ষাটের দশকের বিভিন্ন আন্দোলনে এবং
ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ
ষাটের দশকে ছাত্র ও জাতীয় রাজনীতিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। আইয়ুব খানের সামরিক সরকার ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর নিপিরণ শুরু করলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে সর্বজনাব সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক (প্রয়াত), কে, এম, ওবায়দুর রহমান (প্রয়াত), মোঃ ফরহাদ (প্রয়াত), কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান, রনো, নুরুজ্জামান, শেখ মনি (প্রয়াত), সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক (প্রয়াত) প্রমুখ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বক্সী বাজারে ছাত্রদের হোস্টেলে থাকতেন। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী বা রূপ রেখা নির্ধারণের বেশিরভাগ সভায়ই সে সময় কলেজ ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হতো।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের মুখে শহীদ দিবস পালনে মেডিকেল ছাত্রদের দুঃসাহসিক ভূমিকা স্মরণীয়। এ সময় প্রতিকূল পরিবেশে প্রতি বছরই ছাত্ররা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি ছাত্ররা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শহীদ দিবস উদযাপন ছাড়াও সামরিক শাসনের শুরুতেই মেডিকেল ছাত্ররা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যান। রবীন্দ্রজন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠান উদযাপনও তাদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ‘রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটানো’ সম্পর্কে ড. মোহাম্মদ হান্নানের বক্তব্য (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, ১৯৯৯) খুবই সঠিক। “ঢাকা মেডিকেল কলেজ এ ব্যাপারে একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ যে নিজস্ব উদ্যোগে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালন করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সম্পর্কে অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পূর্বোক্ত জহুরুল মাওলা (পরবর্তী সময়ে স্বনাধন্য সার্জারির অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ) জানিয়েছেন যে, “শুরুতে তাঁরা দুদিনের জন্য অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। এতে ছিল সাহিত্যালোচনা, নাট্যাভিনয়, প্রদর্শনী ও গানের অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান এতই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে যে দর্শক-শ্রোতাদের অনুরোধে তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি। এতে মেডিকেল কলেজের নিজস্ব শিল্পী ছাড়াও ছায়ানটের শিল্পীদের উদার সহযোগিতা লাভ সম্ভব হয়েছিল।” (সূত্র: স্মৃতিবিস্মৃতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ; পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৭)
বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন ও হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রবাস শুধুমাত্র তৎকালীন ছাত্রনেতাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা সভার স্থানই ছিল না কলেজের অনেক ছাত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন।
১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারি গভীর রাতে মূলত ছাত্র ইউনিট-ছাত্রলীগের উদ্যোগে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রনেতাদের যে-বৈঠক বসে তাতে মেডিকেল ছাত্রসংসদের প্রতিনিধি হিসাবে বামপন্থী ছাত্রনেতা আহমেদ জামান অংশগ্রহণ করেন। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে পরদিন ছাত্রধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে বসে ‘ধর্মঘটের প্রথম পোস্টারটি লেখেন কমিউনিস্ট ছাত্রনেতা মোহাম্মদ ফরহাদ। এবং বৈঠকের পর নেতৃবৃন্দ চলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই গোলাম মাওলা জানান: “আহমেদ জামান ভাই (ছাত্রসংসদ সহসভাপতি, ‘৬১-৬২), নূরুল আলম (৫৭ সালের) প্রমুখের সময় ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমাদের জয় ক্যাম্পাসে বাম রাজনীতির ভিত আরো শক্তিশালী করে তোলে। তখনকার মেডিকেল ছাত্রসংসদের অফিস ছিল কলেজের সিঁড়ির নিচে ছোট একটা রুমে। কিন্তু এখানেই এদেশের তদানীন্তন রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” ঠিকই তাই। যেমন বাহান্নর মেডিকেল ব্যারাকে তেমনি পরবর্তীকালের মেডিকেল হেস্টেলে বা কলেজ ছাত্রসংসদ রুমেই একাধিক জাতীয় রাজনীতি বিষয়ক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” আইয়ুব খান জেল, হুলিয়া ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে কিছুকাল আন্দোলন দমন করে রাখলেও ‘৬৮ সালের শেষের দিকে গোপনে আলোচনা শুরু করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ২০শে জানুয়ারি ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল শুরু হলে পুলিশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্তমান জরুরী বিভাগের নিকটে মিছিলে প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান গুরুতর আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কিন্তু চিকিৎসার শুরুর পূর্বেই তিনি বর্তমান ৮ নং ওয়ার্ডে মারা যান। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ আসাদুজ্জামানের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে প্রথম শোক মিছিল বের করে। এই দশকে বিভিন্ন আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার প্রায়ই ঢাকা শহরে কারফিউ দিত। ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে মিছিল বের করলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ এমনকি গুলিবর্ষণ পর্যন্ত করতো। তখনকার ছাত্র-চিকিৎসকরা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সেই কারফিউর মধ্যেই ঘটনাস্থলে যেয়ে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসত এই দুঃসাহসিক কাজ করতে যেয়ে অনেক নির্যাতন ভোগ করেছে। ৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্রদের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের কয়েকদিন পরেই হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা বর্তমান ডক্টরস্ ক্যাফেটেরিয়ার চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
ঊনসত্তর-এর গণঅভ্যূত্থানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভূমিকা প্রসঙ্গে আহমদ রফিক ‘স্মৃতিবিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ’ গ্রন্থে বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে আসাদুজ্জামান মৃত্যুর পর তার লাশ ঘিরে হাসপাতালের আট নম্বর ওয়ার্ডে উপস্থিত মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রী, কর্মরত চিকিৎসক, সেবিকা এবং ওয়ার্ডবয়দের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ছিল একদিকে শোক, অন্যদিকে চোখভরা ক্রোধ আর ঘৃণা। এ শোকাবহ প্রতিক্রিয়ার যথার্থ রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটাতে কিছুক্ষণের মধ্যে ঢাকা হলের ছাত্রজটলা থেকে ছুটে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৎকালীন ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ডা. আশিকুল আলম। আশিক কিছুদিন আগে ডাক্তার হয়ে গেলেও ছাত্রসংসদের নতুন নির্বাচন না হওয়ার কারণে তখনো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর এবং সে সম্পর্ক রাজনৈতিক তৎপরতার।
তাই ছাত্রআন্দোলনের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা তখনো অব্যাহত যেজন্য ঊনসত্তরের ছাত্রআন্দোলনের তাঁর গভীর সংশ্লিষ্টতা ও সক্রিয় ভূমিকা। তখনো আশিক মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এবং সদ্যগঠিত ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে প্রতিনিধি সদস্য; প্রতিনিধি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদের পক্ষে। আবার এ আশিকই ইতঃপূর্বে অর্থাৎ ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী সূচিত ‘ঘেরাও’ আন্দোলনে জঙ্গি সতীর্থদের নিয়ে কর্মতৎপর। এমন কি ঐ আটষট্টির গণআন্দোলনে জঙ্গি মিছিল নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে গুলিস্থান সিনেমা হলের সামনে- গুরুতরভাবে আহত হন তিনি।
আশিক এসে পড়তেই তাঁর সঙ্গে একযোগে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়ে যান পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে। ‘আশিকুল আলমের নেতৃত্বেই রফিকুল হাসান জিন্নাহ, আমিনুল হাসান রিন্টু, কবির, সিরাজ, ফ্রান্সিস রোজারিও, ফওজিয়া মোসলেম, নিলুফার সুলতানা নীলা, রেখা, নেলীসহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম কালোপতাকা উত্তোলন করে এবং প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ ও এক বিরাট শোকমিছিল বের করে’ (সূত্র: ডা. আশিকুল আলম স্মারক গ্রন্থ, ১৯৯৮)। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত শোকমিছিলের সমাবেশ থেকে ২১ জানুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয় এবং ঐ হরতাল দেশ জুড়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বিশে জানুয়ারি শহীদ আসাদকে ঘিরে পরবর্তী পরস্থিতি সম্পর্কে আশিকের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য।
তাঁর ভাষায় “২০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ই পি আর ও পুলিশ ঘিরে ফেলে এবং পরদিন যাতে আসাদের লাশ নিয়ে ঢাকায় কোন মিছিল না হয় সেজন্য বাধা সৃষ্টি করে।
“ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সেদিন জীবন বাজি রেখে শহীদ আসাদের লাশ গোপন করে রাখতে সমর্থ হয়। তখন হলো পুলিশ আসাদের আত্মীয়স্বজনকে লাশ বের করে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। অবশেষে শহীদ আসাদের শোকার্ত পরিবারের অনুরোধে একই দিন রাত সাড়ে ৩টা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে ট্রাকযোগে আসাদের মৃতদেহ তার গ্রামের বাড়ি শিবপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়” (প্রাগুক্ত স্মারক-গ্রন্থ)
সূত্র: ঢাকা মেডিকেল কলেজ: সেবা সংগ্রাম ঐতিহ্য – অধ্যাপক ডাঃ মনিলাল আইচ লিটু, এম আর মাহবুব