You dont have javascript enabled! Please enable it! চাচৈর গ্রামের যুদ্ধ, বরিশাল - সংগ্রামের নোটবুক

চাচৈর গ্রামের যুদ্ধ, বরিশাল

বরিশাল ও ঝালকাঠি মহাসড়কের উপরে নালছিটি থানার অন্তর্গত চাচৈড় একটি ছোট্ট অখ্যাত গ্রাম। এই গ্রামটি হঠাৎ করে ১৯৭১ সালে বিখ্যাত হয়ে যায় যখন বরিশাল এলাকার সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমর এই গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে অস্থায়ী মুক্তিযুদ্ধের কাম্প করে। সময়টা হবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ও অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ। ঐ সময়টায় সারা বাংলাদেশ পাকিস্তানী দালালের অভাব ছিল না।
গ্রামে গ্রামে দালালদের দৌরাত্ন বেড়েই চলছিল। চাচৈড় গ্রামেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এই গ্রামেরই একজন দালাল মারফৎ বরিশালে অবস্থিত পাকসেনারা খবর পেয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ব্যাপারে। তখন বরিশালে অবস্থান করছিল ১০৭ বিগ্রেডের অধিনস্ত ১৫ এফ, এফ রেজিমেন্ট। লে. কর্নেল শামস ছিলেন খুলনাতে। খুবই চতুরতার সাথে তিনি অনেক বাঙালি যুবকদেরকে গোয়েন্দা হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং এদেরকে বরিশালে পাঠিয়ে দেন খবর সংগ্রহের জন্য পরবর্তীতে এরাই গোটা বরিশালে দালালদের একটি শক্তিশালী চক্ত গড়ে তোলে। এই গোয়েন্দারদের একজন ধরা পরে বরিশালে। তখন ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের আদেশে বরিশাল শহরতলীর আমা জনতার সামনে প্রকাশ্যে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লে. কর্নেল শামস যখন চাচৈড় গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবং ক্যাপ্টেন ওমরের কথা জানতে পারলেন তখন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। পাকসেনাদের এই আক্রমণের কথা ক্যাপ্টেন ওমর জানতে পারলেন না। পাকসেনারা সাধারণত দিনের বেলায় আক্রমণ রচনা করে। কারন বাংলাদেশের রাতকে তাঁদের খুব ভয়। পাকসেনারা দিনে বাঘ আর রাতের বেলায় বিরাল। রাতে তার কোনো সময়য় ক্যাম্প থেকে বের হয় না। যেহেতু বরিশাল ঝালিকাঠি হাইওয়ের উপরে অবস্থিত এই গ্রাম সুতরাং পাকসেনাদের একটি কোম্পানি ভোরের প্রথম আলোতে ক্যাপ্টেন ওমরের ক্যাম্প আক্রমণ করে বসল। আচমকা এই আক্রমণে ক্যাপ্টেন ওমর ও তার দল প্রথমে হকচকিয়ে গেলো। কিন্ত পর মূহূর্তেই ওমরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পুরো দল পজিশন নিয়ে পাকসেনাদের পাল্টা আক্রমণ করে বসল। পাকসেনারা ভেবেছিল প্রথম সারপ্রাইজ এ্যাটাকে মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দি করে ফেলবে। কিন্ত যখন দেখল মুক্তিসেনারা আক্রমণের পাল্টা জবাব দিচ্ছে তখন তারাও অস্থায়ী প্রতিরক্ষা পজিশন নিয়ে যুদ্ধ করতে শুরু করল। শুরু হয়ে গেলো দুপক্ষেই তুমুল যুদ্ধ চাচৈড় থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আতাভিম্রুল একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এই গ্রাম তখন্ আবদুল হাই পনার দল গোপন আশ্রয়ে ছিল। পনার দলের প্রায় ১৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাক্ত। যখন তার কাছে ক্যাপ্টেন ওমরের সংবাদ পৌছাল তখন পনা ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নান্না তড়িৎ ৫০/৬০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে নৌপথে রওনা দিল। যখন চাচৈড় গ্রামের দুই কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ল তখন শুনতে পেল এই দুই পক্ষের গুলির শব্দ। খালের পাড়ে “টালাই” ভিড়িয়ে সবাই টপটপ নেমে পড়ল। খালের পড়ের আড়াল নিয়ে পনার দল এগিয়ে চলল পশ্চিম দিকে। পনার দলও পাকসেনাদের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ শুরু করল। অন্যদিকে ঝালকাঠি এলাকার অবস্থান নিয়ে ছিল সুলতান মাষ্টারের দল। সুলতান মাস্টার তার দল নিয়ে অন্যদিক থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ করে বসল। চলছে যুদ্ধ তুমুল ভাবে। পাকসেনাদের হাতে আছে স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ এল,এম, জি ও আমেরিকান জিথ্রি রাইফেল। কুদ্দুস মোল্লার নাম বরিশাল বাসীর কাছে এক কিংবদন্তী। সেই অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস মোল্লা, (বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বীরত্বের জন্য “বীরপ্রতিক” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন) তখন অবস্থান করছিল গৌরনদী বাবুগঞ্জ এলাকার এক গোপন আশ্রয়ে। কুদ্দুস মোল্লা যখন চাচৈড় এর যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে যায় তখন সেও তার দল নিয়ে আসে যুদ্ধের ময়দানে। সেও এসে আক্রমণ করে বসে পাকসেনাদের। এদিকে প্রায় একটানা একরাত ধরে অনবরত যুদ্ধ চলেছে। এবার চারদিক থেকে যখন পাকসেনাদের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু হলো তখন পাকসেনারা বুঝল এবার আর তাঁদের রক্ষা নেই। এই সাঁড়াশি আক্রমণে পাকসেনাদের নিহতের হার বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে তাঁদের তরফ থেকে যুদ্ধের দামামা স্তিমিত হয়ে এলো। দিন দু’টার দিকে কোনো ফায়ারের শব্দ এলো না পাকসেনাদের তরফ থেকে। লোকমারফৎ জানা গেল পাকসেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে বরিশালে চলে গেছে। ফেলে গেছে অনেক নিহত সৈনিকের লাশ। তাঁদের আহতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। সন্ধ্যার সময়য় কয়েকন খালি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদেরও খুঁজে হত্যা করা হয়। সেদিন চাচৈর খালের পানি পাঞ্জাবীদের রক্তে লাল হয়ে যায়। বাকেরগঞ্জ পটুয়াখালী জেলার যতগুলো সংঘর্ষ হয়েছে তার মধ্যে চাচৈর যুদ্ধে পাকবাহিনী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল, শাহে আলম, আক্কেল আলী প্রমুখ শহীদ হয়। চাচৈর যুদ্ধ ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও সহযোদ্ধাদের জন্য খ্যাতি বয়ে আনে। এ যুদ্ধের পর পাকবাহিনী গ্রাম অঞ্চলে অপারেশনে যেতে সাহস হারিয়ে ফেলে। পাকবাহিনীর পরাজয় আসন্ন ও তারা বুঝতে পারে। কাউখালী ও পার্শ্ববর্তী শত্রুমুক্ত করার এই মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পিরোজপুর মহকুমা শহরে বিনা বাধায় নিজেদের অবস্থান সুদুঢ় করতে সক্ষম হয়। এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সর্বপ্রথম উত্তোলন করে। মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয় পিরোজপুর হাইস্কুলে।
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত