বক্তাবলি এলাকায় যুদ্ধ, নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর থেকে পশ্চিম-দক্ষিণে ঢাকা জেলার সীমান্তে বক্তাবলি অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সময়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের দক্ষিণাংশে গোগনগর ইউনিয়নের বুড়িগঙ্গা নদীর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ গোগনগর (মসিনাবন্দ) ও সৈয়দপুরে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা শহরের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করে। গোগনগর ও সৈয়দপুরের মাঝামাঝি লুহিয়ারকুম (জলধার), সৈয়দপুরস্থ জিএমসি মাঠের অপারেশনে পাকিস্তানী নিহত হওয়ার পর শক্র নির্বিচারে গারম জ্বালিয়ে দিতে থাকে এবং মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বুড়িগঙ্গার পশ্চিম পার অর্থাৎ কুরেরপাড়, আলীরটেক, ডিক্রিচর, মুক্তারকান্দি, লক্ষ্মীনগর, বক্তাবলিতে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এসব ক্যাম্প থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করে। ঐ সমস্ত ক্যাম্প যুদ্ধকালীন নারায়ণগঞ্জ থানা কমান্দার গিয়াস উদ্দিনের দলের কতিপয় সদস্য সালাউদ্দিন, তপু, এমদাদুল হক বাচ্চু, নাজির উদ্দিন, আবু বক্কর সিদ্দিক, গফুর, আউয়াল চৌধুরী, আফাজ, রিয়াজুল করিম, বাসার, এসএম গিয়াস উদ্দিন, এসএম মোসলেহ উদ্দিন, শরীফ, ছিদ্দিক, মতিউর রহমান। আমিনুর দলের আমিনুর, এমরান, আফজাল, রাশেদ, আলী আজগর, কমরউদ্দিন দলের কমর উদ্দিন, আঃ কাদির। মাইন উদ্দিন দলের মাইন উদ্দিন, মালেক ও গোপীনাথ সাহা দলের গোপীনাথ,পরিমল, জাহাঙ্গীর শরিয়াতুল্লাহ। সিরাজুল ইসলাম দলের সিরাজুল ইসলাম, আজাহার, তমিজ উদ্দিন রিজভী, ফয়েজ আহম্মেদ, দেওয়ান আবদুল করিম এবং মাহফুজুর রহমান, জানে আলম, ছাত্তার (মরন), রব, সফি উদ্দিন, ইসমাইল। কমল গ্রুপের ফয়েজ আহম্মেদ, মাসুম, মজিবুর এবং হায়দার আলী সকলেই স্থায়ীভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও পরে মেজর হায়দারের নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে স্থাপিত পরগনাসহ অন্যান্য ক্যাম্পগুলোর সমন্বয় সাধন করতেন মাহফুজুর রহমান। মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জের উত্তরাংশে ও বন্দর এলাকায় অবস্থানরত তৎকালীন থানা কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন যৌথভাবে সেক্টর কামান্ডারের নির্দেশিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মসূচী প্রণয়ন করত। কৌশলগত দিক থেকে আলীর টেক ও বক্তাবলি পরগনা বুড়িগঙ্গা নদীর কারণে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। পাকবাহিনী সরাসরি উক্ত এলাকায় যাতায়াত করতে পারত না। মুক্তিযোদ্ধারা এটিকে মুক্ত এলাকার ন্যায় বিবেচনা করে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল এবং সেখান থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহরে অপারেশন পরিচালনা করত। শক্র আতঙ্ক থাকলেও প্রকৃতপক্ষে শহরে অপারেশন পরিচালনা করত। শক্র আতঙ্কে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে উক্ত এলাকায় শুধুমাত্র মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারাই অবস্থান করত। সেখানে কোনো নিয়মিত বাহিনী ছিল না।
২৯ নভেম্বর সুবেহ সাদিক। শীতের ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। পাকিস্তানীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে উক্ত এলাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েকটি গানবোট থেকে ৫০০ জনের উপর পাকিস্তানী ও রাজাকার অবতরণ করে। প্রথমে তারা সমস্ত পরগনা ঘিরে ফেলে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধা অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালায়। এই সময় তাদের নিকট ভারী মর্টারও ছিল। হঠাৎ আক্রমণ শুরু হওয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপগুলো একত্রিত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে যার যার ক্যাম্প থেকে শক্রর অগ্রযাত্রায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গরে তোলে। সর্বপ্রথম শক্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় কুরের পাড়ে ও আলীরটেকের মাঝচরে। প্রতিরোধ গরে তোলে পূর্বদিকে থেকে গিয়াস উদ্দিনের একাংশ এবং পশ্চিম দিক থেকে মাইন উদ্দিনের দল। অন্যদিকে মুক্তারকান্দি, কানাই নগরে একদিকে মাহফুজুর রহমান, জানে আলম, রব ও অন্যানরা অপরদিকে আমিনুর এমরান গ্রুপসহ অন্যান্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধে আলিরটেকে একজন শক্র নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আলীরটেক অঞ্চল থেকে এক কৃষক শক্রর একটি বিধ্বস্ত ওয়ারলেসে সেট ও শক্রর কিছু রক্তমাখা জামা-কাপড় মুক্তি বাহিনীর নিকট হস্তান্তর করে। ভোরের আলো ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্তিবাহিনী পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কারণ তারা পাকিস্তানী সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পাড়ায় সম্মুখ যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। শক্রর সাথে দিনের বেলায় যুদ্ধ করার মতো নূন্যতম ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ছিল না। যদিও তাদের মনোবলের অভাব ছিল না। এলাকার ছাত্র জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সাথে সহযোগী হিসেবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধ ও খন্ডকালীন যুদ্ধের সময় শক্র তাদের অগ্রযাত্রা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখে। ঠিক সেই সময়ই মুক্তিবাহিনী পিছু হটার কৌশল অবলম্বন করে এবং এলাকার পুরুষ ও যুবক নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়। দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে শক্র কয়েকটি হেলিকপ্টার ওপরে উড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয়ের চেষ্টা করে এবং অবস্থান বুঝে গুলিবর্ষণ করে। শক্ররা মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে এলাকার প্রায় ১৩৯ জন নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে ও জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করে। এলাকার সমস্ত বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধাদের মুন্সিগঞ্জের সিরজদিখাঁ থানার তালতলায় জড়ো হতে থাকে। দিনের মাঝ পর্যায়ে সিরাজদিখাঁ থানার মুক্তিযোদ্ধা জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা তাদের সাথে মিলিত হয় এবং পাল্টা আক্রমণের চিন্তা করে। কিন্ত কোনো মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের কাছে ভারী অস্ত্র ও যথেষ্ট গোলাবারুদ না থাকায় পাল্টা আক্রমণ সম্ভব হয়নি। বিশৃঙ্খলভাবে শুরু হওয়া যুদ্ধ বিশৃঙ্খলভাবেই শেষ হয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত