চরফ্যাশন থানা আক্রমণ, ভোলা
পুরো গ্রুপ দিনের বেলায়ই অস্ত্র হাতে রওনা হলাম চরফ্যাশন থানার দিকে। পথে একটি ছোট বাজারে উপস্থিত হয়েছি। মানুষজন ভীত হয়ে ছোটছুটি শুরু করছে। মুরব্বি কয়েকজনকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা মুক্তিযোদ্ধা, ভয়ের কিছু নেই। এখন আমাদের কিছু খাওয়ান। মুড়ি, কিছু মোয়া আর বাংলা কলা, শেষে চা খেয়ে রওনা হলাম। বেলা তিনটার দিকে থানার পশ্চিম ও উত্তর পাশে দুই ভাগে ভাগ হয়ে অবস্থান গ্রহণ করে গুলি শুরু করি। যেহেতু আমাদের গুলির পরিমাণ কম, সে কারণে এক একটি রাইফেল থেকে একটির বেশি গুলি কেউ করছে না। ওই দিকে থানার দিক থেকে প্রথম দশ মিনিট কোনো শব্দ নেই। কোনো প্রতিউত্তর বা পাল্টা আক্রমণ নেই। মনে হলো আজ দিনটি আমাদের অনুকূলে। বোধহয় থানার রাজাকার আর পুলিশরা সারেন্ডার করবে। তারপরই শুরু হলো প্রতিআক্রমণ। আমরা সবাই এক রাউন্ড গুলি করলে ওরা করে দশ রাউন্ড করে। আমরা সঠিক কোনো টার্গেটও করতে পারছি না। থানার বারান্দায় সিমেন্ট-বালির বস্তা দিয়ে বেশ ভালো প্রটেকশন বিল্ডিংয়ের মধ্যে। আমরা এক ঘন্টা এভাবে গুলি চালিয়ে বুঝলাম ওরা আত্মসমর্পণের মনোভাব কেউ নেই। এদিকে আমাদের গুলিও কম। তখন মছু ভাইকে বললাম, চলেন ফিরে যাই। রাজাকারদের মতিগতি ভালো নয়। কিছুক্ষণ পর আমরা ছিদ্দিক মিয়াকেও বললাম। রাজাকারদের মতিগতি ভালো নয়। কিছুক্ষণ পর আমরা ছিদ্দিক মিয়াকেও বললাম। আজিজুল হকও বলল, চলেন, ফিরে যাই। ইতিমধ্যে আমাদের সাইড থেকে গুলি বন্ধ হওয়ার পর ওরা আরো কিছুক্ষণ গুলি চালায়। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে তারা গুলি বন্ধ করে দেয়।
এই অবস্থায় বেলা প্রায় পাঁচটা বাজে, চরফ্যাশন থেকে হেঁটে পিয়ার আলী ব্যাপারী বাড়ি আসি। ওইখানে রাতের খাওয়ার পর আমরা দেউলার গ্রুপ, কাচিয়ার আজিজ গ্রুপ ও ভোলার ছিদ্দিকুর রহমানরা দুই ভাই বদরপুর হাজী বাড়ি এবং লিয়াকত, খোকনরা দালাল বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
এর একদিন পরে দেউলার ছিদ্দিকরা চলে আসে ছিদ্দিকের বাড়িতে। হযরত আলী, আজিজুল হক চরে আসে কচিয়ার দাস বাড়িতে। লিয়াকতরা আবার পিয়ার আলী ব্যাপারী বাড়িতে চলে আসে। মকছু ভাই দেউলা থেকে যায়। হোসেন চৌধুরী বোরহানউদ্দিনে চলে আসে। আমি বদরপুর হাজী বাড়ি থেকে এমসিএ মোতাহার মাস্টারের কথা অনুসারে তাঁর সঙ্গে ফারুককে নিয়ে দেখা করতে যায়। মোতাহার মাস্টারের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানালো চরফ্যাশন থাকা আক্রমণে বেশ ভালো প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ভোলাতে যে মুক্তিযোদ্ধা আছে এটা আপনারা প্রমাণ করে দিলেন। আমাকে খবর দিয়েছিল এই কারণে, যেহেতু এর আগে সাক্ষাৎকারের সময় অস্ত্রের খোঁজ আছে কিনা না জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনার বেয়াই চরবুতার চেয়ারম্যান, তৎকালীন লালমোহন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোখলেছুর রহমান মিয়া একটি রাইফেল ও ১০০ রাউন্ড গুলি জোগাড় করে রেখেছেন।
আমি দেউলা ও চরফ্যাশন ক্যাম্পের টাকা-পয়সার প্রয়োজনের কথা বললাম। তখ মোতাহার সাহেব সে ব্যাপারেও মোখলেস মিয়ার সঙ্গে আলাপ করতে বললেন।
আমাদের পরদিন থাকতে বললেন। সন্ধ্যার পর মোখলেছুর রহমান তিনজন নিয়ে হাজির। সঙ্গে রাইফেল ও গুলি। মোতাহার মাস্টার, মোখলেস মিয়া, ফারুক মিয়া ও আমি সে রাতে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম। বোরহানউদ্দিনের আওয়ামী লীগ থানা সেক্রেটারি সৈয়দ ডাক্তারের কাছে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তিনি কোনো টাকা দেননি সেটাও জানাল্ম। এমসিএ রেজাই করিম চুন্নু মিয়ার সঙ্গে এখনো যোগাযোগই করতে পারিনি তাও জানালেন। মোতাহার মাস্টার আমাদের বললেন, আমার লাইনে চেষ্টা করে দেখি। তাঁর সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ বিশেষ প্রয়োজন। এর মধ্যে ভোলা কলেজের ভিপি ছালে আহমদ তাঁর খোঁজে এসেছিল, দেখা হয়নি। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কিনা জানতে চাইল। আমার সঙ্গে এপ্রিলের পর আর দেখা হয়নি জানালাম।
পরদিন সন্ধ্যায় মোতাহার মাস্টার সাহেব তাঁর একজন বিশ্বস্ত নৌকার মাঝি আমাদের সঙ্গে দিলেন। সেই নৌকা করে আমরা তালুকদার হাটে এসে রাইফেলটি গিয়াসুদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিয়ে পরদিন আমি বোরহানউদ্দিনে ভূঁইয়া বাড়ি চলে আসি এবং মাহাবুব হাওলাদারের বাড়িতে ভলে যাই। লালমোহনে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ হয়েছে। রাজাকার আহত, চরফ্যাশনে রাজাকার কমান্ডার আক্রান্ত, দুজন নিহত-এই খবর পুরো মহকুমায় ছড়িয়ে পড়ল। কিছু গুজবও এর সঙ্গে যোগ হলো। কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মেশিনগান দেখেছে এবং তাদের সংখ্যা একশরও উপরে ইত্যাদি।
এখানে বলে রাখা ভালো, সেই রাতে চরভূতার চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান মিয়া সম্পর্কে আমার বেয়াই হয় তা আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি বলেছিলেন, বেয়াই লাল্মোহন থানা আক্রমণ করার পরিকল্পনা হলে আমাকে আর এমসি সাহেবকে আগে একটু ইঙ্গিত দেবেন। কিছু রাজাকার আছে যারা আমাদের কথা শুনবে।
[৬৪] মাহফুজুর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত