You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.20 | ডুমুরিয়া হাই স্কুল গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

ডুমুরিয়া হাই স্কুল গণহত্যা (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

১৯৭১ সালে ডুমুরিয়া সদরের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে ভদ্রা নামক একটি খরস্রোতা নদী ছিল। দীর্ঘদিন নদীটি মৃত ছিল। সম্প্রতি (২০১৮) খননের মাধ্যমে নদীটি আবার সচল হয়েছে। ডুমুরিয়া সদরের এনজিসি এন্ড এনসিকে হাই স্কুলটির ঠিক পশ্চিম পাশ ঘেঁষে ভদ্রা নদীটি প্রবাহিত ছিল। স্কুল সংলগ্ন এই নদীর চরে স্থানীয় রাজাকাররা একটি গণহত্যা ঘটায়।
ডুমুরিয়া থানা ভবনের পূর্ব পাশে ছিল এনজিসি এন্ড এনসিকে হাই স্কুলের ছাত্রাবাস। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই ছাত্রাবাসটি স্থানীয় রাজাকাররা দখলে নিয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। ডুমুরিয়ার রাজাকারদের আরেকটি ক্যাম্প ছিল থানা ভবনের পশ্চিম পাশে জনৈক মজিদ মোল্লার বাড়ি সংলগ্ন একটি ভবনে। এই ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ছিল ভদ্রা নদী এবং ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে ছিল শোভনা ইউনিয়নের চিংড়া গ্রাম। ডুমুরিয়া সদর এলাকায় রাজাকারদের প্রভাব থাকলেও চিংড়া গ্রাম তথা শোভনা ইউনিয়ন ছিল মজিদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।২২২ এই বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।
৫ সেপ্টেম্বর তারিখে মজিদ বাহিনী শোভনা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ঝিলা নদীতে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের একটি সশস্ত্র লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে পাকিস্তান বাহিনী শোভনা এলাকায় অভিযান জোরদার করে। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে শোভনা ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী নদীতে চারটি লঞ্চ ও গানবোটে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী টহল দেওয়া শুরু করেছিল। এর পাশাপাশি রাজাকাররা শোভনা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় মজিদ বাহিনীর যোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা করতে থাকে। চিংড়া গ্রাম ডুমুরিয়া সদরের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এই গ্রামে রাজাকাররাও তৎপর হয়ে ওঠে।২২৩
১০ সেপ্টেম্বর তারিখে পাকিস্তানি বাহিনী শোভনা গ্রামে নেমে ব্যাপক গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগ করে। এই ঘটনায় এলাকায় বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মজিদ বাহিনী তখন এলাকা ছেড়ে কিছুদিনের জন্য পার্শ্ববর্তী মাগুরখালী ইউনিয়ন ও অন্যান্য এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই বাহিনীর অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন চিংড়া গ্রামের শেখ আমজাদ হোসেন। চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা তাঁর কাছে গিয়ে করণীয় জানতে চায়। এই সময়ে ডুমুরিয়ার রাজাকাররাও চিংড়ার অধিবাসীদের আশ্বাস দিয়েছিল যে, তারা গ্রামে আক্রমণ করবে না। তবে মজিদ বাহিনীর কেউ গ্রামে থাকলে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমজাদ হোসেনও সম্মতি দিয়ে বলেন যে, কেউ কাউকে আর আক্রমণ করবে না, এই প্রস্তাবে সম্মত হলে চিংড়া গ্রামের অধিবাসীরা রাজাকারদের প্রস্তাব মেনে নিবে।
পরদিন সকালে ডুমুরিয়া সদরের রাজাকাররা নৌকায় পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে নদী পার হয়ে চিংড়া গ্রামে হাজির হয়। আগেরদিন পরস্পরকে আক্রমণ না করার ব্যাপারে সমঝোতা হওয়ায় ঐ গ্রামের মজিদ বাহিনীর সক্রিয় সদস্য মোহর আলী ফকির, আবদুল গফুর, জফর আলী প্রমুখ গ্রামেই ছিলেন। রাজাকাররা গ্রামে এসে সকলকে উত্তর চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই খবর পেয়ে গ্রামের অনেক অধিবাসী সেখানে উপস্থিত হয়। তারা ভেবেছিল, রাজাকাররা হয়তো গ্রামবাসীদের কোনো নির্দেশনা দিতে চায়।
চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পরে রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে গ্রামবাসীদের মধ্যে প্রায় বিশ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। পরে তাঁদেরকে নৌকায় করে নদী পার করিয়ে থানা সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে সপ্তাহ খানেক রেখে তাঁদের উপর ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে রাজাকাররা নির্যাতন করে ছেড়ে দিয়েছিল। শেষপর্যন্ত সাত জন তাদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। এঁরা হলেন চিংড়া গ্রামের মোহর আলী ফকির, আবদুর রহিম জোদ্দার, আবদুল গফুর জোদ্দার, সফেদ আলী সরদার, আবদুল গাজী, জফর আলী শেখ ও শিবপুর গ্রামের হারান ঋষি। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে রাজাকাররা এঁদের স্কুলের পশ্চিম পাশে নদীর চরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।২২৪ ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যায়। মুমূর্ষু অবস্থায় আবদুর রহিম ও আবদুল গাজী কোনোরকমে নদীতে ভাসতে ভাসতে চিংড়া গ্রামে পৌঁছায়। পরের দিনই এই খবর রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে রাজাকাররা আবদুর রহিমকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর আহত আবদুল গাজী বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মারা যান।
……………………………………………………
২২২. শেখ আবদুল মজিদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এর খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক। এই দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু শেখ মজিদ তাঁর পার্টির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। ডুমুরিয়া উপজেলায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মজিদ বাহিনী অনেকগুলো সফল অভিযান করে৷
২২৩. ডুমুরিয়ার রাজাকারদের মধ্যে আকব্বর শেখ, ইউসুফ (ইছো) মুন্সী, আতিয়ার শেখ প্রমুখের নাম জানা যায়। সাক্ষাৎকার, রমেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী (রংপুর, ডুমুরিয়া, খুলনা), ১৫ এপ্রিল ২০১৫।
২২৪. সাক্ষাৎকার, শেখ আমজাদ হোসেন (চিংড়া, ডুমুরিয়া), ৩০ এপ্রিল ২০১৫।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার