You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.23 | ফরেস্ট ঘাট গণহত্যা | খুলনা - সংগ্রামের নোটবুক

ফরেস্ট ঘাট গণহত্যা, খুলনা

খুলনা শহরে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত ফরেস্ট ঘাট ছিল ১৯৭১ সালের ঘাতকদের আর এক জল্লাদখানা। খুলনার জেলা জজের বাংলোসংলগ্ন এ ঘাটটি তখন বাগান পরিবেষ্টিত ছিল। অনতিদূরে কয়েকটি সরকারি বাসভবন ছাড়া কোনো সাধারণ আবাসন ছিল না বিধায় এ জায়গাটিতে রাতের বেলায় সাধারণ মানুষ চলাচল করত না। কেবল দিনের বেলা নদী পারাপার ও ঘাটের কাজে কিছু লোক এ ঘাট ব্যবহার করত। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ভয়ে এ ঘাটের ব্যবহার বন্ধ হয় যায়। এটি তখন ঘাতকদের দখল থাকত। এখানে ঘাট থাকায় নদীর কিনারা পর্যন্ত সহজে যাওয়া সম্ভব হতো বিধায় ঘাতক রাজাকাররা এটাকে একটি উপযুক্ত জল্লাদখানা হিসেবে বেছে নেয়। কারণ হত্যার পর লাশগুলো ঠেলে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই নদীর স্রোতে সেগুলো সহজেই ভেসে যেত। ফলে ঘাট পরিষ্কার হয়ে যেত। এখানে প্রতিদিন গড়ে বিশজনকে জবাই করে পেট চিরে নদীতে ফেলে দিত বলে জানা যায়। এ ঘাটে যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে খুলনার কয়েকজন সুপরিচিত ব্যক্তিও ছিলেন। এদের মধ্যে খুলনার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার এবং ক্লে রোডের লাকী মেডিসিন সাপ্লাই নামক ঔষধের দোকানের মালিক আবুল কাসেমের ভাই নজরুল ইসলাম অন্যতম। অ্যাডভোকেট জব্বারকে ২৩ জুন রাতে পাকবাহিনী বাসা থেকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। খুলনা শহরে অবস্থিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এফ.এম. মাকসুদুর রহমানসহ ৪১ জনকে হেলিপ্যাডসহ বিভিন্ন স্থানে অকথ্য নির্যাতনের পর এক রাতে এ ঘাটে এনে পর্যায়ক্রমে জবাই করে নদীতে লাথি মেরে ফেলতে থাকে। কয়েকজনকে এভাবে হত্যা করার পর ক্রমানুযায়ী যখন মাকসুদুর রহমানকে জল্লাদের সামনে দাঁড় করানো হয় তখন তিনি মৃত্যু নিশ্চিত জেনে জল্লাদকে জাপটে ধরে নদীতে ঝাঁপ দেন। এরপর ডুবে ডুবে কিছুদূর এসে নদীতে নোঙ্গর করা একটি লঞ্চের রশি ধরেন ও লঞ্চ কর্মচারীদের সহযোগিতায় উঠে আসেন। এখানে অসংখ্য লোক নিহত হলেও অন্যান্য নিহতদের কোনো পরিচয় জানা যায়নি। এই কাস্টম ঘাটের নিকটেই ছিল পুলিশের রেশন স্টোর। এখানে ৩০ জন পুলিশ ও অফিস সহকারী তখন কর্মরত ছিল। পাকসেনারা প্রায়ই এ অফিস থেকে কর্মচারীদের ডেকে নিয়ে তাদের হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করার কাজে যোগ দিতে বাধ্য করত। তারা পাকসেনাদের নির্দেশ মোতাবেক বন্দীদের হাত শক্ত করে ধরে রাখত আর পাকসেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বন্দিদের সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে ফেলত এবং শেষে লাথি মেরে নদীতে ফেলে দিত | পুলিশ রেশন স্টোরের কর্মচারী আব্দুর রব ও শাহাদাৎ পাকসেনাদের এ ধরনের হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করার পর অফিসে ফিরে এসে সহকর্মীদের নিকট ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তিনি আরো জানান যে, এ ঘাটে প্রতিদিন প্রকাশ্য দিবালোকে গড়ে ৬-৭ জনকে হত্যা করা হতো। রাতে এর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। ঘাটের কাঠের তৈরি জেটির মেঝেতে রক্ত জাট হয়ে পুরু আস্তরণের সৃষ্টি হয়। মানুষের অসংখ্য জুতা-সেন্ডেল ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পড়ে ছিল। তিনি জানান, ভৈরব নদীতে কচুরিপানার মতো অসংখ্য লাশ ভেসে যেতে দেখেছি। সুতরাং এখানে যে শত শত মানুষ হত্যা করা হয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
প্রতিরাতে ফরেস্ট ঘাটের হত্যাকাণ্ডের সময় মৃত্যুপথযাত্রীদের আহাজারি ও মৃত্যু যন্ত্রণার মর্মস্পর্শী কাতরানির শব্দ শুনতে শুনতে পাশে অবস্থিত বাসভবনে তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ খোন্দকার নেছারুল হক ৩০ মে তারিখে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জানা যায়, তিনি এ নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে একদিন এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সামকি কর্মকর্তাকে বিচারালয়ের সামনে এ ধরনের নৃশংসতা না ঘটানোর অনুরোধ করলে সামরিক অফিসারটি তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয় এবং তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। এরপরও আগের মতোই হত্যাযজ্ঞ চালালে তা সইতে না পেরে তিনিই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনার একদিন পর একইভাবে মারা যায় তাঁর কর্মচারী সৈয়দ কায়ছার আলী এবং তার কয়েক দিনের মধ্যে একইভাবে মারা যায় তাঁর পিয়ন আব্দুর রউফ। বাস্তবিক অর্থেই পাকসেনাদের নৃশংসতা সকল শ্রেণী, পেশা ও অবস্থানের মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এ নৃশংসতা কোন পাকসেনাকে ব্যথিত করতেও পারেনি। তারা রক্তের হোলি খেলায় এতই উন্মত্ত হয়ে পড়ে যে, একজন বিচারপতির নির্দেশকে কেবল উপেক্ষাই করেনি, তাঁকে হত্যা করাও হুমকি দেয়। আইনের প্রতি যে তাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। ও এ ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্টভাবেই তা প্রমাণিত হয়। বাঙালিরা সকারের যত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই হোন না কেন যে কোনো অধস্তন পশ্চিম পাকিস্তানি তাদের তাচ্ছিল্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না।
[৯২] মোল্লা আমীর হোসেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত