You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.14 | কটিয়াদির যুদ্ধ, কিশোরগঞ্জ - সংগ্রামের নোটবুক

কটিয়াদির যুদ্ধ, কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানা ছিল ৭০ উইং রেঞ্জার্স এর অপারেশনাল এলাকায়। পাকবাহিনী তাদের সহযোগী রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের মাধ্যমে কটিয়াদি, মটখোলা, কালিয়াচাপড়া, পাকুনিদ্যা, মনোহরদী, বাজিতপুর, কুলিয়াচর ও গচিহাটাতে একাধিক ঘাঁটি স্থাপন করে। ভৈরব বাজার ও আশুগঞ্জে ছিল পাকবাহিনীর শক্তিশালী অবস্তান। কিশোরগঞ্জ কটিয়াদি এলাকায় রেঞ্জার্স এবং রাজাকারের ব্যাপক চলাচল থাকায় মুক্তিবাহিনীর এই এলাকায় কোনো স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠেনি। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ সীমান্ত অবস্থান থেকে এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করত। জুন মাস নাগাদ এই এলাকায় অবস্থান নিতে চেষ্টা করে। এই সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা হারুন-অর-রশিদ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেন। কাটিয়াদির এ্যামবুশ এই যুদ্ধগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ। ১৪ জুলাই ১৯৭১ কটিয়াদি এলাকায় অবস্থানকারী মুক্তিবাহিনীর দলনায়ক হারুন-অর-রশিদের নিকট পাকবাহিনীর চলাচলের একটি সংবাদ আসে। তথ্য সংগ্রহে জানা যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫টি সৈন্যবাহী লঞ্চ বেলাবো থেকে এসে কটিয়াদিতে অপেক্ষা করছে। ১৫ জুলাই লঞ্চগুলি যুদ্ধাস্ত্র, রসদ ও খাদ্য সামগ্রী নিয়ে পরবর্তীতে ঢাকা অথবা ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। কমান্ডার হারুন-অর-রশিদ এই খবরের উপর ভিত্তি করে কটিতাদি এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটিয়াদি থেকে কিছু দূরে সাগরদী বাজারের নিকট অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে লঞ্চের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সময়ে গ্রুপ কমান্ডার মোশররফ হোসেন কিরণ এর নেতৃত্ব ২০ জন মুক্তিযোদ্ধার আরও একটি দল। খিদিরপুর গ্রাম থেকে অগ্রসর হয়ে সাগরদী বাজারে এসে হারুন-অর-রশিদের দলের সঙ্গে যোগ দেন। কমান্ডার হারুন-অর-রশিদ সাগরদী বাজারের কাছে রামপুরা গ্রামের উত্তর প্রান্তে যেখানে ব্রক্ষপুত্র নদী বাঁক নিয়েছে সেখানে এ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা দলটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে তিনটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের নির্দেশ দেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন প্রথম অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর তৃতীয় এবং শেষ অবস্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না চালায়। এই তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন শেখ হারুন-অর-রশিদের নেতৃত্বধীন মূল দল। ১৫ জুলাই পাকিস্তানী সৈন্যবাহী লঞ্চগুলি যাত্রা না করায় অনেকেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তবুও কমান্ডারের নির্দেশে সকলেই শত্রুর অপেক্ষায় থাকে। ১৬ জুলাই সকালে সংবাদে আসে লঞ্চ পাঁচটি কটিয়াদি থেকে রওনা করেছে। যে কোনো সময় রামপুরা বাঁক অতিক্রম করবে। এই সংবাদে শেখ হারুন-অর-রশিদ তার দলকে পুনরায় নদীর তীরে তিনটি স্থানে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৬ জুলাই সকাল ৮টায় পাকবাহিনী প্রথম দু’টি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর অবস্থানে প্রবেশ করে। দু’টি করে লঞ্চ এক সঙ্গে বাঁধা। সকলে দলনেতার নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকে। দ্বিতীয় জোরা লঞ্চ দু’নম্বর উপদলের সম্মুখে উপস্থিত হলে হঠাৎ করে এই দলের মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উত্তেজিত হয় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে লঞ্চের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে সকল মুক্তিযোদ্ধা লঞ্চের উপর গুলি চালাতে থাকে। ততক্ষণে প্রথম দিকের চারটি লঞ্চ অর্থাৎ দুজোড়া লঞ্চ মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশ সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এবং এই ৪টি লঞ্চই আক্রান্ত হয়েছে। পিছনের লঞ্চটি সম্মুখের লঞ্চগুলি আক্রান্ত হয়েছে দেখে আর সম্মুখে না এগিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যেয়ে রামপুর বাজারের নিকট নদীর পশ্চিম তীরে সৈনিকদের নামিয়ে দেয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী লঞ্চের ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে পূর্বেই মজবুতভাবে একাধিক বাঙ্কার তৈরি করে রেখেছিল। সেই অবস্থান থেকে পাকবাহিনী এল এম জি দিয়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। একই সঙ্গে পিছনে স্থলপথে নেমে আসা পাক সৈন্যরাও মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে চালাতে অগ্রসর হতে থাকে। দলনেতা হারুন বুঝতে পারে এই অবস্থায় পাকবাহিনীর সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তিনি তার নিজের দলের এলএমজির ফায়ারিং কভারে তিনটি দলকেই প্রত্যাহার করে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। কমান্ডার হারুন কটিয়াদির যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে নিজদলসহ সাগরদী বাজার পার হয়ে চালাকের চরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আসেন।
[১৬] এ.এস.এম. শামসুল আরেফিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত