বেলোনিয়া অঞ্চলে সম্মুখ যুদ্ধ
বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে ঠিক উওরে বাংলাদেশের ভূখন্ডের একটি ক্ষুদ্র অংশ ভারতের অভ্যন্তরে চলে গেছে। উপদ্বীপ আকৃতির এই অংশ বাংলাদেশের একটি পকেট। এ পকেটটির পশ্চিম,উওর ও পূর্বদিকে পাহাড় ও ঘন বন জঙ্গল অধুষিত ভারত। সর্ব উওরে ছোট সীমান্ত শহরের নাম বিলোনিয়া। বাংলাদেশের বেলোনিয়া পকেটটি ফেনী-শুভপুর মহাসড়ক ( মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা-চট্রগাম মহাসড়ক ) থেকে উওরে বিলোনিয়া পর্যন্ত প্রায় বিশ মাইল এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ছয় থেকে আট মাইল এলাকাজুড়ে অবস্থিত। এটি বর্ত্মানে ফেনী জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই পকেটের পশ্চিম দিকে ভারতীয় একটি পকেট দক্ষিণদিকে প্রবেশ করেছে, যার সর্বদক্ষিণে একিনপুর বাজার। মুহুরী নদী ভারতের বেলোনিয়া শহরের পশ্চিমপ্রান্ত দিয়ে ফেনী জেলায় প্রবেশ করে উওর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ছাগলনাইয়া থানার দক্ষিণে সোনাগাজী থানার উওর সীমান্তে ফেনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে দক্ষিণে সমুদ্রে দিকে চলে গেছে। দুটো অর্ধ পাকা রাস্তা ফেনী ও ছাগলনাইয়া থেকে উওরদিকে গিয়ে পরশুরামে একত্রে মিলিত হয়ে বেলোনিয়া চলে গেছে। একটি মিটারগেজ রেললাইন ফেনী ও বেলোনিয়ার মধ্য রেল-যোগাযোগ স্থাপন করেছে। অঞ্চলটির ভূমিরুপ মোটামুটি সমতল। ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো। অধিকাংশ এলাকা উর্বর শস্যক্ষেতে পরিপূর্ণ।
পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ফেনী দখল করারা পর ফেনীর উওরে ট্যাকনিকাল কলেজ ও দোস্ত টেক্সটাইল পর্যন্ত তাঁদের দখলে নিয়ে আসে। এর উওরে বন্ধুয়া থেকে বেলোনিয়া সীমান্ত পর্যন্ত তারা তখন পৌঁছাতে পারেনি। মাঝে মাঝে তারা তাঁদের দালাল ও রাজাকারদেরকে ঐ অঞ্চলে পেট্রলিং পাঠাতে থাকে। ইতিমধ্য খবর পাওয়া যায় যে, তারা খুব শীঘ্রই সীমান্ত শহর বেলোনিয়া পর্যন্ত দখলে নেওয়ার জন্য অভিযান প্রস্তুতি গ্রহন করেছে। এপ্রিল মাসে শেষ দিকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তাঁর অধীনস্থ সেক্টর ট্রপস নিয়ে ফেনীর উওরে মুন্সিরহাট এলাকায় পাকিস্থানি হানাদারবাহিনীর মুখোমুখি ডিফেন্স স্থাপন করেন। এই ডিফেন্স ছিল সামরিক ও কৌশলগত প্রস্তুতি ও পাকিস্থানি হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। মুন্সিরহাটে মুক্কতিবাহিনীর ডিফিন্সের অবস্থান সম্পন্ন করার আগে ফেনী থেকে বলোনিয়া পর্যন্ত যে রেললাইন রয়েছে তাঁর উপর দিয়ে ট্রেনযোগে হানাদারবাহিনী সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র, রসদ সামগ্রী সরবরাহ করতে না পেরে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত করা হয়। এ ব্রিজের এলাকাগুলোতে পাকিস্থানি হানাদারবাহিনী ও তাঁদের দালালা রাজাকারদের মাঝে মাঝে পেট্রলিং ছিল। তাঁদের দৃষ্টিতে এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে এ দুটি ব্রিজে বিস্ফোরক লাগানো অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ হলেও তের-চৌদ্দ বয়সের স্থানীয় স্কুল ছাত্রদের বিস্ফোরক স্থাপনে পারদর্শী করে গড়ে তোলা পাইওনিয়ার প্লাটুন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সরাসরি নেতৃত্বে জীবন বাজি রেখে এ দুরুহ কাজ সম্পন্ন করে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কোনো একদিন রাতের অন্ধকারে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে পাইওনিয়ার প্লাটুন বিস্ফোরক ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ভারতের বড়কাসারী থেকে কয়েক মাইল রাস্তা অতিক্রম করে ফুলগাজী ব্রিজের অদূরে একটি বাড়িতে অবস্থান নেন। এখানে পৌছার পর ব্রিজের আশাপাশে পাহারারত পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার, মুজাহিদ সমন্বয়ে গঠিত শত্রুপক্ষের পেট্রল পার্টি কতক্ষণ পরপর ব্রিজের উপর আসে তা তারা পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, রাজাকাররা এক-দেড় ঘন্টা পরপর ব্রিজ এসে ফিওে যেত, মুক্তিযোদ্ধারা আগেই পাইওনিয়ার প্লাটুনকে কয়েকভাগে ভাগ করেছিলেন। শত্রুপক্ষের পেট্রলপার্টি যখন ব্রিজে এসে ফিরে যেত, মুক্তিযোদ্ধারা সে-সময়ের মধ্যে গ্রুপে গ্রুপে গিয়ে বিস্ফোরক লাগানোর কাজ অব্যাহত রাখে। এভাবে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মধ্যে শত্রুপক্ষের অগোচরে বিস্ফোরক লাগানোর কাজ শেষ হয়। অতঃপর ব্রিজ থেকে প্রায় একশো গজ দূওে পর্যন্ত সম্প্রসারিত সেফটি ফিউজে দেয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করা হয়। ব্রিজটি ধ্বংস হয় তখন গ্রামের লোকজন ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে এক বিকট আওয়াজে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। একই প্রক্রিয়ারয় মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী বেলোনিয়া রেললাইনের উপর বন্ধুরা ব্রিজ ও ধ্বংস করেন অপরদিকের ১নং সেক্টরের সৈন্যরা বিলোনিয়ার প্রতিরক্ষা অংশ হিসাবে ২৬ মে চাঁদগাজীর গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধার মে মাসের শেষ দিক পর্যন্ত সমগ্র মুন্সিরহাট অ ল জুড়ে প্রতিরক্ষা ডিফেন্স স্থাপন করে। মুন্সিরহাটে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্সের পজিশন ছিল। দক্ষিণে ফেনী শহরের দিকে মুখ করে। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর পজিশন ছিল ফেনী শহরের বাইরে আনন্দপুর ইউনিয়ন ও কারিরবাজার এলাকায়। ফেনী শহরের ছিল তাদের হেডকোয়ার্টার। মুক্তিযোদ্ধাদের মুন্সিহাট ডিফেন্স ও হানাদার বাহিনীর অবস্থান মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় এক থেকে দেড়মাইল। যুদ্ধের প্রথম অবস্থায় হানাদারবাহিনী ফেনী শহর থেকে আক্রমন পরিচালনা করছিল। ঝটিকা আক্রমণ এবং সার্বক্ষণিক মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স পজিশনের উপরে তাদের আর্টিলারি আক্রমন অব্যাহত ছিল। তাদের এ বিচ্ছিন্ন আক্রমণের হানাদারদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং তাদেরকে সংগঠিত হতে না দেওয়া।
মে মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্স থেকে প্রায় এক মাইল ব্যবধানে সমগ্র কারিরবাজার এলাকাজুড়ে হানাদারাবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষামূলক পজিশন গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের defensive Position-এর সামনে খুব ঘন এন্টিপারসোনাল মাইনফিল্ড সৃষ্টি করেন এবং ফেনী বেলোনিয়া রাস্তায় ও অন্যান্যে রাস্তায় এন্টিট্যাংক মাইন পুঁতে রাখেন। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী যেন হঠাৎ করে সরাসরি মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সিভ পজিশনের উপর আক্রমণ চালাতে না পাওে। দক্ষিণে ফেনী শহরমুখী ডিফেন্সিভ পজিশন ডানদিকে ভারত সীমান্ত থেকে বামে অর্থাৎ পূর্বে মুহুরী নদীর তীরে শনিরহাট পর্যন্ত প্রায় পাচঁমাইল প্রশস্ত ও বিস্তুত ছিল। এ ডিফেন্সের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের অবস্থান ছিল ডিফেন্সের মাঝামাঝি স্থান মোক্তারবাড়ির পুকুরপাড়ে, যার সংলগ্ন ছিল ফেনী-বিলোনিয়া সড়ক ও রেললাইন।
সামরিক নিয়ম অনুযায়ী ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সহকর্মী অফিসারবৃন্দ ডিফেন্স থেকে কয়েকশো গজ পেছনে হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে যুদ্ধ-পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডিফেন্সের ফ্রন্টলাইনে তিনি তাঁর বাংকার অর্থাৎ কমান্ডপোস্ট স্থাপন করায় সেদিন তাঁর অধীনস্থ সবার মনোবল ও সাহস অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি সাবসেক্টর দুই-এর প্রায় দুই-কোম্পানী সমানে মুক্তিযোদ্ধার প্রাক্তন বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর নিয়ে গঠিত প্রায় এক-কোম্পনী সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইওনিয়ার প্লাটুন (যাদের কাজ ছিল সার্বক্ষণিক মাইন বসানো ও ব্রিজ উড়ানো) সরাসরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্মুখে কমান্ডপোস্টের দুইপাশে ডিফেন্সিভ পজিশনকে সুদৃঢ় ও বিস্তৃত করেন। এদের ডানপাশে অর্থাৎ পশ্চিমপাশে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত এক-কোম্পনীর অধিক সৈনিকসহ লেফটেনেন্ট শহীদুল ইসলাম ডিফেন্সিভ পজিশন গ্রহণ করে। কমান্ডপোস্টের দুইপাশে বামপাশে অর্থাৎ কামন্ডপোস্টের নিয়ন্ত্রিত ডিফেন্সিভ পজিশনের পর থেকে পূর্বদিকে মুহুরী নদীর পাড় তথা শনিরহাট পর্যন্ত ডিফেন্সিভ পজিশনের দ্বায়িত্বে ছিলেন প্রায় দুই-কোম্পানীর অধিক সৈন্যসহ লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামান। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের ফিল্ডপোস্টে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফেনী কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অনারারি ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান খান।
এই ডিফেন্সের অধিনায়ক হিসাবে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামান ও লেফটেনেন্ট শহীদুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন। এই ডিফেন্সিভ পজিশনের প্রায় অর্ধমাইল পেছনে নতুন মুন্সিরহাটে প্রায় দুই কোম্পানির মতো প্রাক্তন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাসহ অবস্থান নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফর হালদার। তাঁকে মূলত ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ পাঠিয়েছিলেন। মুন্সিরহাটে ডিফেন্সের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য এবং এই ডিফেন্সের পিছনে রিয়ার গার্ড হিসাবে কাজ করার জন্য, যাতে গোপনে শত্রুপক্ষ ডিফেন্সের পেছনদিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে।
মুহুরী নদীর পশ্চিম তীরে শনির হাট এলাকায় যেখানে লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামানের অবস্থান সেই মুহুরী নদ্রী পূর্ববর্তী অরথ্যাত শুভপুর ছাগলনাইয়া এল্কায় ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের অধীনস্থ ক্যাপ্টেন মাহফুজুর রহমান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ তাদের অধীনস্থ সৈনিকদের নিয়ে পাশাপাশি অবস্থান নিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন জাফর তাদের অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে হানাদারবাহিনী লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামাএর অবস্থান অথবা ক্যাপ্টেন গাফফার হালদারের অবস্থানের উপর আক্রমণ করতে না পারে,সেজন্য তাঁরা যেন সতর্ক থাকে সে জন্য বলা হয়। এ ব্যাপারে ১নং সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান এবং তাঁর অধীনস্ত ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন অলি তাঁকে সম্পূর্ণরূপে আশ্বস করেন। এবং আশ্বাস অনুযায়ী তাঁরা তাদের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত পালন করে গেছেন।
এ অঞ্চলে এ ডিফেন্সের সুদৃঢ় বাঙ্কার গড়ে তুলতে এবং ডিফেনসিব পজিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছিল। এ সময়ে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর ডিফেন্সের ওপর দূর পাল্লার আরটিলারি ফায়ার অব্যাহত রেখেছিল। আরটিলারি ফায়ারের শেলগুলো শুধু মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের উপর আঘাত হানেনি সেগুলো লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে এলাকার প্রচুর ক্ষুক্ষতি সাধন করে, মসজিদ,মন্দিন এবং শিক্ষা প্রতিষ্টানে বিচ্চিন্ন ভাবে আঘাত হাতে। এ অঞ্চলের সর্বসাধারণ মানুষ সবাই নিরাপদ জায়গায় চলে যান ,তখন পুরো এলাকা জনশুন্য হয়ে পড়ে। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেতে খামারে যেসব গরু ছাগল ছিলো তারাও দিশেহারা হয়ে যায়। সমগ্র অঞ্চল জুড়ে বিরাজ করে আংতঙ্ক। মুক্তিযোদ্ধারা তখন বাঙ্কারে বয়সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতেন শত্রুর অবস্থানের উপর। অপেক্ষা করত করখন শেলিং বন্ধ হবে এবং তাদের অবস্থানের উপর পদাতিক বাহিনী হামলা করবে। এ শেলিং এর ছত্রছায়ায় হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি ছিল। মে মাসের মাঝা মাঝি সময়ে জুনের শেষ সাপ্তাহ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী কয়েকদফা মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে এক ব্যাটেলিয়নের অধিক সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সিভ পজিশনের সামনে প্রায় এক মেইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ঘন এন্টিপারসোনাল মাইন থাকায় মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের তিন থেকে চারশ গজের মধ্যে তাঁরা অগ্রসর হতে পারত তা। তাঁরা যইত সম্মুখ দিকে আসছিল ততই ঘন মাইন ফিল্ডের ফাদে পড়ছিলো এবং এসব আক্রমে তাদের সংখ্যাও কমে যেতে লাগল। এ সময় তাঁরা কিছুতেই মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের সামনে ৩০০ গজ এর ঘন মাইনফিল্ড অতিক্রম করতে সক্ষমহয়নি। হানাদার বাহিনী যখন মুক্তিবাহিনীর মাইনফিল্ডের শিকার হচ্ছিল তখন চলছিল দুই পক্ষের তরদ থেকে ব্যাপকআরটিলারি সেলিং। এ পর্যায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আরটিলারি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছিল। সে মুহূর্তে গর্জে উঠেছিল মুক্তি বাহিনীর বাঙ্কার থেকে এল এম জি ও এম এম জি-র ফায়ার এবং তিন ইঞ্চি মর্টার ফায়ার।
শত্রুবাহিনী যেহেতু মাইনফিল্ড অতিক্রম করে তিনশো গজের মধ্যে পৌছাতে পারেনি সেজন্য অধিনায়ক জাফর ইমাম স্মল আরমস এর ফায়ারের নির্দেশ দেন নি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ফায়ার শক্তি বা গোলাগুলির শক্তির দৃষ্টিকোন থেকে মুক্তিবাহিনীও একটি বুয়াটালিয়নের অধিক সামরিক বাহিনীর যা কিছু অস্ত্র থাকা দরকার তা থেকি বেশি ছিল। এছাড়া জাফর ইমামের কমান্ড তাঁর অধীন্ত সোনিকদেরকে সুষ্টুভাবে নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল। কমান্ডিং পোস্টের বামদিকে অর্থাৎ মুহুরী নদীর সীমানা পর্যন্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল লেফটেনেন্ট ইমামুজ্জামানকে। কারন পাকিস্থানি হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের সে অংশে সরাসরি আক্রমণ ক্রতে পারত ও মুহুরী নদীর অপর পাড় দিয়ে এসে তাঁর পিছনে আক্রমণ করতে পারত। লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান এ ব্যাপারে সজাগ ছিলেন। জাফর ইমাম তাঁকে নদীপথে শত্রুর সম্ভাব আক্রমণের সম্পর্কে আগেই ধারণা দিয়েছিলেন। নদীর বাধটি তাঁর ডিফেন্সের সামনে কয়েকশোগজ দূরে ছিল সেই বাধটি ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছ;এম। তখন নদী ছিল ভরপুর এবং স্রোত ছিল খুবই তীব্র। এ বাধ ভেঙ্গে দেয়ার কারণে নদীর নিচের দিকে নিচের দিকে অর্থাৎ ডিফেন্সের সামনের দিকে স্রোত আরো তীব্র হয়ে যায়। ফলে নদীপথে শত্রুপক্ষের আক্রমণের আর কোনো সুযোগ থাকল না।
লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জাম সম্পর্কে ২নং সাবসেক্টরের অধিনায়ক জাফর ইমাম এ গ্রন্তের লেখকের নিকট অভিমত ব্যক্ত করেছেন তা হ ‘’ লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান পাকিস্থান সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পদাতিক বাহিনীর একজন্ন দক্ষ অফিসার ছিলেন। স্বাধীনতারযুদ্ধে অংগ্রহনের পূর্ব মুহূর্তে কুমিল্লা ক্যান্টরমেন্টে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। সেখান থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসার সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বুদ্দিমত্তার ওপর ছিল আমার অগাদ বিশ্বাস ও আস্থা। তাই আমি তাকে আমার বাম দিকে মুহুরী নদীর সীমানা পযন্ত দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তিনি এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছিলেনন। “
ইতিমধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যাপক খতির শিকার হয়। এর ফলে তারা মুক্তিবাহীনির ওপর একটি ব্যাপক ও বড় আক্রমণ প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে মুক্তিবাহীনির কমান্ডার গন ধারনা করছিলেন। কারণ তারা যেহেতু কয়েকদফা আক্রমণ পরিচালনায় ব্যথ হয়েছে,তখন স্বাভাবিক ভাবে তারা তাদের রণকৌশল পরিবতন করবে। প্রসংঙ্গত উল্লেখ্য যে,বিলোনিয়াতে যখন যুদ্ধের এরুপ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৮ জুন পাকিস্তান রেডিওতে এ মমে ঘোষণা দিতে যাচ্ছিল যে,সমগ্র পুর্বপাকিস্তানের মাটিতে মুক্তিবাহীনির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ সময়ে ফেনী বেলেনিয়া যুদ্ধে তাদের বিপযয় সম্পকে করে তার উপদেষ্টরা তাকে পরামর্শ দেন যে,যতখখণ পযন্ত বেলোনিয়া মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে পুনরুদ্ধার করা না যাবে ততখন পযন্ত এরুপ ঘোষণা থেকে তার বিরত থাকা উচিত। কারণ একজন রাষ্টপতির ঘোষণার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পকে বিদেশী কোন সংবাদমাধ্যম যেন কোনরুপ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেখিতে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীরর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল হামিদ খানকে ফেনীতে পাঠান। জেনারেল হামিদ খানকে ফেনীতে পাঠানোর কারণ ছিল ইয়াহিয়া খানের পুবনিধারিত ঘোষণা দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। জেনারেল হামিদ খান ফেনীতে এসে মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বেলোনিয়া মুক্তি করার লক্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে প্রত্যকভাবে এাকটি পরিকল্পিত দিকনির্দেশনা দেবার জন্য ফেনীতে অস্থায়ি সদর দপ্তর স্থাপন করেন এবং বিলোনিয়ার ওপর চুড়ান্ত আক্রমনের পরিকল্পনা গ্রহব করেন।
১৯৭১ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে সমগ্র বেলোনিয়া অঞ্চলের ধাঙ্কখেত এবং নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্থানী হানাদারবাহিনীর পক্ষে ঠিক মত রণকৌশল অবলম্বন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারা এ অবস্থায় খোলা রাস্তাঘাট দিয়ে অগ্রসর হয়। অপর দিকে মুক্তিবাহিনী সমগ্র মুন্সিরহাট ডিফেন্সে সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং সার্বক্ষণিক ভাবে প্রতিরক্ষা অবস্থানে পর্যাপ্ত সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়োজিত রাখে। বাংকারের ভেতর থেকেই প্রতিরক্ষা দৈনন্দিন কার্যক্রম চলতে থাকে। হানাদারবাহিনী দিনরাত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। ১৭জুন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পনেরো-বিশ মিনিট পরপর হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর হালকা ও ভারী আর্টিলারি শেলিং অব্যাহত রাখে। শেলিং এর বিকট আওয়াজে সমগ্র এলাকায় এক তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। সেদিন সকাল আনুমানিক দশটার দিকে হানাদারবাহিনী আর্টিলারির একটি শেল ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কমান্ড পোস্টের ঠিক পেছনে পুকুরের অপরপাড়ে মোক্তারবাড়ির কাছারি ঘরে আঘাত হানে।
ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের মতে তাঁর অধীনস্থ হাবিলদার নূরুল ইসলাম এ গোলাটি আঘাত হানার কিছুক্ষণ আগে কোন কারণে তার বাংকার থেকে বের হয়ে মোক্তার বাড়ির কাছারি ঘরে গিয়েছিলেন।
শত্রুর নিক্ষিপ্ত আর্টিলারির শেলটি হাবিলদার নূরুল ইসলামের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। শেলের আঘাতে তাঁর দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এ মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি বলেন: “শেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত অবস্থায় হাবিলদার নূরুল ইসলামের আর্তচিৎকার সে মুহূর্তে শত্রুপক্ষের আর্টিলারি শেলিং-এর বিকট আওয়াজকেও যেন হার মানাচ্ছিল। তার এ আর্তচিৎকার সেদিন দুইপক্ষের শেলিং-এর আওয়াজের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে সে কাছারি ঘর থেকে বের হয়ে চিৎকার করে ‘আমাকে বাঁচান, বাঁচান বলে’ দিশেহারা হয়ে পুকুরঘাটে নেমে পড়ে। এ সংবাদ পেয়ে আমি আমার পাইওনিয়ার প্লাটুনের কাজী রেজাউল করিম সহ কয়েকজনকে সেখানে পাঠাই। তারা রক্তাক্ত হাবিলদার নূরুল ইসলামকে চিকিৎসার জন্য পাশের বাংকারে নিয়ে আসে। আমি দ্রুত তাঁকে দেখার জন্য ঐ বাংকারে গিয়েছিলাম। সে আমাকে দেখে বলেছিল, ‘স্যার, আমি হয়তো এদেশের স্বাধীনতা ও আমাদের চূড়ান্ত বিজয় দেখে যেতে পারব না। আমার শেষ অনুরোধ থাকবে আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। ইনশাআল্লা বিজয় আমাদের হবেই। ‘ আমি তাকে শান্ত হতে বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলাম যে,’তোমার কিছুই হবে না ইনশাআল্লাহ’। কিন্তু একথা বলতে বলতেই হাবিলদার নূরুল ইসলাম আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিল
শহীদ হাবিলদার নূরুল ইসলামকে আমরা ঐদিনই আমাদের ডিফেন্সের পিছনে একটি মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করি। “
হাবিলদার নূরুল ইসলাম মুন্সিরহাট ডিফেন্সে থাকাকালীন বিভিন্ন সামরিক অপারেশনে সাহসিকতার সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি তিনি কয়েক মাইল দীর্ঘ এ ডিফেন্সের বিভিন্ন পয়েন্ট অধিনায়কের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ, নির্দেশ ও প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী সরবরাহ তত্ত্বাবধান করেছিলেন।
এছাড়া কমান্ড পোস্টের নিকটবর্তী বাংকারের একটি এলএমজি পোস্টের পরিচালনার দায়িত্ব ছিল হাবিলদার নূরুল ইসলামের।
পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ডিফেন্সের ওপরে মাইনফিল্ড অতিক্রম করে যতবার আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল ততবার রনাঙ্গনে অন্যান্য এলএমজি ও এমএমজির সঙ্গে গর্জে উঠত হাবিলদার নূরুল ইসলামের এলএমজিটি।
যেহেতু, তার এল এমজি পোস্টটি ছিল ফেনী-বেলেনিয়া সড়কের পাশে, সে জন্য হানাদারবাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করতে এই এল এমজি পোস্টটির ভৃমিকা ছিলো মুখ্য। তাছাড়া হাবিলদার নূরুল ইসলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন বক্সার হিসাবেও খ্যাতিমান ছিলেন। হাবিলদার নূরুল ইসলামের শাহাদাত বরনের বিষয়টি এ ডিফেন্সের মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সেদিন দারুন রেখাপাত করেছিল।
১৯৭১ সালের ২০ জুন পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষন ছাড়া সমগ্র বেলোনিয়া অন্ঞলের মোটামুটি শান্ত অবস্তা বিরাজ করছিল। ২১ জুন সকাল থেকে সারাদিন অবিরাম শেলিং ও কাউন্টার শেলিং এর কারনে এলাকার সাধারন মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এলাকার সাধারন জনগন, পরিবার-পরিজন নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গিয়েছিল। অবশ্য এ আন্চলের অনেক পরিবার এর আগেই ভারত সীমান্তে শরনার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। অবিরাম গোলাবর্ষনের মধ্যে সেদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত সকল মুক্তিযোদ্ধা না খেয়ে ছিল। সন্ধার পর যখন রাতের কালো অন্ধকার নেমে আসে তখনো বিচ্ছিন্নভাবে হানাদারবাহিনী আর্টলারি শেলিং অব্যাহত রেখেছিল। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ও অভুক্ত অবস্থায় ও মুক্তিযোদ্ধারা সবাই শত্রুর মোকাবেলার জন্য সম্পৃর্ন প্রস্তুতি নিয়ে সতর্ক অবস্থায় ছিলেন,। অধিনায়ক জাফর ইমাম ফিল্ড টেলিফোনে ড.ইমামুজ্জামান.লে.শহীদ ও পেছনের ফোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন। সেদিন বিকেল থেকে একটু একটু করে বৃষ্ট হচ্ছিল। এ বৃষ্টির মধ্যে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর একদিকে হানাদার বাহিনীর দূরপাল্লার গোলা নিক্ষেপ করছিল, অপরদিকে হেলিকাপ্টার যোগে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পেছনে ছত্রীবাহিনী নামাচ্ছিল।
অধিনায়ক জাফর ইমাম এ প্রসঙ্গে এ গ্রন্থে লেখকের কাছে ঘটনার বর্ননা করপন এভাবে: সন্ধা সাতটা- আটটা হবে। একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি কয়েকটা হেলিকপ্টার থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কমান্ডো ছত্রীবাহিনী নামাচ্ছে। হেলিকপ্টারগুলো কয়েকবার দক্ষিনন দিক থেকে উত্তরে এভাবে আসা-যাওয়া করল। কিছুক্ষন পর আমাদের পিছনে ক্যাপ্টেন গাফফারের পজিশনের ওপরে ফায়ারিং -এর অাওয়াজ শুনলাম। খবর নিয়ে জানলাম এগুলো শত্রুবাহিনীর ফায়ারিং।
আমাদের ডিফেন্সের সম্মুখে যেখানে মাইন্ডফিল্ড শেষ হয়েছে অর্থাৎ এক মাইল দৃরে কালিরবাজারে হানাদারবাহিনীর অবস্থানে আরো সেনা এসেছে, এবং তাদের পজিশনকে জোরদার করে সুইসাইডাল আটকের মতো একটি প্রস্তুতি গ্রহন করেছে বল আমাদের ধারনা হয়েছিল। আমরা ডিফেন্সে বসেই তাদের ট্যাংকের মুভমেন্টের আওয়াজ এবং ফেনী থেকে বাড়তি সৈন্য নিয়ে আসার আওয়াজ উপলব্দি করলাম। পুরো ব্যাপারটাই রাতের অন্ধকারে হচ্ছিল। ইতিমধ্যে তাদের আর একটি বড় পদাতিক বাহিনী আমাদের বামের ডিফেন্সে মুহুরো নদীর অপর পাড় দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর পেলাম।
ভারতীয় বিগ্রেডিয়ার অয়ানার সরুপ এক সময় আমাকে খবর পাঠালেন যে,আমরা চারিদিক থেকে শত্রুবাহিনী দ্বারা ঘেরাও হতে চলছি। এমতাবস্তায় তিনি আমাদেরকএ ডিফেন্স উইথ্রদ্র করে পিছনে সরে এসে নতুন জায়গায় টেকনিক্যাল পজিশন গ্রহণ করার জন্য পরামর্শ দেন। বিগ্রেডিয়ার আনান সরুপের পরামর্শ পেয়ে আমি তখন আমার ডিফেন্সের বায়ে লে ইমামুজ্জাম ও ডানে লে শহীদের সঙ্গে ফিল্ড টেলিফোনে যোগাযোগ করে সর্বশেষ পরিস্থতিতি নিয়ে আলোচনা করি। তাঁরা আমাকে পরিস্থিতি শত্রুপক্ষের আগের আক্রমণ গুলির তুলনায় একটু ব্যাতিক্রমধর্মী বলে আভাস দিলেন এবং তাদের ডিফেন্সের সামনেও ব্যাপকভাবে শত্রুর মুভমেন্টের খবর জানালেন। হেলিকপ্টার ও পেছনে শত্রুপক্ষের ফায়ারিং এর আয়ওয়াজ সম্পর্কে তখন আমরা ফিল্ড টেলিফোনে আলোচনার মাধ্যমে অভিন্ন মতামতে উপনীত হলাম যে আমাদের ডিফেন্সের পিছনে পাকিস্থানী বাহিনী পরযায়ক্রমে হেলিকপ্টার দিয়ে ছত্রীসেনা নামাচ্ছে এবং ডিফেন্স থেকে আমাদের পিছনে সমস্থ ফাকা জায়গা শত্রুর কমান্ডো বাহিনীর অবস্থান জোরদার করে আমাদের ডিফেন্সের চারিদিকে একটি অবরোধ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। উল্লেখ্যযে আমাদের মূল ডিফেন্সের পিছনে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ছিল আমাদের রিয়ার ডিফেন্সের পজিশন। সে রিয়ার ডিফেন্সের পজিশনের পিছনে শত্রুপক্ষের কমান্ডো ছত্রীসেনারা ক্রমশ তাদের অবস্থান জোরদার করছিল। আমাদের ডিফেন্সের সামনেও শত্রুপক্ষের ব্যাপক মুভমেন্টের খবর পাচ্ছিলাম। আমি লে ইমামুজ্জামান, লে শহী ও ক্যাপ্টেন গাফফারকে পুরো বিষয় জানাই। তাদেরকে আরোও জানালাম ,বিগ্রেডিয়ার আনান সরুপ খবর পাথিয়েছে যে আমরা চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ হতে চলছি, এ অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্বব আমরা যেন বর্তমান ডিফেন্সের পজিশন থেকে সরে এসে পিছনে বিকপল জায়গা দেখি।
তখন রাত প্রায় সাড়ে নয়টা কি দশটা হবে,আমি আমার সহযোগী সফিসারদের নিয়ে আরোও বললাম যে, যতই সময় গড়াবে শত্রুপক্ষ ততই তাদের পরিকল্পনায় এগিয়ে আবেতাতে আমাদের সামরিক মুভমেন্টে৪র ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। । আর তা কাটিয়ে ওটা আমাদের জন্য কষ্ট সাধ্য। পরবর্তীত পরিস্থিতিতে আমাদের সামরিক অভিযান শুদু ডিফেন্সের সামনে শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না,আমাদেরকে একই সাথে সশত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ডিফেন্সের সামনে, দুইপাশে এবং পিছনে। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের চতুরমুখী আক্রমণ আমাদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে সে অবস্থায় যদি আমাদেরকে প্রয়োজনে পিছনে সরে যেতে হ তখন সেটা আমাদের জন্য শুধু কটিনই হবে না বরং আমাদেরকে ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আমরা ফিল্ড টেলিফোন ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধম্যে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আরোও কয়েকঘন্টা অর্থাৎ রাত দুইটা তিনটা পর্যন্ত অবস্থানে থেকে শত্রুর মোকাবেলা করব। যদি এর মধ্যে চারিদিক থেকে শত্রুর আক্রমণ বৃদ্ধিপায় তাহলে আমরা বিগ্রেডিয়ার আনান সুরপের পরামর্শ অনুযায়ী পিছনে সরে গিয়ে বিকল্প জায়গায় অবস্থান নেব। অবশ্য এ সিদ্ধান্তে সেদিন আমরা এক বিরাট ঝুঁকি নিয়ে ছিলাম এবং চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম।
পাকিস্থানী কমান্ডো ছত্রীবাহিনী সেদিন রাত আতটা থেকে প্রায় দুটু পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের চারিদিকে তাদের আক্রমণের প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। তবে কোনো সরাসরি আক্রমণ তখনো পরিচালনা করেনি। শুধু মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে মাঝে মাঝে চারিদিক থেকে হালকা ফায়ারিং চালাচ্চিল। তবে তাঁরা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের চারিদিকে তাদের অবস্থান জোরদার করছিল। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোগন এ ধারণাও করেছিলেন যে পাকিস্থানী আহিনি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে এবং ভোর হওয়ার মুহুরতেই চারদিক থেকেই মুক্তিবাহিনীর উপর বড় রকমের আক্রমণ চালাচে। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগর সিদ্ধান নেন যে পাকিস্থানী বাহিনীর চূরান্ত আক্রমণ পরিচালনা করার আগেই মুক্তিবাহিনী ডিফেন্স পত্যাহার করে পিছনে বিকল্প জায়গায় সরে যাবে। যেহেতু মুক্তিবাহিনীর পিছনের ডিফেন্স তিনদ দিয়ে ভারতূয় সীমানা দ্বারা পরিবেষ্টিত,তাই ডানদিকে ভারতীয় সীমান্ত হয়ে পুছনে চলে যাবে, যারা বামে লে ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে অবস্থান নিয়েছিলো তাঁরা বামদিক হয়ে পিছনীর দিকে চলে আসবে। ডিফেন্সের মাঝামাঝি অবস্থানে যারা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামামের নিয়ন্ত্রনে ছিল তাদেরকে নিয়ে তিনি ডিফেন্সের পিছনে ক্যাপ্টেন আব্দুল জাফর ইমামাএর নিয়ন্ত্রনে ছিল তাদেরকে বিকল্প অবস্থানে চলে যাবে। এছাড়া তাদের আরো সিদ্ধান্ত ছিল যে, এভাবে প্রত্যাহার করার সময় যদি শত্রুর স্নগে এনকাউন্টার হয় সেজন্য সকুকে প্রতুত থাকতে হবে।
এভাবে বিগ্রেডিয়ার আনান সরুপের পরামর্শ অনুযায়ী শত্রুপক্ষের এনকাউন্টের এড়িয়ে কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধারা পিছনে বিকপল স্থানে নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হয়,
যেহেতু মুক্তিবাহিনীর যোগাযোগের জন্য কোনো ওয়ারলেস কমুনিকেশন ছিল না সেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের এ ডিফেন্সে প্রত্যাহার করার সময় শেষ মুহূর্তে নিজেদের মধ্যে সঠিকবভাবে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্বব হয় নি। ফলে ডিফেন্সের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ রাতের অন্ধকারে কিছু সময়ের জন্য একে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। সকালে কয়েক ঘন্টার মধ্যে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে পরবর্তী অবস্থানে এসে মিলিত হয়।
সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে যে,যুদ্ধীর প্রাথমিক পর্যায়ে বেলোনিয়া অঞ্চলের মুন্সিরহাট ডিফেন্স থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এ প্সহচাদসরন পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আরোও বৃহত্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য একটি সুচিন্তিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল প্রাসঙ্গিক বিষয়ে এ ডিফেন্সের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের অভিমত নিম্নরূপঃ
‘’এ উইথড্র্যালের প্রয়োজনীয়তা ও রনকৌশল নিয়ে বিভিন্ন মহলে ও দেশ বিদেশে কয়েকটি সামরিক কলে ও একাডেমিতে ভিই ভিন্ন মূল্যায়ন রয়েছে। তাই উইথড্র্যালের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। প্রথমত সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে মুল্যায়ন করলে দেখা যাবে,এ উইথড্রায়ালের বিকল্প আমাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। আমরা মুন্সিরহাটে প্রায় ৪ মেইল বিস্তৃত ডিফেন্সের সম্মুখে ঘন মাইনফিল্ড সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত ফায়ার পাওয়ার ও প্রয়োজনী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে ফেনীর দিকে মুখ করে যে শক্তিশালি ডিফেন্স গড়ে তুলেছিলাম এবং এ ডিফেন্স থেকে কয়েক দফা শত্রুর সম্মুখ আক্রমনকে প্রতিহত করা। সম্মুখযুদ্ধে বারবার ব্যর্থ হয়ে পরে তাঁরা রণকৌশল পরিবর্তন করে,অর্থাৎ চারিদিকে চারিদিক থেকে আক্রমণ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ঝুঁকিপূর্ণ বৃহত্তম সামরিক অপারেশনের জন্য তাদের ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং আধুনিক ওয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার ক্ষমতা। সর্বোপরি প্রয়োজনে বাড়তি সৈন্য ফেনী থেকে রিইনফোরস করার ক্ষমতা। এছাড়া অন কল আরটিলারি ও বিমানবাহিনীর জঙ্গি বিমান (যা ফেনী শর ও বেলোনিয়া যুদ্ধে তাঁরা ব্যবহার করেছিল) হামলার প্রস্তুতি ছিল সারবক্ষনিক। পক্ষান্ততে আমাদের এসব সুযোগ সুবিধার ঘাটতি চল। তবে তাদের উল্লেখিত সব সুবিধা থাকার পরও সম্মুখযুদ্ধে আমাদেরকে পরাজিত করে আমাদের ডিফেন্স অতিক্রম করার ক্ষমতা তাদের ছিল না,তা আমরা বারবার প্রমান করেছি। শত্রুপক্ষের রনকৌশল পরিবর্তন এবং তা মোকাবেলায় আমাদের ঘাটতি ভহিল উইথড্রয়ালের মূল কারন। তারপরও বলব আমরা এ ত্রীমুখী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতাম। তাতে দুই পক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হত। তাদের ক্ষতি বাড়তি সৈ,অস্ত্র,গোলাবারু ও সরদসামগ্রী ফেনী থেকে এনে ঘাটতি পুরন করতে পারত। এমনকি তাঁরা যখন দেখত যে,ভোরে তিনদিক থেকে এটাক করে আমাদের ডিফেন্স এরিয়া দখল করতে পারছে না তখন কিছুটা সময় নিয়ে তারা আমাদের উপর ব্যাপক আরটিলারি ও বিমানহামলা চালিয়ে আবার আক্রমণ পরিচালনা করত। এতে আমাদের কোনো পালটা ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি আক্রমণ চলাকালীন আমরা তাদের মতো প্রয়োজনীয় আরটিলারি ও বিমানহামলার সহযোগিতা পেতাম না। তখন আমাদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ওয়্যারলেস সেটও ছিল না। ভারত থেকে তখন পর্যন্ত সব ধরনের সাহায্য পরিপূর্ণ আশ্বাস পাওয়া যায় নি। আমরা ভারত থেকে যুদ্ধের এ প্রথম লগ্নে পাচ্ছিলাম, আর্মস,অ্যামুনেশন ও সীমিত আরটিলারি সমরথন। তাছাড়া পাচ্ছিলাম বিভিন্ন ধরনের মাইন ও শত্রুপক্ষের মুভমেন্টের বিভিন্ন খবরা খবর অর্থাৎ আমরা ভারত থেকে পরোক্ষভাবে সীমিত সাহায্য পাচ্ছিলাম। যদিও পরবর্তীতে এ সাহায্য ছিল ব্যাপক এবং বিভিন্ন অপারেশনে তাদের ছিল প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন। মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রস্তুতিলগ্নে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি যদি হত,পরবরতীতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়াত। সার্বিকভাবে অপারেশঙ্গুলোর মধ্যে ইউথড্রয়াল একটি অপারেশন হিসেবে আজও স্বীকৃত। ‘’
মুন্সিরহাট ডিফেন্স থেকে জুনের শেষ সাপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদসরন করে ভারতের সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে শ্রয় নেয়ার পর পাকিস্থানি সেনাবাহিনী এ অঞ্চলটি তাদের দখলে নিয়ে বিলোনিয়া সিমান্ত চৌকি পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সকল দিক দিয়ে সীমান্ত অবরোধ করে দেয়ার প্রচেষ্টা নেয়। পরবর্তীতে পাকিস্থান সেনাবাহিনী এ এলাকায় বেশ সতকাবস্থায় থাকে এবং বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে সমগ্র বিলোনিয়া এলাকায় সতর্ক প্রহরায় নিয়োজিত থাকে এভাবে বিলোনিয়ার প্রথম যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
[১১৩] শফিকুর রহমান চৌধুরী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত