পার কুমিরা-পুটিয়াখালি গণহত্যা
সাতক্ষীরা জেলার পাটকেলঘাটা থানা সংলগ্ন দুটি গ্রাম পার কুমিরা এবং পুটিয়াখালি। পাটকেলঘাটা বাজার থেকে কিছুটা উত্তর দিকে কপোতাক্ষ নদ সংলগ্ন এলাকায় গ্রামদুটি অবস্থিত। গণহত্যার এই স্থানটি সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত হলেও এখানে নিহতদের অনেকে ছিলেন খুলনা জেলার অধিবাসী।
পটভূমি
একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে পাটকেলঘাটা বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। শেখ আব্দুর রহমান নামক আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাটকেলঘাটা ও তৎসংলগ্ন এলাকার কয়েকজন যুবক এপ্রিলের প্রথম দিকে অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তার আশায় ভারতের চব্বিশ পরগণায় ঘুরেও আসেন। ২২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে এই যুবকেরা আবার দেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য এই প্রচেষ্টা, যুবকদের ভারতে গমন, হিন্দুদের শরণার্থী হিসেবে ভারত যাত্রা প্রভৃতি কার্যক্রম স্থানীয় জামায়াত ইসলামীর কয়েকজন নেতার গোচরে আসে। এই জামায়াত নেতাদের মধ্যে খুলনা জেলা পর্যায়ের জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা শেখ আনসার আলী ছিলেন প্রধান তার নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে জামায়াত কর্মী মাওলানা মোমতাজউদ্দিন পাটকেলঘাটার বিহারি কসাই মনোহর (মনু কসাই নামে পরিচিত) এবং জনৈক পাঞ্জাবী পাকিস্তানি গোয়েন্দা পাটকেলঘাটা বাজারে একটি বৈঠক করে। ধারণা করা হয় এই বৈঠকে তারা গণহত্যার পরিকল্পনা করেছিল।৬০
গণহত্যার ঘটনা
২৩ এপ্রিল বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ চারটি মিলিটারি ভ্যান পাটকেলঘাটা বাজারে আসে। পাটকেলঘাটা বাজারের বলফিল্ড-এর কাছে এসে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করা শুরু করে। চারটি গাড়ির মধ্যে দুইটি গাড়ি প্রবেশ করে পার কুমিরায় এবং দুইটি গাড়ি যায় পুটিয়াখালী গ্রামে। পার কুমিরা গ্রামে প্রবেশ করে তারা প্রথমে হত্যা করে ঐ গ্রামের গোষ্ঠবিহারী কুণ্ডুকে। উল্লেখ্য এই গোষ্ঠবিহারী কুণ্ডুর বাড়িতে ঐদিন যশোরের নওয়াপাড়া ও খুলনার ফুলতলা এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক শরণার্থী অবস্থান করছিল। এপ্রিলের শুরু থেকে বহু শরণার্থীকে তিনি খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করে আসছিলেন। ২৩ এপ্রিল সকালে তিনি বাজারের দিকে গিয়েছিলেন এবং দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে পড়ে যান। পাকিস্তানি আর্মির গাড়িতে পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিল পাটকেলঘাটা বাজারের মনু কসাই। সম্ভবত সে গোষ্ঠবিহারীকে চিনিয়ে দেয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই গোষ্টবিহারী কুণ্ডু নিহত হন।
গোষ্ঠবিহারী কুণ্ডুর বাড়িতে ঐ দিন স্ত্রী ও শিশুপুত্র-সহ অবস্থান করছিলেন খুলনার ফুলতলা থানার ফুলতলা গ্রামের খগেন্দ্রনাথ কুণ্ডু। তিনি বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী-সহ শরণার্থী হিসেবে ভারতে চলে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে গোষ্ঠবিহারী কুণ্ডুর বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে-সহ দশ-বারোজন পুরুষকে গোষ্ঠ বিহারী কুণ্ডুর বারান্দা থেকে ধরে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে নিয়ে যায়। খগেন্দ্রনাথ কুণ্ডুর সাথে ঐ দিন ছিলেন তাঁর স্ত্রী আশালতা কুণ্ডু ও তাঁদের দুইটি শিশু সন্তান। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আশালতা কুণ্ডু বলেন, “আমি তখন কাঁদছি। চলে যাবার সময়ে ও (খগেন্দ্রনাথ কুণ্ডু) একবার আমার আর বাচ্চাদুটোর দিকে তাকালো। দেখলাম, তাঁর চোখে জল। তখনও ভাবিনি, তাঁর সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে না। আমিও সাথে সাথে কিছুদূর গেলাম। এরপর তাঁকে উত্তর দিকে পার কুমিরার দিকে নিয়ে গেল।”৬১ এদিন ফুলতলার পার্শ্ববর্তী দক্ষিণডিহি৬২ গ্রাম এবং যশোর জেলার নওয়াপাড়ার বেশকিছু শরণার্থীকেও পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
পুটিয়াখালী যে দুইটি মিলিটারি ভ্যান প্রবেশ করেছিল, সেগুলো গ্রামের বিভিন্ন স্থানে হামলা করতে থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারির একটি গ্রুপ স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে। সেদিন শুক্রবার থাকায় জুম্মআর নামাজ আদায়ের জন্য শেখ আব্দুর রহমান ও তাঁর বড় ছেলে শেখ জালালুদ্দিন তাদের বাড়ি সংলগ্ন মসজিদে অবস্থান করছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা সেখান থেকে তাঁকে-সহ মোট তেরো জনকে ধরে নিয়ে পাশ্ববর্তী পার কুমিরা গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিতর আটকে রাখে। এরপর তাঁদের দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের অপর দুইটি গাড়ি পার কুমিরা গ্রামের কুণ্ডু বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্য থেকে যুবক ও মধ্যবয়সীদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পার কুমিরা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এরপর আটককৃত সকলকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে পার্শ্ববর্তী খোলা মাঠে এনে দাঁড় করায়। শেখ আব্দুর রহমান ও তাঁর বড় ছেলে শেখ জালালুদ্দিনকে আলাদাভাবে একটি দড়িতে বাঁধা হয়েছিল। এভাবে পিতা পুত্র এক দড়িতে বাঁধা থাকা অবস্থায় পিতার উপর শুরু হয় বেয়নেট চার্জ। মাটিতে ঢলে পড়েন শেখ আব্দুর রহমান। আটক করা অর্ধ শতাধিক মানুষ এই নৃশংস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। এরপর আটককৃতদের দুইটি লাইনে দাঁড় কারনো হয় এবং ব্রাশ ফায়ারে সকলকে হত্যা করা হয়।৬৩
পাকিস্তানি সেনারা এরপর পার কুমিরা ও পুটিয়াখালি গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী এবং হিন্দুদের অধিকাংশ বাড়িতে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পাটকেলঘাটা থেকে আসার সময় মিলিটারি স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা শেখ হায়দার আলী এবং আব্দুর রউফকে সঙ্গে করে এনেছিল। আবদুর রউফকে (তৈলকুপি, সরুলিয়া, পাটকেলঘাটা) মিলিটারিরা গুলি করে হত্যা করে। হায়দার আলী ঐ এলাকায় একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম লীগের একজন নেতা হয়ে তিনি তাঁর নিজের এলাকায় মিলিটারির এই ভয়াবহ নৃশংসতা মেনে নিতে না পেরে সম্ভবত এর প্রতিবাদ করেছিলেন। এর পরিণতি হয়েছিল ভয়ংকর। মিলিটারিরা হায়দার আলীর গায়ে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। জীবন্ত দগ্ধ হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়।৬৪
বেলা আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনী সাতক্ষীরায় ফিরে যায়। মোট ঊনআশি জন এই গণহত্যায় মারা গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে ত্রিশ জনের মতো ছিলেন স্থানীয় এবং বাকি সবাই শরণার্থী। স্থানীয়দের পরদিন তাঁদের স্বজনেরা বাড়িতে নিয়ে কবর দেয়। ঊনপঞ্চাশ জন শরণার্থীর মরদেহ পার কুমিরা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পাশে একটি শুকনো নালায় ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়।৬৫
……………………………………………………
৬০. পাঞ্জাবী এই গোয়েন্দা দীর্ঘদিন ধরে সাতক্ষীরায় রুটি বিক্রেতা হিসেবে অবস্থান করছিল। সাক্ষাৎকার: শেখ নুরুল ইসলাম (পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা), ২০ জানুয়ারি ২০১২।
৬১. সাক্ষাৎকার, আশালতা কুণ্ডু (ফুলতলা, খুলনা), ১৪ এপ্রিল ২০১৬।
৬২. এই দক্ষিণডিহিতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরালয়।
৬৩. সাক্ষাৎকার, শেখ নুরুল ইসলাম (পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা), ২০ জানুয়ারি ২০১২। এই শেখ নুরুল ইসলামের পিতা শেখ আব্দুর রহমান। সাক্ষাৎকার, নীলমণি ঘোষ (পার কুমিরা, পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা), ২০ জানুয়ারি ২০১২।
৬৪. সাক্ষাৎকার, নীলমণি ঘোষ (পার কুমিরা, পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা), ২০ জানুয়ারি ২০১২। কেউ কেউ মনে করেন মুসলিম লীগের এই নেতাকে গায়ে পাট পেঁচিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
৬৫. সাক্ষাৎকার, মাজেদ আলী শেখ (পুটিয়াখালি, পাটকেলঘাটা, সাতক্ষীরা), ২০ জানুয়ারি ২০১২। এই মাজেদ আলী শেখ শরণার্থীদের মৃতদেহ টেনে নিয়ে গণকবরে সমাধিস্থ করার কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ভাই সাজ্জাদ আলী শেখও এই গণহত্যায় প্রাণ দিয়েছিলেন।
……………………………………………………
সূত্র: একাত্তরে খুলনা মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাস- দিব্যদ্যুতি সরকার