You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.25 | বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় গণহত্যা ও গণকবর | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় গণহত্যা ও গণকবর, সিলেট

২৫ মে বিকেলে সিলেটের বালাগঞ্জে এসে খানসেনারা ঘোষণা করে, পরদিন সকালে বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ে একটি সভা করে নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুবিধার্থে সবাইকে পরিচয়পত্র দেয়া হবে। আশপাশের প্রতিটি গ্রামের পুরুষরা যেন অবশ্যই সে সময় উপস্থিত থাকেন। এ নির্দেশ শুনে অনেকে আশ্বস্ত হলেও কারো কারো মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে।
পরের দিন সকাল ৮টার পর হতে এলাকাবাসী যথারীতি নির্দিষ্ট স্থানে এসে জমা হতে থাকেন। কজন দালালসহ পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন খানের নেতৃত্বে একদল পাকিস্তানি হায়েনাও ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌছে যায়। এসেই কয়েকজন বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের চারপাশে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যরা পার্শ্ববর্তী কিছু বাড়িতে গিয়ে পুরুষদের সভায় আসার তাগিদ দেয়, লুটপাট করে এবং নারী নির্যাতন চালায়।
সকাল ১০টার দিকে জল্লাদরা উপস্থিত লোকজনকে দু ভাগ করে বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের উত্তর দিকের ভবনে মুসলমানদের এবং পূর্ব দিকের ঘরে হিন্দুদেরকে নিয়ে রাখে। অল্পক্ষণ পর আবার প্রথম ভাগের মধ্য থেকে নেতৃস্থানীয়দের পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে অন্যদের ছেড়ে দেয়। এতে অনেকের মনেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন এক দালাল আশ্বাস দেয়, “ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা কাউকে নিমন্ত্রণ করে এনে হত্যা করে না।’ একই সাথে কার টাকা- পয়সা ও সোনাদানা কোথায় আছে সে খবর প্রকাশের জন্যও চাপ দিতে থাকে।
এভাবে আরও প্রায় এক ঘন্টা চলে যায়। এক পর্যায়ে তারা অস্ত্রের মুখে লাগোয়া বাজার হতে দড়ি আনায়। পরে আটক নেতৃস্থানীয় মুসলমানদের পূর্ব দিকের ভবনে জড়ো করে হিন্দু সম্প্রদায়ের শখানেক লোককে বাঁধতে বাধ্য করে। এ কাজ করতে কেউ কেউ অসম্মতি জ্ঞাপন করায় নানা ধরনের হুমকির শিকার হন। যখন এই বাঁধার কাজ চলছিল, ঠিক তখন একজন প্রাথমিক শিক্ষক কৌশলে বন্ধ একটি জানালা খুলে ফেলেন। একজন খানসেনা সে সময় বাইরে থেকে ঘরের দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল; কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে বুরুঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও এক যুবক লাফিয়ে পড়ে দৌড়াতে শুরু করলে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তবে দুজনই নির্বিঘ্নে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে সক্ষম হন।
প্রায় দুপুর ১২টায় বন্দি হিন্দুদের বুরুঙ্গা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের সবুজ চত্বরে একটি গাছের নিচে এসে বসানো হয়। ইতিপূর্বে পশ্চিমা জল্লাদরা স্থানটিকে ঘিরে ফেলে এবং ৩টি এলএমজি প্রস্তুত করে নেয়। এক সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন নূর উদ্দিন খানের নিকট থেকে নির্দেশ পাওয়া যায়। অমনি প্রতিটি অস্ত্র ‘খই’ ফোটাতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে একটি পবিত্র অঙ্গন রক্তে লাল হয়ে যায়। তবে বিশিষ্ট আইনজীবী রামরঞ্জন ভট্টাচার্যকে আলাদাভাবে বারান্দায় চেয়ারে বসিয়ে কিছুক্ষণ পর হত্যা করা হয়।
পশ্চিমারা রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার পরও এতজন বাঙালির মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিল না। তাই এক ব্যক্তিকে দিয়ে বুরুঙ্গা বাজার থেকে দু টিন কেরোসিন আনিয়ে লুটিয়ে পড়ে থাকা সকলের ওপর ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আহতদের আর্তচিৎকার আর মানুষ পোড়া গন্ধে তখন বাতাস ভারী হয়ে ওঠে; কিন্তু হায়নার দল বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে পৈশাচিক উল্লাস করতে করতে বেলা ১টা নাগাদ ফিরে যেতে শুরু করে। এ সময় বেঁচে গেছি মনে করে গুলিবিদ্ধ একজন উচ্চস্বরে স্রষ্টার নাম উচ্চারণ করামাত্র আবার ছুটে এসে হতাহতদের ওপর আরেক দফা গুলি চালায়। অবশ্য এত কিছু সত্ত্বেও বেশ কজন বেঁচে যান, তবে সবাই কমবেশি আহত হন। পরদিন সকালে লাশগুলো পাশেই একটি গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়।
[৪৩৭] আল আজাদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত