You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04 | কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাট গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাট গণহত্যা (এপ্রিল-জুন ১৯৭১)

ফরেস্ট ঘাট স্থানটি খুলনা জেলখানার অনতিদূরে, জজ কোর্টের পিছনে ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত। কাস্টমস ঘাটের অবস্থানও ভৈরব নদের তীরে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাটে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এপ্রিল এবং মে মাসে এখানকার গণহত্যার প্রাবল্য ছিল সবচেয়ে বেশি।৭৬

গণহত্যার পটভূমি
কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্টঘাট গণহত্যার প্রেক্ষাপট ছিল মূলত রাজনৈতিক। এই গণহত্যার পিছনে মার্চ মাসে খালিশপুরে ঘটে যাওয়া বাঙালি বিহারি দাঙ্গার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। ফরেস্টঘাটে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনের জবানবন্দী থেকে এই গণহত্যা সম্পর্কে জানা যায়।

ঘটনা: এক
খুলনা সদর থানার বাসিন্দা জনৈক কাজী আব্দুল খালেক ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। ২৮শে মার্চে পাকিস্তানি সেনারা তাকে গ্রেফতার করতে এসে প্রথমেই প্রশ্ন করে, ‘তোম বাঙ্গালি হ্যায়, না বিহারি হ্যায়?’ এর জবাবে তিনি ‘আমি পাকিস্তানি মোহাজির হ্যায়’ বলে উত্তর দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, ‘তোম আওয়ামী লীগার হ্যায়, তোম আওয়ামী লীগমে ভোট দিয়া।৭৭ পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আরও বেশকিছু প্রশ্ন করে; তিনিও কৌশলে তার উত্তর দেন। সেদিন কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি নিখুঁতভাবে উর্দু বলতে পারতেন, এ কারণেও পাকিস্তানি সেনারা তাকে সেদিন ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারে।
৭ জুলাই তিনি আবার অফিস থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং ৯ জুলাই তাকে খালিশপুর ‘নেভাল বেস’-এর হাতে হস্তান্তর করা হয়। নেভাল বেস-এর কমান্ডিং অফিসার কর্নেল গুলজারিন তাঁকে প্রশ্ন করে যে, তিনি কতোজন বিহারিকে হত্যা করেছেন। ১১ জুলাই ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন নামক অন্য একজন পাকিস্তানি সামরিক অফিসার তাঁকে একই প্রশ্ন করে। এই নেভাল বেস-এ তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ক্যাপ্টেন শাহাবউদ্দিন তাকে নির্যাতন করার সময় বলছিল, ‘তোম শালা বহুত বিহারিকো খতম কর দিয়া, আওর বহুত বিহারিকো আওরাতকা ইজ্জত লিয়া।’৭৮ নির্যাতন করার পরে তাকে খুলনা জেলে প্রেরণ করা হয়েছিল।

ঘটনা: দুই
২৮ মার্চ ১৯৭১ তারিখে খুলনায় কর্মরত অবস্থায় কবির আহমেদ নামক তৎকালীন একজন ইপিআর সদস্য গ্রেফতার হন। ওই দিন তাঁকে-সহ মোট একশত সাইত্রিশ জন ইপিআর-এর অস্ত্র ও পোশাক কেড়ে নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ৬ই এপ্রিল তাদেরকে খুলনা জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। কবির আহমেদের বিবরণ থেকে সেই নির্যাতন সম্পর্কে জানা যায়:
রোদের উপর উপুড় করে খালি গায়ে শুইয়ে ফেলে বুট দিয়ে লাথিয়েছে, রাইফেলের বাট দিয়ে যেখানে সেখানে পিটিয়েছে, মারতে মারতে ড্রেনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে উপুড় করে ফেলে লাঠি পিঠের উপর ভেঙেছে। সমস্ত শরীর রক্তেভরা, অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত মারতো এবং যথেচ্ছভাবে গালাগালি করতো। বলত, “বল কত বিহারি মেরেছিস’।৭৯
সেপ্টেম্বর মাসে তার বিরুদ্ধে যে চার্জশিট প্রদান করা হয়, তাতে অভিযোগ আনা হয় যে ১. তিনি অবাঙালিদের আক্রমণ করতে গেছেন, ২. সীমান্তে সিপাহি পাঠিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন, এবং ৩. তিনি অস্ত্র সরবরাহের চেষ্টা করেছেন।৮০

ঘটনা: তিন
খুলনার কাজদিয়ার অধিবাসী শক্তিপদ সেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনা ট্রেজারিতে -চাকরি করতেন। ১৯ এপ্রিল তাঁকে অফিস থেকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে যায়। সার্কিট হাউজ ক্যাম্পে নিয়ে তাকে যে সব প্রশ্ন করা হয় সেগুলো এ রকম: ‘১. কাকে ভোট দিয়েছ? ২. কতজন বিহারি মেরেছ?’ ইত্যাদি।৮১
সরকারি অফিস থেকে তুলে নিয়ে হত্যা ও নির্যাতনের আরেকটি ঘটনা ঘটে খুলনার বিএল কলেজে। বিএল কলেজের অফিসের তৎকালীন অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন রবিন বাবু। তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে মিলিটারিরা এপ্রিল মাসে বিএল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে যায়। সেইদিনই সন্ধ্যা সাড়ে আটটার দিকে মিলিটারিরা পার্শ্ববর্তী ভৈরব নদের তীরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের গুলি করে। গুলি করার সময় দুই ভাইয়ের হাত একসাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। গুলি করার পরে দুইজন নদীতে পড়ে যান। রবিন বাবুর ভাই ছটফট করতে করতে নদীতে ডুবে যায়। রবিন বাবুর গুলি লেগেছিল বুকের এক পাশে। নদীতে পড়ে গিয়ে তিনি অতিকষ্টে হাতের বাঁধন খুলে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সাঁতার দিয়ে অপর তীরে গিয়ে ওঠেন। পরে চিকিৎসা করায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। নদীতে ডুবে যাওয়া ভাইয়ের মৃতদেহ তিনি আর খুঁজে পাননি।৮২
উপরিউক্ত ঘটনাসমূহ থেকে কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাট গণহত্যার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বস্তুত এই সময়ে ভৈরব নদের তীরের অনেক স্থানেই ধারবাহিক গণহত্যা চলতো। আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা, নৌকায় ভোট দেওয়া, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়া, খালিশপুরে বিহারিদের হত্যা করা—এসব অভিযোগ এনে সাধারণত এই গণহত্যা চালানো হতো।

গণহত্যার ঘটনা
এপ্রিল ও মে মাসে খুলনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার সবচেয়ে বড় স্পট ছিল ফরেস্ট ঘাট ও কাস্টম্স ঘাট।৮৩ খুলনা শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে সন্দেহভাজনদের ধরে বা গ্রেফতার করে এনে হেলিপোর্ট (সার্কিট হাউজ ময়দানে অবস্থিত), ইউএফডি ক্লাব, সার্কিট হাউজ মিলিটারি ক্যাম্প, জেলখানা প্রভৃতি স্থানে রেখে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের পর সাধারণত বন্দীদের মুমূর্ষু অবস্থায় ফরেস্ট ঘাটে এনে হত্যা করা হতো। গণহত্যার স্থান হিসেবে এই স্থানটিকে বেছে নেবার পিছনে এর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য পাকিস্তান সেনাদের বিবেচনায় ছিল বলে মনে হয়। কারণ, নদীর তীরে এনে হত্যা করার ফলে তাদেরকে লাশ অপসারণের ঝামেলা পোহাতে হতো না। অন্যদিকে, যেসব স্থানে বন্দীদের ওপর নির্যাতন করা হতো, সে স্থানগুলোও ছিল ফরেস্ট ঘাটের সন্নিকটবর্তী। ফলে, নির্যাতনের পরে হত্যা করার জন্য বন্দীদের হাঁটিয়ে এখানে আনা যেতো।
এই গণহত্যায় পাকিস্তানিরা বিভিন্ন এলাকা থেকে বিশেষত তরুণ ও যুবা বয়সী ছেলেদের গ্রেফতার করে আনতো। গণগ্রেফতারের এই কাজটি মূলত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং তাদের অনুগ্রহপুষ্ট সহযোগীরা সম্পন্ন করতো। গ্রেফতারের পর কাদের সরাসরি হত্যা করা হবে অথবা কাদের বন্দী হিসেবে জেলে পাঠানো হবে, সে সিদ্ধান্ত দিতো পাকিস্তানি সেনা। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সরকারি সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করার পর সাধারণত জেলে রাখতে দেখা গেছে। ইতঃপূর্বে ‘ঘটনা-দুই’-এ বর্ণিত কবির আহমেদ-সহ সাঁইত্রিশ জনকে পাকিস্তানি সেনারা গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করেছিল। ‘ঘটনা- এক’-এ উল্লিখিত কাজী আব্দুল খালেককে যখন জেলে পাঠানো হয়েছিল, তখন সেখানে তিনি বহু ‘আওয়ামী লীগের নেতা, প্রফেসর, এবং পুলিশের অফিসারকে’ দেখতে পেয়েছিলেন।৮৪ বেসামরিক যেসব তরুণ যুবকদের গ্রেফতার করা হতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রেফতার করার কয়েকদিনের মধ্যে তাদের হত্যা করা হতো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পুলিশ ছাড়া সন্দেহভাজনদের ধরে আনার জন্য খুলনাতে তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে একটি দুর্বৃত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। শহরের নৈশ প্রহরী ও বাজার পাহারাদারদের একটি অংশ এই কাজে লিপ্ত ছিল।৮৫ মে মাসের পর থেকে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী এই ধরে আনার কাজে সহায়তা করতো। এরা বাজারে, ব্যাংকে, পথে ও বিপণন এলাকাগুলোতে ঘুরে বেড়াতো এবং কারও কাছে বেশি টাকা-পয়সা আছে বুঝতে পারলে মুক্তিবাহিনীর লোক হিসেবে ধরে এনে হেলিপোর্টে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিতো। সেখানে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে প্রথমে নির্যাতন ও পরে হত্যা করা হতো। খুলনা শহরের মেটার্নিটি রোডের ননী গোপাল এবং স্যার ইকবাল রোডের সিমেন্ট ব্যবসায়ী কাঞ্চন মিয়া এই জাতীয় দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানি সেনারা তাদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। সতেরো-আঠারো বছরের উঠতি যুবক ননীগোপালকে হেলিপোর্টের সিলিং-এ উল্টো করে ঝুলিয়ে পিটানো হয়েছিল। নৃশংস নির্যাতন করে মিলিটারিরা তাঁর দুই চোখ তুলে ফেলেছিল। সিলিং-এ ঝুলন্ত অবস্থাতেই তাঁর জীবনাবসান হয়।৮৬

গণহত্যার পদ্ধতি
এপ্রিলের প্রথমার্ধের কিছুদিন বন্দীদের কাস্টমস ঘাট ও হেলিপোর্টে হত্যা করা হতো। তৎকালীন দৈনিক বাংলা (ঢাকা) পত্রিকার নিজস্ব প্রতিনিধির একটি রিপোর্ট থেকে হেলিপোর্টে মানুষ হত্যার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়:
সকাল ১০টা হবে। হেলিপোর্টে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা দীর্ঘ সবলদেহী একজন বাঙ্গালীর পায়ে, হাঁটুতে ও অন্যান্য গিরায় কাঠের রোলার দিয়ে দু’জন সেনা পিটাচ্ছে আর দু’জন সেনা তা উপভোগ করছে। যার উপর অত্যাচার চলছে তিনি বার বার বাধা দিচ্ছেন আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তারপর তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলানো হলো।
পরনে থাকলো জাঙ্গিয়া ও গায়ে গেঞ্জী। পরে খালি গা করে গেঞ্জীটিও অপসারণ করা হলো। আর চললো চাবুকের বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সাথে সাথে তার দেহটি মুচড়ে মুচড়ে উঠতে লাগলো। ঐ ঝুলন্ত অবস্থাতেই তিনি হাত দিয়ে বাধা দিচ্ছিলেন। কিন্তু পরে আর তার হাতে সে জোর রইল না। কিন্তু চাবুকের বাড়ি চললো অব্যাহত ভাবে। আর এই ভাবেই সমাপ্তি হলো একটি বাঙ্গালী জীবন। পরে তার সেই ঠাণ্ডা শীতল দেহটাকে নামিয়ে অবজ্ঞায় তারা দূরে ফেলে দিল—আবার অপর একজনকে।৮৭
প্রথম দিকে হেলিপোর্ট ও সার্কিট হাউজ ময়দানে বন্দীদের হত্যা করা হতো। কিন্তু সেখান থেকে লাশ অপসারণ করতে কিছু ঝামেলা হওয়ায় পরবর্তী কালে পাকিস্তানি সেনারা ঐ স্থানে বন্দীদের হত্যা করতো না। সেখান থেকে নির্যাতন করে বন্দীকে হাঁটিয়ে নদীর তীরে নিয়ে যাওয়া হতো, পরে সেখানে হত্যা করা হতো। ‘ঘটনা-তিন’ এ বর্ণিত শক্তিপদ সেনের বর্ণনায় পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়:
সন্ধ্যা ৮-৩০ পর্যন্ত অত্যাচার করার পর তিনজন মিলিটারী আমাকে হাত খুলে দিয়ে বলে চল শালা তোকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আসি। এই বলে আমাকে সামনে রেখে একজন পিছে আর দু’জন দুই পার্শ্বে রাইফেল ধরে ১নং ফরেস্ট ঘাটে নিয়ে যায়। তারপর সেখানে নিয়ে দু’হাত পিছে দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। আর দুপা এক সঙ্গে করে বেঁধে ভৈরব নদীতে পিছন হতে লাথি মেরে ফেলে দেয়।৮৮
ভৈরব নদীতে খেয়া মাঝির কাজ করতেন নোয়াবেকী গ্রামের আবদুল ওহাব। তিনি ফরেস্ট ঘাট গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি নিজে একদিন তার নৌকার কাছে ভেসে আসা একজন গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন।৮৯ এভাবে হাত পা বেঁধে নদীতে নিক্ষেপ করে কিংবা নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা ছাড়াও নদীর তীরে জবাই করেও অনেককে হত্যা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনা জেলে থাকা কাজী আব্দুল খালেক (খুলনা সদরের অধিবাসী) এ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন:
খান সেনারা প্রত্যেক দিন শহর বা আশে পাশে থেকে যে সব লোককে ধরে আনতো তাদের প্রথমে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে ভীষণ ভাবে টরচারিং করত এবং যাদের মারা হত তাদেরকে জেল হাজতের মাঠে নিয়ে আসতো এবং নদীর পাড়ে ‘জবাই’ করা হত। তাদের কাকুতি মিনতি বা কান্নাকাটি অনেক সময় আমরা শুনতে পেতাম।৯০
ফরেস্ট ঘাট গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন খুলনা শহরের টুটপাড়া মেইন রোডের অধিবাসী মো. হাবিবুর রহমান। আলবদররা তাঁকে চাকরিস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তুলে নেওয়ার পরে কয়েকদিন তাঁকে নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর একদিন রাতে আরও কয়েকজন বন্দীর সাথে তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফরেস্ট ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। মধ্যরাতের ঠিক পরে তাঁদের নদীর তীরে একটি পাটাতনের কাছে এনে জড়ো করা হয়। এরপর একে একে বেয়নেট চার্জ করে তাঁদের নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। চোখের সামনে দেখা এই বীভৎস অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন:
রাজাকার-আলবদররা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে একজন একজন করে ওই কাঠের পাটাতনে নিয়ে যাচ্ছে আর বেয়নেট চার্জ করে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দিচ্ছে। আমার চোখ খোলা, জ্যোৎস্না রাত, সবই দেখা যাচ্ছিল। প্রত্যেককে তারা বেয়নেট এমনভাবে চার্জ করছিল যাতে ভুঁড়িটা বের হয়ে যায়। দেখলাম তারা বেয়নেট পেটে ঢুকায়ে দিয়ে টান দেয় আর লাথি দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। ওরা একটার পর একটা মারছে। যাদের হত্যা করার জন্য নিয়ে গেল তাদের বেশিরভাগেরই চোখ ছিল বান্ধা।৯১
খুলনা জেল থেকেও প্রতি রাতে খানসেনারা অনেক কয়েদিকে বের করে নিয়ে ফরেস্ট ঘাটে হত্যা করতো। প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ আব্দুল জব্বারকে এভাবে ফরেস্ট ঘাটে হত্যা করা হয়েছিল। খুলনা শহরের ক্লে রোডস্থ ‘লাকী মেডিসিন সাপ্লাই’-এর মালিক জনাব আবুল কাশেমের ভাই নজরুল ইসলামও এখানে নিহত হন।৯২ খুলনার তদানীন্তন জেলা ও দায়রা জজ খন্দকার নেসারুল হক-এর বাসভবন ছিল ফরেস্ট ঘাটের পাশে। প্রতিদিন রাতে মৃত্যুপথযাত্রী অসহায় মানুষের সকরুণ আর্তনাদ তাঁকে বিচলিত করতো। মুমূর্ষুদের ভয়াবহ ও বীভৎস আর্তচিৎকারে তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠতো। ৩০ মে ১৯৭১ তারিখে ফরেস্ট ঘাটের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে তাঁর রক্তচাপ অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সাথে সাথেই তিনি মারা যান।৯৩

ব্যাপকতা
কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাট গণহত্যার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে কোনো মন্তব্য করা কঠিন। কারণ, প্রথমত, এখানে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের মরদেহ সব নদীর স্রোতেই ভেসে যেতো। কোনো গণকবর এখানে সৃষ্টি হয়নি। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে তো নয়ই, বর্তমান সময় অবধিও নিহতদের সংখ্যা নির্ণয়ের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই গণহত্যার কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর সন্ধান পাওয়া গেলেও নিহতদের সংখ্যা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ফলে, এখানে নিহতদের সংখ্যা সম্পর্কে অনুমানই মাত্র করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বন্দী অবস্থায় খুলনা জেলে অবস্থানকারী কাজী আব্দুল খালেক নামক জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে এ ব্যাপারে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর দেওয়া বিবরণ থেকে জানা যায় যে, “প্রত্যেক দিন রাত্রিতে খান সেনারা জেল হাজত থেকে অনেক কয়েদিকে জোর করে ধরে নিয়ে যেত”।৯৪ তাঁর বর্ণিত ‘অনেক’ যদি গড় হিসাবে পাঁচ/ছয় জনও হয়, তাহলেও আড়াই থেকে তিন মাসে জেল থেকেই অন্তত শ’পাঁচেক লোককে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল বলে মনে করা যায়। এ ছাড়া হেলিপোর্ট থেকেও যাদের নিয়ে আসা হতো, তাদের সংখ্যা যদি প্রতিদিন গড়ে দুই/তিন জনও হয়, তাহলেও এপ্রিল থেকে জুন মাস অবধি কাস্টমস ঘাট ও ফরেস্ট ঘাটে প্রায় সাত-আটশত লোককে হত্যা করা হয়েছিল বলতে হবে। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর বেশি হওয়াও সম্ভব।৯৫

……………………………………………………
৭৬. জুন মাস থেকে পাকবাহিনী গণহত্যার স্পট হিসেবে ফরেস্ট ঘাটের বদলে গল্লামারীকে বেছে নেয়। সাক্ষাৎকার, মনিরজ্জামান খান ডন (টুটপাড়া, খুলনা), ১৬ জানুয়ারি ২০০৫।
৭৭. মাহমুদ উল্লাহ (সম্পা.) বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (১৯০৫-১৯৭১), ৩য় খণ্ড (ঢাকা: গতিধারা, ১৯৯৯), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯০।
৭৮. মাহমুদ উল্লাহ, ইতিহাস ও দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯০।
৭৯. মাহমুদ উল্লাহ, ইতিহাস ও দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯২।
৮০. মাহমুদ উল্লাহ, ইতিহাস ও দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯২।
৮১. মাহমুদ উল্লাহ, ইতিহাস ও দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯৩।
৮২. আবদুল আজিজের (দৌলতপুর) জবানবন্দী, অন্তর্গত, রাশেদুর রহমান (সম্পা.), খুলনা ১৯৭১ অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান (ঢাকা: প্রথমা, ২০১৩), পৃ. ২২।
৮৩. নিজস্ব প্রতিনিধি, “খুলনার নরমেধযজ্ঞ”, দৈনিক বাংলা (ঢাকা), ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
৮৪. মাহমুদ উল্লাহ, ইতিহাস ও দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯০।
৮৫. দৈনিক বাংলা (ঢাকা), ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
৮৬. হাসান হাফিজুর রহমান, দলিলপত্র, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৪৪–৪৫।
৮৭. নিজস্ব প্রতিনিধি, “খুলনার নরমেধযজ্ঞ”, দৈনিক বাংলা (ঢাকা), ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
৮৮. মাহমুদউল্লাহ, দলিলপত্র, ৩ : ১১৯৩।
৮৯. বাবর আলী, দুর্জয় অভিযান, পৃ. ৬৯।
৯০. মাহমুদউল্লাহ, দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯০।
৯১. মো. হাবিবুর রহমান (টুটপাড়া মেইন রোড, খুলনা সদর)-এর জবানবন্দী। অন্তর্গত, রাশেদুর রহমান (সম্পা.), খুলনা ১৯৭১ অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান (ঢাকা: প্ৰথমা, ২০১৩), পৃ. ১২৬। হাবিবুর রহমানের তখন বাড়ি ছিল ফরিদপুরের আটরশিতে।
৯২. সাক্ষাৎকার, বাবর আলী, ২ ডিসেম্বর ২০০৪।
৯৩. বর্তমান খুলনা টুটপাড়া কবরস্থানে খন্দকার নেসারুল হকের কবর আছে।
৯৪. মাহমুদউল্লাহ, দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৯০।
৯৫. সাক্ষাৎকার, মনিরজ্জামান খান ডন (টুটপাড়া, খুলনা সদর), ১৬ জানুয়ারি ২০০৫।
……………………………………………………

সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার