চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রেহাইচরের যুদ্ধ
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনীর ওপর মিত্রবাহিনী কর্তৃক সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হয়। ঐ সময় ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসরমান মিত্রবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য হয়। ঐ সময়য় ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসরমান মিত্রবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য পাকবাহিনী তাঁদের অধিকাংশ সৈন্য মোতায়েন করে। ফলে পাকবাহিনী তীব্র সৈন্য সংকটে পড়ে এবং এর প্রভাব চাঁপাইনবাবগঞ্জেও স্পষ্ট হয় ওঠে। মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ওই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে।
সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনদিক থেকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন।
ক. ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর নেতৃত্বে একটি দল সোনামসজিদ-শিবগঞ্জ অক্ষ বরাবর মহানন্দা নদী পার হয়ে শত্রু অবস্থানে আক্রমণ করে।
খ. লেফট্যান্যান্ট রফিকের নেতৃত্বে আরেকটি দল বহনপুর-নাচোল-আমনুরা হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আক্রমণ করে
গ. মেজর গিয়াসের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কে ব্লকিং পজিশন দখল করা
১০ ডিসেম্বর চরবাগডঙ্গার মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। ১০ মাইল পথ অতিক্রম করার পর তারা মহানন্দা নদীর পাশে সাহেবঘাট পৌঁছে। নদীর ঠিক ওপর পাশে অবস্থিত নামোশংকরবাটি গ্রাম। নামোশংকরবাটিতে পাকিস্তানীদের আস্তানা আছে কি-না জানার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এমএমজি ফায়ার শুরু করে। বিপরিত দিক থেকে কোনো সড়া না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সেই অবস্থান থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে মহনপুর ঘাটে চলে যায়। সেখানে পৌঁছে তারা জানতে পারে জে নদীর ওপর পাশে পারমোহোনপুরে পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা রয়েছে। তারা সেখানে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে সুবেদার ইসমাইলের কভারিং ফায়ারের সহায়দায় নদী অতিক্রম করে। নদী অতিক্রম কপ্রে সংগঠিত হয়ে তারা পারমোহনপুরে ফায়ার শুরু করে। মর্টার ফায়ারের কারণে শত্রুরা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করে এবং মুক্তিবাহিনী এলাকাটি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে জানা যায় যে, ওই অবস্থানটি রাজাকার দখল করে রেখেছিল। পরে সেখান থেকে মুক্তিবাহিনী টিকরাম্পুরে স্থান পরিবর্তন করে।
একই দিনে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আনুমানিক ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মেহেদীপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে রওনা দেন। পথিমধ্যে তারা তারা ১৯৭১-এর ১১ ডিসেম্বর শিবগঞ্জে রাজাকারদের বন্দি করেন। এই দলটি ১১ তারিখ দুপুর ১১টার সময় বারঘরিয়া পৌঁছায়। ডিসেম্বর ১২ তারিখেও মুক্তিবাহিনী ওই অবস্তাহ্নে ছিল। লেফটেন্যান্ট কাইউম এবং এবং লেফটেন্যান্ট আউয়াল এখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সাথে একত্রিত হন। টিকরাম্পুরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের সগজগ রাস্তা কেটে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। জদিও আগস্ট মাসে হরিপুরের ব্রিজটি ধ্বংস করে, পরবর্তীতে পাকিস্তানী সেনারা সেখানে একটি কাঠের ব্রিজ পুনরায় তৈরি করে। আনুমানিক বিকেল ৫টার সময় মুক্তিবাহিনী রাজারাম্পুরে পৌঁছায়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ভারতীয় আর্টিলারির ফায়ার সহায়তায় পাওয়ার আশায় বাবরিয়ায় অপেক্ষা করে কিন্ত তা কখোনই পৌছায়নি। ফলে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গির ১৩- ১৪ ডিসেম্বর রাতে আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা ছাড়াই চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তিনি তার দল নিয়ে ১২ ডিসেম্বর বারঘরিয়ায় থেকে যান এবং বাকি সবাই ওই দিনই মহানন্দা নদী পার হয়। ১৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ তীব্রতর হয়। মুক্তিবাহিনী সব্দিক থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ করে। পাকসেনারা ভীত হয়ে ওই অবস্থান খালি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তার দলকে কয়েকটি উপদলে বিভক্ত করেন এবং আকন্দবাড়িয়া ঘাট দিয়ে মহানন্দা পার হয়ে টিকরামপুরে পৌঁছেন। রাতের আহারের পর তিনি সৈন্যদের ভবিষ্যৎ অপারেশন সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৬টায় তিনি তার দলসহ রেহাইচরের পাশে অবস্থান অবস্থান নেন আনুমানিক সাড়ে আটটার সময়য় তিনি ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে নদীর পার দিয়ে রেহাইচরের দিকে অগ্রসর হন। দ্রুত পর্যবেক্ষণ পর তিনি অবস্থানটি আক্রমণ করেন। যখন তিনি বাঙ্কার চার্জে ছিলেন তখন হঠাৎ একটি ঘর থেকে শত্রুর বুলেট তাঁকে আঘাতে করে এবং তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন কিন্ত প্রচণ্ড গোলাগুলির কারনে সেদিন তার মৃত্যুদেহ উদ্ধার করা যায়নি। পরে তারে মৃতদেহ ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ উদ্ধার করা হয়। সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তা মুক্তিবাহিনীর জন্য দেশপ্রেম এবং নির্ভীক জদ্ধার স্বাক্ষর রাখে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা পরবর্তীতে পুরো দেশের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করে। পাকবাহিনীর নিচু মনোবল, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনই নিশ্চিত করেছে মুক্তিবাহিনীর বিজয় যা এসেছে অনেকগুলো সাহসী, সত্যিকার দেশপ্রেমিকের তাজা প্রাণের বিনিময়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে তার বুকে ধারন করে আজ গর্বের সাথে স্মরণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সে সকল স্মৃতিময় গর্বিত দিনগুলোর কথা।
[৫৬] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত