You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.29 | মৌলভীবাজার শহর গণহত্যা | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

মৌলভীবাজার শহর গণহত্যা, সিলেট

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার সাথে সাথেই মৌলভীবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা আজিজুর রহমান ও বোমকেশ ঘোষ টেমা বাবুকে গ্রেফতার করে সিলেট নিয়ে যায়। ২৬ মার্চ সকাল আটটা থেকেই শহরে পাকবাহিনী জারি করে ১৪৪ ধারা। আর ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহরের উত্তরাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল আসে। চাঁদনিঘাটের সেতু দিয়ে মিছিল শহরে প্রবেশ করতে চাইলে সেখানে পাকবাহিনী গুলি ছোড়ে। সাথে সাথেই মারা যান লন্দু মিয়া। তিনি সম্ভবত মৌলভীবাজার শহরের দ্বিতীয় শহীদ। একই দিন পশ্চিম দিক থেকে আর একটি মিছিল শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা চালায়। সে মিছিলেও পাকবাহিনী গুলি চালায়। মারা যান মিছিলকারী তারা মিয়া। আহত হয়ে পরের দিন মারা যান জলিল মিয়া। গুলি চালানো হলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। তারা মিয়াই ছিলেন মৌলভীবাজার এলাকার প্রথম শহীদ।
২৯ মার্চ শহরের কাশিনাথ রোডের বাসা থেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শ্রীনিবাস ভট্টাচার্যকে (বলাই)। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ২৮ মার্চ কাশিনাথ রোডের অপর এক বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় তারা নিবেদিতপ্রাণ ন্যাপ কর্মী গৌরপদ দেবকে (কানু)। ক্যাম্পে আটক করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তারপর ৩০ মার্চ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে কানুকে গুলি করে হত্যা করে তারা। এভাবে কানাই ভট্টাচার্য ও অমর জ্যোতি করসহ আরো বহু লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁদের ওপর। গুলি করে হত্যা করা হয় মাখন রঞ্জন করকে। তারপর তার লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় মনু নদীর স্রোতে। এ সময় ব্যাপক লুটপাটও চলে।
মৌলভীবাজার শহরে মোমরেজপুর গ্রামের আবদুল আলীম রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর ওপর গুলি ছোড়ে পাকবাহিনী। সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পয়খড় গ্রামের আবদুল মান্নান, আবদুস সাত্তার এবং সিলেটের সেলিম উদ্দিনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকবাহিনী তিনজনকেই মনু নদীর তীরবর্তী এক বাড়িতে এক সঙ্গে আটক করে রাখে। তাঁদের পরবর্তী সংবাদ আর জানা যায়নি।
এরপর একদিন পাকবাহিনী অভিযান চালায় গন্ধর্ভপুর গ্রামে। এখান থেকে তারা ধরে আনে প্রভাত চন্দ্র রায়, তার ছেলে বেণু রায় এবং সীতু রায়কে। তাদের সবাইকে একই রকম পরিণতি অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করতে হয়।
১২ মে। পাক জল্লাদের এ দেশীয় এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইনাম উল্লার সাথে ব্যক্তিগত মনোমালিন্যের কারণে তিনজন নিরীহ মানুষ খুন হলো এই দিন এবং লুট হয় লক্ষাধিক টাকার মালামাল। হিলালপুর গ্রামের ৭৬ বছর বয়স্ক আবদুল মান্নান কখনো রাজনীতি করতেন না। পুত্র সিরাজুল ইসলামও না। শুধু ইনাম উল্লার সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকার কারণেই দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হন তিনি। ইনাম উল্লা পাকসেনাদের সহযোগিতায় মৌলভীবাজারের নিজ দোকান থেকে ধরে নিয়ে যায় আবদুল মান্নানকে। তারপর তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে পুত্র সিরাজুল ইসলাম ও প্রতিবেশী মোহাম্মদ উস্তারকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করা হয়। সেই সাথে চলে লুটপাট। দালালরাই সেটা করে। পাকবাহিনী লুট করা এক ট্রাক মালামাল নিয়ে যায়। সিরাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ উস্তারকে ক্যাম্পে নিয়ে এসে তাঁদের বিচারের প্রহসন চালানো হয়। শহরে মাইকযোগে তার মৃত্যুদণ্ডের কথা ঘোষণা করা হয়। তারপর ১৩ মে শত শত অশ্রুসিক্ত লোকের সামনে চাঁদনিঘাটের সেতুর ওপর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাথে মোহাম্মদ উস্তারকেও হত্যা করা হয়। লাশগুলো নিহতদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে ভাসিয়ে দেয় তারা স্রোতস্বিনী মনু নদীর জলে এবং আবদুল মান্নানকে পাকবাহিনী তাঁদের বাঙ্কারের ভেতরেই গুলি করে হত্যা করে।
পাকবাহিনী ঘরোয়া গ্রামে হানা দেয় একদিন। সেখানকার সারদা পণ্ডিত ও অন্নদা পণ্ডিত নামের দুই ভাইকে হত্যা করে তাঁদের ঘরের ভেতরেই।
এ সময় লুটতরাজ চলেছে অসংখ্য গ্রামে। ইজ্জত হরণ করা হয়েছে কয়েকশ মা-বোনের। শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে অসংখ্য লোকের ওপর। অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে মানসিক যন্ত্রণাও দিয়েছে তারা। এসব অপকর্মে গোলাম আযমের দোসররাও পাক পশুদের চেয়ে কম যায়নি।
দেশের ভেতর অপারেশন পরিচালনা করতে এসে ধরা পড়ে যায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। দলের সবাইকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ছিলেন বর্ষিঝুরার আবদুস শহীদ মুকিত, সুদর্শন, রানু প্রমুখ।
পাকবাহিনী তাদের পদলেহী দালালদের সহায়তায় কেবল মৌলভীবাজার শহরেই সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করেছে ১৮৫টি বাড়ি। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২২টি বাড়ি। লুটতরাজ করেছে সমস্ত দোকানপাট। শহরের নিকটবর্তী একটি গ্রাম থেকে ধরে আনে জনৈক শিক্ষক ও তার ছাত্র যাদবকে। রাজাকাররা এ কাজে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করে। তারপর হত্যা করা হয় শিক্ষক ও ছাত্র দুজনকেই। এ সময় ওই শিক্ষকের দুই মেয়েরও শ্লীলতাহানি করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের এক রাতে আমতৈল গ্রামের উমেশ চন্দ্র দেবকে ধরে এনে হত্যা করা হয় নির্দয়ভাবে।
মৌলভীবাজার থেকে পাকহানাদার বাহিনী পালাবার আগের দিন কলেজ স্টাফ কোয়ার্টারের পূর্ব পাশে বন্দি ১২১ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ সংখ্যায় ‘যুগভেরী’ একটি সংবাদ প্রতিবেদন ছাপে। একই সংবাদ থেকে জানা যায়, কামালপুর ইউনিয়নে তারা হত্যা করে মোট ১০৫ জনকে আর ঘরবাড়ি পোড়ায় ২০০টি।
মৌলভীবাজার সদর থানার বাটরখালী গ্রামে ছিল আওয়ামী সদস্য শচীন্দ্র গোপের বাড়ি। তিনি শ্রীমঙ্গলে ব্যবসা করলেও সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে অবস্থান করছিলেন নিজের বাড়িতে। সেখানে হাজির হয় শান্তি কমিটির কুখ্যাত সদস্যরা। শচীন্দ্রকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে মারধর করে। গ্রেফতার করে তাঁর ছেলেকে। লুট করে নেয় নগদ ৭ হাজার টাকা, সাড়ে ৫ ভরি সোনা, ঘড়ি, রেডিও, সাইকেল, টর্চ প্রভৃতি। পরে এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় শচীন্দ্র গোপকে। তারপর পাকবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করলে তাঁর ভাগ্যেও জোটে একটি বুলেট। তাঁর স্ত্রী প্রসব করেন একটি মৃত সন্তান। আর শোকে-দুঃখে মৃত্যুমুখে পতিত হয় বড় ছেলে। চুয়াল্লিশের ডা. যামিনী মোহন দেবকে ঈন্দেশ্বর থেকে ধরে এনে হত্যা করেছিল তারা মুন্সিবাজারে। মৌলভীবাজারের সহকারী আনসার অ্যাডজুটেন্ট এ জে মনসুর আহমদও প্রাণ হারান তাদের হাতে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত