বিয়ানীবাজার গণহত্যা ও নির্যাতন, সিলেট
বিয়ানীবাজার সিলেটের একটি উপজেলা। ভারতীয় সীমান্ত বরাবর এর অবস্থান। ঐতিহাসিক নানকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই এলাকায় যে রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তার প্রতিফলন ঘটে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও। উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা যেমন ছিল গর্ব করার মতো, তেমনি দালালদের সংখ্যাও ছিল অনেক। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার লক্ষ্যে দালালদের ১৭ জনকে নিয়ে হানাদার সৈন্যরা গঠন করে মজলিশে শুরা। পরিকল্পনা মাফিক কুকর্ম সম্পাদন করে পাকিস্তানি হায়েনা এবং তাদের এ দেশীয় বশংবদরা। বিয়ানীবাজার ডাকবাংলোর রান্নাঘরকে তারা পরিণত করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এই ক্যাম্পেই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অসংখ্য যুবক, প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ। এর অদূরে টিলাসংলগ্ন একটি কাঁঠালগাছের তলাকে পরিণত করা হয় বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমিতে প্রাণ দিয়েছেন শতাধিক বঙ্গসন্তান। ডাকবাংলোর রুদ্ধ কক্ষে ইজ্জত দিয়েছেন যেসব জায়া-জননী, তাঁদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হতো। এতে কেউ রাজি হলে (অস্ত্রের মুখে) নামেমাত্র বিয়েও করত আবদুল হক কুটুমনা। ধরে আনা ওইসব মা-বোনদের ভোগ করত পাকসেনা ও কুটুমনারা সম্মিলিতভাবে। এভাবে যে কত রমণীর ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে তারা, তার ইয়ত্তা নেই। হাইড়ির লড়াই বিশ্বাসের মেয়ে অঞ্জলি বিশ্বাসকে জোরপূর্বক ধরে এনে বিয়ে করে কুটুমনা। সুপাতলার মহানন্দ ঘোষের বাড়িতেই আটকে রাখা হয় তাঁকে। পর্যায়ক্রমে ভোগ করত সবাই তাঁকে ভাগাভাগি করে। অবশেষে অঞ্জলিকে বিয়ে দেয়া হয় ক্যাপ্টেন গণ্ডলের সাথে। কিছুদিন পর আবার তাঁকে বিয়ে করে কুটুমনা। গোবিন্দ শ্রীর অজয় পুরকায়স্থের ভাগ্নিকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায় চারখাই ক্যাম্পে। ৩-৪ দিন সেখানে আটকে রাখে তারা তাঁকে। মাথিউরা গ্রামের মহেন্দ্র দাশের মেয়ে জ্যোলা এবং নরেন্দ্র দাশের মেয়ে কল্পনাকে ধরে এনে গণ্ডলের দরবারে দু দিন আটকে রাখা হয়। একদিন আওয়ামী লীগ কর্মী মনির আহমদের যুবতী কন্যাকে জোর করে ধরে আনতে তাঁর বাড়িতে যায় আবদুল হক কুটুমনা। সঙ্গে তার বিরাট রাজাকার বাহিনী। অসহায় মনির আহমদ চাপাচাপির মুখে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে দু দিনের সময় প্রার্থনা করেন। তারপর সে রাতেই মনির আহমদ মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান ভারতে। এভাবেই তিনি রক্ষা করেন নিজের মেয়ের ইজ্জত। কিন্তু তার আগে মনির আহমদের এক মেয়েকে রাজাকাররা ধরে এনে এক রাত আটকে রাখে কসবা গ্রামের এক মক্তব ঘরে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিয়ানীবাজার থানা সদরে আসার পরই বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভস্মীভূত হয়ে যায় থানা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, আয়াজউদ্দিনের ধান ভাঙার কলসহ অনেকগুলো দোকানপাট। বিভিন্ন এলাকা থেকে দালালদের সহযোগিতায় নিরীহ-নিরস্ত্র লোকজনকে ধরে এনে থানা সদরের কাঁঠালতলায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এদের সংখ্যা শতাধিক হলেও সকলের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বিয়ানীবাজার উপজেলা সদরের কাছেই কসবা গ্রাম। এ গ্রামের বড়বাড়িয়া আবদুল মান্নান ছিলেন একজন জনপ্রিয় ক্রীড়া সংগঠক। আওয়ামী লীগ করতেন। তাঁর ভাই আবদুল আজিজ ছিলেন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু আবদুল আজিজ তখন ভারতে। একদিন আবদুল মান্নানকে ক্যাপ্টেন গণ্ডলের দরবারে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আবদুল মান্নান ঘৃণাভরে সে নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করলে পাক হায়েনারা চড়াও হয় তাঁর বাড়িতে। পুড়িয়ে দেয় তাঁর বাড়ি। ধরে নিয়ে যায় আবদুল মান্নানের স্ত্রীকে। আটকে রাখা হয় তাঁকে গণ্ডলের ক্যাম্পে। স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষায় উন্মাদ আবদুল মান্নান পরদিন বাধ্য হয়ে হাজির হন গণ্ডলের দরবারে। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কাঁঠালতলার বধ্যভূমিতে। স্বামীর জীবনের বিনিময়ে রক্ষা পায় স্ত্রীর সম্ভ্রম। এই কাঁঠালতলাতেই নিয়ে হত্যা করা হয় বাজার প্রহরী ছলু মিয়াকে। সুপাতলার মিছির আলীকে কর্মরত অবস্থায় একদিন পাকড়াও করে নিয়ে আসা হয়। তাঁকেও হত্যা করা হয় ওই নির্দিষ্ট বধ্যভূমিতে। কসবা গ্রামের আবদুল কাদিরের ছোট্ট একটি শিশুপুত্রকেও হত্যা করেছিল পশুরা নিতান্ত খেলাচ্ছলে। শ্রীধরা গ্রাম থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছিল আফতাব আলীকে।
বন্দিশিবিরে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছে অসংখ্য বিয়ানীবাজারবাসীকে। নির্যাতন করা হয়েছে অমানুষিকভাবে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন বিয়ানীবাজার উপজেলার অসংখ্য তরুণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শেষে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে অনেককে। স্বাধীনতার পর শতাধিক লোকের কঙ্কাল কাঁঠালগাছের তলায় স্তূপীকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেগুলো একটি গর্তে মাটিচাপা দিয়ে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত