You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.12 | নবাবগঞ্জ থানা অপারেশন, ঢাকা - সংগ্রামের নোটবুক

নবাবগঞ্জ থানা অপারেশন, ঢাকা

দেশের অন্যান্য জায়গার মতো ঢাকা জেলার সদর থেকে দক্ষিন-পশ্চিমে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী থানা দোহার ও নবাবগঞ্জের অধিবাসীরা একটি স্বাধীন দেশের জন্য তাদের জীবন বাজি রেখেছিল। তারা ছিল স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব। তাদের দেশপ্রেম তাদেরকে বিভিন্ন যুদ্ধে আত্মহুতি দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাদের আত্মদানের স্মৃতি আজও বহন করছে নবাবগঞ্জের থানা আক্রমণের গৌরব গাথায়। দোহার ও নবাবগঞ্জ এলাকায় সুপরিকল্পিত ও সাংগঠনিক ভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় এপ্রিলের প্রথম দিক থেকে। কিন্ত এর সাংগঠনিক কাজ শুরু হয় ২৫ মার্চের পর থেকেই। শক্রর হিংস্র আক্রমণের প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে উঠতে দু-চারদিন সময় লাগে। জিনজিরায় লাঠি বল্লম নিয়ে, শক্র প্রতিহত করতে গিয়েই ছাত্র তরুণ এবং স্থানীয় জনগণ বুঝতে শুরু করেন যে, এভাবে শক্র প্রতিহত এবং পরাজিত করা সম্ভব নয়। সকলেই বুঝতে পারেন যে, প্রাণপণ যুদ্ধ এবং রক্ত ছাড়া শক্র সম্পূর্ণ ধ্বংস বা পরাজিত না করে দেশের মানুষকে শক্র বাহিনীর ছোবল থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। পাক বাহিনীর বর্বর ও পাশবিক হত্যালীলার ভয়াবহতা ও বীভৎসতায় যুবসমাজের এক অংশের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য নেমে আসে হতাশা। ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী (অব.) ছিলেন মূল সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তার দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা, নিষ্ঠা, সাহস ও সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। তার নেতৃত্বে ১২ এপ্রিল এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক বৈঠক অনুষ্টিত হয় হরিরামপুরের আজিম নগর গ্রামে। দোহার এলাকায় প্রথম থেকেই যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে রামপাড়ার সিরাজ মিয়া, জয়পাড়ার আক্কেল আলী, আনীস আলী (গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক), অধ্যাপক আব্দুল হাই, পালম গঞ্জের ডা. আব্দুল আউয়াল, নারিশার ডা. আবুল কালাম, তোতা গাজী, মোকছেদপুরের সাইদুর রহমান খোকা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, শহীদ মাহফুজ এবং জয়পাড়ার আব্দুর রউফ খান প্রমুখ অন্যতম। পাক হানাদারদের বর্বরতা ও তাদের দোসরদের আস্ফালনে এবং মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রকাশ্যে তৎপরতা না থাকায় জনগনও অনেকটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। দু-একটি সফল দালাল নিধন অভিযানে মুক্তিবাহিনী এবং জনসাধারণ উভয়েই নতুনভাবে উৎসাহ পায়। এরপর থেকে শুরু হয় একের পর এক দুঃসাহসিক অভিযান। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় উৎকণ্ঠিত পাকবাহিনী পূর্বেই এ এলাকার থানাগুলোতে নতুন নতুন অস্ত্র, গোলাবারুদ, মিলিশিয়া ও রেঞ্চার বাহিনী পাঠায়। গোপন সূত্রে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নিকট খবর আসে যে দু’একদিনের মধ্যে দোহার ও নবাবগঞ্জ থানায় শক্রর বর্বর বাহিনী পাঠানো হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রসহ। এছাড়া ইতোপূর্বে মুক্তিযোদ্ধা কতৃক আকস্মিকভাবে দোহার থানা আক্রান্ত হলে এবং কুখ্যাত ডাকাত হুকুমের দল কতৃক নবাবগঞ্জ থানার অস্ত্র লুট হওয়ায় উভয় থানায়ই নতুন করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ৩০৩ রাইফেল, গুলি ও অন্যান্য হালকা অস্ত্র পাঠানো হয়েছিল। দোহার থানার চেয়ে নবাবগঞ্জ থানায় অস্ত্রের পরিমাণ ছিল বেশি। হাই কমান্ড তাই অতিদ্রুত এবং খুব গোপনীয়তার সাথে নবাবগঞ্জ থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং এলাকায় পরপর কয়েকটি সফল দালাল নিধন অভিযানে অংশগ্রহণকারী গেরিলা যোদ্ধাদের (যাদের সকলেই ছিল জয়পাড়া স্কুলের ছাত্র) এ দায়িত্ব দেন। অভিযানের পূর্বে থানা রেকি করেছিল কে তা জানা যায়নি। শুধু এতটুকু জানা যায়, যে থানার চারদিকে চারটি বাংকারে সেন্ট্রি পাহারা থাকে। গভীর রাতে এবং ভোর হওয়ার পূর্বে দুইবার সেন্ট্রি পরিবর্তন করা হয়। শেষ রাতে থানার সম্মুখ দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ থানার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ ও কচুরিপানায় ভর্তি ডোবা। দক্ষিণ দিকে প্রবেশ করার কোনো পথ ছিল না। পূর্ব দিকে ছিল উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা কলেজ। কাজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থানা আক্রমণ করতে হবে হাই কমান্ডোর কড়া নির্দেশ। জীবনের বিনিময়ে হলেও সমস্ত অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে আনতে হবে। এ অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হলেন : ইউসুফপুরের কৃষকের সন্তান হযরত আলী, ফজলুল হক খান, কাটাখালীর নুরুল ইসলাম খান, আইয়ুব আলী, বানাঘাটার কিশোর ছাত্র ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য সাঈদ। হাতিয়ার ছিল একটি ৩০৩ রাইফেল, কয়েকটি গাদা বন্দুক, একটি স্টেনগান, একটি ৩৬ মি.মি. হ্যান্ড গ্রেনেড। আবার হ্যান্ড গ্রেনেডটিও ছিল অনির্ভর যোগ্য। কারণ এর ডেটোনেটরটি পানিতে ভিজে প্রায় অকজোর মতো হয়েছিল। সন্ধার পর যখন কাটাখালী থেকে তিনটি নৌকায় যাত্রা শুরু হয় তখন আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কিছুদূর যেতে না যেতেই শুরু হয় প্রবল বর্ষণ। একদিকে মুষলধারে বৃষ্টি অন্যদিকে ঝড়ো হাওয়ার মাতলামীতে নৌকা ডুবি ডুবি করেও কোনো মতে রাত দুটোর দিকে নবাবগঞ্জ থানার পেছনে পৌঁছে। নৌকার ভেতরে মুক্তিবাহিনীরা সারারাত ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে রীতিমতো কাঁপছিল। আক্রমণের সময় যেহেতু কাকডাকা ভোর সেহেতু আরো কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না। থানার কাছাকাছি এক জঙ্গলের মধ্যে চলল প্রতীক্ষার প্রহর গণনা। বৃষ্টির পানি মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া তার পর জঙ্গলের মশার কামড়ে মুক্তিবাহিনীদের জীবন ওষ্টাগত প্রায়। তবু নীরবে অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ ছিল না। রাতভর মুষলধারে ঝড়-বৃষ্টি হওয়াতে পাক দস্যুরা প্রায় নিশ্চিন্ত মনে এক ঘরে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমাচ্ছিল। ঝড়বৃষ্টির তান্ডবের এমন দুর্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বাঙালি তরুণরা যে থানা আক্রমণ করতে পারে এটা কল্পনাও করতে পারেনি। তাই প্রায় নির্বিঘ্নেই মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন থানা আক্রমণ করে শক্র পরাভূত করতে সক্ষম হয়েছিল। পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা দুভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ থানার পিছনে দক্ষিণ-পূর্ব কোনাকুনি কলেজের দেয়াল ঘেঁষে খুব সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। সারারাত বৃষ্টির ফলে রাস্তার উপর প্রায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমেছিল। বলতে গেলে বাংকার গুলোর উপর ঢেউ খেলতে ছিল। কলেজের দেয়াল ঘেঁষে পা টিপে অগ্রসর হতে গেরিলাদল যখন প্রায় থানা সংলগ্ন ছোট মাঠে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল তখন বিকট শব্দে সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। পর মুহূর্তেই দেখা যায় যে, সামনে বাংকার এর সাথে গাছের আড়াল হতে শক্রর এক নরঘাতক রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করতে উদ্যত। ঠিক এ সময় সাঈদ তার গ্রেনেডটি মাঠে ছুঁড়ে মারে। বিকট শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হলে সামনে সেন্ট্রি হতবিহবল হয়ে পড়ে। এসময় হতচকিত ইয়ানুছের আঙ্গুল তার বন্দুকের ট্রিগারে লেগে যায়। সে ছিল মুক্তিযোদ্ধা মান্নানের পেছনে। কাজেই বন্দুকের ছ’রাউন্ড গুলি মুক্তিযোদ্ধা মান্নানের পিঠে ও মাথায় লেগে যায়। কিন্তু মৃত্যু পাগল গেরিলাদের থামায় সাধ্য কার? আহত অবস্থায় দৌড় দিয়ে থানার মাঠ পেরিয়ে পশ্চিমের রুমের বারান্দায় উঠে দরজার উত্তর দিকের জানালার ভেতর দিয়ে ৩০৩ রাইফেলের ব্যারেল ঢুকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, সারেন্ডার সারেন্ডার। কয়েক মুহূর্ত পরে সত্যি সত্যি পাকিস্তানীরা হাত উঁচু করে একের পর এক ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে নেমে এসে আত্মসমর্পণ করে। এসময় একজন বাঙালি পুলিশ অফিসার (সম্ভবত থানার সেকেন্ড অফিসার ) মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এসে কোথায় নতুন ৩০৩ রাইফেল, বক্স ভর্তি গুলি, পোস্ট অফিসে রক্ষিত টাকা আছে বলতে থাকে। তার বলা অনুযায়ী রাইফেল, গুলির বক্স মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হলো। অভিযান শেষে নৌকায় যাওয়ার পথে অগ্রসর হতেই দেখা যায় চারদিকে লোকে লোকারণ্য। ভোর হতে না হতে গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে প্রথমে জনসাধারণ আতঙ্কিত হলেও প্রকৃত ঘটনা বুঝতে তাদের খুব একটা সময় লাগল না। বাতাসের বেগে চারদিকে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। গগনবিদারী শ্লোগানে চারদিক কেঁপে ওঠে। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে চারদিক মুখরিত। নদীর দুই তীরে ঘেঁষে হাজার হাজার গ্রামবাসী উল্লাসে লাফাতে থাকে, গর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের বুক ফুলে ওঠে। মাঝিরা কিছুতেই নৌকা নিয়ে সামনে এগোতে পারছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের এক নজর দেখার জন্য গ্রামবাসীদের মধ্যে সেকি প্রতিযোগিতা। কুলবধূ থেকে শুরু করে কচি কচি শিশুরা পর্যন্ত হাঁটুর উপর পানি ভেঙ্গে ছুটে এসেছে কে আগে নৌকার কাছে আসবে। এ সময় নৌকার মাঝিদের দাপত দেখে কে? যে মাঝি রাতে ঝড়ের মধ্যে বিল পাড়ি দিতে একশত বার ঝগড়া বাধিয়েছিল এবং মনে মনে মুক্তিযোদ্ধাদের বাপ দাদার শ্রাদ্ধ করছিল, খুশিতে সে বারবার লাফাচ্ছিল। নৌকা বাওয়া বন্ধ করে গলা ফাটিয়ে জয় বাংকা শ্লোগান দিচ্ছিল। বিলে যতক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণ গ্রামবাসীরা বুক পানিতে নেমে হাত নেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দিত করছিল। রায়পাড়া পৌছালে ডা. আওয়াল বে-ড দিয়ে কেটে মুক্তিযোদ্ধা মান্নান এর পিঠের ভিতর থেকে বন্দুকের কয়েকটি গুলি বের করেন। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের অসতর্কতার কারণে একজন আহত হওয়া ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো ক্ষতি হয়নি। অর্জিত হয়েছিল অনেক। ৩০৩ রাইফেল পাওয়া গিয়েছিল সম্ভবত ২৮টি, গুলি কয়েক বাক্স এবং দশ বা পনের হাজার টাকা। এ সময় হাই কমান্ডের নিকট ৩০৩ রাইফেল এবং গুলির মূল্য ছিল সীমাহীন। কারণ চাওরদিকে শত শত মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে বসে বসে হতাশার মধ্যে দিন গুনছিল। কেউ কেউ আস্থা হারিয়ে সীমান্তের দিকে চলে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন হালিম যতই বলছিলেন যে, গেরিলা যুদ্ধে অস্ত্রের অভাব হয় না। জনসাধারণ পক্ষে থাকলে শক্রর অস্ত্র দিয়ে শক্রকে খতম করা যায়, তাতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। ঠিক তখন সম্পূর্ণ নতুন ঝকঝকে ২৮টি ৩০৩ রাইফেল এবং কয়েক বক্স গুলি যেন হাতের মুঠোয় আকাশের চাঁদ ধরার চেয়েও রোমাঞ্চকর। অভিযানের সাফল্যে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ জনগণও দারুনভাবে উৎসাহিত হন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত