চাঁনপুর এলএসডি গোডাউন ও রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, চট্টগ্রাম
বাঁশখালি থানার চাঁনপুর এলএসডি গোডাউন থেকে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের খাদ্য (চাউল ও গম) সরবরাহ করা হতো। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ওপর সরকারি ফরেস্ট অফিসের রেস্টহাউজে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প ছিল। খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার জন্য গোডাউন থেকে খাদ্যসামগ্রী ছিনিয়ে নেওয়া এবং রাজাকার ক্যাম্পে হামলা করে তাদের বিতাড়িত করা ছিল এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য। বাঁশ খালি থানা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর থানার শেষসীমান্ত সংলগ্ন শঙ্খ নদীর পূর্বপাড়ে এবং আনোয়ারা থানা সদর থেকে ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে বর্তমানে তৈলারদ্বীপ ফেরিঘাটের পূর্বপার্শ্বে চাঁনপুর এলএসডি গোডাউন অবস্থিত। সার্জেন্ট মহিউল আলম ও গেরিলা কমান্ডার আবদুল লতিফ এই আক্রমণের প্রস্তাবটি গ্রুপ কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদীর কাছে উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁরা মিলে এই অপারেশনের বিস্তারিত পরিকল্পনা করেন। আলোচনায় ঠিক করা হয় চারজন কমান্ডারের নেতৃত্বে চার গ্রুপে ভাগ হয়ে গেরিলাদের তিনটি গ্রুপে গোডাউন ও রাজাকার ক্যাম্পের তিনদিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করবে। অন্য একটি গ্রুপ পেছনে থেকে তাঁদের কভারিং দেবে। পর্যবেক্ষণ শেষ করে সাম্পানে এসে তাঁরা বরকলঘাটের দিকে সামান্য এগিয়ে যেতেই সিগন্যালের জন্য অপেক্ষমাণ দলকে দেখতে পান। সিগন্যাল পার্টি পেছনের মূল দলকে ঘটনাস্থলে আসবার জন্য সংকেত দেন। উল্লেখ্য, বরকলঘাট থেকে তৈলারদ্বীপের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। তাই রেকি পার্টিকে পাঠিয়ে দিয়ে মূল দল সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে মূল গেরিলা দল কাছাকাছি চলে আসতে সক্ষম হয়। পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কমান্ডার আবদুল লতিফের নেতৃত্বে নুরুল ইসলাম বাবু, সৈয়দ নূর, আবদুল হক, নুরুল আমিনসহ ১২ জনের ৪ নম্বর গেরিলাদলকে শঙ্খ নদীতে কভারিং পার্টি হিসেবে রেখে বাকি ৩টি দল দ্রুত তীরে উঠে যায়। এরপর ৩ নম্বর দলটি কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে হাবিলদার আবু ইসলাম, আবুল বাশার, আবু তৈয়ব, মোঃ সোলেমান, আবুল মনজুর, আবু বকর ও আবুল কাসেমসহ ১১/১২ জন গেরিলা গোডাউনের উত্তরপাশে বাজারে অবস্থান নেন। ২ নম্বর দলটি সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে আব্দুর রাজ্জাক, কাজী ইদ্রিস, আবদুল হক, মোঃ ইদ্রিস, আবদুর আলীম ও জামাল আহমেদসহ ১২ জন গেরিলা গোডাউনের দক্ষিণপাশে ও রেস্টহাউজ উত্তরপাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে চলে যাওয়া রাস্তার পশ্চিম-দক্ষিণ কোণায় অবস্থান নেন। অন্যদিকে ১ নম্বর দলটি গ্রুপ কমান্ডার শাহজাহান ইসলামাবাদী নেতৃত্বে একেএম জয়নাল আবেদিন, ফেরদাউস ইসলাম খাঁ, ডা. গোলাম মাওলা, আবদুল গাফফার, আবুল মনজুর মাহমুদুর রহমান, আবদুল মালেক, নূর মোহাম্মদ, মোজাহেরুল ইসলাম, এস এম আলমগীর মিন্টুসহ প্রায় ১৮/২০ জনের গেরিলা দলটি গোডাউনের মূল ফটকে অবস্থান নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পাদনে মাঝিমাল্লা ও এলাকার লোকজনসহ আনুমানিক শতাধিক লোক ১ নম্বর দলের সাথে গোডাউনের ভেতরে প্রবেশ করেন। প্রবেশের মুহূর্তে প্রথমেই কয়েকজন গেরিলা গেইটে পাহারারত দারোয়ান দুজনকে ধরে ফেলেন এবং ধমক দিয়ে বলেন, ‘গোডাউনের তালা খুলে দে’। ফলে তাঁরা ভয়ে গুদামের তালা খুলে দেয়। তালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে ১ নম্বর গ্রুপের সঙ্গে আসা এলাকার লোকজন ও মাঝিমাল্লারা মিলে গোডাউন থেকে চাউল ও গমের বস্তাগুলো কাঁধে করে ঘাটে অপেক্ষমাণ গেরিলাদের দুটো নৌকায় ভর্তি করতে থাকে। নৌকায় বস্তা ভর্তি করার শেষদিকে রাজাকাররা খবর পেয়ে গোডাউনের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে গোডাউনের দক্ষিণদিকে অবস্থানরত মহিউল আলমের নেতৃত্বে থাকা ২ নম্বর দলের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাঁরা রাজাকার বাহিনীকে গুলি করতে করতে দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে তাঁরা পালিয়ে বাঁশখালি থানার জলদি ক্যাম্পের দিকে পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যে গেরিলারা দুইটি গুদাম থেকে প্রায় ৪০০ বস্তা খাড্যশস্য সাম্পানে করে বাইনজুর গেরিলা দুইটি গুদাম থেকে প্রায় ৪০০ বস্তা খাদ্যশস্য সাম্পানে করে বাইনজুরি গেরিলা শেল্টারে নিয়ে আসেন। গেরিলাদের ২ নম্বর দল রাজাকারদের ক্যাম্প হিসাব ব্যবহৃত রেস্টহাউজে উঠে তল্লাশি করে তেমন কিছু না পেয়ে ফিরে আসেন। তবে বনবিভাগের দুইজন দারোয়ান রেস্টহাউজে প্রহরারত ছিল। এই অপারেশন চলে সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত। গেরিলারা গোডাউন থেকে ণৌকাভর্তি খাদ্যশস্য নিয়ে চলে আসার সময়য় কিছু চাউল ও গম ঐ এলাকার গরিব লোকজনকে দিয়ে দেন। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু খোলাবাজারে বিক্রি করে। যারা গেরিলাদের সাথে সহযোদ্ধা হিসেবে অপারেশনে অংশ নেয় তাঁদের সবাইককে কিছু কিছু চাউল ও গমের বস্তা দেওয়া হয়। বেশকিছু গম ও চাউলের বস্তা আশপাশের গেরিলা শেল্টারগুলোতে রসদ হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই অপারেশনে ২টি এলএমজি, এস এলআর ৫/৬ টি, এসএমজি ৫/৬টি, রাইফেল ১৫/২০টি, গ্রেনেড ২০/২৫ টি ও ৩টি রিভলবার ব্যবহার করা হয়।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত