গরীবপুরের যুদ্ধ, যশোর
যশোর সেনানিবাস থেকে ১১ কিলোমিটার এবং ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত অখ্যাত গ্রাম গরীবপুর। ভারত সীমান্তের বয়রা থেকে এই গরীবপুরের মধ্যে বড় ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা বলতে ছিল কেবল কপোতাক্ষ নদ। তবে বয়রা থেকে গরীবপুর হয়ে যশোর সেনানিবাস নিকটবর্তী এবং গরীবপুর ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ কারনো সম্ভব হওয়ার মিত্রবাহিনীর কাছে কৌশলগত কারণে গ্রামটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। গরীবপুরে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত।
ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাকবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াৎ খান বয়রা-চৌগাছা-যশোর আফ্রা নামক স্থানে ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ঝিকরগাছা অক্ষে ২২ এফএফ, সাতক্ষীরা অক্ষে ১৫ এফএফ প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে এবং ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে যশোর সেনানিবাসে রিজার্ভ ও চৌগাছা থেকে জীবননগর পর্যন্ত ৩৮ এফএফ রেজিমেন্টকে মোতায়েন করে।
অপরদিকে ৯ মাউন্টেইন ডিভিশন, ৪২ ব্রিগেড, ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনী নিয়ে গঠিত মিত্রবাহিনী বয়রা সীমান্ত দিয়ে কপোতাক্ষ নদ অতিক্রম করে গরীবপুরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে।
২০ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াৎ খান গরীবপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানির প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের খবর জানতে পেরে তা অপসারণের লক্ষ্যে আক্রমণের তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়। সে মোতাবেক গরীবপুরে মিত্রবাহিনীর অবস্থানে উত্তর এবং পূর্ব দিক থেকে ২১ নভেম্বর সকাল ৬-টায় পাকবাহিনীর ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুইটি কোম্পানি আক্রমণ করে। কুয়াশার ছত্রছায়ায় খুব অল্প সময়ে পাকবাহিনীর আক্রমণকারী ট্যাঙ্কসমূহ প্রতিরক্ষার প্রায় ১০০ গজ নিকটে পৌঁছে যায়। উভয় পক্ষের আর্টিলারি তখন প্রত্যক্ষ সহায়তায় গোলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু কুয়াশার কারণে টার্গেট রেজিস্ট্রেশন সম্ভবপুর ছিল না বলে ফায়ার ততটা কার্যকর হয় নি। আক্রমণের এই পর্যায়ে কুয়াশার কারণে ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দু’টি কোম্পানি আক্রমণের অগ্রভাগের ট্যাঙ্কের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে। ফলে সহজেই মিত্রিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক ও ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্রের মাধ্যমে আক্রমণকারী পাক-ট্যাঙ্কসমূহকে ধ্বংস অথবা বিকল করে ফেলা সম্ভবপর হয়। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দুইটি কোম্পানি চৌগাছা অক্ষে সংগঠিত হয়ে গরীবপুর প্রতিরক্ষার পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। পাকবাহিনীর এই আক্রমণ আংশিক সফল হয় এবং তারা পশ্চিম দিক হতে গরীবপুরের ভেতর প্রবেশ করে। এই আক্রমণে মিত্রবাহিনী ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সি কোম্পানির ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং তারা স্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যায়। এর মধ্যে কুয়াশা কেটে যাওয়াতে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর স্যাবর জেট আক্রমণের সহায়তায় বোমাবর্ষণ করে। কিন্তু এ বিমান সহায়তা ছিল অল্পসময়ের জন্য। ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারির প্রত্যক্ষ সহায়তা না থাকায় ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট তাদের সফলতাকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে এবং গরীবপুর গ্রামের ভেতর ব্যাপক হাতাহাতি যুদ্ধের পর কোম্পানি দুইটি পিছু হটতে বাধ্য হয়। সকাল ১০-টার মধ্যে গরীবপুরের সম্পূর্ণ এলাকায় মিত্রবাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব পুনরায় তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে।
গরীবপুরের যুদ্ধে পাকবাহিনী প্রায় একটি ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রন (১১-টি ট্যাঙ্ক) ধ্বংস হয় এবং অজানা সংখ্যক সৈন্য নিহত ও আহত হয়। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর ১৯ জন নিহত, ৪৪ জন আহত এবং ২-টি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়।
[৫৭] ইকবাল জাফর খন্দকার
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত