You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.27 | ধালাই অপারেশন, সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

ধালাই অপারেশন, সিলেট

ধালাই সিলেট জেলার একটি অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধালাই রণাঙ্গন প্রখ্যাত ছিল। এই অপারেশনটি চালাবার জন্য প্রথম রেজিমেন্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। যদিও এটি ছিল পাকবাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি তথাপি প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব (শহীদ) তার কোম্পানী নিয়ে একবার শক্রর উপর আঘাত হানেন। কিন্তু স্বপক্ষের বেশ কিছু আহত সৈনিক নিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয়। এদের মধ্যে যারা মারাত্মকভাবে আহত হন তাঁদের মধ্যে দু’জন হচ্ছেন সুবেদার ইব্রাহীম এবং অন্যজন হচ্ছেন রকেট লঞ্চার-এর নাম্বার ওয়ান হাওলাদার সোবহান। এদের দু’জনকেই ঘটনাস্থল থেকে হেলিকপ্টারযোগে মুক্তিবাহিনীর বেইস হসপিটালে পাঠান হয়। এরপর ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী সফলতার সঙ্গে খেজুরীরে টারগেটকে দখল করার পর তদানীন্তন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ধালাই দখল করার ভার কাইয়ুম এর উপর ন্যস্ত হয়। যদিও এই রণাঙ্গন ছিল দুর্ভেদ্য তবুও দৃড়তার সাথে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এর দায়িত্ব দেন। এই প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন ঠাট্টা করে কাইয়ুমকে বএলছিলেন, ‘তোমরা নতুন যে প্যান্টটা তৈরি করেছ তা অন্তত একবার পড়ে নাও। নতুবা মরে গেলও হয়ত দুঃখ থেকে যাবে।
১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর রণাঙ্গনের দামামা বেজে ওঠে। যেহেতু পুরা ব্যাটালিয়ন এতে অংশ গ্রহণ করেছিল সেহেতু পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘এ’ ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী ২৭ অক্টোবর রণাঙ্গনের দিকে যাত্রা করে। তাদের দায়িত্ব ছিল পিছন থেকে যাতে সৈন্য এবং রসদ সরঞ্জামাদি পরিবহন করতে না পারে তা নিশ্চিন্ত করা। ধালাই এলাকার বেশ এক অংশ জুড়ে পাকিস্তানি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল। এমনকি প্রত্যেকটি বাংকার কংক্রিটে নির্মাণ নির্মাণ করা হয়েছিল। বাংকারগুলো এমন ধরনের ছিল যে, এর ভেতর থেকে বাইরে বেরুনের বড় প্রয়োজন খুব একটা হত না। কারণ, রসদ সরঞ্জামাদি প্রচুর পরিমানে মওজুদ থাকত। রণকৌশলের দিক থেকে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল কাইয়ুমের পরিকল্পনা। সেদিক থেকে বিচার করে ২৮ অক্টোবর সকাল ৪টার সময় কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হন। ক্যাপ্টেন এক নম্বর প্ল্যাটুন নিয়ে বাম দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকেন। টারগেট থেকে যখন তারা ৫০ গজ দূরে ছিলেন তখন আক্রমণ চালান। তখন শুধু বুলেটের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। শক্র প্রত্যক্ষভাবে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অবশেষে শক্রর অধিকাংশ শক্তি নিয়ে কাইয়ুমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম আর অগ্রসর হতে পারছিলেন না। তিনি ডান দিকের বেশ একটা অংশ দখল করে শক্রর নাকের ডগার উপর বসে যান। কাইয়ুমের বেশ কিছু সংখ্যক সেনা হতাহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ট শহীদ হামিদুর রহমান। এই যুদ্ধে আরও দু’জন জোয়ান তাঁদের দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তাদের একজন হলেন হাওলাদার মকবুল হোসেন ও অপরজন সিপাহী আবদুর রহমান, যিনি মূলে পুলিশবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তুমুল যুদ্ধের পর ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান সাহেব কাইয়ুম যেখানে ছিলেন সেখানে থাকতে নির্দেশ দেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘এ’ ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানির যারা পাত্রখোলা চা বাগানের মধ্যে তাঁদের আধিপত্য কায়েম করেছিলেন তাদের উপর বেশ কয়েকটি আক্রমণ চলে। কিন্তু আক্রমণের ফলে যথেষ্ট হতাহতের পর শক্র পিছু হটতে বাধ্য হয়। যেহেতু এই স্থানটা দখল করা ছিল একান্ত প্রয়োজন সেহেতু বড় ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। ২৯ অক্টোবর সকাল ৫টার সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়ান কাইয়ুমের নেতৃত্বাধীন কোম্পানীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে কিন্তু সেখানেও মুক্তিযোদ্ধারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। পর্যায়ক্রমে এক ব্রিগেড ভারতীয় সোইন্য এক ডিভিশন আর্টিলারী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ গ্রহণ করে। এভাবে একটাকা পাঁচদিন যুদ্ধের পর শক্রপক্ষ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধে ভারতীয় ব্রিগেড কমান্ডার এবং দ্বিতীয় জাঠ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার আহত হন। এই যুদ্ধে শক্রপক্ষ যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দেয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনবরত পাঁচদিন যুদ্ধের পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাদের মধ্যে অবশ্য প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাকী সৈন্যদের মধ্যে অনেক ধরা পড়ে এবং অনেকে পালিয়ে যায়। পরাজয়ের একমাত্র কারণ ছিল শক্রর লাইন অব কমনিকেশন চতুর্দিক থেকে কেটে দেওয়া হয়। তাই সম্মুখ সমরে তারা সুবিধা করতে পারেনি। এই যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা পুরোপুরি নির্ণয় কর সম্ভব হয়নি। তবুও বলা চলে শক্রবাহিনীর নিহতেতর চেয়ে আহতই বেশি হয়েছে। অন্যদিকে, শক্রর নিহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ধলাই যুদ্ধ পরাজয়ের পর সিলেটে শক্রবাহিনী অনেক ছুটাছুটি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, যে ক’টি বিখ্যাত ঘাঁটি ছিল তার মধ্যে ধলাই ছিল অন্যতম। এখান থেকেই প্রায় ৫০ মাইল এলাকাতে নিয়ন্ত্রণে রাখা হত।
১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটে সমস্ত শক্রর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল করার জন্য ভিতর দিয়ে এডভান্স টু কন্ট্রাক চালাবার জন্য পরিকল্পনা করা হয়। ২০ নভেম্বর ঈদের নামাজের পর ভারতের সীমানা অতিক্রম করে বালা গ্রামের পিছনে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম অবস্থান করেন। সমস্ত এলাকা দেখার পড়ে রাত আটটার সময় পুরা ব্যাটালিয়ন নিয়ে কাইয়ুম কয়েকটি টারগেটের দিক অগ্রসর হন। উল্লেখযোগ্য বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বেশ কয়েকটি টারগেট এখানে ছিল। এদের মধ্যে যেগুলোতে সৈন্য সংখ্যা বেশি ছিল সেগুলোর মধ্যে আটগ্রাম, চারগ্রাম ও বালা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট কতকগুলো শক্রছাউনি থাকাতে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া বেশ দুষ্কর ছিল। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরেই চারদিক থেকে ছোট ছোট অস্ত্রের গোলাগুলি আসতে থাকে ফলে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ও তার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের কিছুক্ষণের জন্য অবস্থান নিতে হয়। পুরো ট্রাসকে পিছনে রেখে কোম্পানী কমান্ডারকে তার দল নিয়ে রেকি করতে হত। তারপর আবার পথ চলতে হত। এভাবে রাত প্রায় দুটোর সময় ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ‘সি’ কোম্পানীকে নিয়ে বালায় অবস্থিত টারগেট থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে ডিফেন্স নেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ৪৫ গুর্খাবাহিনীও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশগ্রহণ করেছিল। ৪৫ গুরখাবাহিনীর সাথে ছিল ‘ডি’ কোম্পানী। তাদের দায়িত্ব ছিল আটগ্রামের শক্রঘাঁটি দখল করা। ‘বি’ কোম্পানীর দায়িত্ব ছিল চারগ্রামের শক্রঘাঁটি দখল করা। সব কোম্পানী নিজের দায়িত্ব পালন করার জন্য সুবিধামতো টারগেটের নিকটবর্তী কোন জায়গায় হাইড-আউট করেছিল। শক্র বাংকারগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত থাকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নড়াচড়া একটু সাবধানেই করতে হত। কাইয়ুমের কোম্পানীর এই চ আওতায় ছিল সকাল ৬টা সুতরাং এইচ আওয়ারের পাঁচ মিনিট আগে গোলান্দাজ বাহিনীকে ডাকা হয়-যাকে বলা হয় প্রি আওয়ার গোলাবর্ষণ। ৫ মিনিট নর্মাল ফায়ার। এরপর গোলান্দাজ চুপ হয়ে যায়। তার সাথে সাথে বালা, চারগ্রাম ও আটগ্রাম এর উপর বঙ্গশার্দূল ও গুর্খারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আধ ঘন্টার বেশি সময় তুমুল গোলাগুলির পর তিনটি শক্রঘাঁটি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এদের মধ্যে শক্রর সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় আটগ্রামে। এটা শক্রর ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার এবং দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল। শক্ররা সহজে আত্মসমর্পণ করে এবং কিছু এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়। আটগ্রামে শক্রর হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০ জন। এর মধ্যে ৪ জন অফিসার ছিলেন। যথেষ্ট গোলাবারুদ ক্যাপ্টেন কাইয়ুম কোম্পানির হস্তগত হয়। অন্যদিকে কাইয়ুম কোম্পানির হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩ জন অফিসারসহ ৫০ জন সৈন্য। বালাও মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। চারগ্রামে অবশ্য শক্র যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ আশংকা বুঝতে পেরে তারা পশ্চাদপরণ করে এবং কোন প্রকার ক্ষ্যক্ষতি ছাড়াই মুক্তিবাহিনী চারগ্রাম দখল করে।
বালা দখল করার পর কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে করমিগঞ্জের দিকে রওয়ানা দেন। করিমগঞ্জে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কমান্ডর ছিলেন মেজর এ যে আমিনুল হক।
এরপর করিমগঞ্জ থেকে কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে বৈরামপুর রওয়ানা হন এবং বৈরামপুর দখল করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বৈরামপুর যাবার পথে পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর এমবুশ করে। ফলে মুক্তিবাহিনীর দু’জন যোদ্ধা শহীদ হন। দু’জন নিখোঁজ হন এবং ৬ জন গুরুতর আহত হন। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট লিয়াকত গুরুতররূপে আহত হন। তিনি আহত হবার পর ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ‘সি’ কোম্পানীর ক্যাপ্টেন নূরকে স্থানান্তর করে ‘সি’ কোম্পানীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বৈরামপুর ছিল করিমগঞ্জ থেকে ৩০/৪০ মাইল দূরে। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মাহবুব আর্টিলারী শেলিং করেন। পাকসেনারা আর্টিলারী শেলিং কর আথেকে বিরত ছিল না। আর্টিলারী শেলিং-এর এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন। শেলিং-এর টুকরা তার শরীরে আঘাত করে। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে সরিয়ে নেয়া হয়। কিছুক্ষণ পড়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং শহীদ হন। তার সিগনালরাও শহীদ হন এবং রানার আহত হন। এই তিনজন মুক্তিসেনার নাম অবস্মরনীয় হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে এ আশা আমরা করি। পরদিন সকালে ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট কাইয়ুমের কোম্পানী আক্রমণ করে। কিন্তু এ আক্রমণে তারা ব্যর্থ হয় এবং তিনজন অফিসার ও তিনজন সুবেদার নিহত হয়। ১২ জন পাঞ্জাবী মুক্তিসেনাদের হাতে বন্দি হয়।
এর পরদিন সকালে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে বৈরামপুর থেকে শহীদপুরের দিকে যাত্রা করেন এবং এখানেও যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নয়জন হতাহত হয়। তারপর কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে কচুয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং ডিফেন্স নেন। ইপিআর বাহিনী ইতিপূর্বেই কানাই ঘাট দখল করেছিল। কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
রণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কোন দূরদর্শী সেনাবাহিনীই তার শক্রকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না। কারণ পিছনের আক্রমণ প্রতিহত করা অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। সেই জন্য ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে শক্রঘাঁটির মধ্যে নিয়ে এডভান্স উ কন্টাকট শুরু করেন। কানাইঘাট থেকে বিকেলে ৫টার সময় কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে সিলেট এম সি কলেজ অভিমুখে যাত্রা করেন। কারণ তিনি জানতেন এম্ সি কলেজকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিরাট একটি দুর্গে পরিণত করেছিল। সেই দুর্গকে অবরোধ করে দখল করার লক্ষে কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে অগ্রসর হন। পরদিন বিকেল ৬টার সময় কাইয়ুম তার কোম্পানীকে নিয়ে কেওয়াচরা চা বাগানে ডিফেন্স স্থাপন করেন। রাত্রিবেলা পেট্রোল পার্টি পাঠাল খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের পাঠানো পেট্রোল পার্টি শক্রর এম্ববুশে পড়ে এবং একজন নিখোঁজ হন। শক্রর অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর পাওয়ার পর সকাল বেলায় ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। কিন্তু শক্র দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কতক্ষণ ডিফেন্সে থাকেন। এই দু’ঘন্টার মধ্যেই অন্যান্য কোম্পানীও কাইয়ুমের কোম্পানীর বাম দিকে গিয়ে অবস্থান নেয়। কাইয়ুম তার কোম্পানীকে ফর্ম আপ করে শক্রর উপরে চার্জ করেন। ফলে একজন শহিদ এবং কয়েকজন আহত হন। শক্র পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং কয়েকজন আহত হন। তাঁদের পক্ষেও যথেষ্ট হতাহত হয়। সেদিন সেখানেই অবস্থান করার পর সন্ধ্যায় কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে এম সি কলেজ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। পরদিন সকাল ৪টার সময় এম সি কলেজের টিলার উপরে এসে তারা শক্রর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন। শক্র ক্যাপ্টেন কাইয়ুম কোম্পানীর গতিবিধি সম্বন্ধে একটুও সজাগ ছিল না। সুতরাং তারা ডিফেন্সের ভিতর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। কাইয়ুম ও তার কোম্পানী এর ফাঁক দিয়ে পজিশন নেয়ার বন্দোবস্ত করছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট পাঞ্জাবী সৈন্য একসঙ্গে দেখাতে কাইয়ুম ও তার কোম্পানী ৬টা মেশিনগান দ্বারা তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করলেন। শক্রর মাথায় যেন বজ্র ভেঙ্গে পড়ল। তারা পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিল। এর ভিতরই বেশ কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য নিহত হয়। কিছু সৈন্য হাত তুলে সারেন্ডার করে। আর্টিলারী রেজিমেন্ট তাঁদের অস্ত্র নিয়ে তাড়াহুড়া করে স্মল আর্মসরেঞ্জের বাইরে চলে যায়। শক্রপক্ষের বেশ কিছু হতাহতের পর তারা ক্যাপ্টেন কাইয়ুম ও তার কোম্পানীর অবস্থান থেকে আরও উঁচু টিলা দখল করে। তাঁদের সমস্ত শক্তি তারা নিয়োগ করে। এরপর মুক্তিবাহিনীর ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানীর উপরে কয়েকটা মেহসিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আর্টিলারী ফায়ারও চলতে থাকে। পড়ে ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানীর যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়। তাঁদের একজন প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার ফয়েজসহ বেশ কিছু লোক নিহত হয়। যারা আহত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে পিছনে নিয়ে যায়। এভাবে আরও কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর ‘বি’ এবং ‘ডি’ কোম্পানী একটু আড়ালে গিয়ে অবস্থান করে। তারপর ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এগুতে দেননি। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর দু’জন লোক আহত।
১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর এগারোটা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলতে থাকে। এবং আর্টিলারি সমর্থনে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের বাহিনী কিছু দূর এগুতে সমর্থ হন। তারপরই আসে আত্মসমর্পণের পালা। পাকবাহিনী তাদের সমস্ত হাতিয়ার ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এর উপর ‘বি’ ও ‘ডি’ কোম্পানীর দায়িত্ব অর্পিত হয়। তিনি শক্রকে আর এক পাও সম্মুখে এগুতে দেননি। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর দু’জন লোক আহত হয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন যুদ্ধ পরিচালনা করা বাঙালি ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেখানে ছিল না বল, জন, অস্ত্রশস্ত্র। পুরো জাতিই মুক্তিবাহিনীর রূপ ধারণ করে। বাঙালি যে যেখানেই ছিল কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া বাকী সবাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।
[৫৫] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত