You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.17 | কামুটিয়া যুদ্ধ, টাঙ্গাইল - সংগ্রামের নোটবুক

কামুটিয়া যুদ্ধ, টাঙ্গাইল

বাসাইল থানাটি টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে পূর্ব-দক্ষিণে এবং সখিপুর ও মির্জাপুর থানার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ১৭ জুন, সকাল আটটা। মুক্তিযোদ্ধারা অন্যত্র যাবার জন্য প্রস্তুত। দু’এক মিনিটের মধ্যেই রওনা হবে। এমন সময় খবর আসে, টাঙ্গাইল থেকে করটিয়া হয়ে একদল পাকিস্তানী সৈন্য বাশাইলের দিকে আসছে। খবর পেয়ে কাদের সিদ্দিকী তার কর্মসূচি বাতিল করে ঐ অবস্থাতেই বাশাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নদীর দিকে ছুটে যান। কামুটিয়া নদীর পাড়ে পূর্ব থেকেই মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। ৩০ জনের একটি দল নিয়ে উর্ধবশ্বাসে ছুটে ত্রিশ-পয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে তিন মাইল অতিক্রম করে নদীর পাড়ে হাজি হয় কাদের সিদ্দিকী। সেখানে যারা ছিল তাদের কাছ থেকে খবরাখবর সংগ্রহ করে যে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পিছিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা, শত্রুর জন্য শিকারীর মতো ওঁৎ পেতে বসে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা কামুটিয়া নর্থখোলা খেয়াপারে পশ্চিমমুখী হয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়।
হাত ট্রিগারে, দৃষ্টি সামনে শত্রুর গতিবিধির উপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৬/৭ জন শত্রু নদীর পাড়ে এসে ডান-বামে দেখতে থাকে। ঘাটে খেয়া না দেখে তারা ডাকাডাকি করে, “ভাইলোগ। তোমলোগ কাহা হো। হামলোগ দুশমন নেহি। দোস্ত হু, কিস্তি লে আও।” এসময় আরো ১০/১৫ জন এগিয়ে আসে। আর বসে থাকা যায় না। শিকার নাগালের মধ্যে বন্দুকের নলের সামনে এসে গেছে। এইতো মোক্ষম সময়। মাত্র ৬০/৭০ মিটার দূরে ওপর পাড়ে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সতের জন পাকিস্তানীর উপর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে গুলি ছোড়া শুরু করে। প্রথম ঝাঁক গুলিতেই চারটি বিশালদেহী শত্রু দানব গড়িয়ে নদীতে পড়ে যায়। ৩ জন নদীর পাড়ে, উঁচু বাঁধের উপর পড়ে থাকে। তাদের কোনো সাড়াশব্দ নেই, নড়াচড়াও নেই। বোঝা যায় দেহে প্রাণ নেই। তবুও আরো কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এবার শত্রুপক্ষ থেকে পাল্টা গুলি শুরু হয়। শত্রুর মেশিনগান দিকবিদিক কাঁপিয়ে বৃষ্টির মতো অবিশ্রান্ত গুলি ছুড়ে চলে। ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চির মর্টার এবং রকে লঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপের বিরাম নেই। গোলাতে চারদিক প্রকম্পিত করে গগন বিদারী আওয়াজ হয়। পাকিস্তানীরা প্রায় আধঘন্টা অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ করে কোনো উত্তর না পেয়ে ভাবে, মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ে পালিয়েছে অথবা নিপাত গেছে। তাই খুশি মনে আবার আস্তে আস্তে দু’একজন করে বাঁধের কাছে এগিয়ে আসে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা মালেকের গুলি তাদের একজনের বক্ষ ভেদ করে যাওয়ার সে উল্টে নদীতে পড়ে। এরকম একটা হতাশাজন বিভ্রান্তিকর অবস্থার মুখে শত্রু সাহস ও শক্তি ফিরে পাবার জন্য চিৎকার করে শ্লোগান তুলে ‘ইয়া আলী’, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মুক্তিযোদ্ধারা ততোধিক জোরে চিৎকার করে আকাশ-বাতাস-মাটি কাঁপিয়ে মুহূর্তেই শ্লোগান তুলে ‘ইয়া আলী’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় মুক্তিবাহিনী’। গ্রামবাসীরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে হিম্মত বাড়ানোর উদ্দেশ্যে শ্লোগানে যোগ দিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলে। তাদের সে কি আনন্দ! কী উল্লাস! মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের তখনকার মিলিত অনুভূতি প্রকাশ করে রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। মুক্তিযোদ্ধাদের শ্লোগান শুনে শত্রুরা চিৎকার করে ওঠে, “শালা কাফের লোগ। শালা লোগ ইয়া আলী ভী বলতা হ্যায়, জয় বাংলা ভী বলতা হ্যায়। এ কিয়া চিজ হ্যায়। এসময় কাদের সিদ্দিকী একটি অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন। মোটামুটি জোরে-জোরে ওয়ারলেসে ম্যাসেজ পাঠানোর মতো কোম্পানিগুলোকে ডান ও বামে শত্রু ঘিরে ফেলতে ম্যাসেজ পাঠাতে থাকেন। যখন ডানের কোম্পানিকে এগিয়ে যেতে বলা হয় তখন শত্রুর বন্দুকের নলও ডানদিকে ঘুরে যায়। আবার বাম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরে যেতে বলতে শত্রু বন্দুকের নলও সেই দিকে ঘোরে। এই যুদ্ধে আবদুস সবুর নদীর পাড়ে প্রায় আধা মাইলব্যাপী একবার ডানে একবার বামে দৌড়াদৌড়ি করে প্রায় তিন ঘন্টা গুলি চালায়। এই আধমাইল এলাক জুড়েই মুক্তিবাহিনী পজিশন নিয়েছে, শত্রুকে এটা বুঝিয়ে দেয়াই ছিল সবুরের উদ্দেশ্য। এ কাজে সবুর পুরোমাত্রায় সফল হয়। সে দুই শত্রুকে গুলি করে বালুচরে ফেলে রেখেছে। এমন সময় জায়গায় দুটি পাকিস্তানী পড়ে আছে যেখান থেকে তা উদ্ধার করা শত্রুর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ তখন মুক্তিবাহিনী অনুকূলে। ৬/৭ সহযোদ্ধা নিয়ে অনেকটা উত্তরে গিয়ে নদীর পাড়ে যান কাদের সিদ্দিকী। নদী পার হওয়ার ঘটনাও অভিনব। পানিতে ডুবিয়ে রাখা ১০/১২ হাত লম্বা একটি ডিঙি নৌকা কয়েকজন যুবক ডাঙায় তুলে কাত করে পানি ফেলে দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। নৌকা ডাঙায় তোলা ও নদীতে ভাসানোর কাজে যুবকদের অত্যন্ত কম সময় লাগে। যুবকেরা যোদ্ধাদের দুই মিনিটে নদী পার করে দেয়। আব্দুস সবুর, সামসু, সাইদুর ও ছানোয়ারকে নিয়ে উর্ধশ্বার্সে কিছু পশ্চিমে এগিয়ে দক্ষিণ দিকে ছোটেন কাদের সিদ্দিকী। শত্রু অবস্থানের ৩০০ মিটারের মধ্যে গিয়ে গুলি ছোড়েন। কিন্তু এ কী! কোনো উত্তর নেই। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দূরবীন দিয়ে খুব ভালোভাবে দেখতে চেষ্টা করা হয়। দেখা যায় পাকিস্তানীরা অনেক দূর পিছিয়ে গেছে। তাদের সর্বশেষ সদস্যটি বাংড়া পর্যন্ত চলে গেছে। শত চেষ্টা করেও পালিয়ে যাওয়া শত্রুর ৩০০ মিটারের বেশী কাছে যেতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির জবাবে তারা একটি গুলিও ছুড়ল না। বাঘে-তাড়া করা হরিণের মতো তারা কামুটিয়ায় একমুহূর্তেও অপেক্ষা না করে হুড়মুড় করে বাসে ট্রাকে উঠে টাঙ্গাইলের দিকে চলে যায়। মোকাদ্দেছ, রঞ্জু, মালেক ও সোহরাব করটিয়ার সাবে জমিদারদের বাড়ি পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে কয়েকটি ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছোড়ে। কাদের সিদ্দিকী তাড়াতাড়ি লোক পাঠিয়ে তাদের গোলাগুলি ছুঁড়তে নিষেধ করে। শত্রু পালিয়ে যাওয়ার পর গোলাগুলি ছোড়ার কোনো মানে হয় না। বরঞ্চ ক্ষতি হতে পারে। মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাক তা মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। তিনবার একইভাবে ঘা খেয়ে শত্রু ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। শত্রুর মনোবল যেমন কিছুটা ভেঙে যায় ঠিক তেমনি মুক্তিবাহিনীর মনোবল অনেকটা বেড়ে যায়। এই যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানী হতাহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনোরূপ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত