You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.14 | গর্জনার যুদ্ধ, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

গর্জনার যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

গর্জনা গ্রামটি টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানায় অবস্থিত। ১৪ ই আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এখানে পাক সেনাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মাটি কাটার জাহাজ মারার যুদ্ধ শেষে ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে চলে যায় সখীপুর সদর দপ্তরে। দিনের আলোয় সড়ক অতিক্রম করা সম্ভব নয় ভেবে কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর কয়েকজন ক্ষুধায় কাতর সঙ্গী ঘাটাইল থেকে দু’মাইল পশ্চিমে গর্জনা গ্রামের বি ডি মেম্বারের বাড়িতে ওঁ তাঁর পাশের বাড়িতে দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে রাত্রি যাপন করে। সকালে বি ডি মেম্বার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাসী জবেহ করেন।
মুক্তিসেনারা রাত্রে সড়ক অতিক্রম করে চলে গেছে এটা ছিল কাদের সিদ্দিকীর বিশ্বাস। কিন্তু সকালে জানতে পারেন যে, বেনুর কোম্পানি গর্জনার পশ্চিম পাড়ায় এবং খোরশেদ আলমের কোম্পানি পাশের গ্রামের আত্মগোপন করে আছে। কাদের সিদ্দিকী সকল দলকে একত্রিত করে চারদিকে শত্রুর অবস্থানের কথা জানিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন। কাদের সিদ্দিকীর অনুমতি নিয়ে খোরশেদ আলম নৌকাযোগে বেনুর সাথে তার (বেনুর) কোম্পানি যোদ্ধাদের দেখতে যায়।
এদিকে বিডি মেম্বারের বাড়িতে রান্না চলছে, কিন্তু বাড়ির মহিলা ও শিশুরা
বাক্স-পেটরা নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কাদের সিদ্দিকীকে ভাবিয়ে ভোলে। তিনি বুঝতে পারেন ভিতরে ভিতরে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের সজাগ করে তিনি দূরবীন নিয়ে ঘরের বাইরে আসেন এবং গ্রামের চারপাশ দেখেন। পাশের বাড়িতে অবস্থানরত নূরুন্নবী, বুলবুল খান, নূরুল ইসলাম ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে গোলা বারুদ চারটি নৌকা বোঝাই করে ভোলা, আলীম ও লতিফকে দিয়ে দূরের গ্রামে পাঠিয়ে দেন। এ সময় গোয়েন্দা বিভাগের মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ দেয়। ঘাটাইল থানা থেকে ১০টি নৌকা বোঝাই শত্রু গর্জনার দিকে আসছে। খবর পেয়েই তিনি চারজন সঙ্গী রেখে বাকি যোদ্ধাদের অন্যত্র সরিয়ে দেন। বাড়ী থেকে বের হয়ে দূরবীন দিয়ে দেখেন ছয়টি নৌকা এদিকে আসছে আর ৪টি নৌকা অন্য পথ ধরেছে উদ্দেশ্যে অন্যদিক থেকে গ্রামটা ঘিরে ফেলা। অবস্থা সঙ্কটজনক বিবেচনা করে তিনি বাড়ি থেকে দূরে উচু খড় বনের মধ্যে অবস্থান নেন। তিনি অন্য পথ ধরা শত্রুর নৌকা ৪টির পথ আগলে বসে থাকেন। কিন্তু নৌকাগুলো তাঁর দিকে না এসে বেনুর অবস্থানরত গ্রামের দিকে চলতে থাকলে তিনি অপর নৌকাগুলির অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকেন।
ঐ দিকে বেনু, খোরশেদ আলমকে সঙ্গে নিয়ে তার কোম্পানির যোদ্ধাদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। বেনুর ধারণা হয়েছিল যে, শত্রুরা বাহিনী প্রধানের অবস্থানের উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু বাস্তবে শত্রুরা তাদের অবস্থানের চারদিকে নেমে পাশের বাড়িতে অবস্থান নেয়। বেনু ও খোরশেদ বাড়ির দু’পাশে দুটি দল নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকে। বাড়ির পূর্বপাশে অবস্থানরত খোরশেদ বাড়ির দু’পাশে দুটি দল নিয়ে যুদ্দের জন্য প্রস্তুত থাকে। বাড়ির পূর্বপাশে অবস্থানরত খোরশেদ দেখতে পায় শত্রুরা নৌকা থেকে নেমে পাশের বাড়িতে অবস্থান নিচ্ছে, অমনি তাঁর স্টেনগান গর্জে উঠে। শত্রু সেনারাও গুলি চালায়। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়।
বাড়ির দক্ষিণ পাশের জঙ্গল দিয়ে একজন রাজাকার কয়েকজন খান সেনা নিয়ে সেই বাড়িতে নামে। খোরশেদ ব্রাশ ফায়ার করলে একজন শত্রু সেনা নিহত ও অপর একজন মারাত্মক আহত হয়। বাকী একজন খান সেনাকে জীবন্ত ধরতে গেলে পাশের বাড়িতে অবস্থানরত শত্রু সেনাদের দু’টি গুলি খোরশেদের বাহুও পিঠে একপাশ ভেদ করে চলে যায়।
তুমুল যুদ্ধ চলাকালে কালিহাতি থানা আওয়ামী লীগের সম্পাদক খোন্দরাক নূরুল ইসলাম, কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে তিনখানি নৌকা নিয়ে আহত খোরশেদ আলমের কাছে উপস্থিত হয়। ইতিমধ্যে বেনুর কোম্পানির আছলত, স্মৃতি, মতি, আনিস ওঁ মন্টু অসীম বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শত্রু সেনাদের হটিয়ে দেয়। তারা দু’খানি নৌকা দিয়ে একজন শত্রুসেনার লাশও ১০ জন জখম খান সেনাকে নিয়ে চলে যায়।
বেনু ও খোরশেদের কোম্পানি কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলিত হয়ে স্থান ত্যাগ করার সময় শত্রুরা আবার ৩ ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ শুরু করে। সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আহত খোরশেদকে সাধারণ ব্যান্ডেজ করে সখীপুরে যাত্রা করে।
মুক্তিবাহিনী এই আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণ হলো কাদের সিদ্দিকীকে জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে বলে হানাদার বাহিনী ঘোষণা দিয়েছিল। এই লোভে বি ডি মেম্বার খাসী খাওয়ার ফাঁদ পেতে ঘাটাইলে পাক সেনাদেরে খবর পাঠায়। কিন্ত বি ডি মেম্বারের আশা পুর্ণ হয়নি হানাদাররা ভালো রকম মার খেয়ে পিছু হটে। আর জনসাধারণ বি. ডি মেম্বারকে ধরে তাঁর লোভের চির সম্পাতি ঘটায়।
[৫৯৫] ফিরোজ খায়রুদ্দিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত