কপিলমুনির যুদ্ধ, খুলনা
ডিসেম্বর খুলনা বিজয়ের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত যুদ্ধসমূহের মধ্যে কপিলমুনির যুদ্ধ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কপিলমুনির রাজাকারদের বিরুদ্ধে খুলনার বি,এল,এফ ও নৌ-কমান্ডোর যৌথ বাহিনী এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা অঞ্চলের নো-কমান্ডো প্রধান লেফটেন্যান্ট গাজী রহমত উল্লাহ দাদু ও সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মোঃ ইউনুস আলী ইনু। কপিলামুনিতে রাজাকারদের নেতৃত্বে ছিল হাজী নেছার আলী, শেখ মতিউর রহমান, আ. গণি মোড়লসহ স্থানীয় মুসলিম লীগ ও জামায়তে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ। খুলনা শহরে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাইকগাছা থানার ১২ কিলোমিটার উত্তরে কপোতাক্ষ নদের পূর্ব তীরে কপিলমুনি বাজার অবস্থিত। এ বাজারের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাজারের রূপকার হিসেবে খ্যাত রায় সাহেব বিনোদ বিহারি সাধুর পৈতৃক বাড়ি বিনোদ ভবন। এর পশ্চিমে পাশে কপোতাক্ষ নদ ও পূর্ব পাশে খুলনা-পাইকগাছা সড়ক অবস্থিত। দ্বিতল এই বিনোদ ভবন চতুর্দিকে ১২ ফুট উঁচু ও ৩ ফুট প্রশস্ত প্রাচীর এবং মূল ফটক কলাপসিবল গেট দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। এর মূল ভবন থেকে চারদিকের সীমানা প্রাচীরের দূরত্ব ১০ ফুট থেকে ২০ ফুট। বহুকক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটির দোতলার পূর্ব ও পশ্চিম পাশে রয়েছে প্রশস্ত খোলা ছাদ ও দক্ষিণ পাশে একটি বারান্দা। এ বাড়িতেই স্থাপিত হয় রাজাকারদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের মার্চের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সমগ্র খুলনা পাকিস্তানী বাহিনী ও তাঁদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার
পর কপিলমুনিতে গঠিত হয় পিস কমিটি। পাইকগাছা পিস কমিটির সেক্রেটারি আ. গনি মোড়লের বাড়ি ছিল কপিলমুনিতে। পিস কমিটির সদস্যরা তার নেতৃত্বে এই বাজারের হিন্দুদের বাড়ি ঘর ও দোকান-পাট লুট করে নিয়ে যেতে থাকে। ফলে স্থানীয় হিন্দুরা বাড়ি ঘর ও দোকান-পাট লুট করে নিয়ে যেতে থাকে। ফলে স্থানীয় হিন্দুরা বসত বাড়ি ছেড়ে মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে সহায়সম্বলহীনভাবে ভারতে পাড়ি জমাতে শুরু করে। তাদের অত্যাচারের কথা শুনে তালার মুক্তিযোদ্ধারা এক রাতে কপিলমুনিতে মফেজ মল্লক নামক এক লুটেরা নেতাকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে হত্যা করে। স্থানীয় ব্যাক্তিরাও পিস কমিটির বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। এ সময় ভারতগামী ১১ জন ছাত্র খাদ্য ক্রয় করতে কপিলমুনি বাজারে এলে কপিলমুনি পিস কমিটির লোকেরা তাদেরকে নিয়ে খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পরে তাদেরকে গল্লামারীতে নিয়ে হত্যা করা হয়। এতে কপিলমুনিসহ সমগ্র পাইকগাছায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পিস কমিটির লোকজন আত্মরক্ষার জন্য এখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। এতে পিস কমিটির নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দেড় শতাধিক রাজাকার নিয়ে এসে বিনোদ ভবনে অবস্থানরত বিনোদ বিহারি সাধুর ভাই নিকুঞ্জ বিহারি সাধুকে বের করে দিয়ে সেখানে রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার তারিখ নিয়ে মতদ্বৈততা থাকলেও সমসাময়িক অন্যান্য ঘটনার প্রেক্ষিতে মনে হয় জুন মাসের শেষ নাগাদ এ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতল বিনোদ ভবনের উপর দু পাশের বাড়িতে ছাদ ও দক্ষিণের বারান্দায় রাজাকাররা বাঙ্কার স্থাপন করে। এর চারপাশে কোনো উঁচু বাড়ি-ঘর কিংবা গাছ-পালা না থাকায় এখান থেকে চারদিকে অনেক দূর পর্যন্ত নজর রাখা সম্ভব ছিল। এছাড়া নিচে সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন মাটিতে ৫-টি বাঙ্কার ও বাড়ির খোলা জায়গায় বিরাট বিরাট গর্ত খনন করে মাটির নিচে তাঁদের আশ্রয়স্থল তৈরি করে। এভাবে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য রাজাকার বাহিনী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। ফলে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পটি একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়। এ ক্যাম্প দখলের পর লে. গাজী রহমত উল্লাহ দাদু এ ক্যাম্পটি ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের চেয়ে সুরক্ষিত বলে মন্তব্য করেন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত