ঘুইঙ্গার হাটের যুদ্ধ, ভোলা
মিষ্টির জন্য বিখ্যাত ঘুইঙ্গার হাট ভোলা সদরের সামান্য দক্ষিণে অবস্থিত একটি হাট। সদর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল দূরত্বে ঘুইঙ্গার হাট। পাক আর্মির মূল ঘাঁটি ছিল ভোলা সদরের ওয়াপদা কলোনিতে। সেখান থেকে দক্ষিণের ৬ থানার যে কোনো থানা সদরে যেতে হলে ঘুইঙ্গার হাট হয়েই যেতে হয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম থেকেই পাক আর্মির স্বাভাবিক চলাচলে বাঁধ প্রদান করত এই ঘুইঙ্গার হাট থেকেই। তারা মনে করতো যদি। পাঞ্জাবি সৈনিকদের এখানে আটকে দেয়া যায় তাহলে সার ভোলার নাগরিকরা তাদের কবল থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে। ঘুইঙ্গার হাটের প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিণে টনির হাট বা বাংলা বাজার। সেখানে ছিল মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। যুদ্ধের শুরু দিকে তারা কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও পরের দিকে তারা বেশ সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করতো। আগে-পরে এই ঘুইঙ্গার হাটে দুচারটা ছোটখাট সংঘর্ষ হলেও মূল যুদ্ধটি হয় ২৭ অক্টোবর ভোর রাত থেকে সে রাতে পাকআর্মি সড়ক পথে সোজাসুজি না এসে লঞ্চযোগে বাঘমারে হয়ে একটি দল হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি বাংলা বাজার, অপর দলটি কমরদ্দি হয়ে ঘুইঙ্গার হাটে আসে। এঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে রাজাকার মোহাম্মদ টন্নি ও মকবুল কমান্ডার। ভোলায় তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে দেন আনসার এডজুটেন্ট আলী আকবর বড় ভাই। আর ঘুইঙ্গার হাটের দায়িত্ব ছিল কমান্ডার ফারুক বাচ্চু। বিভিন্ন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই জানতো পাকআর্মি যে কোনো সময়ে তাদের উপর হামলা চালাতে পারে। এজন্য তাদের মধ্যেও চলছিল রণপ্রস্তুতি। তারা ঘুইঙ্গার হাটের বিভিন্ন স্থানে খনন করে ১০টি বাঙ্কার। চারটি বাঙ্কার ছিল উত্তরমুখী। অপর ছয়টি ছিল তিন দিকে মুখ করা। বাংকারগুলো ছিল মূল সড়কের খুব কাছাকাছি। যাতে পাকআর্মির গাড়ীর বহর রাস্তা অতিক্রম করার সময়য় তারা গোপনস্থান থেকে হামলা চালাতে পারে। তাছাড়া তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বরিশালের কুদ্দুস মোল্লার কাছ থেকে একটা গ্রুপ চেয়ে পাঠিয়েছিল। কথা ছিল ২৫ অক্টোবর দিবাগত রাতে কুদ্দুস মোল্লার দলটি ভোলায় এসে পৌঁছবে। কিন্তু রাজাকার তোফাজ্জেল দফাদরের মাধ্যমে পাকআর্মি মুক্তিযোদ্ধাদের এহেন প্রস্তুতির কথা জেনে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটা ধারণা ছিল তাদের শক্তি বৃদ্ধি পেলে তারা ভোলা থেকে পাকআর্মিকে হটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বিধিবাম। নির্দিষ্ট রাতে কুদ্দুস মোল্লাহর দলটি এল না। দল সেজে এল রাজাকার ও পাকআর্মির একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ। ঘুইঙ্গার হাট যুদ্ধের একজন অন্যতম শহীদ হলে জোবেদ আলী ফরাজি। তিনি ছিলেন একজন মুদি দোকানদার। দৈনিক গরুর গাড়ি চালিয়ে তিনি ভোলা সদরে যাতায়েত করতেন এবং মহাজন পট্টিতে যে বাঙালি ই.পি.আর সদস্যরা থাকতো তাদের থেকে পাকবাহিনী গতিবিধি সম্পর্কিত খবরাখবর এনে মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন। মূলত তার কাজই ছিল ই.পি. আর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদান এবং চিঠি চালাচালি। এ কাজের সাথে যুক্ত ছিল আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধা ছোট ফারুক ও জুলু। দুর্ভাগ্যজনক হলে সত্য, জোবেদ আলী ফরাজির সংবাদ আদান প্রদানের বিষয়টি রাজাকার তোফাজ্জল দফাদারের মাধ্যমে পাকবাহিনী জেনে ফেলে। ফলে ২৬ অক্টোবর সে প্রতিদিনের রুটিন মাফিক ওয়াপদা কলোনির সামনে দিয়ে যাবার সময়য় পাকবাহিনী জোবেদ আলীকে ধরে ফেলে এবং ক্যাম্পের ভিতর নিয়ে জবাই করে হত্যা করে। ঘটনাটি ২৬ অক্টোবর বিকেল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা জানতো না। তারা তো অপেক্ষায় ছিল, কখন জোবেদ আসবে। কখন তারা নতুন তথ্য জানতে পারবে। দিন গিয়ে রাত নামে। রাতে জানাজানি হয় যে, জোবেদ আলীকে মেরে ফেলা হয়েছে। পরে নৈমুদ্দিন বাজারে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জোবেদ আলী মৃত্যুর ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়। ঐ দিনই ভোলায় পাকআর্মির মেজর ঘোষণা দেয়-ফারুক বাচ্চুসহ যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে কেউ ধরে এনে দিতে পারে, তাকে এক লাখ টাকা পুরষ্কার দেয়া হবে। এই ঘোষণার পর রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নামে। তোফাজ্জল দফাদার ছাড়াও এ কাজে পাকবাহিনীকে সাহায্য করে নজীর মাওলানা, আজহার কেরানী, সৈয়দ মাস্টার, মন্নান মহাজন ও ফয়েজ মিয়া। ঘুইঙ্গার হাট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক্যাম্প সেটা ছিল শরৎ ডাক্তার বাড়িতে। কমান্ডার ছিলেন ফারুক বাচ্চু সাহেব। তিনি কিছুটা হলেও জোবেদা আলী মৃত্যুর কথা শুনে ভড়কে গেলেন এবং আশঙ্কা করলে শিগগিরই যুদ্ধ লাগতে পারে। এজন্য তিনি তৎকালীন ভোলা জেলা কমান্ডার আলী আকবর সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। কিন্তু সেদিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলে না। সারাদিন ধরে বাঙ্কারগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাম্বুশ করে ছিল। রাত হতেই ফারু বাচ্চু সাহেব দশ-বারজনকে পাহারায় রেখে তিনি তার দলবল নিয়ে ক্যাম্পে চলে গেলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন, কী নির্দেশ আসে সে মোতাবেক কাজ করার জন্য। রাত অনুমান দুইটার দিকে পাকআর্মির একটি দল ছদ্মবেশে রাজাকার সহকারে হাজির হলো ধুইঙ্গারহাট বাজারে। তারা এসেই বাজারে টহলরত দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে পেয়ে গেল। তারা বলল-আমরা কুদ্দুস মোল্লার লোক। একথা শুনে যোদ্ধা এবং সাধারণ লোক তাদের কাছাকাছি যায়। কাছে যেতেই কজনকে তারা বেঁধে ফেলে। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না এরা আসলে কারা? ঠিক সে সময়য় হযরত আলী হজু ও শাহজল দুজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা ক্যাম্পে পৌঁছে খবর দিল যে, অবস্থা বেগতিক। ফারুক বাচ্চু চিন্তা-ভাবনা করলেন কী করা যায়। শেষরাতের দিকে মুক্তিযোদ্ধা মনির হোসেনের নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি দল পাঠানো হয় পাঞ্জাবি সেনাদের গতিবিধি জানা ও আক্রমণ হলে প্রতি আক্রমণ করার জন্য। তারা তিন-চারশ’ হাত দূরে থাকতেই বুঝে ফেললল যে, পাকআর্মি ওৎ পেতে আছে। কাছে গেলেই তারা গুলি ছুঁড়বে। পাঞ্জাবি সৈনিকদের সাথে ছিল প্রচুর রাজাকার ও আলবদর। মনিরের দল কাছাকাছি আসতেই উভয় গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়। পাকআর্মি বাগানের ভিতর থেকে গুলি করাতে মনির ও শামসুদ্দিন ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন। ডা. আবুল বাশারসহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। সে অবস্থায় সকলে এদিকে ওদিকে সরে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। অতঃপর রাতে শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে আবার বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, পুরো দলকে ৫টি গ্রুপে বিভক্ত করে চারদিক থেকে আক্রমণ চালাতে হবে। সে মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধারা পাঁচটি উপদলে বিভক্ত হয়ে ভোর নাগাদ পাক আর্মির উপর একযোগে হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা একটা গুলি চালালে পাকআর্মি চালা একশ গুলি। এভাবে থেমে থেমে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত মনে হলো চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাজারের চারদিকে লোক জড়ো হচ্ছে। সে তুলনায় পাকআর্মি একা হয়ে পড়েছে। বিকেল পর্যন্ত তাদের পাল্টা আক্রমণের ধারাও কমে যেতে থাকে। এর মধ্যে গাড়িতে চড়ে তাদের দুই তিনটা দল চলে গেল। রাজাকার আলবদররাও হতাশ হয়ে পড়ল। তারাও যে যার মতো আত্মগোপন করতে থাকল। বিকেল ৪টা নাগাদ মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে এল এবং পুরো ধুইঙ্গারহাট বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এল। অবশ্য কোনো ফাঁকে যেন ১২ জন পাকসেনা মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। পরে তারা পালানোর চেষ্টা করলে সাধারণ মানুষ তাদের ধরে ফেলে। এ যুদ্ধ মারা যায় যে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁরা হলে মুক্তিযোদ্ধা-এলএমজি চালক মনিরুল ইসলাম, শদীদ আবদুল মান্নান, চাপরাশী দীলিপ, শহীদ শামসুদ্দিন, খলিলুর রহমান ও পিরোজপুরের বানেশ্বর এবং উত্তম। এ যুদ্ধে মারা পড়ে বহু পাক আর্মি ও রাজাকার। ধুইঙ্গারহাট সংলগ্ন শরৎ ডাক্তারের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ঘাঁটি ছিল সে ঘাঁটিতে এবং ধুইঙ্গারহাট বাঙ্কারে খাবার বহন করে নিয় আসত আবুল কাসেম, আবুল কালাম, খোরশেদ আলম। খাদ্য সরবরাহ করত মোখলেস, মতলেব, কাদের খান, শাহাজল হক, বজলু ও আবদুর রব খান। এছাড়া নানাভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন জনাব ইউনুস আনছার, ফরমুজুল হক, আবদুল বারি মাস্টার, আমির হোসেন, কালু মুনাফ ও হজু। তাদের প্রায় সকলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
[৩৭] কালাম ফয়েজী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত