জুনাহারের যুদ্ধ, বরিশাল
২৪ এপ্রিল ফরিদপুর পতনের সংবাদ বরিশাল পৌছে। যেকোনো মুহূর্তে পাকবাহিনীর আক্রমণ করতে পারে। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী জলে, স্থলে, আকাশ পথে বরিশালের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। বরিশালের বীর জনতা তাদের হালকা অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জন্য প্রস্তুত ছিল। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। তাই তারা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে বরিশালে আক্রমণ চালায়। ২৫ এপ্রিল ১১-৪৫ মিনিটে পাকিস্তানী নৌবাহিনী জুনাহার আক্রমণ করে জুনাহার পূর্বে বড় খাল ছিল। বর্তমানে জুনাহার নদী। সায়েস্তাবাদ নদী হতে জুনাহার হতে কীর্তনখোলা নদীতে যেতে হয়। জুনাহারের পশ্চিমে সায়েস্তাবাদ এবং পূর্ব দিকে চরমোনাই ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন ও তালতলী। জুনাহারের পূর্ব পারে হবিনগর, পশ্চিম পাড়ে রাজাপুর এবং দক্ষিণ পাড়ে কোটকার চরলে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে। জুনাহার নদীর দু’পারে ইরানী ও মাজভী ষ্টীমার। একদল মুক্তিযোদ্ধা হবিনগরে ওয়াজেদ হাওলাদারের বাড়ি, একদল তালতলীর নিকট নাজির বাড়ির স্কুল এবং একদল বেলতলায় ছিল। লেঃ ইমাম আলী মেহেদী, লেঃ নাসির, ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহাম্মদ ফজলুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেছেন। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। তিনি তালতলী অবস্থান করছিলেন। প্রথমে গানবোট হতে সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হাবিবনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পালটা আক্রমণ চালায়। গানবোট ঘায়েল করার জণ্য তাদের কোন অস্ত্র ছিলনা। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলার আঘাতে ষ্টীমার ইরানী ও মাজভী ডুবে যায়। আজও ষ্টীমার দু’টো জুনাহারের দু’ পাড়ে ডুবে আছে। নৌবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেকে নিহত ও আহত হয়। জুনাহারে ইছাকাটির আব্দুল মোতালেব আকন্দ, গৌরনদী থানার স্যারালের সিপাহী ইসলাম প্রমুখ সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের বিপক্ষে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর জুনাহারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির পতন হয়। মুক্তিবাহিনী জুনাহার ত্যাগ করার পরও নৌবাহিনী জুনাহার অতিক্রম করার সাহস পায়নি। ২৬ এপ্রিল ভোরে তারা বরিশাল আই ডব্লিউ টি ঘাটে পৌঁছে। ২৫ এপ্রিল বেলা একটার সময় দু’টি হেলিকপ্টারে ছত্রী সেনারা চরবাড়িয়া বোর্ড স্কুলের উত্তর পাশে অবতরণ করে এবং নাজির বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। আর একটি দল চরবাড়িয়া ইউনিয়নের কাগাশুরা, মতাশয়, উলান গুণি, পুরাণপাড়া হয়ে শহ্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঠিক এমনি সময় নূরুল ইসলাম মঞ্জুর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তালতলী ছিলেন। কিছু দূরে পাকসেনাদের দেখতে পান এবং অতিদ্রুত শহরের দিকে চলে যান। জুনাহার পতনের পর নাজির বাড়ি, বেলতলা, সায়েস্তাবাদ ও শহর হতে মুক্তিযোদ্ধারা পিছনে চলে যায়। তাদের হাতে ভারী অস্ত্র না থাকায় সম্মুখ যুদ্ধ সম্ভব ছিল না। চরবাড়িয়া বোর্ড স্কুল হতে পাকসেনারা ক্রলিং করে নাজির বাড়ির দিকে যাচ্ছে। গ্রামের লোক ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেয়। সামনে পাকবাহিনী যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। ট্রেঞ্চের ভিতরে ছিল চরবাড়িয়ার জাফর হাওলাদার এবং কোলে ছিল এক বছরের ছেলে। পাকসেনারা গুলি করে সেই শিশুটিকে হত্যা করে। আতঙ্কে সকলে আল্লহর নাম নিয়ে উপরে উঠে আসলে অনককে হত্যা করে। নাজির বাড়ির আবদুল বারেক তহশীলদার দৌড় দিলে পাকবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। ইতিমধ্যে মহারাজের কয়েকজন লোক বাঁচার জন্য পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে পাকবাহিনীকে অভ্যর্থনা জানান। তালতলী হতে পাকবাহিনী দু’টি পথে শহরের দিকে অগ্রসর হয় এবং পথে ১০০০ লোক হত্যা করে। তাদের গুলির আঘাতে প্রাণ দেয় চরবাড়িয়ার শামসুল হক হাওলাদার, জালাল উদ্দীন হাওলাদার, আবদুল ওহাব, লালবরু, বিল্লবাড়ির রকমান মুন্সী, উলানঘুণির আতাহার আলী হাওলাদার, সুলতান আহমেদ, দিয়াপাড়ার মোতাহার আলী সিকদার, সারসী গ্রামের ৮ বছরের রোকেয়া, লাখুটিয়ার ৫ বছরের হোসেন আলী, চরবাড়িয়ার ৮ মাসের জাকির হোসেন পলান ও আরও অনেকে। যাবার পথে তারা সর্বক্ষণ গুলি বর্ষণ করতে থাকে। গানবোট থেকে বোমা নিক্ষেপ করে এবং ৫/৬ মেইল দূরেও গোলা নিক্ষেপ করে। হাজার হাজার লোক ভীত হয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে আশ্রয় নেয়। সম্পূর্ণ সায়েস্তবাদ, চরবাড়িয়া ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পড়ে। লেঃ মেহেদী, ফ্লাইট, সার্জেন্ট ফজলুল হক আবদুর রহমান চাঁদপাশায় আশ্রয় নেয়। ঠাকুর মল্লিকের খলিলুর রহমান সায়েস্তাবাদ হতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অস্ত্র নৌকা বোঝাই করে কমিশনার নিয়ে যান এবং তা চাঁদপাশার আবদুর রহমানকে বুঝিয়ে দেন। আবদুর রহমান এ সকল অস্ত্র দিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী শহরে উঠে যায় এবং রাতে একদল বি এম কলেজ এবং আর একদল বেলতলা মাহমুদিয়া মাদ্রাসায় ছিল। নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, মহিউদ্দীন, লেঃ নাসির, মাহফুজ আলব বেগ প্রমুখ ২৫ এপ্রিল ২টায় শহর ত্যাগ করে লাখুটিয়া হয়ে মাধব পাশায় চলে যান। ২৬ মে পাকবাহিনী শহরে বেরিয়ে পড়ে এবং শহরে যারা আত্মগোপন করে ছিল তাদের অনেককে হত্যা করে। ২৬ এপ্রিল হাজী আদম আলী পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে লঞ্চঘাট হতে পাকসেনাদের অভ্যর্থনা জানান। ২৬ এপ্রিল বরিশাল শহর থেকে পাকিস্তান সরকারের দখলে চলে যায়। ২১-২৫ এপ্রিল বরিশালের উপর পাকবাহিনীর বর্বর হামলা পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল আতিক মালিক, মেজর ইয়াহিয়া হামিদ, মেজর সালাম, ক্যাপ্টেন এজাজ, ক্যাপ্টেন কায়ানী প্রমুখ।
[৫৭] সিরাজ উদ্দীন আহমদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত