বেলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধ, ফেনী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১১টি সেক্টরে সংঘটিত হয়েছিল। এই ১১টি সেক্টরের মধ্যে ২ নং সেক্টর সেক্টর সংঘটিত হয়েছিল বেলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধে। আমরা যদি বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ঠিক ফেনীর উত্তরের অংশে অবস্থিত ছোট সীমান্তবর্তী শহর বেলোনিয়া। পাকিস্তানী বাহিনীর প্রাথমিক আক্রমনঃ পাকিস্তানী সৈন্যরা সালিয়ার দক্ষিণ দিক থেকে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে। একই সাথে পাকিস্তানী সৈন্যরা উত্তর দিক থেকে বার বার আক্রমণ করেত থাকে এবং প্রতিবাদে অপর পরিখা থেকে পাল্টা ফায়ার করতে থাকে এবং শক্রর সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে। দুই পক্ষের সাথে সারাদিন বৃষ্টির মতো গুলি বিনিময় হতে থাকে। একই সাথে মুক্তিবাহিনী তাদের নিজস্ব অবস্থার উন্নতি সাধন করে আরো অনেক বেশি পরিখা খনন করে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে থাক। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ দিনের শেষ ভাগে মিত্রবাহিনী সৈন্যদের খবর প্রথমবারের মতো সীমান্তের অপর পার্শ্ব থেকে পরিখার মাধ্যমে পৌছায়। পরবর্তীতে যোগাযোগ পরিখাগুলো আরো উন্নত করায় গোলাবারুদসহ সকল ধরনের সরবরাহ সময়মতো পৌছানো সম্ভব হয়। শক্রর বিমান হানাঃ ৪ নভেম্বর বিকেলে আকস্মাৎ শক্রর চারটি এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান আকাশে দেখা যায়। বিমানগুলো মিত্রবাহিনী অবস্থানের ওপর আকাশে দুইবার চক্রাকারে ঘুরতে থাকে এবং হঠাৎ কর এদুটি বিমান মিত্রবাহিনীর কাছাকাছি এসে অনবরত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সৈন্যরা পরিখা থেকে নিজেদের কাছে যে সকল ক্ষুদ্রাস্ত্র ছিল তা দিয়েই শক্রর বিমানের ওপর ফায়ার করতে থাকে। ২ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানিতে এই সময় একজন নায়েব সুবেদার একটি ভারী মেহসনগান দিয়ে শক্রর বিমান লক্ষ্য করে ফায়ার করেছিলেন। তার ফায়ার চলাকালীন একটি বিমান নিচের দিকে আসে এবং তার দিকে একটি সবুঝ ট্রেসার নিক্ষেপ করে। সাথে সাথে অপর একটি জেট বিমানও নিচে নেমে আসে এবং তার ওপর অনবরত ফায়ার করতে থাকে। কিন্তু সে সুবেদার বীরত্বের সাথে এই মেশিনগান দ্বারা ফায়ার করতে থাকেন এবং শহীদ হন। তার ভারী মেশিনগানটিও শক্রর বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ধ্বংসের পূর্বে এই মেশিনগান দ্বারা শক্রর বিমানেও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একই সাথে চারটি বিমান এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সমস্ত বিকেল এবং পরবর্তী রাত পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। পরবর্তী দিন অর্থাৎ ৫ নভেম্বর পরিস্থিতি অনেকটা অপরিবর্তিত ছিল। বিকেলের দিকে তিনটি পাকিস্তানী বিমান মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে এবং গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্ত তারপরও তারা মুক্তিবাহিনীকে তাদের জায়গা থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়নি। বিমান হামলার পর পাকিস্তানী বাহিনী অনেকবার চেষ্টা করছিল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য এবং উত্তরে আটকে থাকা সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য। কিন্তু প্রতিবারই তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল। সালদা বাজার দখলঃ ধানিকুন্দার দক্ষিণে মুহুরী নদীর পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত সালদা বাজারে শক্রর অবস্থান ছিল অত্যান্ত সুদৃঢ়। লেফটেন্যান্ট ইমামাএর নেতৃত্বাধীন ধানিকুন্দায় অবস্থিত এ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একটি ফাইটিং টহল পাঠিয়ে শক্রর অবস্থান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য। এ কোম্পানি ৫ নভেম্বর মোট ৩০ জন জনবলের একটি শক্তিশালী টহল দল এই উদ্দেশ্যে পাঠায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই টহল দলটি শক্রর অ্যাম্বুশের মধ্যে পড়ে এবং শক্রপক্ষ অতি নিকট থেকে তহল দলের ওপর ফায়ার করতে থাকে। টহল দলের উপ-অধিনায়ক নায়েক তৈহিত উল্লাহ শক্রর মুখোমুখি হয়ে তার অবস্থান থেকে এলএমজি দ্বারা ফায়ার করতে থাকে। সে শক্রর যথেষ্ট ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয় এবং অ্যাম্বুশ রচনাকারী শক্রপক্ষ সকলেই এলোমেলোভাবে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভবে নায়েক তৈহিদের ওপরও শক্র ফায়ার করে এবং সে ৫টি বুলেট বিদ্ধ হয়। টহল অধিনায়ক নায়েক আজিজ সেখানেই শহীদ হন এবং টহলের অন্য তিনজন সৈনিকও মারাত্মকভাবে আহত হন। মধ্য রাত্রিতে এই খবর পেয়ে এ কোম্পানি সকল সৈনিক প্রতিরক্ষা থেকে সালদাবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ কোম্পানি নিজিস্ব মর্টার ফায়ারের আবরণে সালদা বাজারের বহির্মুখী চৌকির ওপর তরঙ্গ গতিতে আক্রমণ করতে থাকে। পাকিস্তানী বাহিনী অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়ে এবং কোনোরূপ দেরি না করে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যন্ত্রপাতি রেখে পালিয়ে যায়। ৬ নভেম্বর প্রথম আলোর মধ্যে এ কোম্পানি সালদা বাজার সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়।
চূড়ান্ত আক্রমণঃ ইতোমধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৮৩ পাহাড়ি ব্রিগেড সীমান্তের কাছাকাছি আসতে থাকে। ভারতীয় কমান্ডার সমগ্র এলাকা পরিদর্শন করেন এবং মুক্তিবাহিনীর প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করেন। তারা বেলোনিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সমস্ত বেলোনিয়া দখল করতে মুক্তিবাহিনীকে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার পরিকল্পনা প্রদান করেন। ধারণা করা হচ্ছিল বেলোনিয়ার উত্তর প্রান্তে চতুর্দিকে ঘেরাওকৃত সৈন্যরা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু ৬ নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের একত্র থেকে ফায়ার প্রতিরোধ করা দেখে ষোলান্টি-পরশুরাম এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত করার লক্ষ্যে শারীরিকভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ ডগরা রেজিমেন্ট ৬/৭ নভেম্বর মধ্যরাতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্ধারিত ব্যাটালিয়ন আক্রমণে যাবার পূর্বে এলাকায় প্রায় আধাঘন্টা যাবত ২৩ পাহাড়ি ডিভিশন আর্টিলারি দ্বারা গোলাবর্ষণ করা হয়। মিত্রবাহিনীর গোলাবর্ষণে যখন লক্ষ্য্যবস্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখনই ৩ ডগরা রেজিমেন্ট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে আক্রমণ রচনা করে। পাকিস্তানী বাহিনীর অনেক পরিখা ও শক্র ঘাঁটি রকেট লাঞ্চারের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পরে পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং সম্পূর্ণ এলাকা প্রথম আলোর পূর্বে মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে। পাকিস্তানী বাহিনী মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি গোলান্দাজ ও এসল্টের সময় প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর ২০০-এরও বেশি সৈনিক মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং আহত হয় অনেকেই। দুজন পাকিস্তানী অফিসার এবং ৭২ জন অন্যান্য পদবীর সোইনিক এতে আত্মসমর্পণ করে। ভারী অস্ত্রসহ প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র বেলোনিয়া পরশুরাম এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। ক্ষুদ্রাস্ত্রের গোলাবারুদসহ বিপুল পরিমাণ রকেট লাঞ্চার এবং মর্টারের গোলা উদ্ধার করা হয়। ৭ নভেম্বর থেকে বেলোনিয়া ব্রিজের উত্তর প্রান্তের ৭৫ কিলোমিটার জুরে বিস্তৃত এলাকা শক্রমুক্ত হয়। যদিও সালিয়ার দক্ষিণে অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনী কিছুটা হলেও মজবুতভাবে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তার পরেও তারা পরবর্তীতে বেলোনিয়া-পরশুরাম এলাকা পুনর্দখলের কোনো চেষ্টা করেনি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ এবং মিত্রবাহিনী বেলোনিয়া মুক্ত ভূমিতে প্রবেশ করতে থাকে। কে ফোরসের সদর দপ্তর পরবর্তীতে পরশুরাম পুলিশ থানার ওপর উড়তে থাকে এবং বেসামরিক প্রশাসন ওই এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে। তারপর থেকে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যরা তাদের দখলকৃত এলাকাতেই অবস্থান করতে থাকে এবং মুক্তভূমিতে পাহারা দিতে থাকে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত