কাশিয়াবাড়ী যুদ্ধ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত হোসেন শত্রুবাহিনীর গুলিতে শাহাদৎ বরণ করেন। তিনি চাঁপাই নওয়াবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার বাহাদুরগঞ্জ গ্রামের ঝড় সেখের ছেলে। ঐ দিন বেলা ৩টার সময় কাশিয়াবাড়ী ডিভেন্স থেকে মুক্তিবাহিনীর একটি সাধারণ টহল দল কালপুর ঠাকুরের আম বাগানের উদ্দেশ্যে বের হয়। মুক্তিবাহিনীর ৭/৮ জন সদস্যের এই টহল দলে কমান্ডার ছিলেন সৈয়দ আঃ রাজ্জাক রাজা মিয়া। ইপিআরের নায়েক গিয়াসউদ্দিন ও ল্যান্স নায়েক মনিরও এই দলে ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিন্নাত অত্যন্ত দুঃসাহসী ছিলেন। তিনি টহল দলের অন্যান্য সদস্যদের পজিশনে যেয়ে বলে তাদের পেছনে রেখে শত্রুবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় ৫০ গজ মতো অগ্রবর্তী হন। বীরযোদ্ধা জিন্নাতের কাছে মাত্র ৩টি গ্রেনেড ছিল। তিনি কাশিয়াবাড়ী মসজিদের সামনে রহনপুরগামী রাস্তার দক্ষিণাংশের নীচ দিয়ে বাঁক ঘুরে চলা মাত্রই পাকবাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পর মুহূর্তেই শত্রুরা ব্রাশ ফায়ার করে। তাৎক্ষণাৎ অন্যান্য যোদ্ধারা আমগাছ ও বাড়ীর প্রাচীর ও টাটিবেড়ার আড় হয়ে পজিশনে যান এবং উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। এখানে স্মরণযোগ্য যে, মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য পাকবাহিনী তা আঁচ করতে পারেননি। ফলে নির্ভীক যোদ্ধা জিন্নাত হোসেন শত্রুর উপস্থিতি নির্ণ্যের উদ্দেশ্যে অগ্রগামী হলে তিনি শত্রুর গুলিতে শহীদ হন। বেলা ৩টা থেকে গুলি ছোঁড়াছুড়ি শুরু হয় আর শেষ হয় মাগরিবের পর। গুলি চালাচালির মধ্যে উভয় পক্ষের বাহিনী সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটে এবং তারা আপন ডিফেন্স থেকে এসে যুদ্ধ অংশ নেন। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে কোম্পানি কমান্ডার লেঃ রফিকুল ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনে যান। এদিকে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ওয়ারলেশ মারফত যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে আড়াগাড়া থেকে নৌকাযোগে তাঁর টাইগার বাহিনীর ২০ জন সদস্য নিয়ে কাশিয়াবাড়ী যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করেন। ততক্ষণে উভয় পক্ষের গুলি ছোঁড়া বন্ধ হয়ে গেছে। পাকফৌজ গুলি ছোঁড়া বন্ধ করে নীরব হয়ে যাবার পর তারা ডিফেন্স উইথড্র করে সমবেত হন এবং জিন্নাত হোসেনের নিহত হবার বিষয় সবাই নিশ্চিত হন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা অবহিত হন যে, নরপিশাচ হানাদার বাহিনীর জিন্নাত হোসেনের লাশ নিয়ে গিয়ে বোয়ারিয়ায় নির্যাতন করে অসীম সাহসী বীর সন্তান জিন্নাতকে হারিয়ে মুক্তিবাহিনী ভগ্নমনা অবস্থায় ফিরে আসে কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স। প্রতিরক্ষা ব্যূহতে এসে সাব-সেক্টর কমান্ডার তেজোদীপ্ত বীর সেনানী দুর্ধর্ষ সমর নায়ক ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ জিন্নাতের বদলা নেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসে উঠেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে যাওয়া হানাদার বাহিনীর ওপর তাৎক্ষণিক হামলা চালানোর অভিপ্রায়ে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে তড়িৎ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীর তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন টাইগার বাহিনীর ২০ জন এবং স্থানীয় সাহসী ও চৌকস ২০ জন মোট ৪০ জন যোদ্ধা নিয়ে রাত প্রায় ৮ টার দিকে বোয়ালিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন। হানাদার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে অস্ত্র-শস্ত্র রেখে বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময়ে মুক্তিবাহিনী হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী আকস্মিক মুহূর্তে হামলার দরুন পাকবাহিনী হত-বিহবল হয়ে পড়ে এবং দিশা হারিয়ে ফেলায় হামলা মোকাবিলা করার মতো ওই মুহূর্তে তাদের প্রস্তুতি গ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না। মুক্তবাহিনী খুব দ্রুত পাকফৌজদের ওপর গোলাগুলি ও ভাংচুর করে ফিরে আসে। এই অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর ২ ইঞ্চি মর্টারেরে গোলার আঘাতে পাকফৌজদের বেশ ক’জন হতাহত এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। হতবিহব্বল পাকবাহিনী ডিফেন্স ছেড়ে পিছু হটে যায় এবং আতঙ্কিত অনেকেই নদীর ওপারে নৌকাযোগে পলায়ন করে। সফল অপারেশন শেষ করে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাগণ কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্সে সারারাত কড়া সতর্কবস্থায় থাকেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর অকস্মাৎ হামলায় ক্ষতবিক্ষত শত্রুবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা হামলা চালানোর মতো অবস্থা তাদের ছিল না। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর হানাদার বাহিনীর প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধাদের কঠর সতর্কাবস্থায় থাকায় নির্দেস দিয়ে পরদিন (১ অক্টোবর) সকালে তাঁর গন্তব্যে রওয়ানা হন এবং পাকবাহিনীকে সমুচিত শিক্ষা দেবার অভীপ্সায় বোয়ালিয়া পুনঃআক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য কয়েকদিন পর আসবেন বলে জানান। ২/৩ দিন পর তিনি এই ডিফেন্সে এসে ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় বোয়ালিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সে মোতাবেক সবাইকে যথাযথ নির্দেশনা দিয়ে আড়গাড়া-কলাবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
[৫৮৭] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত