বেলকুচি থানা আক্রমন, সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জ জেলা সদর থেকে বারো তেলো মেইল(২০-২১ কিলোমিটার) দক্ষিনে তাত প্রসিদ্ধ এলাকা বেল্কুচি থানা অবস্থিত। যমুনা নদীর ভাঙ্গনের কারণে বেলকুচি থানার বিভিন্ন সরকারি -বেসরকারি অফিসগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে উঠেছে বাঁধের পাশ দিয়ে। এরই ফলস্ববরুপ বেলকুচি থানা ভবন ও পুলিশ স্টেশন নদীর পাড়ে ওয়াপদা বাঁধের বাইরে বিরাট হাটসংলগ্ন জায়গায় অবস্থিত। ১০ সেপ্টেম্বর কাজিপুর মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকসেনাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়। ফলে ১১ সেপ্টেম্বর স্বাবাভাবিকভাবেই পাকসেনারা কাজিপুর থানা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে ৫০০ জনের এক বিরাট মুক্তিবাহিনীর দল ওইদিনই সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থিত টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলীর চরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে আনুমানিক ৩০০ জনের একটি দল কাজিরপুর থানায় রেইড পরিচালনা করে। ১২ সেপ্টেম্বর সিংগুলীর চরের পশ্চিম দিকে নদীতে লঞ্চযোগে পাকবাহিনী হিন্দু শরণার্থী এক নৌকাবহরে আক্রমণ করে। গুলির শব্দ শুনে মুক্তিবাহিনী চর থেকেই পাল্টা আঘাত হানে। অত্র অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী আমির হোসেন ভুলু বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে পান যাত্রীবিহীন ২০-২৫ জন পাকবাহিনী একটি লঞ্চ। প্রায় ৩০-৪০ মিনিট দুই পক্ষের মধ্যে একটানা যুদ্ধের পর পাকসেনাদের লঞ্চটি দ্রুত সিরাজগঞ্জ সদরের দিকে পলায়ন করে। পরে জানা যায়,এই যুদ্ধে ৫-৬ জন পাকসেনা মারা গিয়েছিল। এই ঘটনায় মুক্তিবাহিনী সাহস বৃদ্ধি পায় এবং বেলকুচি আক্রমণ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিরাজগঞ্জ ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. সাইদ আহম্মেদকে আদাচাকীতে(সমেস পুরের নিকট) তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। বেলকুচি বা সোহাগপুরের সাপ্তাহিক হাট ছিল বুধবার। সাইদ আহম্মদের ওপর নির্দেশ ছিল উক্ত হাটে গিয়ে তেল লবণ ক্রয়ের ফাঁকে থানার সবকিছু রেকি করে আসবে। বেলকুচি থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি আততায়ীর হাতে নিহত সোবাহান সাহেবের ছেলের সহযোগিতায় সাইদ আহমেদ রেকি করে রাত ৮টার সময় মুক্তিবাহিনীর নৌকায় ফিরে আসে এবং আমীর হোসেন ভুলুর সভাপতিত্বে রেকির ওপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন খ ম আক্তার হোসেন কোম্পানি কমাণ্ডার,ডেপুটি কমাণ্ডার ফজলুর মতিন মুক্তা,গ্রুপ লিডার (মৃত) সোহরাব হোসেন,আব্দুল বারী(ইউপি চেয়ারম্যান বহুলী),গ্রুপ লিডার সাইদুল ও আরো অনেকে। আলোচনা শেষে রেইড পার্টি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে রেইড দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একদল সদর থানা অফিসের পাশ দিয়ে,অন্য একটি দল বাধ দিয়ে আরো দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে পরবর্তীতে পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে এবং অপর দল ভাটির টানে ৪-৫ টি নৌকা বোঝাই হয়ে ১২ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে চারটার সময় বেলকুচি থানা আক্রমণ করে। সদর থানার অফিসে পাশ দিয়ে গমনকারী দলের দায়িত্ব ছিল টেলিফোন সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করা। কিন্তু যথাস্থানে পৌঁছে তারা দেখতে পায় একটি বিল্ডিং(বর্তমানে বেলকুচি থানা টিএনও এর বাসভবন)-এ রাজাকারদের মিটিং চলছে। তিন দিক থেকে থানা এলাকায় পৌঁছে মুক্তিবাহিনী ফায়ারিং শুরু করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাক মিলিশিয়া বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। এই যুদ্ধে ডেপুটি লিডার আব্দুর রশিদ ও অন্য একটা গ্রুপের কোম্পানি লিডার সাইদুর রহমান ও উল্লাপাড়া থানার শামসুল হক গুরুতর আহত হন। তবে কেউ শহীদ হয়নি। ৪০-৫০ জন পাক মিলিশিয়ার মধ্যে ৩-৪ জন মারা যায় এবং ১৫ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসএমজি,মর্টার,চাইনিজ রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ আটক করে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসে। খাদ্যসামগ্রী হস্তগত হয় প্রচুর। যা পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর কাজে লাগে। চলতে থাকে মুক্তিবাহিনী জয়ের উৎসব। হিট অ্যান্ড রান এই পদ্ধতি ছিল মুক্তিবাহিনীর কৌশল। পাকবাহিনী বেলকুচি পৌঁছার পূর্বেই মুক্তিবাহিনীর ডিঙ্গা নৌকাগুলো পাল তুলে ঢেউয়ের তালে পাড়ি জমায় সিংগুলির চরে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত