টোকাপাড়ার যুদ্ধ, পঞ্চগড়
চাউলহাটি বিএসেফ ক্যাম্প থেকে পূর্বদিকে একটি পাকা সড়ক অমরখানা ও জগদলহাট শক্রু ঘাঁটি হয়ে পঞ্চগড় পাকিস্তানী গ্যারিসন পর্যন্ত বিস্তৃত। অপরদিকে গড়ালবাড়ি বিএসএফ ক্যাম্প থেকে একটি পাকা সড়ক পূর্ব দিকে টোকাপাড়া পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। এই টোকাপাড়াতেই মুক্তিবাহিনী একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। টোকাপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের চতুর্থ দিন পিন্টু, গাউস ও আহিদার পরবর্তী পরিকল্পনার জন্য বৈঠকে বসে। ভাটপাড়ায় শক্রুর একটি ক্যাম্প ছিল। নানা বিপর্যয়ের মুখে তাঁরা ক্যাম্পটি গুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়ার আগেই মুক্তিযোদ্ধা মালেককে তথ্য সংগ্রহের জন্য পঞ্চগড় শহরে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য, তালমা ব্রিজ থেকে শুরু করে পুরো পঞ্চগড় শহর এলাকায় শক্রুর বিভিন্ন অবস্থানের নিখুঁত একটা চিত্র নিয়ে আসে। সময় এবং সুযোগমত মালেক একদিন তালমা ব্রিজ পার হয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে পঞ্চগড় শহরে গিয়ে পৌছে। বন্ধু পারভেজের আত্মীয়ের বাসায় থেকে সবকিছু ঘুরে ফিরে দেখে। শক্রুর সমরশক্তি আর অবস্থানগুলোর একটা ছবি মনের মানচিত্রে এঁকে নিয়ে চাওরদিনের মাথায় ফিরে আসে এবং টোকাপাড়ায় এসে রিপোর্ট করে। পঞ্চগড় থেকে সংবাদ নিয়ে আসে যে শক্র শিগগিরই টোকাপাড়া আক্রমণ করবে। পঞ্চগড়ে পাকিস্তানী অবস্থানগুলোর বর্ণনা দেয়। সহযোদ্ধাদের ধারণা এটা একটা গুজব। কিন্তু ১২ জুলাই বেলা ১টার দিকে হঠাৎ করে ভেতরগড় এলাকা থেকে শোরগোল ভেসে আসে। ক্যাম্পের ছেলেদের জন্য তখন মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন চলছে। ক্যাম্পের একেবারে সামনেই শক্রর দুটো মর্টারের শেক সশব্দে বিস্ফোরিত হয়। সেই সাথে বাড়তে থাকে আর্টিলারির সিক্স ডাউন্ডারের শেলিং। একটার পর একটা শেলিং বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা আখতার-একরামুলের গ্রুপটি পাঠক্ষেত পার হয়ে একটা জুতসই জায়গায় তাদের অবস্থান নেন। এদিকে পাকিস্তানীরা প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু করে বিরামহীনভাবে। তাদের মাথার অপর দিয়ে ভীতিকর শব্দ তুলে শেলের ঝাঁক ছুটে যেতে থাকে টোকাপাড়ার দিকে। মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে গিয়েই অগ্রসরমান শক্রর দিকে তাদের রাইফেল তাক করে গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। কিন্তু কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ার পরপরই ওরা নিশ্চিত টার্গেট হয়ে যায় শক্রর। তখন শত সহস্র গুলির ঝাঁক আসতে থাকে তাদের পজিশন লক্ষ্য করে। গোলাম গাউস অপেক্ষা করতে থাকেন। পাকিস্তানীরা প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারটা সে দেখতে পায়। কিন্তু অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা জেদ পেয়ে বসে ওকে। যে করেই হোক, একার শক্তিতেই সে এখানে শক্রর গতিরোধ করবে। ধীরে ধীরে সে তার কোমরে গুঁজে রাখা গ্রেনেড দুটো বের করে হাতের কাছে রাখে। স্টেনগানটা উঁচু মাটির ঢালে রেখে লক্ষ্য স্থির করে বুকের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে থাকে। পাকিস্তানীরা ততক্ষণে ফায়ার ওপেন করে দিয়েছে। অবিরাম শেল পড়ছে টোকাপাড়ার আশেপাশে। সম্মুখের রাস্তা দিয়েই আসছে শক্রর মূল কলাম। স্থির, নিষ্কম্প মনে গাউস তার স্টেনগানের ট্রিগারে আঙুল রেখে প্রতীক্ষারত। তার স্টেনগানে গুলি রয়েছে এক ম্যাগাজিন অর্থাৎ মাত্র ত্রিশটি। একটা পুরো বাস্ট্রেই তা শেষ হয়ে যাবে। গ্রেনেড রয়েছে তিনটি। দুটো তার কাছে। একটা পারভেজের কাছে। শক্রর তরফ থেকে ফায়ার ওপেন হওয়ার পর থেকেই পারভেজ তাগিদ দিচ্ছিল পালানোর জন্য। কিন্তু গোলাম গাউস সে কথায় কর্ণপাত না করে অমিত সাহসে বসে থাকে শক্রর জন্য। পারভেজ পেছনে ঝোপের ভেতর দিয়ে একটা পানিভর্তি খালে নেমে পড়ে। গোলাম গাউস তখন তার স্টেনগান আর দুটো গ্রেনেড নিয়ে একা। অবশেষে নিকটবর্তী হয় শক্র। গোলাম গাউস স্পষ্ট তাদের দেখতে পায়। স্টেনগানের ট্রিগারে চাপ দিল দুবারের ব্রাশেই ম্যাগাজিন শূন্য। একেবারে সামনে থেকে এভাবে আচমকা গুলি আসায় হতচকিত হয়ে পড়ল আগুয়ান শক্ররা। তাৎক্ষণিকভাবে মাটিতে বুক লাগিয়ে পজিশনে গিয়ে মাথায় হেলমেটকে ঢাল হিসেবে রেখে ওরা বুকে হেঁটে (ক্রলিং করে) এগোতে লাগল। ওদের একজন ধরাশয়ী হয়েছে বলে গোলাম গাউসের অবস্থানের দিকে ঝাঁক ঝাঁক গুলিবর্ষণ করতে করতে এগোতে লাগল শক্ররা। গাউস মাথা তুলতে পারছিল না। কিন্তু সেই অবস্থাতেই দাঁত দিয়ে একটা গ্রেনেডের পিন খুলে নিয়ে সেটা সে সম্মুখের শক্রর সারির মধ্যে ছুঁড়ে মারল। এবার ধরাশায়ী হলো দুজন। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রেনেডটা ছোড়ার আগেই শক্রর গুলি এসে ডান বাহুতে লাগল। সোজা ঘাড়ের কাছে সে গুলিবিদ্ধ হয়। হাত তুলতে পারল না সে। গ্রেনেডটা গড়িয়ে পড়ে হাত থেকে। প্রচণ্ড ব্যাথায় সারা শরীর কুঁকড়ে উঠে। এর মধ্যেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এক ঝাঁক গুলি এসে তখন ঝাঁঝরা করে দিয়েছে তার বুক। পড়ে যায় গোলাম গাউস। দ্রুততার সাথে আয়সোল্ট ভঙ্গিতে ওর কাছে চলে এসেছে ওরা। ওদের মধ্যে থেকে একজন ওকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করল। আর অন্য একজন সে অবস্থাতেই তার পেটে বেয়নেট চার্জ করে কয়েকবার। ততক্ষণে মোতালেবের চোখে তার ক্যাম্পের বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানীদের অগ্রসর হওয়ার দৃশ্য পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হেলমেট পরা মাথা সামনে রেখে এগিয়ে আসছে ওরা। দেরি না করে ফায়ার ওপেন করল মোতালেব। একজনকে গড়িয়ে পড়তে দেখল সে। তবু তাঁরা ক্ষান্ত হলো না। এগিয়ে আসছে। বাঁদিকের তিন নম্বর কলামটাও তখন প্রায় ক্যাম্পের একশ গজের মধ্যে পৌঁছে গেছে। পিন্টু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পেছনে চলে যাবে। ক্যাম্পের সবাইকে সে পেছন দিকের পথ ধরে ঝোপঝাড়, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কাহ্লে নেমে ওপারে যেতে নির্দেশ দেয়। মোতালেব চরম ধৈর্য আর অদম্য সাহস নিয়ে তখনো একটার পর একটা শক্র টার্গেট করার চেষ্টা করতে থাকে। ক্রমশ অবস্থা খারাপ হয়ে উঠতে তাহকে। ওদের অবস্থান থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজের মধ্যে শক্রুরা। এক বারস্ট্রে ম্যাগাজিন শেষ করে মোতালেব তার এলএমজি হাতে বাঙ্কার ত্যাগ করে। শক্র মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে যায় এবং ক্যাম্প দখল করে ফেলে। ওরা প্রতিটা বাঙ্কার চার্জ করে। ঝোপের আড়ালে ঠিক ক্যাম্পের ঢালে ডোবার পানির মধ্যে নিজেদের নিশ্চল করে রাখে পিন্টু আর মোতালেব। আর এভাবেই টোকাপাড়া ক্যাম্প চার দিনের মাথায় শক্রর দখলে চলে যায়। গোলাবারুদসহ সব কিছু চলে গেল শক্রর কবলে। ক্যাম্পের তাঁবুসহ সবকিছুতেই ধরিয়ে দেয় আগুন। তন্ন তন্ন করে মুক্তিবাহিনীকে খুঁজতে থাকে। ঘন্টাখানেক ধরে এই অভিযান চলার পর তারা ফিরে চলে যায়। বিকেল বেলায় দূর থেকে মানুষজন তাদের ফিরে যাওয়া দেখতে পায়। শক্রদের তাদের তিনজন আহত কিংবা নিহত সহযোদ্ধাকে বহন করে নিয়ে যেতে দেখা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদেরও কয়েকজনকে হতাহত হতে দেখা যায়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ সপ্তম খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত