সেনাক্যাম্প নির্যাতন, ফরিদপুর
পাকসেনাদের প্রধান ক্যাম্প ছিল ফরিদপুর স্টেডিয়ামে। যেখানে অসংখ্য নিরীহ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়। ওখান থেকে কম সংখ্যক লোকই ফিরে এসেছে। অধিকাংশকেই অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ঐ ক্যাম্পে বন্দিদশা থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা নির্যাতনের পরিণতিতে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে যান।
মুন্সি মহিউদ্দিনের বর্ণনায় যে চিত্র ফুটে ওঠে তা মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। ২৪ জুন অনেক রাতে দরজায় করাঘাত, প্রথমে ধীরে ধীরে বেশ জোরে জোরে। উর্দুতে হাঁকডাক। দরজা খোলো নেই তো তোড় দেঙ্গে। আব্বা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আর্মি ঢুকে বাবাকে থাপ্পড় বসাল, তোমহারা ছাপ্পা মারা লাড়কা মহিউদ্দিন কি ধার হ্যায়। আব্বা আমতা আমতা করে বললেন ঘরমে নেই হ্যায়। এক আর্মি বলল, তো ও কিধার গিয়া। আব্বা বললেন, গাও মে ঘুমনে গিয়া।
থানার বাঙালি ওসির নামটা মনে নেই, বাবাকে একটা থাপ্পড় বসাল দশাসই গোছের। একজন ডিআইবি ওয়াচার আনোয়ার নামের ফরিদপুরে দীর্ঘদিন ছিল 1 সেও আব্বাকে অপমান করতে উদ্যত হলো। আমি তখন জানালার শিক বাঁকা করে পালানোর কাজে ব্যস্ত ছিলাম। পুরনো বাড়ি শিক খুলেও ফেলেছিলাম, কিন্তু যে দিকের জানাল খুলি দেখি আর্মি। পালানোর সব পথই রুদ্ধ। চার ট্রাকভর্তি আর্মি ও পুলিশ সারা পাড়া ঘিরে ফেলেছে। দেখলাম আমি পালালে মা এবং বোনদের ওপর অত্যাচার করবে। তাই স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসে আর্মির সামনে দাঁড়ালাম। বাবা কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন, একজন পাঞ্জাবি ৭০ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে ঠেলে ফেলে দিতেই মা এসে হাউমাউ করে তুললেন বাবাকে। আমার অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা বোনটা স্মৃতি ফিরে পেয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম কথা বলল কী যেন, বুঝলাম না। চমক ভাঙল সিপাহীর গলা ধাক্কায়।
আমাকে কিল, চড়, ঘুষি মারতে মারতে আমার বাবা-মার সামনে দিয়ে ট্রাকে এনে টেনে তুলল কয়েকজন সিপাহী। তখন বৃষ্টি হচ্ছে। গাছের পাতায় টপটপ শব্দ মা ও বাবা কাঁদছিলেন। ট্রাকের তলায় বৃষ্টি কাঁদায় সয়লাব। তার ভেতরে অ্যাডভোকেট সামসুল বারী (মিয়া মোহন) ভাই বসা। তার দু কাঁধে দুপা দিয়ে সিটে বসা দুই সিপাই। আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা দিতেই আমি অর্ধচেতন হয়ে পড়লাম। কাদায় ফেলে পাড়া দিয়ে বসল চার-পাঁচজন। কেউ গলায়, কেউ কোমরে, কেউ বা আমার পায়ে। আব্বা আমার একটা শার্ট দিতে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বিশ্রী ভাষায় ওরা গালাগালি দিতেই তিনি মায়ের ডাকে ঘরের দিকে ফিরে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। রাজেন্দ্র কলেজের হিন্দু হোস্টেলকে তখন মিলিটারিরা ক্যাম্প বানিয়ে কাজ করছেন। আরো কয়েকজন ট্রাকে কাদা পানির ভেতরে গড়াচ্ছে। কিন্তু তখন আর তাদের চেনার মতো মন-মানসিকতা বা জ্ঞান ছিল না।
মোরগের বাক শুনে বুঝলাম জ্ঞান ফিরেছে। মোহন ভাই কয়েকবার চেষ্টা করেছেন ডাকতে। তারও ঘাড়-কোমর ভাঙা। ক্যাম্পের আরো যারা ছিলেন, তার সবাই প্রায় অর্ধচেতন। ফ্লোরে কাদা-পানিতে একাকার। ভোরের আজান শুনে বুঝলাম আমরা বেঁচে আছি। কাদা-পানির ভেতরে বর্বরগুলো আমাদের হাত-পা, কোমর দড়ি দিয়ে বেঁধে, জানালার গরাদের সঙ্গে বেঁধে দড়ির এক প্রান্ত ধরে দরজায় তালা দিয়ে একজন সেপাই বসে থাকত পর্যায়ক্রমে। আর মাঝে মাঝেই তালা খুলে বাকি সিপাইরা কিছুক্ষণ পরপর বুট দিয়ে লাথি দিয়ে গুনত, আমরা কেউ পালিয়ে গেলাম কিনা। বৃষ্টিতে সারা রাত ভিজেছি।
গা চুলকালেও কোনো উপায় ছিল না চুলকানোর। পায়খানা-পেশাব ভয়েই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথবা এসব হবার মতো অবস্থাই ছিল না। জাহাঙ্গীরকেও (বর্তমানে সাংবাদিক) ধরে এনেছে। মেরেছে বেদম মার। শাহজাহান (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র), খায়রুজ্জামান ভাই তাদেরও ধরে রেখেছে কামরাটায়। সবারই আমার মতো অবস্থা। আরো ছিলেন আমজাদ হোসেন খান। সবারই হাত- পা বাঁধা। একইভাবে কাদা-মাটিতে বেঁধে রাখা ছিলাম সারারাত। আমার যত দূর মনে পড়ে, আমাদের সঙ্গে আরো ছিল ন্যাপের কর্মী মতিউদ্দিন মুকুল এবং দুলাল। আরো একটা ছেলে ছিল কমিউনিস্ট পার্টির। ছেলেটাকে পরে আবার ধরে নিয়ে হত্যা করে।
ফাঁসির আসামিরও কিছু সম্মান আছে। কিন্তু নির্যাতন শিবিরের এই চেহারা দেখে আমার মনে হলো এটা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর। একটা মজার ঘটনা ঘটল প্রথম রাতেই। জয়নুল আবেদীন নামের একজন প্রা. স্কুলের হেডমাস্টার রাজাকারদের প্যারেড করাতেন। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগার। আর এক জয়নাল আবেদীন ছিলেন ফরিদপুর হাইস্কুলের শিক্ষক। তার নামে ওয়ারেন্ট রিপোর্ট ছিল। সামরিক জান্তা ও গুপ্ত পুলিশ মিলে ভুলক্রমে সেম সাইড করে। মেরে হাড্ডি ভেঙে, পা নুলা করে তাদেরই শিবিরের অন্যতম সমর্থক পরম বিশ্বাসী প্রা. স্কুল হেড মাস্টার জয়নুল আবেদীনকে। তাকে মেরে অর্ধমৃত করে এনে বাঁধল আমাদের সঙ্গে। আধো-আলো অন্ধকারে তিনি গোঙাচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘শালা গাধার বাচ্চারা নিজের আর পরের লোকও চেনে না। আমার ডায়াবেটিস হাড্ডি ভেঙে ছারখার করে দিয়েছে, শালা ছাতুখোর, অশিক্ষিত মূর্খ গাদ্দারির বাচ্চারা।’
রাতে হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই ঘুমুতে হতো আমাদের। দুদিন পর ঘটল মর্মান্তিক ঘটনা। সকালে নাস্তা দিয়ে গেল, কাদার ভেতরে ছুড়ে দেয় দুটো রুটি। আর কাদামাখা বাটিতে একবাটি ডাল। হাতের দড়ি কিছুটা আলগা করলেও দড়ি বাঁধা ঝুলছিল। চোখে রক্ত ঝরায় কোনো ঝাল জিনিস এমনকি পানিও খেতে পারতাম না। ব্লু-ক্রসের দুধের কৌটায় করে এক কৌটা পানি দিত। সেদিনও কেবল নাস্তা করব বলে বাটি সামনে নিয়ে বসেছি। অমনি পাঁচ-সাতজন সিপাই হুড়মুড় করে ঢুকে জাহাঙ্গীর ও আমাকে উঠে দাঁড়াতে হুকুম করল। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। ওরা নাস্তার পাত্রগুলো সরিয়ে নিয়ে আমাদের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধল। কোমরে ও হাতে মোটা রশি দিয়ে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে এবং চোখে কালো পুরু মোটা কাপড় বেঁধে টেনেহিঁচড়ে মেরে পিটিয়ে নিয়ে তুলল ট্রাকে। পেছনে শুনলাম সবাই জোরে জোরে মুখস্থ কোরআন তেলাওয়াত করছে। মিয়া মোহন ভাই আস্তে আস্তে বলেছিল, তোমরা না ফেরা পর্যন্ত আমরা নাস্তা-পানি মুখে দেব না। আসার সময় মিয়া মোহন ভাইকে বলেছিলাম, আপনি আমার বুড়ো মা-বাবাকে একটু সান্ত্বনা দেবেন। ওরা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলবে, এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বললেন, একে একে আমাদের ওরা মেরে ফেলবে। ট্রাক ছুটে চলল শহর ছেড়ে গ্রামের নির্জন পথে। কিছু দূর গিয়ে নির্জন একটা অঞ্চলে জাহাঙ্গীরকে, আমাকে আর দুধ বাজারের পাশে জনৈক বিধবার একমাত্র পুত্র দুলালকে নিয়ে দাঁড় করল। পাঞ্জাবি ভাষায় বলল, এক থেকে তিন বলব, এর ভেতরে তোমরা লিখিত দেবে, তোমরা মুক্তিযোদ্ধা এবং তোমরা শহর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিলে। এ কথা লিখিতভাবে স্বীকার করলেই তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে। দুলাল স্বীকার করল, জাহাঙ্গীরও দুর্বল হয়ে পড়ল। ওদের মিষ্টি কথায়। আমি ওদের লক্ষ্য করে নিস্বরে বললাম, খবরদার কেউ স্বীকার করো না। স্বীকার করলেই ওরা গুলি করে মারবে। দুলাল ওদের মিথ্যা আশ্বাসে স্বীকার করায়, তাকে গুলি করে মেরেছিল। আমরা দুজন রাজি হলাম না। ওরা গুলি লোড করল। ঘটঘট করে চড় টানল। ট্রিগারের লগে হাত রেখে এক থেকে তিন গুনল, ক্ষণিকের জন্য আপনজনদের ছবি মনে ভেসে উঠল। এভাবে প্রায় অচেতন অবস্থায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নরপশুরা আমাদের পিঠে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটাল আর বলল, ওঠ শালা তোম লোভ অভি তোক জিন্দা হ্যায়। আবার ফিরে এলাম ক্যাম্পে। পরদিন আবার নিয়ে গেল নির্যাতন কক্ষে। প্রথমে অনেকক্ষণ ঝুলিয়ে মিলিটারিরা বেত দিয়ে পেটাল বেদমভাবে। তারপর রাগে কিল-ঘুষি লাঠিপেটা করেও কোনো কাজ হলো না দেখে চাবুক হাতে চাপকানো দেহটায়। দেহটার মানচিত্রে তখন অনেক ভাগের পরতে অজস্র নদী- নালার মতো চাবুকের ঘা। এক সময় নেতানো ক্লান্ত দেহে মনে হলো বোধ হয় জ্ঞান নেই। কিছু কিছু পোকামাকড়ের মতো মানুষ, কিছু কিছু গোলমেলে শব্দ শুনতে শুনতে ক্ষীণ মিনমিনে গলায় পানি চাইলাম। উপর থেকে দড়ি বাঁধা দেহটা নামিয়ে ব্লু-ক্রসের কৌটায় দেয়া নোনা পানি ঢক করে খেলাম। পরদিন মোহন ভাই বলল, তুমি পেশাব খেলে কী করে? ওরা তো তোমাকে পানির বদলে পেশাব খাইয়েছে, বললাম হুঁশ ছিল না।
পরদিন আবার আমাকে আর জাহাঙ্গীরকে বেদম পেটাল। তারপর দড়ি দিয়ে উল্টো করে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে উপরে তুলল। নিচে ফুটন্ত পানির পাত্র। আমি ভয়েই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর আর মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম ওরা আবার আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে। পরদিন আবার নিয়ে গেল নির্যাতন শিবিরে। একজন অফিসার আমাকে মাটিতে বসিয়ে দুই কাঁধে দুই পা দিয়ে বলল, অন দ্য ফলোইং নাইট অব টুয়েন্টি সিক্সথ জুন এন অ্যাটাক ওয়াজ টুবি লাঞ্চ আপন দ্য আরমি হেড কোয়ার্টার এট ফরিদপুর ইউর লিডারশিপ। ইজ ইট নট? সে অনলি ইয়েস অর নো। প্রতিবাদ করতেই সে আমাকে কিল-ঘুষি মারতেই মাটিতে ফেলে দিল। তারপর একটা কুয়োর উপরে দাঁড় করিয়ে বলল, নাউ ইউ লুক ডাউন। নিচে তাকিয়ে রক্ত হিম হয়ে গেল। কুয়োতে পানি নেই মৃত মানুষের হাড়গোড়ে ভর্তি। হেসে উঠল আর্মি অফিসার। ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, ছুন ইউ উইল মিট দেম। একটা লোডেড রিভলবার আমার পেটে ঠেকিয়ে হাসতে থাকল সে হিন্দি ছবির ভিলেনের মতো। বললাম, আমি শিল্পী। ছবি আঁকি। মানুষ বাঁচাতে জানি, মারতে শিখিনি। এক কথাই বারবার বলায় ক্যাপ্টেন একটা সিপাহি ডেকে আমাকে বলল, ইউ গো ইউ উইল বিল কলড লেটার অন। অন থিং ইউ নো এনিথিং অব মুক্তিজ, প্লিজ টেল আস। ইউ বি রিলিজড।
এর কয়েক দিন পরে আমাদের পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট এলো, আমরা আওয়ামী লীগার নই, ছিলামও না, আমরা মওলানা ভাসানীর অনুসারী। তাই অফিস ইনচার্জ মেজর বেগ আমাদের একদিন সবাইকে ডেকে বললেন, তোমরা নির্দোষ, তোমাদের ভুল করে ধরা হয়েছে। ভাসানী সাব কিউ ইন্ডিয়া মে গিয়া, উসকো সমঝাও, অউর আজ শামকে। আজাদ কর দেঙ্গে। যো কুছহগুয়া উছ ভোলো হো গ্যায়া। কিন্তু তখন শরীরে কোনো শক্তি ছিল না। বন্দিশিবিরে ট্রাকে আনা দুই-আড়াই মণের গুলি আর আটার বস্তা টেনে, নির্যাতন শিবিরে মার খেয়ে, অত্যাচার-নিপীড়নে চোখের কোণে মাংস ছিঁড়ে ঝুলছে। পায়ের মাংস ছেঁড়া। গায়ের পরতে পরতে চাবুকের চিহ্ন। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় যখন মুক্তি পেয়েছিলাম তখন কী হচ্ছে তা বোঝার বা অনুধাবন করার ক্ষমতাই আমার ছিল না।
বন্দিশিবিরে নামাজ পড়তে চাইলেও সে সুযোগ দেয়া হতো না। একদিন আমজাদ সাহেব নামাজ পড়বেন। একজন সিপাইকে ডেকে বাঁধন খুলে দিতে বললেন এবং ওজুর পানি চাইলেন। সিপাই বুট দিয়ে তাকে পাড়া দিয়ে বলল, “কিয় বলতা, নামাজ ছে কিয়া হোগা। আল্লাকো ছোড়কে আজরাইলকো বুলাও। তুমকো উও মদদ দেগা।’ আমজাদ সাহেবের ধারণা ছিল যেহেতু পাকিস্তানি সৈন্য নামাজের কথা বললে নিশ্চয়ই সময় ও সুযোগ দেবে। কিন্তু ক্রমাগত চড়-থাপ্পড় ও লাথি খেয়ে তিনি একদম বোকা হয়ে গেলেন। মোহন ভাই তাকে পরে বোঝালেন তায়াম্মুম করে নামাজ পড়তে।
বন্দিশিবির থেকে হানাদার পাক সেনাদের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে রিকশায় করে বাসায় এলাম। বাসায় পৌঁছালে মা-বাবা, বোন সবাই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তাদের কোনো সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার ছিল না। আমার কোমরের হাড়টা ভাঙা। স্বাধীনতার পর ভারতের বোম্বে নগরীতে টাটা হাসপাতালে দুই মাস চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা সুস্থ। কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ কোনো দিনই হব না। দেশের সার্বিক অবস্থায় কখনো কখনো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করি। ভাবতে ভালো লাগে সেসব ডেথ মেটদের কথা। যাদের নিয়ে একত্রে মৃত্যুর প্রহর গুনেছি। কত বন্ধু যে নির্যাতন শিবিরে অত্যাচারে মারা গেছেন, তাদের সঠিক ইতিহাস হয়তো কেউ কোনো দিনও লিখবে না। আমরা জানব না সঠিক ইতিহাস।”
১৪ থেকে ১৯ আগস্ট বন্দিখানায় কাটিয়েছেন সৈয়দ মাসুদ হোসেন। তার কাছে ভয়াবহ রাত ছিল ১৭ আগস্ট। যশোর থেকে ‘ছে পানজাব’ গ্রুপ আসে। ঐ রাতে ২১ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শোনা গেছে তাদের তালমার কাছে জোড়া ব্রিজের ওখানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। মাসুদের বক্তব্য : পাকসেনাদের নির্মম নির্যাতন কোনো দিন ভোলা যাবে না। তবে তার মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল ক্যান্টিনের ইনচার্জ একজন বেলুচ। নাম আশরাফ খান। যিনি গোপনে খাবার ও সিগারেট সরবরাহ করতেন।
বেলুচ সৈনিকের সহানুভূতিতে প্রাণে বেঁচে আছেন মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আবু ইউসুফ সিদ্দিক (পাখী)। ফরিদপুর থেকে আগস্ট মাসে পাখীকে যশোরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনেকের সঙ্গে তার ওপরও চলল অমানুষিক নির্যাতন। একদিন জনৈক বেলুচ ড্রাইভার ঊর্ধ্বতন অফিসারকে বলেন, আমার কাছে ছেড়ে দিন, আমি ওদের শিক্ষা দেব। তিনি পাখীসহ কয়েকজনকে আধমরা অবস্থায় বস্তায় পুরে নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য আগ্রহ করে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কথা ছিল ফরিদপুর যাওয়ার পথে তাদের কামারখালীর গড়াই নদীতে ফেলে দেয়া হবে। তা না করে ঐ মানুষের বস্তাগুলো ফরিদপুর গোয়ালচামট পাখীদের বাড়িতে রেখে যান। এভাবে প্রাণ ফিরে পান পাখী ও তার সঙ্গীরা।
বোয়ালমারীতে নির্মাণাধীন হাসপাতালে সেনাক্যাম্প ছিল। ঐ ক্যাম্পে পাকসেনারা বোয়ালমারী থানা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সুবোধ চন্দ্ৰ রায়কে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। ওখানে হত্যা করা হয়েছে আরো অনেককে।
২৪ আগস্ট ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সংগঠক রেজাউল ইসলামকে ক্যাম্পে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ২৬ আগস্ট তাকে হত্যা করে। ২৪ আগস্ট কামার গ্রামে শওকত রেজা চানুর বাড়িতে রেইড করে তাকে না পেয়ে তার ছোট ভাই স্কুলছাত্র শওকত হাবিব মানুকে ধরে এনে ক্যাম্পে রাখা হয়। ছোলনার ছাত্রলীগ কর্মী মোশারফ হোসেন মুসা এবং তার চাচা আবু মিয়াকে এনে বেধড়ক মারপিট করা হয়। তাদের ফরিদপুর এনে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়।
ফরিদপুরের গোয়ালচামটে অরুণ বসু পাকসেনাদের হাতে ধৃত হয়ে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। তার রয়েছে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি।
[১৫] আবু সাঈদ খান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত