গোয়ালন্দ দখল
পাকহানাদারবাহিনি ১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ রাতে ঢাকা মহানগরী ধ্বংস সাধঙ্কল্পে অভিযান চালিয়েছিল, ওই একই সময়য় বাংলাদেশের বিভিন্ন সেনানিবাসগুলিও তারা অতির্কিত আক্রমণ করে নিয়ন্ত্রনভাব পূর্ণভাবে গ্রহণ করে। বাঙালি সৈনিকগণ এই অতর্কিত আক্রমণে বহু নিহত হয়, অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করে। অতপর তাদের পরিকল্পনা মতো মফঃস্বল জেলা শহরগুলিও একের পর এক দখল করতে থাকে। ফরিপুর শহর দখল এবং অত্র জেলার সমগ্র নিয়িন্ত্রণ করায়ত্ত করার জন্য গানবোট নদী পথে আসে, ফরিদপুরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের তত্ত্বাবধানে এসময় জেলা অঞ্চল হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য ঢাকা হতে আসার সম্ভাব্য পথ গোয়ালন্দ ও নাডার টেক চরে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করা ও খুব সতর্কতার সাথে পাকসেনাদের আগমন বার্তা সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাকসেনারা গানবোট করে পদ্মা নদীতে আসার সংবাদ সময়য় মতো নেতৃবৃন্দ পেয়ে যায়। কিন্ত তারা নাড়ার টেকের পথে না এসে নদী পথে গোয়ালন্দ অভিমুখে চলে যাচ্ছিল। তখন আমরা ফরিদপুর হতে মোটামুটি নিশ্চিত হলাম যে আক্রমণ প্রথমে গোয়ালন্দ পথেই হবে। পূর্বেই এ সংবাদ গোয়ালন্দ ডিফেন্সে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌঁছান হয় এবং সতর্কতার সাথে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
গোয়ালন্দ বাজার হতে অল্প দূরে নদী সংলগ্ন সাহজাদপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। গোয়ালন্দ থানা আওয়ামী লীগ যুব নেতা ফকির আব্দুল জব্বারের ও অন্যান্যদের তত্ত্বাবধানে ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) আনসার ও আওয়ামী লীগ সেচ্ছাসেবক সমন্বয়ে প্রায় ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্স লাইনে অবস্থান করছিল। ১টি এইচএমজি, ৩টি এলএমজি, ১টি থ্রি ইঞ্চি মর্টার ও ২০ টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ছিল। ২১ শে এপ্রিল ভোর রাতে গোয়ালন্দের নিকটবর্তী পদ্মা নদীতে গানবোট এসে পাকসেনারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়। একদল চরে নেমে ক্রলিং করে আসতে থাকে। অন্যদল। ঐ চরের উপর থেকে মর্টার দিয়ে শেল মারতে থাকে এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা গানবোট নদীপথে গোয়ালন্দের দিকে আসতে থাকে। নিকটে এসে প্রথমেই কোনো গোলাগুলি বর্ষণ না করে প্রায় আধ ঘণ্টা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। বেলা প্রায় ৬টায় পাকসেনারা গুলি বর্ষণ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করে। দুই পক্ষের অশ্ত্রে সজ্জিত রণে নিপুন পাকসেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণের প্রচণ্ডতায় অল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করে। এই অবস্থায় আরও অধিকক্ষণ যুদ্ধ করার অর্থ সবাই খানসেনাদের হাতে মৃত্যু বরণ করা। অন্যদিকে স্থল পথে যারা ক্রলিং করে আসছিল, তারাও প্রায় নিকটবর্তী এসে যায়। সুতরাং পিছু হটে জীবন রক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এরকম মরণমুখী সঙ্কটাপন্ন বেগতিক অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা তখন গানবোট হতে নেমে আসে। এসে মুক্তিযোদ্ধাদের কোন পাত্তা না পেয়ে তাঁদের প্রতিহিংসার প্রথম শিকার হয় বাহাদুরপুর গ্রাম। গ্রাম জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। গ্রামের লোকজন আগেই পালিয়ে যায় কিন্ত সরল পল্লী কনি তোফাজ্জেল হোসেন পাকসেনাদেরকে তার ভাবুক মন হয়ত অত নিষ্ঠুর মনে করেনি। তাই স্ত্রীর বার বার অনুরোধকে উপেক্ষা করে বারিতেই ছিল। ফলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে পাকসেনাদেরকে গুলিতে নিহত হয়। বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে আহম্মদ মন্ডল তার মামা অ নায়েব আলিসহ ৭/৮ জন গুলিতে নিহত হয়। অতপর রাস্তার পার্শ্ববর্তী গ্রামের ঘরবাড়ি জালাএ সিএন্ডবি রাস্তা দিয়ে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকে। রাজবাড়ি আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী, কাজী হেদায়েত হোসেন, ডা. এস. এ. মালেক, া জলিল, মোসলেম উদ্দীন অ তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক শাহ্ মোঃ ফরিদ গোয়ালন্দে মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম কাজে সহযোগিতা করেন।
[৬৪৬] মোঃ সোলায়মান আলী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত