You dont have javascript enabled! Please enable it! ধলনগর-করিমপুরের যুদ্ধ, কুমারখালী - সংগ্রামের নোটবুক

ধলনগর-করিমপুরের যুদ্ধ, কুমারখালী

ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই পাকবাহিনী চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কুষ্টিয়া জেলার সকল রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটে। কুষ্টিয়ার পার্শ্ববর্তী শৈলকূপা থানা ও কুষ্টিয়ার খোকশা থানার পতন ঘটে এ মাসের প্রথমেই। মরিয়া হয়ে পাকিস্তানীবাহিনী তাঁদের অবস্থান পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়। ফলে কুমারখালীর ধলনগরে সংঘটিত হয় থানার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে কোনরূপে যোগাযোগ ছাড়াই কুমারখালী থানার এফএফ ও বিএলএফ দীর্ঘ সময়ের এ যুদ্ধে পাকসেনাদের কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।
এটা কাঁঠাল বাগান হাটের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। বিত্তিপাড়া কুটি (সদর থানা)তে আর্মি ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে তারা সহযোগী রাজাকারদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কোনো অপারেশনে যেত অথবা সদলবলে টহল দিতে আসত। এ সময়ে তারা দু’পাশের ফসলের মাঠ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত এবং নিরীহ লোকদের হত্যা করত। আর এদের সহযোগী রাজাকারেরা তাঁদের উপস্থিতিতে ব্যাপক লুটতরাজ করৎ এবং মেয়েদের ধরে দিত। তাই মুক্তিযোদ্ধারা এদের গতিপথে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া বা আর্মিদের পিছু হটে যেতে বাধ্য করত।
মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকূপা থানার বালিঘাট, জাঙ্গালিয়া এবং আরও কিছু গ্রামে অবস্থান করছিল। তারা পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে (রেকি করে) সংবাদের মাধ্যমে কালী নদিড় দুইপাড়ে কৌশলগতভাবে অবস্থান নেয়। নদীর পশ্চিমে করিমপুর, মৃত্তিকাপাড়া-কুষ্টিয়া সদর থানার এই অংশে অবস্থান গ্রহণ করে বদরুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ জাপান, মোকাদ্দেস হোসেন, আব্দুল হামিদ প্রভৃতি কমান্ডারগণ ও তাদের দল। এদিকে নদীর পূর্বপাড়ে কুমারখালী থানার ধলনগর, প্রতাপপুর ও কাঁঠাল বাগান হাটের মধ্যে পজিশন নেয় জাহিদ হোসেন জাফর, শামসুজ্জোহা, আঃ মাসুদ ফুল, জাফরুল ইসলাম জাফরি, মীর শহিদুল হক আন্টু প্রভৃতি কমান্ডারগণ ও তাঁদের বাহিনী। সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন কুমারখালী থানা মুজিববাহিনীর সহযোগী কমান্ডার জাহিদ হোসেন জাফর।
বিত্তিপাড়া ও কুষ্টিয়া থেকে পাকিস্তানীবাহিনী ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পান্টির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। উজান গ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও পিস কমিটির সভাপতি করিমপুরের আফতাব মুন্সী ও তার রাজাকার বাহিনী অতি উৎসাহের সঙ্গে পাকিস্তানীবাহিনীকে সহায়তা করতে থাকে। তাদের পরিবহনগুলি যেইমাত্র সেতুর উপরে (নদীর মাঝে শক্ত কাঠ দিয়ে গাড়ি চলাচলের মতো মজবুত সেতু ছিল) উঠে সঙ্গে সঙ্গে দুইপাড় থেকে ব্যাপক আক্রমণের মুখোমুখি হয়। তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলোও গর্জে উঠে। কিন্তু নদীর দুইধারে ঘনঝোপ, বাঁশবাগান আর শীতের শুকনো নদীর মধ্যে মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলেদের “অ্যাম্ববুশের” মধ্যে সেগুলো তাদের কোনো কাজই দিল না। তারা অনেক সময় ধরে চেষ্টা করল কোনোক্রমে আগানো যায় কিনা। কিন্ত দুই দিক থেকে যুগপৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে তারা ক্রমে ক্রমে পিছু হটতে লাগলো। কমান্ডারদের কাছে শুধুমাত্র একটি খ.গ.এ. কয়েকটি ঝ.খ.জ. আর ৩০৩ দিয়ে এই তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বসেরা সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করতে থাকে প্রায় ৫ ঘন্টা (৮/৮.৩০-১.৩০/২টা)। ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসের মধ্য থেকে পাকিস্তানীবাহিনী তাদের সহযোগী যোদ্ধাদের লাশ ও আহতদের নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকে। পশ্চিম পাড়ের নূর মোহাম্মদ জাপান ও তার দল তাদেরকে ফিরে যেতে না দেওয়ার অঙ্গীকার করে এবং আরও অগ্রসর হয়। এমতাবস্থায় কিছু রাজাকার পালিয়ে যাবার সুযোগ খোঁজে এবং ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি দিতে থাকলে কমান্ডার মনে করে যে অন্য গ্রুপও এসে গেছে। ফলে তিনি গুলি বন্দগ করে সামনে যান এবং তার দল খুব কাছ থেকে একঝাঁক গুলি বৃষ্টির মাঝে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই দূর্বাচারার শহীদুল ইসলাম বাবু শহীদ হন এবং নূর মোহাম্মদ জাপান, মাসিরউদ্দিন মৃধা (মিলপাড়া) গুরুতর আহত হন। রাজাকাররা এই সুযোগে পালিয়ে যায়। শহীদ বাবুর ভাই সবু ধরা পড়ে। এপাড়েও বাহ্নীর সদস্যরা খুবই সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে থ্যাকে। পাকিস্তানী আর্মিরা তখন এলোপাতাড়ি গুলি চালাচ্ছে। তাদেরই একটা গুলি বাহিনীর সবার সামনের যোদ্ধা অসম সাহসী বীর মহব্বত হোসেন খেড়োর মাথায় লাগে এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হন। উল্লেখ্য, এই বীর সন্তানের সম্বল ছিল একমাত্র ৩০৩ রাইফেল। এপাড়ে আরো আহত হন আবুল কালাম আজাদ (পান্টি) জয়নাল আবেদীন (পাণ্টি)। এই যুদ্ধে প্রায় ১০০ জনের মতো পাকিস্তানী আর্মি ও তাদের সহযোগীরা ছিল যাদের বেশিরভাগই আহত ও নিহত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।
উল্লেখ্য, ধলনগর গ্রামের নদীর পাড়ে যে স্থানে মহব্বত হোসেন খেড়ো শহীদ হন সে জায়গায় ওই গ্রামের কোনো এক মা ঐদিনেই একটা বটের চারা রোপণ করেন। যা আজ বিশাল মহীরুহ হিসেবে তাঁর মহান আত্মত্যাগের ও দেশমাতৃকার গভীর ভালোবাসার কথা সগর্বে তুলে ধরছে।
[১২] এ.টি.এম. যায়েদ হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত