৌছালে নীলকুটি এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীরা এল এম জি দিয়ে ফায়ার করে। তবে পাকসেনারা সতর্ক থাকায় তেমন কোনো ক্ষতিকরা যায়নি। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মো হানিফ মারা যায়।
পাকসেনারা বেলাবো বাজারে এবং গ্রামের কিছু ঘর বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। বেলাবো বাজারে এবং গ্রামের কিছু কিছু ঘর বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। বেলাবো অ্যামবুশে সুবেদার বাশার এবং আনসার কমান্ডার মমতাজ ছাড়াও শহীদ হন সিপাহী আবদুল বারী,সিপাহী আবদুস সালাম, সুবেদার বাশারের শাহাদাত বরণকে স্মরনীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে দেশপ্রেমিক জনগন বেলাবো মাটিয়াল পাড়া এলাকায় একটি স্মৃতিস্থম্ভ নির্মাণ করেছে। বেলাবো অ্যামবুশ এবং পাকিস্থানিদের গনহত্যার শিকারে এলাবো অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনী মুলত পরাজিতই হয়েছিল। দেশীয় কিছু কুলাঙ্গারের বেঈমানী,শত্রুকে সহজভাবে নেয়া এবং তাদের চিরাচরিত ও স্বাভাবিক নিয়মিত আচরনকে নিশ্চিত হিসেবে সুবেদার বাশার ভুল করেছিলেন। ভুল করেছিলেন তাঁরা যুদ্ধ পরিকল্পনায়। যুদ্ধের শেষ বিচারে না জিতলে মুক্তিযোদ্ধারা সাহস ও শৌর্যে হারেনি। যারা এমবুশ এবং গনহত্যার শিকার হয়েছিলেন,তাদের অনেকেই আড়িয়াল খাঁ ও ব্রক্ষপুত্র নদীর মোহনা বরাবর রাস্থার উত্ত্র পার্শে (থানা থেকে প্রায় ১ কিমি দূরে) গনকবরে শায়িত।
[৫৯৪] রিয়াজ আহমদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত