You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.09 | বড়াইলের যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া - সংগ্রামের নোটবুক

বড়াইলের যুদ্ধ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

জুন মাসের দিকে নবীনগর থানার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর গণহত্যা, অত্যাচার-নির্যাতন চলতে থাকে; একথা শুনে সাব-সেক্টর কমান্ডার আইনউদ্দিন, আল-মামুন সরকারের নেতৃত্বে ৩৫ জনের এক বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার বড়াইল গ্রামে পাঠানো হয়। আল-মামুন সরকার বড়াইল গ্রামে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে পাকবাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন। ৯ অক্টোবর ভোরে কুয়াশার মধ্যে পাগলী নদীতে পাকবাহিনীর একটি লঞ্চের আগমন লক্ষ্য করা যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে বড়াইল খালের মোহনায় প্রবেশ পথে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়। আল-মামুন সরকার বড়াইল বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থান নেন। সারওয়ারদীর নেতৃত্বে নদীর মোহনা সংলগ্ন খারঘর গ্রামের একটি বাড়ির বাঁশঝাড়ের নিচে ছয়জন আনসার সদস্য এবং দক্ষিণে একটি কবরস্থানে আবুল খায়েরের নেতৃত্বে আরও কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা পজিশন নেয়। চার থেকে পাঁচ’শ লোকের বাস ছোট এই খারঘর গ্রামে। গ্রামের মানুষ কিছু বুঝবার পূর্বেই শতাধিক সৈন্য নিয়ে পাকবাহিনী খারঘরের নিকট বড়াইলে খালের মোহনায় পৌঁছে যায়। সাথে সাথে খারঘর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রাথমিকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকসেনারা লঞ্চটিকে দ্রুত নদীর পাড়ে ভিড়িয়ে কাদাজলসমপন্ন ধান ক্ষেতের আইলে অবস্থান নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। আল-মামুন সরকারও তার বাহিনী নিয়ে বড়াইল থেকে পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে। বড়াইল থেকে পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণের তীব্রতা অনুধাবন করে বড়াইল প্রবেশের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্রুতগতিতে খারঘর ঢুকে পড়ে এবং খারঘর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমনস্থল চারদিকে ঘিরে ফেলে। চতুর্দিকে পানি ও প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যদিয়ে গ্রামের মানুষজন নিরাপদে পালাতে চেষ্টা করে। প্রায় আধা ঘন্টা পর্যন্ত এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। খারঘরে প্রথম গুলিবর্ষণের প্রায় একঘন্টা পর সারওয়ারদী এবং তাজুল দৌড়ে এসে আল-মামুন সরকারকে জানাল যে, পাকবাহিনী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে-একদল খারঘরে এবং অপর একটি দল ধানক্ষেত দিয়ে-বড়াইলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গ্রামের ভেতরে ঢুকে পাকবাহিনী এলোপাথারি গুলি করছে। এরই মধ্যে বড়াইল উত্তরপাড়ায় একতি (আলগা) বাড়িতে অগ্নিকুণ্ড ও আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখে উত্তর দিক থেকে আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত বড়াইল বাজার খালের দক্ষিণ পাশে বিভিন্ন বাড়িতে পজিশন গ্রহণ করে। সকাল ১০টা নাগাদ পাকবাহিনীর ৩০/৪০ জনের একটি দল বাজার পুকুরের উত্তরপাড় দিয়ে দ্রুত বাজারে প্রবেশ করে। তখন মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকবাহিনীর মধ্যে দূরত্ব ছিলো মাত্র কয়েকশ গজ। আল-মামুন সরকার তাৎক্ষণিক এল.এম.জি দিয়ে ফায়ার শুরু করে। সাথে সাথে অন্যান্যরাও নিজ নিজ অবস্থান থেকে ফায়ার শুরু করে। পাকবাহিনী এই ঝাটিকা আক্রমণে বাজারের বিভিন্ন দোকানের পিছনে লাফিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করে এবং কিছু পাকসেনা পুকুরের পূর্বপাড়ে একটি হিন্দু বাড়িতে পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। ১৫/২০ মিনিট উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে করতে দ্রুত বড়াইল থেকে খারঘরে পৌঁছে লঞ্চযোগে পশ্চাদপসরণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সৌভাগ্য যে, সামনে ও পিছনে খাল, ডোবা ও বর্ষার পানি থাকায় শক্রর নিক্ষিপ্ত মর্টারের একটি গোলাও বিস্ফোরিত হয় নি। এ আক্রমণে বড়াইল বাজারে পাকবাহিনীর অন্তত পাঁচ জন সৈনিক হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ প্রতিরোধের কারণে পাকবাহিনীর বড়াইলে আক্রমণ ব্যর্থ হয়। কিন্ত বরাইলে সেদিন কোন ক্ষয়-ক্ষতি করতে না পারলেও খারঘর গ্রামে এরা ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকান্ড ও পাশবিক নির্যাতন চালায়। বরাইল থেকে পিছু হঠে পাকবাহিনী সকাল ১১টা দিকে খারঘরে প্রবেশ করে। দুপুর ১২টার দিকে পাকবাহিনী খারঘর থেকে পশ্চাদপসরণের সাথে সাথে নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুসন্ধান শুরু হয় খারঘরে। বিধ্বস্ত গ্রামে তখন প্রতিটি বাড়িতে স্বজন হারানোর গগণ০বিদারী কান্নার আওয়াজ। এই যুদ্ধে যারা শহীদ হন, তাদের মাঝে আনসার সদস্য আলী আজগর, রেনু মিয়া, খুরশিদ মিয়া, দারু মিয়া, রইছ মিয়া ও আবুল কাশেম অন্যতম। আবুল খায়ের ও গোলাপ অস্ত্রসহ বন্দি হন। পাকবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হলেন গ্রামের ৪৬ জন নারী ও পুরুষ। আহত হলেন শতাধিক, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হলে অনেক পূন্যবতী মা ও বোন। ব্যাপক লুটপাটে গ্রামটি বিধ্বস্ত হলো। দুপুর নাগাদ পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহ থেকে স্বজনদের খোঁজে ছুটে এলেন হাজার হাজার মানুষ। এসময় ছিলো না শহীদদের কাফনের কাপড়, ছিলো না আহতদের চিকিৎসার জন্য কোন ডাক্তার, এমনকি কোন ঐষধ এর সুবন্দোবস্ত পর্যন্ত ছিলো না।
[৫৫] মোঃ আবু মুসা

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত