কটিয়াদি অপারেশন, নরসিংদী
ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ ভূঁইয়া মার্চের পরবর্তী দিনগুলোতে শিবপুর রণাঙ্গনের সাথে অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক নেতৃবৃন্দের মতোই যোগসূত্র স্থাপন করেন। তিনি মান্নান ভূঁইয়ার সাথে শিবপুরে অনেক দিন অবস্থান করেন। তিনি সে সময় জানাতে পারেন যে, তার নিজের এলাকা কটিয়াদীতে মুক্তিযোদ্ধবিরোধী শক্তি এবং ডাকাত বাহিনী জনগণের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালচ্ছে। তিনি এ বিষয়ে মান্নান ভূঁইয়ার সহায়তা প্রার্থনা করেন। সিদ্ধান্ত হয় দূর্বৃত্তের দমনে একটি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা দল মাহফুজ ভূঁইয়ার সাথে ওই অঞ্চলে যাবে। সে অনুযায়ী ১০ জনের একটি দুর্ধর্ষ দল গঠন করা হয়। মজনু মৃধার নেতৃত্বে এই দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন-মজিবুর রহমান, কনক খান, হযরত আলী, আবদুল কাদির প্রমুখ। বেলাব থেকে নৌকায় চড়ে, ডুমারকান্দি হয়ে কাটিয়াদী পৌঁছে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে গইচ্ছাহাটি স্টেশন হয়ে পুনরায় নৌকাযোগে নিকলী, অতঃপর নীলগঞ্জ স্টেশনের কাছে মাহফুজ ভূঁইয়ার বাড়িতে দলটি গোপন অবস্থা নেয়। সে সময় ওই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে একটি সশস্ত্র ডাকাতদল যথেষ্ট লুটপাট চালিয়ে আসছিল। এই বাহিনীর নেতা ছিল কুখ্যাত রহমান ডাকাত। একদিকে এই ডাকাত দলের অত্যাচার, অন্যদিকে হায়েনা পাকবাহিনী ও তার স্থানীয় দোসরদের সন্ত্রাস-এর ফলে জনসাধারণের এক অসহনীয় অবস্থা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য মাহফুজ ভূঁইয়া ব্যস্থ হয়ে দোসরদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী রহমান ডাকাতের বাড়ি আক্রমণের জন্য ছদ্মবেশে অবস্থান নেয়া হয়। সে অনুযায়ী রহমান ডাকাতের বাড়ি আক্রমণের জন্য ছদ্মবেশে অবস্থান নেয়া হয়। কিন্তু সে বাড়িটি সার্বক্ষণিক পাহারাধীন থাকত। এ অবস্থায় বাড়ির কাছাকাছি হলে পাহারাদার বাহিনী সন্দেহ করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। প্রত্যুত্তরে মুজিবুরের এলএমজি থেকে ব্রাশফায়ার হয়। এভাবে অনেকক্ষণ ধরে গোলাগুলির পর ডাকাত দল পরাভূত হয়। এতে তাদের ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়, বাকিরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে। স্বয়ং রহমান ডাকাত ধরা পড়ে। কিন্তু এদের মধ্যে বেলালের কুখ্যাত বাশার ডাকাত কোনোক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। রহমান ডাকাতকে ধরার পরে গ্রামবাসীর সে কি উল্লাস। তার বাড়ির সকল মালামাল ক্রোক করা হয় এবং জনসাধারণকে তাদের থেকে লুট করা মাল প্রমাণসাপেক্ষে ফেরত নেয়ার আহবান জানানো হয়। তার নিজের এবং আর বোনের বাড়ি থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। অতঃপর প্রকাশ্য বিচারে জনসাধারণের রাতে এই কুখ্যাত ডাকাতকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই অপারেশনের ফলে স্থানীয় জনগণের মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আস্থা প্রগাঢ় হয়। এই থানাটিকে কেন্দ্র করে পাক হানাদআর বাহিনীর দোসররা জনসাধারণের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছিল। রাজাকার আর শান্তি কমিটির তথাকথিত সদস্যরা গ্রামের যুবতী মেয়েদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে খানসেনাদের উপঢৌকন দিত। গ্রামের গৃহস্থের খাসি,মুরগি নিয়ে তাদের সরবরাহ করত। এছাড়া এরা স্থানীয় একজন প্রকৌশলী/ ডাক্তারকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এসব কারণে স্থানীয় জনসাধারণের অনুরোধে এই ‘জুলুম কেন্দ্রটি’ অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিকল্পনামাফিক ভোররাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে অমিত তেজে লড়াই করে দশজনের এই দল ৫০-৬০ জনের শত্রু পক্ষকে পরাস্ত করে। শত্রুপক্ষ ভীতসস্ত্রস্ত পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এর ফলে প্রায় ৫০-৬০ রাইফেল মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। এরপর এই দুটো অপারেশন শেষে এই দলটি শিবপুর ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু ফিরে আসার পূর্বে মাহফুজ ভূঁইয়ার সাথে আলোচনাক্রমে স্থানীয়ভাবে একটি মুক্তিযোদ্ধাদল গঠনের ব্যবস্থা করা হয় এবং সে উদ্দেশ্যে ১০টি রাইফেল রেখে আসা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, মাহফুজ ভূঁইয়া স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কমরেড তোয়াহার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দলের সাথে সম্পৃক্ত হন।
[১২৭] সিরাজ উদ্দীন সাথী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত