You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06 | গল্লামারী গণহত্যা (জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯৭১) | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

গল্লামারী গণহত্যা (জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯৭১)

গল্লামারী গণহত্যার প্রেক্ষাপট ফরেস্টঘাট গণহত্যারই অনুরূপ। এপ্রিল ও মে মাসে ফরেস্ট ঘাটে গণহত্যার ফলে প্রায়ই ভৈরব নদীতে প্রচুর মৃতদেহ ভাসতে দেখা যেতো। ফলে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়াতো। মার্চের পর এই অঞ্চলের পরিস্থিতি যে শান্ত ও স্থিতিশীল আছে, বহির্বিশ্বে এই প্রচার চালানোর পক্ষেও এই ভাসমান লাশগুলো ছিল অন্তরায়। এসব কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জুন মাস থেকে ধীরে ধীরে তাদের হত্যার স্থান পরিবর্তন করে। পরিবর্তিত এই স্থানটি হলো গল্লামারী; খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে আড়াই কিলোমিটার মতো দূরে অপেক্ষাকৃত কম জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে এর অবস্থান। গল্লামারীর ঠিক পাশেই রয়েছে ময়ূর নদী এবং নদীর ওপরকার সেতু পার হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সহজেই অপর তীরে অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে এই হত্যাকার্য সমাধা করতে পারতো।
পাকিস্তানি সেনারা খুলনা শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে যে সব মানুষকে আটক করে আনতো, প্রথমে তাদের হেলিপোর্ট, ইউএফডি ক্লাব প্রভৃতি স্থানে রেখে নির্যাতন করতো। কাউকে কাউকে জেলেও রাখতো। পরে সেখান থেকে তাদের গাড়িতে করে গল্লামারী নিয়ে হত্যা করা হতো। এ সম্পর্কে দৈনিক বাংলার একটি রিপোর্ট উল্লেখযোগ্য:
সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের [বাঙালিদের] ধরে এনে জেলখানা হেলিপোর্ট ও ইউ.এফ.ডি ক্লাবে জমায়েত করা হত। তারপর মধ্য রাত হলে সেই সব হতভাগ্য নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের [বাঙালিদের] পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের১৮৮ সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা তা ‘ব্রাস’ [তাদের ব্রাশ ফায়ার করে] মারতো, রক্তাপ্লুত দেহে লুটিয়ে পড়তো হতভাগ্যেরা। হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হতো তখন সেই সব নিরুপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার আশে পাশের সবাই শুনতো। কিছুদিন (পর) জল্লাদরা ঠিক করলো গুলী করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। এবার থেকে শুরু হলো জবাই, কিন্তু সংখ্যায় কমলো না—সেই শতাধিক প্রতি রাতে।১৮৯
খুলনার অন্যতম বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অচিন্ত্য বিশ্বাসের বক্তব্যেও এ সম্পর্কে ধারণা করা যায়:
প্রথম দিকে এই বধ্যভূমিতে রাতের বেলা ধৃত বাঙালিদের আনা হতো। পরে তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে গুলি করে হত্যা করা হতো। অবশ্য এরপর গুলির পরিবর্তে শুরু হয় প্রকাশ্য দিবালোকে জবাই করে হত্যা।১৯০

মৃতের সংখ্যা
গল্লামারী গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এই গণহত্যার কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাওয়া গেলেও তারা কেউই মৃতের প্রকৃত এমনকি আনুমানিক সংখ্যা সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি। এ ক্ষেত্রেও আমাদেরকে সহায়ক কিছু উৎসের উপর নির্ভর করতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রথমে দৈনিক বাংলার রিপোর্টের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। এই রিপোর্টে গল্লামারী গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে এভাবে : “এবার থেকে শুরু হলো জবাই, কিন্তু সংখ্যায় কমলোনা—সেই শতাধিক প্রতিরাতে।১৯১ ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে:
সকলের চোখের সামনে দিনে পিঠ মোড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙ্গালী [বাঙালি] নিয়ে যাওয়া হতো আর ঘণ্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসতো— গল্লামারীতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগে যাওয়া সেইসব মানুষের শীতল দেহগুলি। খুলনা শহর মুক্ত হবার পর গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। ধানক্ষেতে ঢুকে দেখলাম এক নৃশংস দৃশ্য। একাধিক লাশ পড়ে আছে সেদিকে, একটি কুকুর খাচ্ছে।১৯২
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঠিক আগের সময় পর্যন্ত যে গল্লামারীতে গণহত্যা ঘটেছিল, তার প্রমাণ ধানক্ষেতে পড়ে থাকা এই ‘কুকুরে খাওয়া’ মৃতদেহ। মোটামুটিভাবে জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে গণহত্যা ঘটেছিল। সময়ের হিসেবে এর ব্যাপ্তি ছয় থেকে সাত মাস। উপরে বর্ণিত রিপোর্টে যে প্রতি রাতে ‘শতাধিক’ মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, সেটি যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে ছয় মাস চলে, তাহলে মোট মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত আঠারো হাজার দাঁড়ায়। অবশ্য, প্রতিরাতেই যে অঙ্কের হিসেবে শ’খানেক লোককে হত্যা করা হতো, এমনটি না হওয়াই স্বাভাবিক। দিন ও রাত মিলিয়ে যে বেশ কয়েকবার ট্রাকে করে মানুষ ভর্তি করে গল্লামারীতে নিয়ে হত্যা করা হতো, তার অনুমিত সংখ্যা শতাধিক। মৃতের সংখ্যা হিসাব করার ক্ষেত্রে সময়ের ব্যাপারটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। জুন থেকে (এমনকি মে মাস থেকেও) সেপ্টেম্বর এই চার মাস সময়ে গণহত্যার প্রাবল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। এরপর একদিকে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত প্রতিরোধ এবং অন্যদিকে শরণার্থী হিসেবে বহু মানুষ খুলনা ত্যাগ করার কারণে গণহত্যার পরিমাণ আগের তুলনায় কমতে থাকে। তবে তা কখনও বন্ধ হয়নি। জুন থেকে সেপ্টেম্বর সময় পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন যদি বিশজনও গল্লামারীতে খুন হয়ে থাকে তাহলেও এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় আড়াই হাজারে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা শপাঁচেক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এখন প্রশ্ন হলো এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ খুন হওয়ার ফলে এখানে তীব্র দুর্গন্ধ বা অন্যান্য পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছিল কি না। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, এখানে যাদের মারা হতো, তাদের বেশিরভাগকেই হত্যার পর পেট চিরে ময়ূর নদী ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য খালে ফেলে দেওয়া হতো। ফলে প্রথমদিকে নদীতে প্রায়শই ভাসমান লাশ দেখা গেলেও পরবর্তীকালে তা তেমন দেখা যেতো না। তবে যে সব লাশ রাস্তার আশেপাশে ঝোপ-ঝাড়ে বা ধানক্ষেতে পড়ে থাকতো সেগুলো শিয়াল কুকুর ও শকুনে খেতো। তীব্র দুর্গন্ধ ও বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কারণে স্থানটি জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল।
এই গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য আরেকটি তথ্য থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। খুলনা মুক্ত হবার পর শুধু গল্লামারী নদী থেকেই দুই ট্রাক মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়েছিল।১৯৩ এই তথ্যে অতিশয়োক্তির সম্ভাবনাটুকু মাথায় রেখেও বলা যায় যে, মাথার খুলি দিয়ে নিতান্ত ঢিলেঢালা ভাবে দুটি ট্রাক ভর্তি করলেও তার সংখ্যা দুই হাজারের কম হওয়ার কথা নয়। এই সংখ্যার সাথে উদ্ধার করতে না পারা মাথার খুলি এবং পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন ছোট ছোট খাল, ডোবা, ঝোপ- ঝাড় এবং পশুপাখির মাধ্যমে হারিয়ে বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মৃতদেহের সংখ্যা যোগ করলে নিহতের পরিমাণ আরও বেশি হওয়া স্বাভাবিক।
……………………………………………………
১৮৮. তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান খুলনার সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল গল্লামারী ব্রিজ পার হয়ে পশ্চিম দিকে বটিয়াঘাটা থানার উত্তর সীমান্তে। বর্তমানে (২০১৬) এটি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন৷
১৮৯. দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
১৯০. দেলোয়ার হোসেন, আঞ্চলিক ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৯। সাক্ষাৎকার, অচিন্ত্য বিশ্বাস (ফুলতলা, বটিয়াঘাটা) ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২।
১৯১. দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
১৯২. তদেব।
১৯৩. দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার