রাঙামাটিয়া ও এর আশপাশের গ্রামের গণহত্যা, গাজীপুর
কালিগঞ্জের যে এলাকাটিতে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল তার নাম রাঙামাটিয়া।
নভেম্বরের আগ পর্যন্ত পাকসেনাদের আনাগোনা তেমন ছিল না। রবি রিবেরু জানান, নভেম্বরের ২৪ তারিখে ঢাকা থেকে ট্রেনে করে পাক আর্মি এখানে আসতে শুরু করে। এই সংবাদ পেয়ে এন্ড্রু ডি কস্টার আহ্বানে এখানে আসেন শান্ত রোজারিও, সুনীল, আই ডি কস্টাসহ আরও অনেকে। তাঁরা আশকোনা বাড়ি রেল ব্রিজ ভেঙে ফেলেন। পরদিন ২৫৪ তারিখ একটা মালগাড়ি বোঝাই হয়ে পাকসেনারা ব্রিজ ঠিক করতে আসে। ফিরে যাবার সময় মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করলে তারা গ্রামের দিকে ফিরে আসে। তখন আড়িখোলা স্টেশন, তুমুলিয়া মিশন, কালিগঞ্জ মিলে আর্মিদের ঘাঁটি ছিল। এদের গ্রামে ঢুকতে না দেয়ার জন্য হাজার হাজার মানুষ রেললাইন উপড়ে ফেলতে শুরু করে। এ সময় মালগাড়ি ও তিনটে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ২৬ তারিখে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দড়িপাড়া ব্রিজটি ধ্বংস করেন। ২৭ তারিখ দুপুর বারোটা পর্যন্ত সব চুপচাপ ছিল। গ্রামের পরিবেশ ছিল থমথমে। দুপুরের পর প্রায় শতিনেক পাক সৈন্য গ্রামের দিকে আসতে শুরু করে। গ্রামের লোকজন তখন আতঙ্কিত অবস্থায় পালাতে শুরু করেন। পাকিস্তানিরা ঘরবাড়িতে আগুন দিতে দিতে এগুতে থাকে। মাঝপথে গুলি করে হত্যা করে গেদু কস্টা ও পিটার ডি কস্টাকে। ছোট সাতানীপাড়ার খাকুর ভিটার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন দশ-এগারোজন নারী-পুরুষ। এঁদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলিতে আহত অবস্থায় পানিতে পড়ে যান অনেকে। এঁদের মধ্যে ঊষা মারিয়া কস্টা ছিলেন একজন। তিনি বর্তমানে রাঙামাটিয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। বাবার নাম এলিয়াস কস্টা। তাঁরা পাঁচ বোন, দুই ভাই। মা তেরেজা রোজারিওর সাথে ঐ দিন ঊষা ও তাঁর বোন রেণু এলিজাবেথ কস্টা ঐ ভিটার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্য ভাই-বোনরা তখন বাবার সাথে অন্যদিকে চলে যান। ঊষা জানান, তখন বিকেল পাঁচটা। সবাই প্রাণভয়ে ক্ষেতের আলের পাশে লুকিয়ে ছিলেন। এ সময় সারু নামের এক ধান কুড়ানি মহিলা তাঁদের দেখে ফেলে। সবাই সারুকে তাঁদের সাথে লুকাতে বললে সে তাঁদের অবজ্ঞা করে গ্রামে ফিরে যায়। কিছুক্ষণ পর মিলিটারিসহ ঐ মহিলা ফিরে আসে। এরপর পাক আর্মিরা প্রথমেই সারুকে গুলি করে এবং অন্যদের লাইন করে দাঁড়াতে বলে। এরপর একসঙ্গে গুলি করলে সবাই পানিতে পড়ে যান। ঊষা মারিয়া উরুতে এবং তাঁর বোন রেণু বাম বাহুতে গুলি লেগে আহত হন। ঊষা জানান, ঘটনাস্থলে মুক্তিযোদ্ধা অনিল ডি কস্টা মারা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী এবং গ্রামবাসীদের বক্তব্য অনুযায়ী, পাকসেনাদের হামলায় নিহতদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে যাঁদের নাম সংগ্রহ করা হয় তাঁরা হলেন-পল রড্রিক্স, কেতু রড্রিক্স, মার্থা কস্টা (স্বামী-লুকাস কস্টা), ফেলু কস্টা (পিতা-বিলু কস্টা), মুক্তিযোদ্ধা অনিল ডি কস্টা (পিতা-মনাই কস্টা), মোরিজোসিনতা রড্রিক্স ও ডা. পিটার।
তুমুলিয়া এবং রাঙামাটিয়া গ্রামগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্য অনুপ্রবেশের প্রধান পথ ছিল রেলপথ। বিল এলাকায় পানির কারণে নভেম্বরের আগে তারা হামলা করতে পারেনি। এই এলাকায় আড়িখোলা স্টেশন, নলছাটা ব্রিজ, পুবাইল ব্রিজ, তুমুলিয়া মিশনের কাছে রেলওয়ে ব্রিজগুলোকেও তারা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
এই এলাকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন নিরপরাধ সাধারণ মানুষ, যাঁরা অধিকাংশই বয়স্ক ছিলেন। পাকিস্তানিরা প্রার্থনারত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে গেদু কস্টাকে, ঘর থেকে উঁকি দেয়ার অপরাধে হত্যা করে অসুস্থ পিটার ডি কস্টাকে। ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারে এক বৃদ্ধকে। এ যেন কেবল অস্ত্র ব্যবহার করার মাধ্যমে আনন্দ লাভের প্রয়াস। স্থানীয় খ্রিষ্টান কবরস্থানে এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের সমাহিত করা হয়।
[৩৪] ডা. এম.এ. হাসান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত