কালিহাতি সেতুর যুদ্ধ, টাঙ্গাইল
কালিহাতির অবস্থান টাঙ্গাইলে মধুপুর সড়কের টাঙ্গাইলে থেকে উত্তর দিকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বে। ’৭১ এর প্রথমদিকে টাঙ্গাইলে এবং ময়মনসিংহে অবস্থান করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। কোয়ার্টার জয়দেবপুর রাজবাড়িতে ছিল এই রেজিমেন্টের হেড। ঢাকা বিগ্রেডের অধীনস্থ বাঙালি এও রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যার ফলে ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্য কোনো সৈন্য দল না থাকায় এলাকার নিয়ন্ত্রণে জন্য নতুনভাবে সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজনে দেখা দেয়। ঢাকা বিগ্রেডের অধীনস্থ এই এলাকায় ৩১ বালূচ রেজিমেন্টকে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই ৩১ বালূচ রেজিমেন্ট প্রথমে টাঙ্গাইল এবং পরবর্তীতে ময়মনসিংহে অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকবাহিনীর একটি সৈন্যদল ঢাকা থেকে জয়দেবপুর হয়ে টাঙ্গাইল শহরে পৌঁছনের লক্ষ্যে যাত্রা করে। পথে একাধিক বেরিকেড পার হওয়ার কারণে সৈন্যদল চলার গতি ঠিকমতো রাখতে পারছিলনা। মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ ৮ এপ্রিল কালিহাতি সেতুর কাছে পাকবাহিনীর এই সৈন্যদলকে বাঁধা দেয়ার পরিকল্পনা করে। এই কালিহাতি সেতুর যুদ্ধই টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ।
৮ এপ্রিল ১৯৭১ টাঙ্গাইলের জননেতা লতিফ সিদ্দিকী বিভিন্ন যুদ্ধে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছেয়ে আসা ইপিআর সদস্যদের একত্রিত করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত করেন। এই সময়ে ইপিআর সৈন্যদলের নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার জিয়াউল হক। দলের মূল লক্ষ্য ছিল কালিহাতি সেতু ধ্বংস করে পাক সৈন্যদলের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা। প্রাথমিক অবস্থায় হাতুড়ি, শাবল দিয়ে চেষ্টা করে সেতুটি ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব না হওয়ায় ভারত থেকে ডিনামাইট অথবা বিস্ফোরক জোগাড়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিস্ফোরক পৌঁছাবার পূর্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেতুর পাশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সেতুর অপর পাড়েও পাকবাহিনীর জোরালো অবস্থান থাকায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সেতু ধ্বংস করার চেষ্টা করে।
একই দিন দুপুরের পরে পাকবাহিনী সেতু অতিক্রম করে সামনের দিকে আসার চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী কয়েকটা রকেট লঞ্চার ও এল এম জির সাহায্যে আক্রমণ শুরু করে। পাকাবাহিনীর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। এই আক্রমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নেশ কয়েকজন সৈনিক ও একজন অফিসার নিহত হয়। চার পাঁচটা গাড়িও বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু পাকবাহিনী ব্যাপক গোলাগুলির মাধ্যমে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এলাকা ছারতে বাধ্য হয়। কালিহাতির এই এগারো জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সাত আট জন আহত হয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন। ইপিআর সুবেদার জিয়াউল হক তাঁর অধীনস্থ সৈনিকদের নিয়ে এই সময় এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহের মুক্তাগছা চলে যান।
[৫৯৫] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত