একাত্তরের ২৬শে মার্চ, চট্টগ্রাম
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
২৬ মার্চ, ১৯৭১। ওই দিনটি আমার কেমনভাবে কেটেছিল সেই স্মৃতি কথাই বলতে চাই। আমার বয়স তখন ২৫ বছর। সেনাবাহিনী তে তরুণ ক্যাপ্টেন। পোস্টিং চট্টগ্রামের ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে। সদ্যবিবাহিত ক্যান্টনমেন্টের ভেতর বাসা না পাওয়ার থাকাতে হতো শেরশাহ কলোনির একটি সরকারি ভাড়া করা বাড়িতে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোন কারণ ছাড়াই পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণায় ফুঁসে ওঠে বাঙালী জাতি। ১৯৭১- এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ইয়াহিয়া নানা টালবাহানা শুরু করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মারচ্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেশের শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি আমাদেরকে পাকিস্তানীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে প্রভাবিত করেছিল। ওই সময়ে সারা দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমরাও ছিলাম সমানভাবে উদ্বিগ্ন। ২৫ মার্চ দিনের বেলা অফিসে বসে আমরা বাঙালী অফিসাররা নানা জল্পনা-কল্পনা ও ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে কাটাই। কি হবে, কি হতে যাচ্ছে-এ নিয়ে সবার মধ্যে একটা অবিশ্বাস ও আতঙ্কের ভাব। এ রকম থমথমে অবস্থার মধ্যেও সেদিন রাত আটটার দিকে আবার ক্যান্টনমেন্টে গেলাম। চারদিকের পরিস্থিতির জন্য মন ছটফট করছিল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উদ্বেগ কেব বেড়েই যাচ্ছিল। সে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছিল কৌতূহলও। এক পর্যায়ে মেজর বেগের (পাঞ্জাবী অফিসার)। ঢুকেই তিনি দু’শত রিক্রুটকে বিনা রাইফেলে টহলদানের জন্য দু’জন সুবেদারকে নির্দেশ দেন। একজন সুবাদার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে-স্যার, রাইফেল ছাড়া টহল দেয়া কি করে সম্ভব? জনসাধারণের সঙ্গে যে কোন সময়ে সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে। উত্তরে ‘রাইফেল নিয়ে টহল দিলে জনসাধারণের মনে অহেতুক উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে’- এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে লে. কর্নেল ওসমানী বেরিয়ে গেলেন। আমরা চুপচাপ বসে রইলাম। রাত ৯টা। মানে নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে বাসায় ফিরছি। সারা দিনের ঘটনা ও আলাপ-আলোচনা কেবলই মাথায় এসে ভিড় করতে লাগল। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পথে একজন সুবেদারের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি জানালেন, সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের জওয়ানদের সব রাইফেল অস্ত্রগারে জমা নেয়া হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো সুবেদার প্রশ্ন করল- স্যার আমাদের ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি ডিউটি কি শেষ হয়ে গেল? আমাদের কি আর অস্ত্রের প্রয়োজন নেই? (উল্লেখ্য, রাইফেলের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। যা ছিল তাও মান্ধাতার আমলের ৩০৩। সে সময়ে সাধারণত টেনিং ইন্সটিটিউশনগুলোতে এ ধরনের অস্ত্রই ব্যবহৃত হতো)। একটা গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস পেলেও আমাদের জওয়ানদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে বললাম, অর্ডার মাফিক কাজ তো করতেই হবে। মুখে এ কথ বললেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এর মূলে নিশ্চয়ই কোন ষড়যন্ত্র আছে। তা আঁচ করতে পারলেও আমি ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিতে পারিনি। এর পেছনেও কারণ ছিল সেনাবাহিনীর ব্যাপারটিকে তেমন গুরুত্ব দিতে পারিনি। এর পেছেনও কারণ ছিল। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার নিরিখে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মান ছিল অত্যন্ত উঁচু। সেই সেনাবাহিনীর অফিসার বৈধ আদেশ মেনে চলবে-এটাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রমই অস্বাভাবিক। ধরুন, আমরা সেই অস্বাভাবিক অবস্থার একটা কিছু করলাম এবং তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল, তাহলে যারা অংশ নিলেন, মিলিটারি বিচার অনুযায়ী তাদের ভাগ্যে কি জুটত? ইতিহাসে বিদ্রোহ করার অপরাধে সামরিক বাহিনীর লোকদের ফায়ারিং স্কোয়ার্ডের সামনে যেতে হয়েছে বহুবার। তাছাড়া আমরা যখন এক সঙ্গে চাকুরী করতাম, তখন স্বাভাবিকভাবেই একে-অন্যের সঙ্গে ভাইয়ের মতো আচরণ করতাম। ভাই হয়ে কেউ কখনও ভাইকে হত্যা করতে পারে- সে চিন্তাও মাথায় আসেনি। সেই বিশ্বাসটুকু আঁকড়ে ধরেই সে রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ২৫ মার্চ রাত ১টা। ২০ নং ‘বেলুচ রেজিমেন্টের ছয় ট্রাক সৈন্য প্রথমেই আঘাত হা রেজিমেন্টাল সেন্টারের অস্ত্রগারে। সেখানে প্রহরারত বাঙালী সৈনিকদের হত্যা করে ছুটে যায় রিক্রুট ব্যারাকের দিকে। তারপর রিক্রুট ব্যারাক ঘিরে পজিশন নিয়ে শুরু করে সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রিক্রুট ব্যারাকের প্রতিটি কক্ষ ঝাঁঝরা করে দেয়া হল বুলেট। ঘুম ভাঙ্গার আগেই মৃত্যুবরণ করল অধিকাংশ বাঙালী সৈনিক। রেজিমেন্টাল সেন্টারের যে পআকা গ্রাউন্ড মুখরিত হতো রিক্রুটের পায়ের আওয়াজে, সেখানে টেনেহিচড়ে স্তুপ করা হল তাদেরই ক্ষত-বিক্ষত লাশ। সে রাতেই তাঁরা হত্যা করেছিল আমাদের লে. কর্নেল এমআর চৌধুরী এবং লে. কর্নেল বিএ চৌধুরীকে। আগেই বলেছি, আমি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে থাকতাম। তাই তাদের এই অতর্কিত আক্রমণের খবরও জানতাম না। অন্য দিনের মতো ভোরে পিটিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় আমার ব্যাচম্যান খলিল খবর নিয়ে আসল, সে ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে পারেনি। বায়েজিদ বোস্তামী রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে খবর পেয়েছে, ক্যান্টমেন্ট এখন ২০ নং বেলুচ রেজিমেন্টের দখলে। এ অবস্থায় আমার কি করা উচিত, কি করণীয়, কিছুই কূল-কিনারা করতে পারছিলামন না। এমন সময় দরজায় করাঘাত। চমকে উঠলাম। এই বুঝি পাঞ্জাবীরা এসে গেল। ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল খলিল। আমিও আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। যে কোন মুহূর্তে ওরা দরজার ওপাশ থেকে গুলি করে বসতে পারে। তাই দরজা খুলে দাঁড়ালাম। দেখি আমরাই অধীনস্থ একজন হাবিলদার হাঁপাচ্ছে। তার সারা শরীর রক্তে মাখা। খুনিগুলোর পরিবর্তে তাকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। সে চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল-ওরা সব বাঙালী সৈন্যদের মেরে ফেলেছে, স্যার। ক্যান্টনমেন্ট আমাদের রকে ভাসছে। হাবিলদারের বিবরণ শুনে সেই মুহূর্তেই মনে মনে ঠিক করলাম, এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে। অন্য বাঙালী অফিসারদের নিতে হবে। ঘর ছেরে বেরিয়ে পড়ার আগে অন্য বাঙালী অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সমীচীন মনে করলাম। পাশের বাসা থেকে ৮ নং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে টেলিফোন করলাম। উদ্দেশ ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করা। কিন্তু মেজর জিয়াকে পেলাম না। ৮ নং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সৈনিক জানাল মেজর জিয়া সেখানে নেই। মনে তখন প্রতিশোধের আগুন। সময় খুব কম। পাকিস্তানী সৈন্যরা হয়তো আমাকে বন্দী করার জন্য এগিয়ে আসছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতায় আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, এ স্থানে তোমার আমার জন্য আদৌ নিরাপদ নয়। তুমি আপাতত কোন বাঙালীর বাসায় গিয়ে লুকিয়ে থাক। তারপর সুযোগ মতো নিরাপদ স্থানে চলে যেও। আমি আসি। আমার স্ত্রী কিছু না বলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমি আবেকজড়িত কন্ঠে বললাম, আমাদের এ দেখাই হয়তো শেষ দেখা। আমি সন্ধ্যায় মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করব। আমার কণ্ঠ যদি তুমি আর সরাসরি নাও শুনতে পাও, তবে এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি যদি বেঁচে থাকি তাহলে তুমি অবশ্যই আমার সংবাদ পাবে। সে বলল, তুমি সফল হও এই দোয়াই করি। তার কথা শেষ হতেই ‘খোদা হাফেজ’ বলে আমি ও খলিল ৮ নং ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেণ্টে গিয়ে পৌছালাম। ওই রেজিমেণ্টের প্রায় সবাই ছিল বাঙালী সৈনিক। তাই বুকভরা আশা ছিল। কিন্তু কারও সঙ্গেই দেখা হল না। এ রকম সংকটময় মুহূর্তে কি করা যায়-কিছুই ভেবে পাচ্ছিলয়াম না। কিন্তু কোথায় আছে- ‘ডুবন্ত মানুষ শেষ চেষ্টা হিসাবে খড়কুটো ধরে রক্ষা পেয়ে চায়, ‘আমরাও তখন সেই অবস্থা। সে রকম চেষ্টা হিসেবে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের সাহায্য নেয়ার কথা মনে পড়ল। পায়ে হেঁটে প্রায় দেড় ঘন্টা পরে পুলিশ সুপারের অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম। তাকে অফিসেই পাওয়া গেল। বলললাম, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিয়েছে। আমাকে বলল আপনি পুলিশ বাহিনী দিয়ে সাহায্য করুন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া! পুলিশ সুপার অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, শুধু পুলিশ দিয়ে আপনি কি করবেন? পুলিশ বাহিনী দিয়ে কি ক্যান্টনমেন্টে উদ্ধার করা সম্ভব? তাছাড়া আমি এভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারছি না। আপনি বরং এ ব্যাপারে ডিআইজির সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। পুলিশ সুপারের কথা আমি আশা ছাড়লাম না। পাশেই ডিআইজির অফিস। তার সঙ্গেও দেখা করলাম। আমার কথা শুনে ডিআইজি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, এতবড় বাহিনীর সঙ্গে আপনি কি পেরে উঠবেন? পুলিশ সুপার এবং ডিআইজির কাছ থেকে সারা না পেয়ে অগত্যা আমি ডিসিকেই টেলিফোন করলাম। ফোনে অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর অবশেষে তিনি সাহায্য করতে সম্মত হলেন। আমাকে সাহায্য করার জন্য তিনি পুলিশ সুপারকে বলে দিলেন। পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলার সময় নায়েব সুবেদার মফিজের টেলিফোন পেলাম। তিনি জানালেন, ৭০ জন সৈনিকসহ তিনি পাহাড়তলি পুলিশ রিজার্ভ ক্যাম্পে আছেন। তবে এঁদের অনেকের কাছেই হাতিয়ার নেই। বেলা দশটার দিকে পুলিশ সুপারের কাছ থেকে ৫০টি রাইফেল এবং এক হাজার রাউন্ড গুলি নিয়ে বেলা ১১ টায় পৌঁছলাম পাহাড়তলি পুলিশ ফাঁড়িতে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ৭০ জন সৈন্য এবং এক হাজার রাউন্ড গুলি ছিল নেহায়েতই সামান্য। তাই আরও সৈন্য সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগে ক্যান্টনমেন্ট পুনরুদ্ধার করতেই হবে। তাই সবাইকে সেখানে রেখে আমি হালিশহর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে যাওয়ার পথে শুনলাম, কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দিকে পাকিস্তানীদের একটি ব্যাটালিয়ন এগিয়ে আসছে। ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে অ্যামুনেশন নিয়ে আবার ফিরে এলাম পাহাড়তলির পুলিশ রিজার্ভ ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে আবার একটা ইপিআর প্লাটুনকে পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে নিশ্চিত হওয়া গেল, কুমিল্লা থেকে ২৪ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের দিকে আসছে। ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যার আগেই ক্যান্টনমেন্ট দখল করব। কিন্তু শত্রুর শক্তি বৃদ্ধির জন্য কুমিল্লা থেকে যে ২৪ নং এফএফ রেজিমেন্ট এগিয়ে আসছে, তাকে প্রতিরোধ করাই তখন প্রধান কর্বত্য হতে দাঁড়াল। তখন বিকেল ৫টা। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরের মোট ১০২ জন যোদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত সেনাদল নিয়ে অভিযানে বের হলাম। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি হেভি মেশিনগান, কয়েকটা লাইট মেশিনগান, বাকি সব রাইফেল। শত্রুর মোকাবিলায় অগ্রসর হওয়ার আগে সাধারণ সৈনিকদের উদ্দেশ্যে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা বলা প্রয়োজন মনে করলাম। একটা খোলা ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললাম বাঙালী ভাইয়েরা, জাতি আজ এক মহাপরীক্ষার সম্মুখীন। ইয়াহিয়া সরকারের লেলিয়ে দেয়া পশ্চিমা সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে আমাদের ক্যান্টনমেন্ট দখল করে নিয়েছে। তারা আমাদের সৈনিকদের মেরে ফেলেছে। এ এক চরম বিশ্বাসঘতকতা। এতদিন আমরা তাদের ভাই বলে মনে করেছিলাম। কিন্তু তারা আজ আমাদের বুকে আঘাত হেনে সেই বিশ্বাসকে ধূলায় লুটিয়ে দিয়েছে। আজ থেকে আমরা আর বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী নাই। আজ আমরা স্বাধীন। বাংলার অন্যযায়গায় কি ঘটছে আমরা তা জানি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যেসব বাঙালী পশ্চিমাদের হাত থেকে বেঁচে থাকবে, তারা অবশ্যই এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যোগ দেবে। মনে রাখবেন, আমরা এই যুদ্ধে জয়ী না হলে তারা আমাদের দাসে পরিনণত করবে। আমাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাবে। ধন-সম্পদ লুট করবে। বাড়ি-ঘর,গ্রাম জনপদ সব জালিয়ে-পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেবে, মা-বোনদের ইজ্জত লুট করবে ইত্যাদি। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা। আমারা কুমিরায় পৌছালাম। শত্রুকে বাধা দেয়ার জন্য জায়গাটা উপযুক্ত মনে হল। পথের ডানে পাহাড়, বামে কিছু দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা, মধ্যে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। এলাকাটি দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যামবুশের পরিকল্পনা তৈরি করলাম। ১নং প্লাটুন ডানে, ২নং প্লাটুন বামে এবং ৩নং প্লাটুন আমার সঙ্গেই রাখলাম। খুব তাড়াতাড়ি আমরা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো করে পজিশন নিলাম। গ্রামের লোকজনের সহযোগিতায় গাছের একটা বিরাট ডাল কেটে রাস্তার মাঝখানে ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করলাম। শত্রুর জন্য ওৎ পেতে রইলাম। সন্ধ্যা তখন সোয়া সাতটা। শত্রুবাহিনী ওখানে পৌঁছে গেল। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড পরিষ্কার করতে ব্যস্ত, তখন আমি প্রথম ফায়ার করলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডান দিকের ভারী মেশিনগানটিও গর্জে উঠল। শুরু হল শত্রু নিধন পালা। চারদিক থেকে কেবল গুলি আর গুলি। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল ট্রেসার রাউন্ড বের হচ্ছে। আমাদের আকস্মিক আক্রমণে ওরা তখন হতচকিত। ওদের সামনের কাতারের অনেকই আমাদের গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পেছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার ও আর্টিলারি থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে দিল। এভাবে চলল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও শত্রুপক্ষ আমাদের ব্যুহ ভেদ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাক আগুন ধরে গেল। প্রায় ২ ঘন্টা প্রাণপণ লড়েও তারা শেষ পর্যন্ত হটতে বাধ্য হল। এই যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল শাহপুর খান ও একজন লেফটেন্যন্টসহ বিভিন্ন পদের ১৫২ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। আমরা শত্রুদের দু’ট্রাক অ্যামুনেশন কজা করি। আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামী ১৪ জন বীর সৈনিক শাহাদৎ বরণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কুমিরার লড়াইটি ছিল প্রথম ও মুখোমুখি মারাত্মক। সংঘর্ষ। শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে এভাবেই কেটেছিল ১৯৭১-এর ২৬ শে মার্চের সেই দিনটি। এ রকম অনিশ্চিয়তা, কিন্তু একই সঙ্গে গভীর প্রতিজ্ঞা এবং আত্মবিশ্বাস ছিল আমাদের সবার মধ্যে। সেদিন আমরা জানতাম না কি অপেক্ষা করছে আমাদের ভাগ্যে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই জানতাম কি করতে হবে আমাদেরকে।
[৫৮৭] মোঃ রবিউল ইসলাম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত