চট্টগ্রাম ‘মোহাম্মদ আলীর বাড়ি’ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ
চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ান হাট থেকে পশ্চিমে পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেটের পূর্বদিকে ঈদগা এলাকায় মোহাম্মদ আলীর পেট্রোল পাম্প এবং একই সাথে তার বাড়ি অবস্থিত। পাকবাহিনীর একান্ত সহযোগী মোহাম্মদ আলী ১৯৭১-এ তার বাড়িটি রাজাকার ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্রে পরিণত করে। এ মোহাম্মদ আলী ও তার বাড়িকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাগণ দুটি অপারেশন পরিচালনা করেন। প্রথমত কেসি-৪ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক মোহাম্মদ আলীকে সরিয়ে দিতে মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক দানু, শফিউল বশর, আহসানুল হক মণি তাঁকে সরাসরি আক্রমণ করে হতযার অপারেশনে যান। মণি কভারিং-এ থাকেন এবং দানু ও শফি তাঁকে আক্রমণ করেন। দানু তার স্টেনগান দিয়ে মোহাম্মদ আলীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাবার চেষ্টা করেন কিন্তু স্টেনগান থেকে কোনো বুলেট বের হয় না। এ সুযোগে সে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার শুরু করে। পাশের ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে ডাকাত মনে করে ট্রাক ড্রাইভাররা ছুটে আসে। মণি কভারিং-এর জন্য পজিশন নিয়েছিলেন এ অবস্থায় তিনি দৌড়ে এসে ব্রাশ ফায়ার করেন। এক ট্রাক ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। এছাড়া অনেকেই আহত হলেও ধুরন্ধর মোহাম্মদ আলী বেঁচে যায়। দ্বিতীয় মোহাম্মদ আলীর হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি গ্রুপ মিলে যৌথ অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সৈয়দ, হারেস ও ডা. জাফর বিস্তারিত রেকি করে ৫০ জনের একটি গেরিলা দল অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করেন। দিনটি ছিল প্রথম রমজান। পরিকল্পনা মতো রাত ১১টার দিকে ৫০ জনের ওই গেরিলাদল অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে অবস্থান নেন। ইতিমধ্যে পাহাড়তলীর দিক থেকে পুলিশের একটি ভ্যান গাড়ি দেওয়ানহাটের দিকে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে অবস্থানরত একটি গ্রুপ তাঁদের পথরোধ ও নিরস্ত্র করে। এর ফলে আক্রমণের পূর্বে গোলাগুলি ও কোন শব্দ না করে ও শত্রুকে বিস্মিত করে আক্রমণ করার পরিকল্পনা ব্যহত হয়। পেট্রোলপাম্পের সামনে রাস্তার বিপরীতে ছিল একটি সরকারি গুদামঘর। সেখানে নিরাপত্তারক্ষার জন্য কিছু মিলিশিয়া অবস্থান করত। তাঁরা টের পেয়ে পূর্বোক্ত ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। ফলে বিভিন্নস্থানে পজিশন নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে সার শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে এ গোলাগুলি চলে। এদিকে এ ঘটনার খবর পাক-আর্মির একটি এসে পজিশন নেয় কদমতলীতে। এরপর তাঁরা দেওয়ানহাট মোড়ে অবস্থান হতে থাকে। একই সাথে অলংকার-এর দিক থেকেও বিপুলসংখ্যাক সৈন্য ঐদিকে অগ্রসর হয়। অপরদিকে গোলাগুলি চলার সময়ে রাজাকাররা সাধারণ পোশাকে বের হয়ে যায়। এলাকার সাধারণ জনতা মনে করে মুক্তিযোদ্ধাদের একপর্যায়ে উইথড্র সিগনাল দেওয়া হয়। উইথড্র করলেও মুক্তিযোদ্ধা হারুন ও ফজলু শেষ মুহূর্তেও পেট্রোলপাম্পে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্য নিকটবর্তী এসে যাওয়ায় উপায়ন্তর না দেখে দুজনে ধানক্ষেতে লাফ দিয়ে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করেন। এই অপারেশন চূড়ান্তভাবে সফলতার মুখ না দেখলেও পাকবাহিনীর দোসর স্বাধীনতা বিরোধীদের ভেতর প্রচণ্ড ভীতি সৃষ্টিকারী এ অপারেশকে গেরিলা যুদ্ধোত্তরমতে সফল অপারেশন বলে গণ্য করা যায়।
[৫৭] কে.এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত