হেলিপ্যাড নির্যাতন কেন্দ্ৰ, খুলনা
খুলনা সার্কিট হাউস সংলগ্ন জজকোর্টের সম্মুখে হেলিপ্যাড অবস্থিত ছিল। এর পাশের টিনশেড ছিল হেলিপ্যাডের অফিস। এ অফিস কক্ষটিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী কর্তৃক ধৃত বাঙালিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রহসনমূলক বিচার করা হতো। মূলত এখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলত অমানুষিক নির্যাতন আর বিচারর রায় ছিল পূর্ব নির্ধারিত, অবধারিতভাবে মৃত্যুদণ্ড। পাকসেনারা হেলিপ্যাডে কাঠের তৈরি ফ্রেমে মানুষকে বিভিন্নভাবে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন চালাত। এই অবস্থানের পার্শ্ববর্তী প্রত্যক্ষদর্শী জনগণ এখানকার বাঙালি নির্যাতনের হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে বাধ্য হতেন। এদেরই একজন সার্কিট হাউসের নিকটবর্তী রূপালী ব্যাংকের তৎকালীন কর্মকর্তা আব্দুস সালাম সরদার জানান যে, ‘অফিসের সামনে এসে তাকালেই দেখা যেত হেলিপ্যাডের নির্যাতনের চিত্র। একদিন দেখি, ১২-১৩ বছরের একটি সুন্দর ছেলেকে হেলিপ্যাডের কাঠের ফ্রেমে পা উপরের দিকে তুলে ও মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে পেটাচ্ছে। সারা শরীর দিয়ে রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। ছেলেটি ততক্ষণে হয় মরে গিয়েছিল, নয়তোবা অজ্ঞান অবস্থায় ছিল। এভাবে প্রতিদিনই অসংখ্য লোককে নির্যাতন করত। সহকর্মীদের নিকট এক এক সময় নির্যাতনের এক এক কাহিনী শুনতাম। আমরা নিজেরাও ভীতসন্ত্রস্ত থাকতাম। সালাম সরদার আরো জানান যে, হেলিপ্যাডে নির্যাতনের জন্য লোক ধরে আনার কাজে তার অফিসের একজন অবাঙালি দারোয়ান জড়িত ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর সালাম সরদারের সহকর্মী আব্দুল জলিল উক্ত দারোয়ানকে রসিকতার ছলে ‘কবে দেশে ফিরে যাচ্ছো’ বলে প্রশ্ন করলে দারোয়ান ক্ষেপে যায়। যুদ্ধ শুরু হলে জলিল সাহেবকে ধরার জন্য দারোয়ান কয়েকজন অবাঙালিকে নিয়ে অফিসে আসে। কিন্তু সালাম সরদার জলিল সাহেবকে সরিয়ে দেয়। তাঁকে না পেয় দারোয়ান বলতে থাকে, ‘পালিয়েছে, পেলে তাকে হেলিপ্যাডে ঝুলাব’। এভাবে হুমকি দিয়ে চলে যায়। ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত হলে জলিল সাহেব অফিসে এসে উক্ত দারোয়ানকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু তাকে আরও পাওয়া গেল না। তবে অফিসের সিঁড়ির নিচে তার থাকার কক্ষে বিছানার নিচে একটি গ্রেনেড পাওয়া যায় অবাঙালিরা বাঙালিদের হত্যা করার জন্য সার্বক্ষণিকভাবেই যে তৎপর ছিল এ তার এক অনন্য নজির। তারা াদের চিন্তা-চেতনায় সর্বদাই হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা লালন করত এবং বাঙালিদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করত।
পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন অগণিত মানুষ ধরে তাদের অধিকাংশকেই এই হেলিপ্যাডে এনে নির্যাতন চালাত। এদের হাত-পা বেঁধে পা উপরের দিকে ঝুলিয়ে শরীরের ওপর বিভিন্নভাবে আগাত করত। অনেকে এ অবস্থায়ই মারা যেত। অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেত। যারা অজ্ঞান হয়ে যেত তাদের অনেককে এ অবস্থাই নদীতে ফেলে দিত। আবার অনেককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত। ঘাতকরা মারার পর উল্লাস প্রকাশ করত বলে জানা যায়। এখানে যারা নিহত হয় তাদের মধ্যে ম্যাটার্নিটি রোডের ননী ও স্যার ইকবাল রোডের সিমেন্ট ব্যবসায়ী কাঞ্চন মিয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত