চাপাইনবাবগঞ্জ-হরিপুর আমনুরার যুদ্ধ
১৯৭১ সালে ৭ নং সেক্টরের অন্তর্গত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে অনেক খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কোন বড় ধরনের সাহায্য ছাড়াই মুক্তিবাহিবনী শত্রুসেনাদের পরাস্ত করতে সমর্থ হহয়।
১৪ আগস্ট পকিস্তানি সৈন্যরা যখন তাঁদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের ব্যস্ত ছিল ঠিক তখনই শত্রুর ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। মেজর গিয়াস ওই দিন সকাল ৭টায় পাক অবস্থানের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ৮৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি দলে বিভক্ত করে এই আক্রমণ পরিকল্পনা করেন।
সুবেদার ইসমাইলের দল ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত ছিল। তার দলকে ১৪ আগস্টে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত মর্টার ফায়ারের দায়িত্ব দেয়া হয়।
দ্বিতীয় দলটি সুবেদার আমিরুজ্জামান নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত ছিল। মেজর গিয়াসও এই দলের সাথে ছিলেন। এই দলের কাজ ছিল হরিপুরের ব্রিজ ধ্বংস করা এবং শত্রুকে হত্যা করা যাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহির মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নায়েক সুবেদার আমান উল্লাহ তৃতীয় দলে ৩১ জন সদস্য ছিলেন। তার দায়িত্ব ছিল বিদিরপুর রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস করা।
১৪ আগস্ট ফরিদপুর বিওপি থেকে দলগুলো সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু করে। ফরিদপুর বিওপি পদ্মা এবং মহানন্দার মধ্যখানে অবস্থিত। তাঁদের গন্তব্বস্থলে পৌছতে ১৭ মাইল পাড়ি দিতে হয়। দলগুলো সন্ধ্যা হওয়ার আগেই টার্গেট এলাকার ৩ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়।
রাত ৯টার সময়য় মেজর গিয়াস তার প্রথম ও দ্বিতীয় দলকে হরিপুর ব্রিজের ৬০০ গজের কাছাকাছি যাওয়ার আদেশ দেন। তৃতীয় দলটিকে ২টি নৌকায় বিদিরপুর রেলওয়ে ব্রিজের নিকট পাঠানো হয়।
দ্বিতীয় দলটি ধীরে ধীরে হরিপুর ব্রিজের দিকে প্রথম দলে ফায়ার সহায়তায় এগোতে থাকে। যখন দলটি ব্রিজের কাছে পৌঁছে তখন শত্রু তাঁদের চিহ্নিত করে ফেলে এবং এলএমজি ও রাইফেল ফায়ার শুরু করে। তৎক্ষণাৎ দলগুলো শত্রুর অবস্থানের ওপর ঝাঁপিয়ে পরে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিজটি দখল করে নেয়। এই আক্রমণ দুজন শত্রু মারা যায়, দুজন নদীতে লাফ দেয়, একজন আহত হয় এবং বাকি এগারো জন বন্দি হয়। মুক্তিবাহিনীর একজন আহত এবং আরেকজন শাহাদাতবরণ করেন।
ব্রিজ দখল করার পর প্রথম দলটি দ্রুত চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। তারা শহর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরর্বে একটি জায়গা নির্বাচন করে শত্রুর অবস্থানের ওপর মর্টার ফায়ার শুরু করে। এ সময় পাকিস্তানী সৈন্য, রাজাকার এবং তাঁদের মিত্ররা তাঁদের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছিল। তারা মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক বোমা হামলায় পলায়ন শুরু করে।
তৃতীয় দলটি বিদিরপর রেলওয়ে ব্রিজে পৌঁছার পুর্বেই শত্রু তাঁদের চিহ্নিত করে এবং শত্রুর তীব্র ফায়ারের সম্মুখীন হয়। দ্বিতীয় দলটি হরিপুরের ব্রিজটি ধ্বংস করার জন্য যখন ২৪০ পাউন্ড বিস্ফোরক লাগাচ্ছিল তখন শত্রু ব্রিজটির ওপর টহরলত অবস্থায় মেশিন গান ফায়ার দিচ্ছিল। মেজর গিয়াস সবকিছু ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কি না তা তত্তাবধান করছিলেন। ইতিমধ্যে প্রথমে দলের কিছু মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের সাথে যোগ দেয়।
১৫ আগস্ট রাত ১২টা ৫ মিনিটে ব্রিজ ধ্বংস করা হয়। ধ্বংস করার পর মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজের ক্ষতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য ছুটে যায়। এই সময়ের মধ্যে তৃতীয় দলটি তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে।
শত্রুপক্ষ মুক্তিবাহিনীর কার্যবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমনুরা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুটি টহল দল পাঠায়। তবে ভুল বোঝাবুঝির কারণে একটি টহল দল ওপর দলটিকে শত্রুর টহল দল ভেবে একে-অপরের ওপর ফায়ার করে। এই সংঘর্ষের ফলে ৬ জন সাথে সাথে মারা যায়।
[৫৬] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত