নোয়াখালীর শেষ যুদ্ধ
ডিসেম্বরের ৫ তারিখে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ফেনীতে পাকবাহিনী টিকতে না পেরে ক্যাম্প ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টেনমেন্টে চলে যায়। এই সময় সারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী একসাথে পাকবাহিনীর উপর আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে। সারা বাংলাদেশে হানাদার বাহিনী ভীষণভাবে মার খেয়ে ক্যান্টেনমেন্ট সমূহে আশ্রয় নেয়া আরম্ভ করে। ৫ ডিসেম্বর চৌমুহনীর টেকনিক্যালে একদিকে লুৎফুর রহমানের দল, একদিকে লুৎফুর রহমানের দল, একদিকে রুহুল আমিনের দল, বি.এল.এফ ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা কমান্ড সব মিলে প্রায় হাজার পাঁচেক সৈন্য টেকনিক্যাল আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধ প্রায় আট ঘন্টা স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধে নুর মোহাম্মদ, হাবিলদার হামিদসহ আরও ৫/৬ জন শহীদ হন। হানাদার বাহিনী ৫ ডিসেম্বর বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল থেকে পালিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ করে। নোয়াখালি রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা অধিকাংশ মাইজদীতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ৬ ডিসেম্বর বিকেলে ‘সি’ জোনের নেতৃবৃন্দ ও কমান্ডাররা একত্রিত হয়ে মাইজদী শহর আক্রমণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং শহর আক্রমণের যাবতীয় কাজ নির্ধারণ করেন। সুজাপুরের রফিকউল্লাহ ও লক্ষী নারায়ণপুরের আবুল খায়ের তৎকালীন ডী.সি মঞ্জুরুল করীমের সঙ্গে রাত ৮টায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে বলেন, আমরা সকালে শহরে আসব, আপনার বাহিনী যেন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি নবা করে। ডি.সি সাহেব শুধু জানতে চান, আপনারা কে? উত্তরে তারা বললেন, আমরা বাঙালি। ছয় তারিখে বেগমগঞ্জের মান্নান, শাজাহান, তাঁদের বাহিনী নিয়ে মাইজদীতে আসেন, কানকীর হাট এবং সেনবাগের নবীপুর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কবিরহাট, চাপরাশিহাট, রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এখান থেকে মাইজদী কোর্ট বাদ দিয়ে হারিয়ণাপুর স্টেশন এর দক্ষিণ দিকে পজিশন নিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। সেখান থেকে গ্রেনেড চার্জ করে গোদার মসজিদে উঠলেন, লালবিহারীর দোকানের ভিতরে কয়েকজন রাজাকার ছিল। সেখান থেকে রাজাকাররা গুলি করে। মুক্তিযোদ্ধারা শুয়ে পড়লে গুলি আর লাগেনি। এতে জাহাঙ্গীর আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পজিশন পরিবর্তন করেন। মাইজদী বাজার হতে সোনাপুর পর্যন্ত ১২টি পথে ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত ৩টা থেকে আক্রমণ শুরু করে। মাইজদী ভোকেশনাল আক্রমণ করলে টিকতে না পেরে রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। অপর দিকে বি.এল.এফ এর প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েতের নির্দেশে বি.এল.এফ বাহিনী পূর্ব দিকে কোর্ট স্টেশন রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে ক্যাম্পের পতন ঘটায় এবং তারা পি.টি.আই-এর দিকে এগুতে থাকে। ‘ডি’ জোনের রফিক কমান্ডার তার বাহিনী নিয়ে দত্তের হাট ক্যাম্প আক্রমণে ‘সি’ জোনের মুক্তিবাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে যৌথভাবে আক্রমণ করে। দত্তেরহাট ক্যাম্প আনুমানিক ৮/১০ জন রাজাকার নিহত হয়। এসময় সোনাপুর থেকে মাইজদী বাজার পর্যন্ত শহরের সকল এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করে। বেলা ১১টার সময় পুলিশবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং ম্যাগাজিনের সমস্ত গুলি, রাইফেল, অস্ত্র শস্ত্র, ‘সি’ জোন হেড কোয়ার্টার ছয়ানীতে নিয়ে রাখা হয়। পি.টি.আই, এর রাজাকাররা দোতলা থেকে থেমে থেমে চতুর্দিকে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর, মিজান, ফজলে এলাহীর নেতৃত্বে চতুর্দিকে ঘেরাও করে রাখে ও গুলি অব্যাহত রাখে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিল্ডিং বিধ্বংসী ভারী অস্ত্র না থাকায় ফেনী থেকে ২ ইঞ্চি মর্টারগান এনে আনুমানিক সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মাইজদী স্টেডিয়ামের উত্তর পশ্চিম কর্নার থেকে পি,টি.আই রাজাকার হেড কোয়ার্টারের উপর মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে এক সাথে প্রচণ্ড আক্রমণ করলে কয়েকজন রাজাকার মারা যায় ও বাকিরা সেখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এমনিভাবে মাইজদী শহর ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীন হয়।
[৪৪] জোবাইদা নাসরীন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত