You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মুসা সাদিকের লেখা - সংগ্রামের নোটবুক

মুসা সাদিক তাঁর “১৫ই আগস্ট ট্রাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়” বইতে লিখেছেন – 

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমি বঙ্গভবনে ছিলাম৷ ১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ এবং সেই সাথে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সাথে সংযুক্ত অফিসার হিসেবে আমি কর্মরত ছিলাম৷ ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের মহান বিজয়ের পরে ২১শে ডিসেম্বর থেকে আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির অফিসে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলাম৷ বঙ্গভবনে বিভিন্ন সময়ে ছয়জন রাষ্ট্রপতির এবং ১৯৯১ সালে প্রথম কেয়ার টেকার সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের সময় অর্থাৎ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আমি বঙ্গভবনে উচ্চ পদে বহাল ছিলাম৷ ১৯৭১-এ পিস কমিটির চেয়ারম্যান স্বাধীনতা বিরোধী আব্দুর রহমান বিশ্বাস বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৯১ সালের যেদিন প্রবেশ করেন, তার পরদিনই তিনি বঙ্গভবন থেকে আমাকে বিদায় করে দেন৷ ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বঙ্গভবনের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সরকারের উত্থান-পতন, হত্যা-ক্যু, পাল্টা ক্যু- ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল এবং মন্ত্রি, সচিব ও জেনারেলদের খোলস বদল, ভোল বদল ও চরিত্র বদল আমার চোখের সামনে ঘটেছে৷
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনককে হত্যার পর থেকে খুনি মোশতাক-জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভবন, সচিবালয় ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মহান দেশপ্রেমিক সামরিক-বেসামরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দুঃসাহসিক প্রতিরোধের গোপন কার্যক্রমের সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলাম৷ বঙ্গবন্ধুর খুনি এজিদদের উৎখাতে জীবন উৎসর্গের প্রতিজ্ঞায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব দুঃসাহসিক অভিযানের সফলতা, ব্যর্থতা আমি সংযুক্ত থেকে প্রত্যক্ষ করেছি ও শাস্তি ভোগ করেছি৷ জাতির জনককে হারানোর পর বেদনার্ত বক্ষে আমি খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে চলেছি৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খুনি চক্রের গোপন ও প্রকাশ্য সকল তথ্য ও উপাত্ত আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করে যে, তারা ১৯৭৫ সালে আপাতদৃষ্টে বঙ্গবন্ধুকে খুন করে বটে, তবে তাদের মূল নিশানা ছিল বাংলাদেশকে খুন করে সমাধিস্থ করা এবং পূর্ব পাকিস্তান পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করা৷
‘৭১-এ বীর বাঙালি মুক্তি সেনারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দর্প চূর্ণ করে প্রায় এক লক্ষ হানাদার পাক সেনাকে পরাজিত ও বন্দি করে, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে বাংলাদেশ যে হীন ও হতভাগা জাতিতে পরিণত হয়েছে— সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পশ্চাতে পাকিস্তান ও তার সহযোগী আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য৷
১৯৭২-১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ছয়জন রাষ্ট্রপতির সাথে দেশ- বিদেশে এবং ১৯৯২-২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে-বিদেশে অন্যান্য সরকারি ভ্রমণের সুযোগে বহু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা সরকারি উচ্চ পদস্থ সচিব, জেনারেল এবং Royal family বঙ্গবন্ধু হত্যা বিষয়ে অনেক অজানা ও গোপন তথ্য আমাকে দিয়েছেন৷ বহু তথ্য তদন্ত করে আমি বাদ দিয়েছি৷ কিন্তু অনেক তথ্য তদন্তে ও পাল্টা তদন্তের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় তা আমি এ বইতে সন্নিবেশিত করেছি৷ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু ব্যক্তির বিষয়ে অনেক গোপন-অজানা ঘটনা ও কার্যক্রম পাঠক এ বইতে জানতে পারবেন৷ কিন্তু কলেবর বৃদ্ধি পাবে বলে দেশি- বিদেশি আরও অনেক ষড়যন্ত্রকারীর ভূমিকার বিষয়সমূহ এ বইতে অন্তর্ভূক্ত করা থেকে বিরত থাকলাম৷ আশা করি, দ্বিতীয় খন্ডে পাঠক তাদের বিষয়ে আরও জানতে পারবেন এবং এই বই পড়ে দেশবাসী ও বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে যাবেন৷
বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন লিখে রেখে গেছেন: “Truth is stranger than fiction”. (সত্য, কল্প কাহিনীকেও হার মানায়)৷ মোশতাক-জিয়া-ডালিম-ফারুক-তাহের উদ্দীন ঠাকুর-শাহ মোয়াজ্জেম গং বঙ্গবন্ধুর পায়ে কদমবুসি করে তাঁর পদতলে বসে পড়ে তাদের জীবন ধন্য করতো৷ কিন্তু ১৫ই আগস্ট এই খুনি চক্র তাঁকে হত্যা করে তাঁর লাশ সিঁড়িতে ফেলে রেখে তার নামে নোংরা কটুক্তি করে সদম্ভে বঙ্গভবনে শপথ নেয়৷ সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যেসব সচিব খুনি মোশতাকের পায়ে কদমবুসি করে বীরদর্পে তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছে- গিরগিটির মতো রঙ বদলকারী সেসব মুখোশধারী বিশ্বাসঘাতক বর্ণচোরা সচিব এইচ.টি. ইমামরা বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত থেকেও মন্ত্রি ও উপদেষ্টার মুকুট পরে সদম্ভে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে! যদি এইচ.টি. ইমামদের মতো ৫০ জন সিএসপি সচিবের স্থলে ১৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগের ৫০ জন পিওন বাংলাদেশ সরকারের ৫০টি মন্ত্রণালয়ের সচিবের আসনে আসীন থাকতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বঙ্গভবনে মোশতাককে এনে খুনিদের সরকার ১ মিনিটও স্থায়ী করতে পারতো না৷ আওয়ামী লীগের ৫০ জন পিওন ১৫ই আগস্টের সকালে সচিবালয় বন্ধ করে ওয়াসার পানি বন্ধ করে দিতো, টিএন্ডটি’র টেলিফোন লাইন অচল করে দিতো, পিডিবি’র লাইন অফ করে বিদ্যুৎ কেটে দিতো, রেডিও-টিভি অফ করে দিতো, গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিতো৷ এভাবে ঢাকাবাসীর বুকে কেয়ামত নাযিল করে দিতো৷ শুধু তাহলেই ১৫ই আগস্ট দুপুরের আগেই ঢাকাবাসী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের টুকরা টুকরা করে কেটে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিতো৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ও বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী ৫০ জন সিএসপি সচিব বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতে হাত মেলালে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের স্বপ্ন ১৫ই আগস্টে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়৷
অথচ, তারা আজও বহাল তরিয়তে আছে এবং নিরন্তর তারা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু বলে সাধু-সন্ন্যাসীর বেশে বাঙালি জাতিকে সদুপদেশ-হিতোপদেশ বিতরণ করে যাচ্ছে! বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের নব প্রজন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোয় আলোকিত লক্ষ-কোটি বাঙালি ভাই-বোন এই সব খুনি দেশদ্রোহীদের দম্ভ প্রত্যক্ষ করে হতভম্বচিত্তে বেদনায় থর থর বক্ষে অশ্রুসজল নেত্রে বিশ্বকবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে পাপ মোচনের প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করে:
“সেই হোমানলে হের আজি জ্বলে
দুঃখের রক্ত শিখা,
হবে তা সহিতে, মর্মে দহিতে
আজ সে ভাগ্যে লিখা৷ ”
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ-বিদ্রোহী কবি নজরুলের বাংলাদেশে জলে-স্থলে, বনভূমি ও নদীর কূলে, প্রজাপতি-ফড়িং-পাখির কল-কাকলিতে, লক্ষ-কোটি মানব-মানবীর মরমী কণ্ঠস্বরে ভাসমান-বহমান, আত্মার অমর সঙ্গীত
“যদি রাত পোহালেই শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই,
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই”,
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে যদি তা সত্য করে দিতেন, তাহলে, ভণ্ড, ভোল বদলকারী, রং বদলকারী, সুরত বদলকারী, মুখোশধারী সেক্সপিয়রের ওথেলো নাটকের বর্ণচোরা ইয়াগোদের খুনি চেহারা দেখে বঙ্গবন্ধু চমকে উঠতেন এবং এই বই লেখা আমার সার্থক হতো৷
প্রবাদ আছে যে, বহু দেশে তাদের জীবিত নেতার চেয়ে, তাদের মৃত নেতা অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠেন৷ বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে প্রবাদ বাক্যটি লক্ষ কোটি গুণে সত্য প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশে৷ পাকিস্তান ও বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধরেরা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন হত্যা করে, তখন বঙ্গভবন-সচিবালয়-ঢাকাসহ ৫৪০০০ বর্গমাইলের বাংলাদেশ সংজ্ঞাহীন, শোকে পাথর, মুহ্যমান, অবশ হয়েছিল বাংলাদেশের দিনরাত্রি! হিমালয় পতনের অবিশ্বাসে ও আকস্মিকতায় নিষ্প্রাণ-নিঃসাড়-নিস্তব্ধ- শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ!!
নিকষ কালো সেই অবশ আঁধারে বঙ্গজননীর বুক চিরে কার নাম জপ করে ফেরে উদ্ভ্রান্ত-দিক-ভ্রান্ত বোবা বাঙালির কাফেলা? গোলা-গুলি কারফিউ-এর মধ্যে স্বর্গ থেকে কোন সে বীর প্রমিথিউস আলোক রশ্মির সংকেত দেয় নিষ্প্রাণ-নিঃসাড়-বাঙালির সংজ্ঞাহীন, প্রাণহীন দেহে?
বঙ্গজননীর সেই মহান সন্তান, বঙ্গবন্ধুর নামের জাদুমন্ত্রে ধীরলয়ে জেগে ওঠে বাঙালির সম্বিৎ৷ বাঙালির প্রাণহীন দেহে ফেরে প্রাণের স্পন্দন৷ সাত আসমান ভেদ করে কানে তার ভেসে আসে অমিয় বাণী:
যতদিন রবে পদ্মা যুমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান৷
মরণজয়ী বীর বাঙালি চকিতে ‘জয় বাংলা’ বলে গর্জে ওঠে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে জেগে ওঠে ত্রিশ লক্ষ শহীদের দেশ, বাংলাদেশ৷
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের ট্রাজেডির পর বাঙালির হৃদয়ের রাজ সিংহাসন অলংকৃত করে বঙ্গবন্ধু পুনরায় স্বর্গীয় আলোর কিরণে বাংলাদেশকে উদ্ভাসিত করে ফিরে এসেছেন তাঁর পুণ্যের মন্দির বাংলাদেশে৷ বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা৷
“১৫ই আগস্ট ট্রাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়” বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের সোনার বাংলার বিশ্বাসঘাতক বেসামরিক ও সামরিক অফিসারদের কলঙ্কের কলঙ্কিত অধ্যায়৷
মুসা সাদিক
০৪ জানুয়ারি, ২০১৭

মুখবন্ধ

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন৷ হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের পূণ্যময় আত্মদানের ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বীরের জাতি বাঙালি মহান বিজয় অর্জন করে৷ বাঙালি জাতির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বব্যাপী বাঙালি জাতিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীরের জাতির গৌরবে গৌরবান্বিত করেন৷ সেই থেকে বাঙালির শিরে বীরত্বের মুকুট শোভা পাচ্ছে৷ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম “বলো বীর চির উন্নত মম শির” বলে যে বীর বাঙালির চোখের তারায় স্বপ্ন রেখা এঁকেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই বাঙালির শিরে সেই বীরত্বের ও বিক্রমের জ্যোতির্ময় গৌরব মহিমার মুকুট পরিয়ে দিয়ে গেছেন৷ বীরের জাতির খ্যাতি ও মহিমায় মহিমান্বিত বাঙালি জাতির প্রাতঃস্মরণীয় নাম- শেখ মুজিবুর রহমান৷ বীর বাঙালির অনুপ্রেরণার অসীম উৎসের পূণ্যময় নাম- শেখ মুজিবুর রহমান৷ আফ্রো-এশিয়ার মুক্তিকামী মানুষের মহান মুক্তিদূতের নাম- শেখ মুজিবুর রহমান৷ মুক্তিকামী বিশ্বের দিকে দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাতঃস্মরণীয় বীর নায়কের নাম- শেখ মুজিবুর রহমান৷
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ঊষালগ্নে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের দেশীয় এজিদেরা তাঁকে হত্যা করে বাঙালি জাতিকে এতিম করে দেয়৷ বীর বাঙালি জাতিকে শোক স্তব্ধ পাথর জাতিতে পরিণত করে দেয়!! মুসা সাদিকের লেখা ‘১৫ই আগস্ট ট্রাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়’ বই ১৫ই আগস্টের শোক স্তব্ধ পাথর জাতির পাথর ভাঙ্গার মর্মবেদনা, দীর্ঘশ্বাস ও অশ্রুজল৷ বিশ্বব্যাপী খৃস্টান জাতি যিশু খৃস্টকে পেরেক বিদ্ধ করে হত্যার মর্মযাতনা যেভাবে শত-সহস্র বর্ষব্যাপী বয়ে বেড়াচ্ছে, তেমনিভাবে বাঙালি জাতির মুক্তিদূত, বাঙালি জাতির অমর নাম শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মর্মবেদনা অশ্রুসিক্ত নয়নে বাঙালি জাতি শত-সহস্র বর্ষব্যাপী মাতম করে বেড়াবে৷
আজ ও অনন্তকালব্যাপী বঙ্গজননীরা যাঁর পথ পানে চেয়ে, যাঁর পূণ্য নাম ধরে আল্লাহ’র কাছে ফরিয়াদ করে বলবেন, আল্লাহ ঘরে ঘরে দাও মানবজাতির সেই পরম আরাধ্য বীর সন্তান- যাঁর পূণ্যময় নাম শেখ মুজিবুর রহমান৷ মুসা সাদিকের ‘১৫ই আগস্ট ট্রাজেডি ও বঙ্গভবনের অজানা অধ্যায়’ শোক স্তব্ধ বাঙালি জাতির শোকগাঁথা এক সাগর অশ্রুজল— শোকে পাথর বাঙালি জাতির পাথর ভাঙ্গা মর্মভেদি বেদনায় কাতর কৃষ্ণ তাজমহল৷
প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার মাধ্যমে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে আঁতুর ঘরেই হত্যার নীল নকশা করা হয়৷ ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর থেকে বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটা মৃত দেশের মতো পড়েছিল৷ বিশ্ব মানব জাতির দুয়ারে দুয়ারে বাঙালি জাতি, খুনের দায়ে কলঙ্কিত একটি জাতি হিসেবে এতিমের মতো ভিক্ষা মেঙ্গে, দয়া ভিক্ষা করে, দাতাদের ভর্ৎসনা ও বহু দেশের রক্ত-চক্ষু দেখে যেতো হতভাগ্য এ জাতির! অথচ ‘৭১ সালে বিশ্বব্যাপী এক ঝাঁক নক্ষত্রের মতো নাম শোনা যেতো ব্রেজনেভ, দ্য গলে, আলেন্দে, মার্শাল টিটো, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিব, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলা…৷ আকাশ ভরা তারার মেলায় উদীয়মান জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ছিলেন শেখ মুজিব আর তাঁর সোনার বাংলা৷
‘৭১-এর বাঙালি জাতির বিস্ময়কর বিজয়ের পর বিশ্বব্যাপী ধন্য ধন্য রব উঠেছিল বাংলাদেশের নামে৷ বিশ্বব্যাপী জয়ধ্বনি উঠেছিল বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে৷ বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাস খোলার ও রাষ্ট্রদূত পাঠানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল৷ বিশ্বের নানান দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা বাংলাদেশে এসে সম-সাময়িক বিশ্বের বিস্ময় নেতা শেখ মুজিবকে এক পলক দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন৷ কিন্তু ঢাকায় এত দূতাবাস খোলার মতো ভবন ও আয়োজন বাংলাদেশ করে উঠতে পারছিল না৷ বহু হোটেলে বাংলাদেশ সরকার তাদের অফিস খোলার ব্যবস্থা করে দেয়৷
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে আগত ফ্রান্সের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. ভুভুশেলে৷ তাঁর অফিসের স্পেস দেয়া হয় হোটেল পূর্বাণীতে৷ আমি তখন বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী স্যারের অফিসার৷ বিশাল বপুর অধিকারী ড. ডুভুশেলে প্রায়ই তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং বঙ্গভবনের দেয়ালের অপর পাশেই তাঁর অফিস বিধায় আমি মাঝে মাঝেই যেতাম৷ (সুস্বাদু ফ্রেঞ্চ চিজ এবং টক-মিষ্টি ফ্রেঞ্চ ফ্রুটস কেকসহ তাঁর আপ্যায়ন বিস্মৃত হবার নয়৷) আমেরিকার মিত্র হওয়া সত্ত্বেও ‘৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ফরাসী সরকারের বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সমর্থন দানের কথা তিনি গর্বের সাথে প্রতিবার উল্লেখ করতেন৷ ফ্রান্সের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক আঁদ্রে মার্লো মুজিবনগরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ ব্যক্ত করে সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করেন৷ রণাঙ্গনের ‘ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ হিসেবে আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের রক্তাক্ত যুদ্ধের বর্ণনা তিনি শুনতে চাইতেন এবং পুলকিত হতেন৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্যারিসের হিংস্র নাৎসী বাহিনীর প্রতিরোধ যুদ্ধে তাঁর পরিবার অংশ নিয়েছিলেন বলে তিনি বিশেষ করে, বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা, বিক্রমের কথা ও শহীদ হবার পূণ্যময় ঘটনার কথা বার বার আন্তরিকতার সাথে শুনতে চাইতেন৷ কখনো কোনো বেদনার স্মৃতি উন্মোচনের সময় আমার কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে আসতো৷ (রণাঙ্গনের আর্তনাদ ও মৃত্যুর চেহারা তখনও জ্বলজ্বল করে আমার দু’ চোখে ভেসে উঠতো৷) চোখ দুটো তখন অশ্রু সজল হয়ে যেতো৷ আমি থেমে যেতাম৷ ভিনদেশি মানবতাবাদী ড. ডুভুশেলের চোখেও জল দেখতাম৷ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রকৃত এক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী৷
তিনি যাবার সময় আমার হাত ধরে বলেছিলেন প্যারিসে গেলে আমি যেন তাঁর আতিথেয়তা গ্রহণ করে তাঁকে ধন্য ও কৃতজ্ঞ করি৷ আমার মতো নবীন অফিসারের প্রতি তাঁর সর্বোত্তম সৌজন্যতার ও বদান্যতার কথা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে৷ কিন্তু তার চেয়ে আমার স্মৃতিতে চির অম্লান হয়ে আছে তাঁর বিদায়লগ্নে তাঁর আনুষ্ঠানিক ডিনারে হোটেল পূর্বাণীতে আমিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মতিন চৌধুরী, প্রফেসর ড. কোরেশী, প্রফেসর কবির চৌধুরী, সম্পাদক ওবায়দুল হক, খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমিন তালুকদার, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল প্রমুখদের সাথে সে সময়ের যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং মুক্তিযোদ্ধা ও যুব সমাজের নয়ন মণি শেখ ফজলুল হক মণির উপস্থিতিতে তাঁর দেয়া ভাষণটি৷ মনে পড়ে কয়েকজন ছাত্র নেতা আ.স.ম. রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশাহ উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ আফটার ডিনার স্পিচ-এ ড. ভুভুশেলে বলেছিলেন, “বাংলাদেশ এক অমিত সম্ভাবনার দেশ৷ বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ বীরদের দেশ হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছে৷ যে যুদ্ধে বাংলাদেশের নিশ্চিত পরাজয় ধরে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলো ভয়াবহ এক ট্রাজেডির দিন গুনছিলো- সেই যুদ্ধে এই জাতি বিস্ময়কর বিজয় অর্জন করে ইউরোপ-আমেরিকার রাজধানীগুলোর হিসাব-নিকাশ সব উল্টে-পাল্টে দিয়েছে৷”

পৃষ্ঠা: ১৫
একথা উল্লেখ করে তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে আরও বলেছিলেন, “এই বিস্ময়কর বিজয়ের পশ্চাতে ছিল ‘শেখ মুজিবের যাদুকরী নাম’৷ বিশ্বে কোনো জাতির মধ্যে এমন কোনো ‘যাদুকরী নাম’ সৃষ্টি হয়নি, যার নাম মুখে নিয়ে, একটি জাতি যুদ্ধ করেছে, যার নাম মুখে নিয়ে ৩০ লাখ মানুষ হাসিমুখে জীবন দিয়েছে এবং এই পৃথিবীতে একটি দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে৷ বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশ সৃষ্টি হয়েছে৷ ‘শেখ মুজিব’ যাদুকরী নামটি সূর্যের চেয়েও প্রবল, পরাক্রমশালী ও মহা শক্তিশালী ছিল বলে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার মাইল দূরের কারাগারে পাকিস্তানিরা তাঁকে বন্দি করে রেখেও তাঁর নামের রশ্মিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের পক্ষে আনবিক শক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত সমর্থ হয়নি৷ সে সময় তাঁর নামের যাদুতে ফরাসি জাতিসহ বিশ্ববাসী বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে৷ সূর্যের রশ্মি যেমন কালো মেঘের আড়ালে বন্দি রাখা যায় না৷ তাঁর নামের রশ্মি ‘৭১ সালে সূর্য রশ্মিকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল৷”
তিনি বাংলাদেশের জন্য তাঁর স্বপ্নের কথা এই বলে শেষ করেছিলেন, “এমন বীরের বেশে যে জাতির জন্ম, সেই দেশ ও জাতি আগামী এক দশকের মধ্যে বিশ্বের অনেক দেশের কাছে ঈর্ষার দেশে পরিণত হবে এবং এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী জাতি হয়ে নেতৃত্ব দেবে৷”
ফ্রান্সের মাননীয় রাষ্ট্রদূত ড. ডুভুশেলে, তুমি কোথায় আছো জানি না, ১৫ কোটি বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তোমাকে সালাম ও অভিবাদন জানিয়ে বলি, যে যাদুকরী নাম ‘শেখ মুজিব’কে তুমি সূর্যের চেয়ে পরাক্রমশালী বলে শ্রদ্ধামণ্ডিত স্বীকারোক্তি করেছিল৷ সেই বীরের অস্তাচলে বাংলাদেশ প্রায় ২০ বছর মৃত লাশ হয়ে পড়েছিল৷ ‘৭১-এর বাংলাদেশের খোলস পড়েছিল৷ বাংলাদেশ ছিল না৷ ‘৭১-এর যে বাঙালি জাতি বীরত্বে- বিক্রমে বিশ্বব্যাপী নন্দিত-বন্দিত হয়েছিল, ‘৭১-এর সেই বাঙালি জাতি ‘৭৫ পরবর্তী ২০/২৫ বছর ধরে বিশ্বের দুয়ারে দুয়ারে অসহায় ও এতিমের ন্যায় লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, পদদলিত হয়েছিল৷
আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি নবাব সিরাজউদ্দৌলা বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হবার পূর্ব মুহূর্তে আক্ষেপ করে বলে গিয়েছিলেন: “বাঙালি দাঁত থাকতে তার দাঁতের মর্যাদা বোঝে না৷” তাঁর নিহত হবার পর ভারতবাসী স্বাধীনতা হারিয়ে ২০০ বছর ধরে পরাধীন ছিল৷ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হবার দু’শত আঠার বছর পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গের আরেক মহান অধিপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাসঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হবার পর বাংলাদেশ কঙ্কালসার মৃতদেহে পরিণত হয়েছিল এবং সত্যিকারের স্বাধীন জাতির মর্যাদা হারিয়ে বাঙালি জাতি পরাধীনের পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল৷ স্বাধীন জাতির স্বকীয় মর্যাদা ও ‘৭১-এর বীরের জাতির শৌর্য-বীর্য বিলীন হয়ে গিয়েছিল৷ দুর্নীতির পক্ষাঘাতে পঙ্গু বাংলাদেশকে সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ দেশসমূহের সাথে দেখানো হতো৷ আমেরিকান কংগ্রেস কয়েক বছর আগে কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্টে বাংলাদেশকে ব্যর্থ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল! যে আমেরিকার প্রবল বিরোধীতা ও প্রচণ্ড হুঙ্কারের মুখে বাংলাদেশ ‘৭১ সালে তার বিজয়ের ও স্বাধীনতার পতাকা নীল আকাশে পত্‌ পত্‌ করে উড়িয়ে দিয়েছিল, সেই আমেরিকা বাংলাদেশের কপালে ব্যর্থ, পঙ্গু রাষ্ট্রের সিল মোহর লাগিয়ে দিয়েছিল।
মহাত্মা গান্ধী জীবিত আছেন এমন দিনে বিশ্বের এমন কোনো শক্তি কি ছিল যে, ভারতের কপালে কলঙ্কের কালো তিলক লাগায়? কৃষ্ণ মানব জাতির মহামানব নেলসন ম্যান্ডেলার জীবদ্দশায় আফ্রিকার দিকে প্রশ্নের কোন আঙ্গুল তোলে এমন কোনো শক্তি বিশ্বের কোথাও ছিল কি? তিনি ছিলেন আফ্রিকার শক্তি ও সাহসের প্রতীক৷ আফ্রিকার হিমালয়৷ আফ্রিকার মায়েরা আজও স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা হবে আফ্রিকার মহান নেতা ম্যান্ডেলার মতো৷
বাংলাদেশের মায়েরা সন্তান কোলে নিয়ে কার মতো হবার স্বপ্ন দেখাবেন তাঁদের প্রাণপ্রিয় সন্তানদের? অথচ বাংলাদেশের মুক্তিদূত শেখ মুজিব নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির জন্য, আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসন অবসানের জন্য এবং রোডেশিয়ার (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) বর্ণবাদী শাসন অবসানের জন্য গরিব বাংলাদেশ থেকে ১৯৭২ সালে বিরাট অঙ্কের অর্থ প্রেরণ করেছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে (এপ্রিল মাসে বরাদ্দ ) ১২ মাসের বাজেটের জন্য নেয়া অর্থের বেঁচে যাওয়া ৩ মাসের অর্থ বঙ্গবন্ধু ফেরৎ না দিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর থেকে right off করিয়ে নেন৷ সেই অর্থ তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির আন্দোলন এবং আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার ২টি দেশের বর্ণবাদী শাসন অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ ও গণযুদ্ধের সাহায্যার্থে প্রেরণ করেন (মুজিবনগর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস প্রদত্ত তথ্য)৷
ষাটের ও সত্তরের দশকে বিশ্বের দিকে দিকে মানব জাতির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দিশারী ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিব৷ এশিয়া-আফ্রিকার মানব জাতির মুক্তিযুদ্ধে ও মুক্তি আন্দোলনে “শেখ মুজিব” নামটি ছিল এক অনন্ত ও অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস৷ বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চোখে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে শেখ মুজিবের অর্থ সাহায্য ও অস্ত্র সাহায্যের কর্ম তৎপরতা ছিল অদৃশ্য-অন্ধকারে ঢাকা৷ তাঁর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস (আমার মামা) এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পরিকল্পনা মন্ত্রী শ্রী ডি.পি. ধর, রুমানিয়ার প্রেসিডেন্ট চেসেস্কোর মাধ্যমে আফ্রিকার মুক্তি সংগ্রামীদের বঙ্গবন্ধুর দেয়া অর্থ ও অস্ত্র চালানোর গোপন অদৃশ্য কার্যক্রম পরিচালনা করেন৷ সত্তরের দশকে মুক্তিকামী বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্বব্যাপী এক নিঃশ্বাসে শেখ মুজিব-ফিডেল ক্যাস্ট্রো-চে গুয়েভারা-প্যাট্রিস লুমুম্বা-নেলসন ম্যান্ডেলার নাম নিতেন৷
এশিয়া-আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিদূত শেখ মুজিব আজ মানব জাতির মাঝে বেঁচে নেই৷ আফ্রিকার কৃষ্ণ মানব-মানবীর মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলা বেঁচে নেই৷ মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, শেখ মুজিব ও নেলসন ম্যান্ডেলা আজ এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা-ইউরোপবাসীর কাছে তথা বিশ্ব মানব জাতির কাছে এক প্রাতঃস্মরণীয় পূণ্য নাম৷ মানব জাতির স্বপ্নের এক প্রিয়তম নাম৷ বিশ্বের দেশে দেশে জননীরা স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা যেন হয় মানব জাতির মহান মুক্তিদূত শেখ মুজিব, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, চে গুয়েভারা, প্যাট্রিস লুমুম্বা, নেলসন ম্যান্ডেলার মতো৷ বাঙালি জাতির জনক আজ বেঁচে থাকলে বিশ্বের দেশে দেশে জননীরা আজ স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের সন্তানেরা যেন হয় এশিয়া-আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিদূত শেখ মুজিবের মতো৷
১৯৮৯ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা বাংলাদেশ সফরে আসেন৷ তিনি বঙ্গভবনে আসলে বঙ্গভবনের হল রুমের প্রবেশ পথে কয়েকটি ছবি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাঁকে বাংলাদেশের জাতির জনকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, “Excellency, this is the portrait of Sheikh Mujibur Rahman, he is our main leader of independence.”
প্রেসিডেন্ট মিতেরা তৎক্ষণাৎ তাকে বললেন, “French people and the world knows about him. But why not you put “the great ” after his name? প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিব্রত হয়ে বললেন, “Excellency, who will recognize us?”
প্রেসিডেন্ট মিতেরা সরাসরি এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “We write the ‘great’ after the name of our national hero Napoleon Bonaparte, so also Britanie’s write ‘great’ after the name of Queen Victoria. So that, so the Greeks put ‘great’ after their war hero Alexander. Indian’s also write æAkbar the great”. No nation needs permission to address their national heroes whatever way they like.”
ইতিহাস বিমুখ, বীরত্ব বিস্মৃত বাঙালি জাতি তাদের “জ্যোতির্ময় শেখ মুজিব” নামের জ্যোতিতে বিশ্বকে উদ্ভাসিত, অলংকৃত করতে আজও লিখলো না— “শেখ মুজিব দি গ্রেট”? হায় হতভাগা বাঙালি! কবে আর তোর দিব্যদৃষ্টির ভাগ্য হবে?
বাঙালির সেই স্বর্গীয় ভাগ্য কেড়ে নিলো কারা? কারা কালো কাফনে মুড়িয়ে দিলো বীর বাঙালি জাতির বিক্রম ও বীরত্বের অমর নামকে? কারা কেড়ে নিলো বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাধনা ও স্বপ্নের ধনকে? কারা বাংলাদেশের আকাশ থেকে সূর্য সরিয়ে নিয়ে গেল? কারা তারা? কোন এজিদের বংশধর তারা? কারা বাঙালি জাতিকে বিশ্বব্যাপী খুনিদের কলঙ্কের অভিশাপে অভিশপ্ত করলো?
অঙ্কুরেই বাংলাদেশকে, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের ও ইউরোপ- আমেরিকার কাছে বিশ্বের সর্বকালের বর্বর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিভাত করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের আরম্ভিক লগ্ন ১৫ই আগস্টের ট্রাজেডি৷ বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে বাংলাদেশকে বিশ্বের সর্বকালের বর্বরতম ও ব্যর্থতম রাষ্ট্রে পরিণত করা পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশসমূহের সম্মিলিত শক্তির পক্ষেও সম্ভব নয় বলে তারা নিশ্চিত হয়ে-বঙ্গবন্ধুকে যে কোন উপায়ে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে ‘৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়৷ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অপরাধ যে, বঙ্গবন্ধু কেন তাদের সম্মতি, সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন! তার দন্ড হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মূল এবং বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তানরূপে পুণঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে পাকিস্তান এবং আরব বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাধর দেশ এবং আমেরিকা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়৷ পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের মধ্যে অতি সংগোপনে ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে প্রথমে এক মিলিয়ন ডলার এবং দ্বিতীয়বারে আরও দেড় মিলিয়ন ডলার বিতরণ করা হয়৷
বলা হয়, আরব বিশ্বের “ফি সাবিলিল্লাহ” ফান্ড থেকে কিছু সাহায্য এসেছে পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর নিঃস্ব ও রিক্ত অফিসার এবং জে.সি.ও’দের জন্যে৷ তাদের সাহায্যার্থে এ অর্থ তাদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে৷ নিম্নে এককালীন ২০ হাজার টাকা থেকে উর্দ্ধে লেঃ কর্ণেল পদাধিকারী অফিসাররা ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন৷ (তাদের কেউ লেঃ কর্ণেল পদের উর্ধ্বে ছিল না)৷ পাকিস্তান প্রত্যাগতদের সকলে এটা পেয়েছেন৷ উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাদের করাচী নৌবন্দরে জাহাজে তোলার সময় একটা করে কোরান শরীফ তাদের বুকে ঝুঁলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় তাদের ওয়াদা করতে বলা হয়৷ তখন জেসিও, ক্যান্টেন, মেজর এমকি লে. কর্নেলের যে বেতন ছিল, সেই বেতনের চাইতে শতগুন বেশি টাকা থোক বরাদ্দ হিসেবে এক সাথে পেয়ে আনন্দে লাফ দিয়ে ওঠে৷ কেউ কেউ আরব ওয়াতান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে ওঠে৷ কিন্তু এর মাজেজা তারা টের পায়, যখন ১৫ই আগস্টে তাদেরকে আর্মির এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জানিয়ে দেয়া হতে থাকে যে, তোমরা যারা আরব বিশ্বের “ফি সাবিলিল্লাহ” ফান্ড থেকে গিফট পেয়েছো, আরব বিশ্ব থেকে তোমাদেরকে ১৫ই আগস্টের বিপ্লবে যোগদান করার নির্দেশ দিচ্ছে৷ ১৫ই আগস্টের বিপ্লবকে তোমরা সমর্থন না করলে তোমরা আরব বিশ্বের কাছে গাদ্দার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়বে এবং তোমরা কঠিন অজানা শাস্তির মুখে পড়বে৷ তোমরা কেউ কোনদিন হজ্ব করার ভিসা পাবে না৷
‘৭৩ সালে প্রাপ্ত “ফি সাবিলিল্লাহ” ফান্ডের গিফট গ্রহণকারীরা তখন আঁৎকে উঠলো এই দেখে যে, বঙ্গবন্ধুর দেশি-বিদেশি হত্যাকারীরা আড়াই বছর আগেই তাদেরকে ফাঁদে ফেলে ধরে রেখেছে৷
এই অর্থ গ্রহণকারী একজন কর্ণেলের (পরবর্তীতে জেনারেল) সাথে আমার কথা হয়েছে৷ আমার মামা রুহুল কুদ্দুস সাহেবের কথা হয়েছে৷ তিনি স্বীকার করে বলেছেন, “প্রথমে তারা আরব বিশ্বের কোন এনজিও ফান্ডের সাহায্য হিসেবে পেয়েছিল৷ ১৫ই আগস্টের পর যখন জানাজানি হয়ে গেল যে, এটা বিপ্লবের সমর্থনের জন্য, তখন তারা সমর্থন দিতে বাধ্য হয়৷ কারণ, টাকাটা তারা বহু আগেই হজম করে ফেলেছে এবং ফিরিয়ে দেবার আর্থিক সামর্থ্য পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা অফিসারদের ছিল না৷”
উভয় সংকটের মাঝে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়ে তারা হাসিমুখে খুনিদের পক্ষে যোগদান করে৷
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সংবাদে সমগ্র বিশ্ব থর থর করে কেঁপে ওঠে৷ জার্মানীর চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিথ ঘৃণাভরে ঘোষণা দেন, “বাঙালি জাতিকে আর বিশ্বাস করা যায় না”…বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন কভার স্টোরি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে লেখে, “শেখ মুজিবকে হত্যা যদি করা হবে, তাহলে বাঙালি জাতির জন্মের প্রয়োজন ছিল না এবং তাদের জন্য নতুন কোনো দেশের অভ্যুদয় আবশ্যক ছিল না৷”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তখন বিশ্ব মানবজাতির পথ প্রদর্শক এক মহামানব এবং বিশ্বের উদীয়মান নক্ষত্ররূপে বিশ্বব্যাপী নন্দিত-বন্দিত করা

পৃষ্ঠা: ২০
হতো৷ পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মন্দিরে ও বাড়িতে পূজার ঘরে বঙ্গবন্ধুর ছবি রেখে সকাল-সন্ধ্যা তাঁকে দেবতারূপে পূজা করা হতো৷ বঙ্গবন্ধুকে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইরাক, আলজেরিয়া, মিশরসহ কয়েকটি দেশে “নির্যাতিত মুসলিম কওমের জন্য আল্লাহ প্রেরিত মুক্তিদূত” রূপে উল্লেখ করা হতো৷ আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন শেষে মিশরের বিখ্যাত “আল আহরাম” পত্রিকায় ১৯৭৩ সালে এটা প্রকাশ করা হয়৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর বাংলাদেশ সময় বিকেলের মধ্যে আরব বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যাবার সাথে সাথে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বাংলাদেশের তদানীন্তন ইরাকস্থ রাষ্ট্রদূত ভাষা সৈনিক জনাব কে.জি. মুস্তফাকে (বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার সাবেক সম্পাদক) তাঁর প্রাসাদে ডেকে পাঠান৷
প্রাসাদে আসামাত্র প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন তীব্র ভর্ৎসনার স্বরে বলেছিলেন, “তোমরা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছো কেন? মুসলিম বিশ্বের এত বড় মুসলিম নেতা আমরা আর কোথায় পাবো? সে আমাদের হয়ে, মুসলিম জাতির হয়ে, অন্য জাতির নেতাদের যেভাবে মোকাবেলা করতে পারতো, এখন আর কে করবে?”
এ কথাগুলো বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে সাদ্দাম হোসেন কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন৷ আমাদের রাষ্ট্রদূত বসে থাকলেন৷ ১০ মিনিট পরে তাঁর সামরিক সচিব এসে বললেন যে, “তাঁকে তৎক্ষণাৎ বহিস্কার করা হলো৷ তিনি সেখান থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে যাবেন এবং ইরাকের সামরিক অফিসাররা তাঁর পরিবার ও বাড়ির জরুরি জিনিসপত্র, পরিধেয় বস্ত্রাদি ইত্যাদি ১ ঘণ্টার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন৷ তাঁর বাসার অন্যান্য সামগ্রী তাঁর অফিসের স্টাফরা পরবর্তী সপ্তাহে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে৷ সেই সাথে তাঁকে আরও জানানো হলো যে, শেখ মুজিবের প্রতি মুসলিম জাহানের শ্রদ্ধা ভালবাসার প্রতীক হিসেবে সাদ্দাম হোসেন ৫০ বছরের জন্য বাংলাদেশকে বাকিতে যে তেল দিয়ে যাচ্ছিল, তা বন্ধ করে দেয়া হলো৷ একই সাথে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ এর আগস্ট মাস পর্যন্ত ইরাকী তেলের টাকা তৎক্ষণাৎ পরিশোধ করতে হবে৷ তা করা না হলে বাংলাদেশের ওপর ইরাকী নৌ ও বিমান বাহিনী হামলা করবে৷” সাদ্দামের ভয়ে ওই দিনেই কে.জি. মুস্তফা সাহেব ইরাক ছেড়ে বিমানে সিরিয়ার দামেস্কে পৌঁছে যান৷
খুলনার অধিবাসী, ২০০৮ সালে আমার গুলশানের ৮৪ নং রোডের সরকারি বাড়ির পরের রোডে বসবাসরত জনাব এ.কে.এম আজিজুল আবরার-এর (ছদ্মনাম) সাথে আমার কয়েক মাস আগে পরিচয় হয়৷ মূলত গুলশান পার্কে আমরা একত্রে প্রাতঃভ্রমণকালে এই পরিচয় এবং দিনে দিনে তার সাথে অকৃত্রিম বন্ধুত্বপূর্ণ এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ তিনি আমার বাসায় এসে আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধের বই “বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম” উপহার হিসেবে নিলেন এবং জানলেন যে বঙ্গবন্ধু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে আমি দীর্ঘদিন কাজ করছি এবং তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষী, সংগ্রহ করছি ও তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি৷ তখন স্বতঃপ্রণোদিত চিত্তে তিনি আমাকে বললেন যে, বঙ্গবন্ধুর উক্ত খুনি চক্রকে তিনি চিনতেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনের আগে ও পরের বহু ঘটনা তিনি খুনি ডালিম, ফারুক, রশীদ, নূরদের মুখে শুনেছেন৷ ইসা নবীর নামের সাথে পরম্পরা আছে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট জনাব আবরার উক্ত খুনিদের অভিশম্পাত দিয়ে বললেন, “এই খুনিদের জন্য বিশ্বের কোনো এয়ারপোর্টে বা হোটেলে গিয়ে আমরা মুখ দেখাতে পারি না৷” খুনিদের ওপর তাঁর ঘৃণা ও ক্ষোভ তাঁর প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করে এবং উক্ত খুনিদের পূর্ব পরিকল্পনা ও পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি যা যা জানেন, সে বিষয়ে আমি আমার বাসায় ও তাঁর বাসায় কয়েকদিন ধরে বিশদ সাক্ষাৎকার নেই৷ সাক্ষাৎকার শেষে আমার বাসায় তার একটি ছবি তুলি এবং ছবি তোলার জন্য তিনি সানন্দে পোজ দেন৷
প্রশ্ন : “বঙ্গবন্ধু খুনিদের সম্পর্কে যা জানেন, বলুন৷”
জনাব আবরার : “বঙ্গবন্ধু হত্যার বীজ বপন করা হয় একজন হিপ্পি সোলিমকে কেন্দ্র করে৷ সেই হিপ্পি সেলিম-এর বাবার নাম ছিল আর. আই. চৌধুরী৷ তার দুলাভাইয়ের নাম মেজর ডালিম৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর উক্ত তরুণ কানাডায় পড়াশুনা করতে যায়৷ সেখানে গিয়ে কানাডিয়ান হিপ্পিদের সাথে মিশে সে হিপ্পি সেলিম হয়ে যায়৷ ‘৭৫ সালের মার্চ মাসে তার ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে সে ঢাকায় আসে৷ বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে৷ উক্ত বিয়ের অনুষ্ঠান যখন শেষ পর্যায়ে, অর্থাৎ কনের বাবা-মা যখন লেডিস ক্লাবের দোতলা থেকে কনেকে নিয়ে নিচে নেমে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় লেডিস ক্লাবের চত্ত্বরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কতগুলো তরুণ-কিশোরদের সাথে উক্ত হিপ্পি সেলিম- এর বেশ-ভূষা, চাল-চলন, চুলের বাহার ও চোঙ্গার মতো প্যান্ট এবং মেয়েদের মতো হাই-হিল জুতা নিয়ে হাস্য কৌতুক চলতে থাকে৷ কারণ, তখনও বাংলাদেশে হিপ্পি সেলিমদের তেমন আগমন ঘটেনি৷ সে কারণে তাকে নিয়ে সেখানে সকলের অনেক কৌতূহলের ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ কৌতূহল ছাপিয়ে হিপ্পি সেলিম-এর লম্বা চুল ধরে উক্ত তরুণ-কিশোরদের মধ্যে কেউ কেউ টানাটানি করে৷ উক্ত তরুণ-কিশোরদের মধ্যে তদানীন্তন রেডক্রসের (বর্তমান রেড ক্রিসেন্ট) চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার দুই ছেলেও ছিল৷ সেখানে উপস্থিত অন্যান্য আমান্ত্রিতরা মনে করছিল যে, তারা সবাই মিলে-মিশে কৌতুক করছে৷
কিন্তু হঠাৎ এর মধ্যে আমন্ত্রিতরা লক্ষ্য করলেন যে, হিপ্পিটি গাজী গোলাম মোস্তফার এক ছেলে এবং তার এক বন্ধুকে আকস্মিকভাবে কয়েকটি কিল-ঘুষি এবং হাই হিলের জুতা দিয়ে লাথি মেরে দৌড়ে লেডিস ক্লাবের দোতলায় মেয়েদের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ তাকে দৌড়ে ধরতে গিয়ে উক্ত তরুণ-কিশোররা মেজর ডালিম-এর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ তখন তারা কয়েকজন একটি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ এরপর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত হয়ে যায়৷ বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা ততক্ষণে চলে গেছেন৷ মেজর ডালিম ও ডালিমের মা এবং আত্মীয়রা বর-কনেকে গাড়িতে তুলে দিতে এগিয়ে আসে৷ এমন সময় ঘটে সেই বিস্ময়কর আকস্মিক ঘটনা৷”
প্রশ্ন: কী বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে সেখানে?
জনাব আবরার: “তখন রাত পৌনে এগারোটা হবে৷ বর-কনেকে দোতলা থেকে নামানো হয়েছে, এমন সময় গাজী গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে একটি উন্মুক্ত জিপ, একটি কার এবং দুটি ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র তরুণ- যুবকেরা সেখানে প্রবেশ করে৷ তখন সবাই বুঝতে পারলো যে, এখান থেকে আধা ঘণ্টা আগে গাড়িতে করে বেরিয়ে যাওয়া মার খাওয়া তরুণ- কিশোররা গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে এসেছে৷ সশস্ত্র অবস্থায় তাদেরকে এভাবে ঢুকতে দেখে সেই বিয়ে অনুষ্ঠানের শেষ সময়ে যারা ছিল, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে৷
প্রশ্ন: তারপর কী হলো?
জনাব আবরার: জিপ থেকে নামতে নামতে গাজী গোলাম মোস্তফা মেজর ডালিমের নাম ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে, “Who is Dalim? Who is Dalim?”
সেনাবাহিনীর একজন মেজর ডালিমের নাম ধরে এভাবে ডাকাডাকি করায় ক্ষুদ্ধ-ক্রুদ্ধ হয়ে ডালিম লেডিস ক্লাবের দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে চিৎকার করে বলে ওঠে, “You shut up. Who the hell you are? I am Major Dalim of Bangladesh Armed Forces.”
ডালিমের কথা শেষ হতে না হতেই গাজী গোলাম মোস্তফার ইঙ্গিতে তার জিপ থেকে ও তার পেছনের দুটি ট্রাক থেকে সশস্ত্র যুবকেরা ডালিমকে তার জিপে টেনে হিচড়ে তুলে ফেলে৷ সেই সাথে তারা ছুটে গিয়ে দোতলা থেকে হিপ্পিকে ধরে নিয়ে আসে৷ হিপ্পি সেলিমকে ধরে আনা মাত্র হঠাৎ দেখা যায় যে, হিপ্পির মুখের এক পাশে গাজীর কেউ রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে৷ হিপ্পির গাল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে৷ সেই অবস্থায় গাজী গোলাম মোস্তফার নির্দেশে সশস্ত্র যুবকেরা হিপ্পিকে তার জিপে তুলে দেয়৷ তারা তাকে নিয়ে চলে যেতে যখন উদ্যত হয়, তখন ডালিমের স্ত্রী নিম্মি জিপের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দেয়৷ তৎক্ষণাৎ মেজর ডালিমের স্ত্রী নিম্মি চিৎকার করে বলতে থাকে, “তাকে নিলে আমাকেও নিতে হবে৷” তখন গাজী গোলাম মোস্তফা তাকে নিতে চাচ্ছিলো না এবং তার লোকেরা বাধা দিচ্ছিলো৷ কিন্তু তারপরেও ডালিসের স্ত্রী নিম্মি জিপের রড ধরে ঝুলতে থাকে৷ তখন তাকেও গাজীর জিপে তুলে নেয়া হয়৷
প্রশ্ন: তাদেরকে নিয়ে গাড়িগুলো কোথায় যায়?
জনাব আবরার: “এরপরের ঘটনা মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মি আমাকে যেভাবে বলেছে, তাদের বর্ণনামতে- গাজী গোলাম মোস্তফা তার সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে গাড়িগুলো লেডিস ক্লাব থেকে বের হয়ে বাংলা মটর হয়ে ফার্মগেট দিয়ে খামারবাড়ির সামনে দিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ পার হয়ে মিরপুর রোড ধরে গাবতলীর দিকে অগ্রসর হয়৷ তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা৷ তাদের সশস্ত্র গাড়ি বহর যখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে পৌঁছায়, তখন পুলিশের এক পেট্রোল গাড়ির সামনে পড়ে৷ পুলিশ তাদেরকে দেখে প্রথমে মনে করে তারা ডাকাত দল৷ পেট্রোল গাড়ি থেকে সাব-ইন্সপেক্টর তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে রাস্তার ওপর শুয়ে তাদের দিকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং স্টেনগান তাক করে চ্যালেঞ্জ করে৷ সাব-ইন্সপেক্টর চিৎকার করে বলে, “সারেন্ডার, সারেন্ডার৷ সারেন্ডার না করলে এখনই গুলি চালাবো”৷ তখন গাজী গোলাম মোস্তফার জিপ থেকে সশস্ত্র যুবকেরা চিৎকার করে বলে, “এই সাবধান, এটা গাজী গোলাম মোস্তফার জিপ৷ গাজী সাহেব সামনে বসে আছে৷” পুলিশের সেই সাহসী বীর সাব- ইন্সপেক্টর চিৎকার করে বলে ওঠে, “তোমাদের হাতে এসব অস্ত্র কেন? তোমরা তো ডাকাত দল”৷ তখন গাজী গোলাম মোস্তফা নিজে বলে উঠলেন, “তোমরা আমাদের পথ ছাড়৷ আমি গাজী মোস্তফা, রেডক্রসের চেয়ারম্যান বলছি৷” কিন্তু কোনোভাবেই ভীত না হয়ে সেই বীর সাব- ইন্সপেক্টর তাদের দিকে স্টেনগান তাক করে বলে ওঠে, “এদিকে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” গাজী গোলাম মোস্তফা তৎক্ষণাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছি৷” সাব-ইন্সপেক্টর তাকে আর জোরদার চ্যালেঞ্জ করে বলে ওঠেন, “তাহলে তো আপনারা পিছনে যাবেন, সামনে যাচ্ছেন কেন? ধানমন্ডি ৩২ নম্বর আপনাদের পিছনে৷” পুলিশ বাহিনীর চ্যালেঞ্জের মুখে গাজী গোলাম মোস্তফা তার সশস্ত্র দলবল নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল৷ পুলিশের পেট্রোল গাড়িটিও তাদেরকে অনুসরণ করলো৷
প্রশ্নঃ তারা কি সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে গেছেন?
উত্তর: হ্যাঁ, গাড়ি সেদিকেই অগ্রসর হলো৷
গাজীর জিপের ভিতরে বসে মেজর ডালিম যখন দেখল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে থেকে গাজী গোলাম মোস্তফা জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন সে ও তার স্ত্রী নিম্মি জিপের ভিতরে বসে তাদের দাঁত দিয়ে তারা উভয়ে তার স্ত্রীর কাপড় ও ব্লাউজ ছিঁড়তে থাকে এবং ব্রেশিয়ার টেনে ছিঁড়ে ফেলে৷ তার স্ত্রীর পেটিকোটও দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলে৷ তার স্ত্রী নিম্মিকে বলে তার ভাই হিপ্পির গাল দিয়ে যে রক্ত বেরোচ্ছে, সে রক্ত নিয়ে নিম্মি যেন তার বুকে, পিঠে, মুখে লাগায়৷ যেন তাকে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত দেখায়৷ তারা দু’জন পরামর্শ করে যে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পৌঁছে যে কোনো উপায়ে তারা জিপ থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে এবং বঙ্গবন্ধুকে বা যাকে পায় তাকে দেখাবে যে, তার স্ত্রীকে বলাৎকার করা হয়েছে৷ বলাৎকারের ফলে তার স্ত্রী রক্তাক্ত হয়েছে৷ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে থেকে তারা ১০ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে যায়৷ ফলে গাজী গোলাম মোস্তফার জিপ ও দুই ট্রাক সশস্ত্র যুবক (কমপক্ষে ২০ জন) সহজেই ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে পৌঁছে যায়৷ গাজীর নাম বলতেই অস্ত্রধারী যুবকদেরসহ গাজীকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গার্ড গেটে যেতে দেয়৷ বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না৷ (বঙ্গবন্ধু সীমাহীন নিরাপত্তাহীন অবস্থায় থাকতেন-এ ঘটনা তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ)৷ সেখানে পৌঁছে গাজী সাহেব জিপ থেকে নেমে তার বাহিনীকে নির্দেশ দেয় যে, ডালিম ও ডালিমের স্ত্রী এবং তার শ্যালক হিপ্পি যেন তার জিপ গাড়ি থেকে কোনোক্রমেই বেরিয়ে না আসতে পারে৷ তার সশস্ত্র লোকেরা জিপ গাড়িটিকে ঘেরাও করে রাখে৷ গাজী গোলাম মোস্তফা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে দোতলায় উঠে যায়৷ দোতলার বারান্দায় গাজী সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর দু-একটা কথোপকথন নিচে থেকে শোনা যাচ্ছিল৷ জিপের ভিতরে বসা ডালিম, ডালিমের স্ত্রী ও সশস্ত্র যুবকেরাও শুনতে পাচ্ছিল৷ গাজী সম্ভবত মেজর ডালিমের নাম-পরিচয় না বলেই অজানা কোনো সন্ত্রাসীদের তিনি বন্দি করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো এ্যাকশন নেবার কথা বলছিলেন৷ কিন্তু গাজীকে থামিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছিলেন, “মাহবুব কোথায়? মাহবুবকে ছাড়া তুমি ধরার কে? মাহবুবকে খুঁজে বের কর৷ মাহবুব আসুক৷”
এই সময় হঠাৎ লাফ দিয়ে মেজর ডালিম জিপের বাইরে বেরনোর চেষ্টা করে৷ কিন্তু জিপের সশস্ত্র লোকেরা তাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়৷

পৃষ্ঠা: ২৫
ডালিম তাদেরকে বলে, “এই তোরা জেনে রাখ আমি আর্মির মেজর৷ আমার কিছু করলে বাংলাদেশ আর্মি রিভোল্ট করবে৷ তোরা সব উড়ে চলে যাবি৷ তোরা আমাকে নামতে দে…৷”
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে এসপি মাহবুবকে ওয়ারলেসে মেসেজ দেয়া হয়৷ মেসেজ পেয়ে রাত প্রায় দেড়টায় ঢাকার এসপি মাহবুব সেখানে পৌঁছায়৷ গাজীর জিপের ভিতর থেকে মাহবুবকে দেখতে পেয়ে মেজর ডালিম সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে জিপ থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়ে৷ কিন্তু বের হতে পারে না৷ মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে ডালিম চিৎকার করে বলে ওঠে, “মাহবুব ভাই, নিম্মিকে ও তার ভাইকে দেখেন, মেরে ফেলেছে, তাদের লাশ এ গাড়ির ভিতরে আছে৷ বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের নিয়ে চলেন৷” এসপি মাহবুব তাকে কথা দেয় যে, সে বঙ্গবন্ধুর কাছে তাকে নিয়ে যাবে৷
একথা বলে মাহবুব দৌড়ে দোতলায় বঙ্গবন্ধুর কাছে উঠে যায়৷ তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলে ওঠেন, “কোথায় ছিলি? নিচের কারা ওরা? গাজী কাদের ধরে এনেছে?” কিন্তু গাজী গোলাম মোস্তফা কাদেরকে ধরে এনেছে, এসপি মাহবুব তাদের নাম বলতে সাহস পাচ্ছে না৷ বঙ্গবন্ধুর জিজ্ঞাসার যথাযথ উত্তর না দিয়ে মাহবুব বলে, “ওদের আমি নিয়ে আসি, ওদের আপনি চেনেন৷” কিন্তু গাজী গোলাম মোস্তফা তার বিরোধীতা করে বলে, “ওরা সন্ত্রাসী, ওরা দলের অনেক ক্ষতি করেছে৷ ওরা অনেক আওয়ামী লীগারকে মেরে ফেলেছে৷ ওদের আপনার সামনে আনা যাবে না৷ মাহবুব বোঝ না কেন? তুমি ওদের নিয়ে যাও৷”
বঙ্গবন্ধু গাজী গোলাম মোস্তফাকে ধমক দেন এবং মাহবুবকে বলেন, “কারা ওরা? আমি যদি চিনি, তাদের নাম বল না কেন? কী নাম?” বঙ্গবন্ধুর ধমকের মুখে মাহবুব বলে ফেলে, “ মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মি৷” শোনামাত্র বঙ্গবন্ধু গাজী গোলাম মোস্তফাকে ধমকের পর ধমক দিয়ে বলল, “এই হারামজাদা, তারা কিসের সন্ত্রাসী? তারা তো আমার ফ্যামিলি মেম্বার৷ তারা তো আমার আর্মি অফিসার৷ যা, এক্ষুণি নিয়ে আয় তাদের৷”
প্রশ্ন: এসপি মাহবুব নিচে গিয়ে তাদেরকে কি বঙ্গবন্ধুর কাছে আসলো?
জনাব আবরার: হ্যাঁ, তৎক্ষণাৎ এসপি মাহবুব নিচে গিয়ে মেজর ডালিম, তার স্ত্রী নিম্মি এবং তার ভাই হিপ্পি সেলিমকে দোতলায় নিয়ে আসে৷ প্রায় অর্ধ উলঙ্গ ও রক্তাক্ত অবস্থায় নিম্মি এসেই হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বঙ্গবন্ধুর পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে৷ বঙ্গবন্ধু নিম্মিকে ও তার ভাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বলে ওঠে, “হায়! হায়! এই তোরা আমার মেয়েকে কী করেছিস? জানিস, নিম্মির অভিভাবক কে? আমি নিম্মির অভিভাবক৷ ওর বাবা চৌধুরীকে আমি যখন লন্ডনে পোস্টিং দিয়ে পাঠাই, তখন সে তার মেয়েকে আমার হাতে দিয়ে বলে গেছে, এখন থেকে আমি তার অভিভাবক৷ আর তোরা আমার মেয়েকে, তার ভাইকে রক্তাক্ত করে ফেলেছিস৷ ওরে হারামজাদা, দূর হ, দূর হ, আমার চোখের সামনে থেকে৷ জীবনে তোর মুখ যেন আর না দেখি৷” (বঙ্গবন্ধুর দয়ায় নিম্মির বাবা ৪র্থ বার লন্ডনে পোস্টিং পান৷) এ বলে তিনি গাজী গোলাম মোস্তফাকে বাড়ি থেকে লাঞ্ছিত করে বের করে দিলেন এবং “রেনু, রেনু” (বেগম ফজিলাতুন্নেসার ডাক নাম) বলে চিৎকার করে তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন৷ তিনি বেরিয়ে আসলে রক্তাক্ত নিম্মিকে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, “দেখ হারামজাদারা আমার মেয়েকে কীভাবে খুন করেছে৷ ওকে বাঁচাও৷ তা না হলে ওর বাবার কাছে আমি মুখ দেখাবো কী করে?” বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে জড়িয়ে ধরে নিম্মি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলেন এবং গাজী গোলাম মোস্তফা তার ছোট ভাই ও তার স্বামীকে কীভাবে নির্যাতন করেছে, তা চিৎকার করে বলতে লাগলেন৷ তার স্বামী মেজর ডালিম বিয়ে বাড়ির ঘটনা বর্ণনা করে গাজী গোলাম মোস্তফা কীভাবে তাকে লাঞ্ছিত করেছে ও তার শ্যালককে মেরে ফেলতে চেয়েছে সে কথা বঙ্গবন্ধুকে বলতে থাকলেন৷ বঙ্গবন্ধু নিম্মিকে ও তার আহত ভাইকে তৎক্ষণাৎ পিজি হাসপাতালে পাঠাতে বললেন৷ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম সাহেবকে (বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং পিজির ডাইরেক্টর) ফোন করতে বললেন৷ নিম্মির মাথায় হাত দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, “মা এসবের বিচার হবে৷ আগে তোমরা হাসপাতালে যাও৷ মাহবুব জলদি নিয়ে যাও৷ যে কোনো মূল্যে বাঁচাও তাদের৷ তা না হলে আমি তাদের বাবার কাছে মুখ দেখাতে পারবো না৷” তখন বিচলিত বিব্রত বঙ্গবন্ধুর ব্যস্ততার মুখে নিম্মি অসাবধানতা বশত বলে ফেললো, “আংকেল, আমার কিছু হয়নি৷ আমার ভাইয়ের রক্ত আমার গায়ে লেগেছে৷” বঙ্গবন্ধু বিস্মিত হয়ে বললেন, “ওর রক্ত তোমার মুখে ও সারা গায়ে লাগলো কী করে?!! রেনু, রেনু তুমি নিম্মিকে নিয়ে ওর গায়ের রক্ত পরিষ্কার করিয়ে দাও, খুকুর (শেখ কামালের স্ত্রী শেখ সুলতানা কামাল খুকু) একটি শাড়ি পরিয়ে দাও৷ ”
প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু কি মেজর ডালিম ও নিম্মির প্রতারণার বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন?
উত্তর: “না৷ মেজর ডালিম তার বন্ধুদের আমার সামনে হাসতে হাসতে বলেছিলেন tall men are generally fool. বঙ্গবন্ধু এটা ধরতেই পারেনি নিম্মিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে রেখে মেজর ডালিম এবং এসপি মাহবুব আহত হিপ্পিকে নিয়ে পিজি হাসপাতালে ছুটে চলে গেল৷ সেখানে পরীক্ষা করে দেখা গেল যে, তার মুখে ভারী কিছুর আঘাত লেগেছে বলে মাড়ির নিচের অংশ ফেটে গেছে এবং জিভ সামান্য কেটে গেছে৷ কিন্তু মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়নি৷ ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেবের উপস্থিতিতে তার মাড়িতে সেলাই দেবার পর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাবার জন্য তারা যখন তাকে নিয়ে নিচে নেমে আসে, ততক্ষণে নিম্মি ৩২ নম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে করে পিজি হাসপাতালে পৌঁছে যায়৷ সেখান থেকে মাহবুবসহ ডালিম ও তার স্ত্রী এবং শ্যালক হিপ্পি নিউ ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে চলে আসে৷ সেখানে গিয়ে জানতে পারে যে, সবাই বাড়ি চলে গেছে৷ পরে সেখান থেকে মাহবুব ও ডালিমরা যার যার বাড়ি চলে যায়৷

কিন্তু ডালিম তার বাড়িতে গিয়ে এই ঘটনার ইতি টানেনি৷ সেখান থেকে রাতেই নিম্মিসহ ক্যান্টনমেন্টে ছুটে যায় এবং সারা রাত ক্যান্টনমেন্টের অফিসারদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে ও মেজরের স্ত্রীকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়েছে বলে সকলকে উত্তেজিত করে ও সকলের কানে বিষ ঢালে৷ তারা সেই রাতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছেও যায় এবং তার পূর্ণ সমর্থন পেয়ে যায়৷ পরদিন সকাল দশটার মধ্যে ডালিম, ফারুক, রশীদ, নূর, মহিউদ্দিনসহ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকিস্তান প্রত্যাগত আর্মি অফিসাররা দলে দলে জটলা পাকাতে থাকে৷ সকাল সাড়ে এগারটার মধ্যে তারা দলবদ্ধ হয়ে তদানীন্তন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাদের র‍্যাঙ্ক ও ব্যাচ খুলে ফেলে তার টেবিলে রেখে দেয়৷ তারা দাবি তোলে যে, তাদের প্রতি সুবিচার না করা হলে ও তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার না হলে তারা কেউ আর সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে না৷ উল্লেখ্য যে, সেনাবাহিনীর আইনের কঠোর শৃংখলা ভঙ্গ করে আর্মি হেড কোয়ার্টারে এরূপ উদ্ধত আচরণকারী পাকিস্তান প্রত্যাগতরা চিফ অব স্টাফ-এর পরিবর্তে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ-এর কাছে গিয়ে যে তাদের র ্যাঙ্ক ও ব্যাজ খুলে রাখলেন তা সম্পূর্ণ ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমানের নীরব সমর্থন ও ইঙ্গিতে৷ এ ঘটনার নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তান প্রত্যাগত সেসব অফিসাররা, যাদেরকে সিআইএ এবং আইএসআই তাদের চরম গোপনীয় চক্রান্তের নীল-নকশা বাস্তবায়নের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ডেপুটেশনে কর্মরত অবস্থা থেকে নভেম্বরের শেষ দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য প্রেরণ করে৷ মূলত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করে অন্তর্ঘাত কার্যক্রম পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে গেছে, সে তথ্য প্রবাসী সরকার পরিচালনাকারী শীর্ষ নেতাদের অজানা ছিল৷ তার মূল কারণ বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ অর্থাৎ ডিজিএফআই তখনো পর্যন্ত পাকিস্তান প্রত্যাগত গোয়েন্দাদের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ছিল৷
উক্ত বিষয়ে পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম আমাকে বলেছেন, “তাঁর ডেপুটি, অর্থাৎ জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মোশতাকের অনুসারীরা বঙ্গবন্ধুকে ভুল বুঝিয়ে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগকে চিফ অব স্টাফ-এর অধীন থেকে বিলুপ্ত করে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ-এর অধীনে অর্থাৎ জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে ন্যস্ত করে নেয়৷” ফলে, খুনিরা স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদানকারী বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী শীর্ষ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে থাকে প্রকাশ্যে এবং কোন রকম রাখ-ঢাখ না করে৷ ভারতের সেনাবাহিনী বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে এ রকম ঘটনার এক ভগ্নাংশ পরিমাণ ঘটনা ঘটালে তাদের সকলকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো৷
মেজর ডালিমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা বঙ্গবন্ধু যখন জেনে গেলেন, তখন তিনি আরও জানলেন যে, তার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়া তাদের পিছনে গোপনে মদদ দিচ্ছে৷ তার স্বচ্ছ প্রমাণ হল যে, ডালিমের পক্ষের অফিসাররা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাদের র‍্যাঙ্ক, ব্যাজ খুলে জমা দিচ্ছে৷ বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর মূখ্য সচিব (যিনি তাঁর সাথে আগরতলা মামলায় ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছেন এবং তার নির্দেশ মোতাবেক বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা রচনা করেছেন) জনাব রুহুল কুদ্দুসকে নির্দেশ দিলেন যে, ওদেরকে ডাকো৷ সে মোতাবেক ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ তাদেরকে দুপুর দু’টায় গণভবনে ডাকা হয়৷ রুহুল কুদ্দুস সাহেব সেখানে মধ্যাহ্ন ভোজের ব্যবস্থা করেন৷ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গাজী গোলাম মোস্তফা সাহেব সেখানে আসেন৷ বঙ্গবন্ধু সেখানে ডালিম, ফারুক, রশীদ, মহিউদ্দিন গংদের সাথে গাজী গোলাম মোস্তফার বিবাদের বিষয়টি মীমাংসা করে দেন৷ গাজী গোলাম মোস্তফা তাদের সামনে নিজ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন৷ বঙ্গবন্ধু ডালিমসহ সকল অফিসারের সাথে গাজী গোলাম মোস্তফার করমর্দন ও কোলাকুলি করিয়ে দেন এবং সকলে হাসিমুখে ও আনন্দিত চিত্তে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে থাকে৷ কিন্তু সবার আগে জেনারেল জিয়া গাড়িতে বেরিয়ে যাবার সময় তাদের কানে আবার বিষ ঢেলে দিয়ে যান৷ তখন সেখান থেকে ফারুক ও রশীদ গণভবনের দোতলায় এসে বঙ্গবন্ধুকে বলে যে, গাজী গোলাম মোস্তফাকে ক্যান্টনমেন্টে এসে একবার ক্ষমা চেয়ে আসতে হবে৷
বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে তাদের সামনে গাজী গোলাম মোস্তফাকে সরল মনে বলে দিলেন, “কাল তুই ওদের ওখানে যাবি৷ ওদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করে আসবি৷ ওদের মনে যে কষ্ট হয়েছে, সে কষ্টটা দূর করে আসিস৷ ওদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে আসিস৷” গাজী সাহেবও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অবনত মস্তকে মেনে নিলেন এবং পরদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে সাক্ষাৎ করবেন বলে ওদের জানিয়ে দিলেন৷
কিন্তু দিন যখন শেষ হলো রাতের আগমনের সাথে সাথে অন্ধকারের কীটেরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আরেক ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল৷ আমেরিকার বিশ্বস্ত অনুচর খন্দকার মোশতাক তার অনুচর তাহের উদ্দিন ঠাকুর এবং শাহ মোয়াজ্জেমকে দিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফাকে হাত করে ফেললেন৷ সেই রাতের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীরা অর্থাৎ খন্দকার মোশতাক, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সোহরাব হোসেন, মতিয়ার রহমান, কোরবান আলী, এম. এ মঞ্জুরসহ আট-দশ জন এবং বঙ্গবন্ধুর আরেকজন বিশ্বস্ত সহচরসহ ধানমন্ডির এক বাসায় গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন৷ সেখানে মোশতাক বললেন, পার্লামেন্টের এমপি’রা যদি বেতনভূক সামরিক বে-সামরিক কর্মচারীদের কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে বেড়ায়, তাহলে সরকারের অস্তিত্ব থাকে না এবং আমরা সরকারে থাকবো না৷” তার প্রস্তাব মোতাবেক পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তারা এসে সাক্ষাৎ করে গাজী গোলাম মোস্তফার ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার বিরোধীতা করেন৷ সেখানে আমার মামা রুহুল কুদ্দুস সাহেবও উপস্থিত ছিলেন৷
বঙ্গবন্ধু তাদের বলেছিলেন, “তোমাদের মনে এত কু কেন? গাজীর কাজে তারা অসন্তুষ্ট হয়েছে, মনে কষ্ট পেয়েছে৷ গাজী গিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করে আসবে৷ গাজী তো বাড়াবাড়ি করেছে৷ সে ক্ষমা চেয়ে আসবে৷ এই আমার হুকুম৷ আর তোমরা যার নেতৃত্বে আমাকে এসব বলতে আসছো, তার মাথার প্রত্যেকটা চুলে একটি করে ষড়যন্ত্র ঘুর-পাক খায়, টুপি দিয়ে ঢেকে সে (খন্দকার মোশতাক) আড়াল করে রাখে৷ তোমরা দেখতে পাও না, আমি দেখতে পাই৷”
বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে উপস্থিত সকলে হো হো করে হেসে উঠলেন৷ খন্দকার মোশতাক মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো৷
বঙ্গবন্ধু উঠে পড়লেন৷ সেদিন বঙ্গবন্ধুর যশোর ক্যান্টনমেন্ট যাবার কথা৷ তিনি এয়ারপোর্টে রওয়ানা হয়ে গেলেন৷

পৃষ্ঠা: ৩০
ঢাকায় মোশতাক ও তার আমেরিকার বন্ধুদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকলো৷ গাজী গোলাম মোস্তফাকে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া থেকে তিনি এবং তার ষড়যন্ত্রকারীরা রুখে দিলেন৷ অপরদিকে ক্যান্টনমেন্টে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষুদ্ধ অফিসারদের ক্রোধ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন৷ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ অফিসাররা তার সামনেই ঘোষণা করলেন, “আজকের মধ্যেই গাজী গোলাম মোস্তফা যদি ক্যান্টনমেন্টে এসে আমাদের সকলের সামনে ক্ষমা না চায়, তাহলে আমরা আগামী কালকের মধ্যে গাজীকে তার স্ত্রীসহ ক্যান্টনমেন্টে ধরে এনে তার বিচার করবো৷”
অবশেষে যথার্থই সেই দিন ভোর রাত ৫টায় মেজর ডালিম তার অধীনস্থ ২৫০ জন ফোর্স নিয়ে নয়াপল্টনস্থ জোনাকি সিনেমা হলের পেছনে অবস্থানরত গাজী গোলাম মোস্তফার টিন সেডের বাড়ি ঘেরাও করে মাইকে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়৷ গাজী ও তার পরিবার হতভম্ব হয়ে পড়ে৷ কিন্তু গাজী সাহেব বঙ্গবন্ধুকে ফোন করার সাহস পায় না৷ কারণ, সে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অমান্য করে বসে ছিল৷ সেই ভোরে সে এসপি মাহবুবকে ফোন করে বিষয়টি জানায়৷ এসপি মাহবুব বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলে বঙ্গবন্ধু জেনারেল শফিউল্লাহকে জানালে তিনি সিজিএস জেনারেল খালেদ মোশাররফকে নির্দেশ দিলেন ডালিমের ফোর্সকে সেখান থেকে ফেরৎ আনার জন্য৷
সি.জি.এস-এর নির্দেশে ৪৬ ব্রিগেড গিয়ে মেজর ডালিম ও তার ফোর্সকে virtually বন্দি করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসে৷ সরকারের অজান্তে এবং সেনাবাহিনী প্রধানের অনুমতি ব্যতিরেকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোর্স বের করে নিয়ে যাওয়াকে, সেনাবাহিনীর বিধানে “বিদ্রোহ” রূপে সংজ্ঞায়িত করা আছে৷ সেনাবাহিনীর বিধানে যে কয়টি সর্বোচ্চ অপরাধ উল্লিখিত আছে, তার মধ্যে এটা একটি সর্বোচ্চ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত৷ কমান্ডিং অফিসারের জন্য এরূপ বিদ্রোহের একমাত্র শাস্তি ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা এবং সেই ফোর্স ভেঙে দেয়া৷ অর্থাৎ সেই ফোর্স বিলুপ্ত করা৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আইয়ুব খানের সময় চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডো ফোর্সকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল এবং এ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে উক্ত কমান্ডো ফোর্সের কমান্ডিং অফিসারকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের শান্তি প্রদান করা হয়েছিল৷ পাকিস্তানের অন্যান্য অফিসারদের সাথে দণ্ডপ্রাপ্ত ও অবসরপ্রাপ্ত হন উক্ত কমান্ডো ফোর্সে চাকরিরত বাঙালি মেজর মান্নান৷
কিন্তু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ অনুরূপ এবং একই ধরনের উক্ত বিদ্রোহের ঘটনার পরও মেজর ডালিমের নিশ্চিত ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকায় তাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সাধারণ বদলী করা হয়৷
প্রশ্নঃ “এ ধরনের বিদ্রোহের ঘটনার পর তার মৃত্যুদণ্ড কেন হলো না?”
জনাব আবরার: “আর্মি চিফ অব স্টাফের বিনা অনুমতিতে ফোর্স বের করে নিয়ে যাওয়া, সেনা বিদ্রোহের শামিল৷ যার একমাত্র দণ্ড, মৃত্যুদণ্ড৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু দয়াপরবশ হয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে, তাদের কয়েকজন অফিসারকে শুধুমাত্র চাকরি থেকে অপসারণ করে দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করেন৷ কিন্তু তারা এটা মেনে নেয়নি৷ তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে৷”
প্রশ্নঃ “আপনাকে এ পরিকল্পনার কথা কে বলে? কীভাবে তাদের পরিকল্পনা শুরু করে?”
জনাব আবরার: “১৫ই আগস্ট ঘটনার পরপরই মেজর ডালিম একটি হোটেলে মদ খেতে খেতে রাত ৪টা পর্যন্ত তার সাথে চাকরিচ্যুত কয়েকজন অফিসারসহ আমাকে তাদের উক্ত পরিকল্পনা বলে যেতে থাকে৷ উক্ত সেনা বিদ্রোহের মারাত্মক অপরাধে সেনাবাহিনীর আইনে বিভিন্ন র‍্যাংকের ১৬ জন অফিসার চাকরিচ্যুত হবার পর তারা নটরডেম কলেজের ব্রিজের কাছে ডালিমের আত্মীয় আবুল খায়ের লিটুর অফিসে প্রকাশ্যে নিয়মিত মিটিং করতে থাকে৷ জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁকে বিভ্রান্ত করে তাঁর মন্ত্রীরা (ডালিমের আত্মীয় লিটুকে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা দেন৷ জিয়া বিমান বন্দরে গোল্ড মাইন জমি বরাদ্দ দেন অবৈধভাবে৷)
উক্ত মিটিংয়ে উল্লেখ্য ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ চাকরিচ্যূত ১৬ জন আর্মি অফিসারসহ আর্মিতে নিয়মিত চাকরিরত, তাদের সমর্থক অফিসাররাও প্রকাশ্য দিবালোকে, রাতে, গভীর রাতে গাড়িতে করে আসা-যাওয়া করতে থাকে৷ শেষ দিকে ক্যুর প্ল্যান নিয়ে তারা কোনো রাখ-ঢাক করেনি৷ সেখানে আশে-পাশের অফিসের লোকেরাও শুনতে পায় যে, আর্মির চাকরিচ্যূতরা এখানে দিনে-রাতে ক্যু করার জন্য মিটিং করছে এবং শেখ মুজিবের সরকারের বিরুদ্ধে শীঘ্র ক্যু হতে যাচ্ছে৷ সেখানে ক্যু’র প্ল্যান নিয়ে যারা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাইতো না, তারা ‘৭৫-এর জুন মাসে এক রকম নগ্নভাবে ক্যুর কথা বলা শুরু করে৷ তারা বলতে থাকে যে, তাদের ক্যু শতভাগ সফল হতে যাচ্ছে৷ কারণ, আমেরিকান দূতাবাসের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছে বলে তারা confident বলে প্রকাশ্যে মত-মন্তব্য করতে থাকে৷ এসব অফিসার এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম না নিয়ে বলতে থাকে যে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জেনারেলরাও চায় তাদের ক্যু প্ল্যান successful হোক৷ এ সময় আমেরিকান দূতাবাসের কয়েকজন অফিসার ছদ্মনামে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটা ফ্লোরের সব রুম ভাড়া নিয়ে নেয়৷ যেখানে ডালিম-ফারুকদের সাথে তাদের গোপন শলা-পরামর্শ হতে থাকে৷ ঢাকার বিখ্যাত একটি বাংলা দৈনিকের সম্পাদকের সাথে সেখানে তাদের নিয়মিত মিটিং-সিটিং হতো৷”
প্রশ্ন : “তাদের ক্যু’র প্লানে কোন কোন জেনারেলের সমর্থনের কথা তারা বলতো?”
জনাব আবরার: “তারা কোনো জেনারেলের নাম না ধরে হাব-ভাবে দেখাতো যে, আর্মি হেড কোয়ার্টারের টপ দুই জেনারেলের কোনো একজনের direct blessings নিশ্চিতভাবে আছে৷ (ক্যু’র পরে প্রমাণিত হল যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান টোটাল ক্যু পরিকল্পনার সাথে শতভাগ সম্পৃক্ত ছিল৷) তারা ক্যু করে ফেললে তিনি নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবেন— এটা তাদের দৃঢ়ভাবে জানা ছিল৷ তিনি এমন ইঙ্গিত তাদেরকে বহুবার দিয়ে রেখেছিলেন৷”
প্রশ্ন : “খন্দকার মোশতাকের সাথে তাদের কীভাবে যোগাযোগ হতো বলে জেনেছেন?”
জনাব আবরার : “আগা মসিহ লেনে তারা অনেক পরে যায়৷ আগস্ট মাসের শুরুতে যায়৷ তার আগে যায়নি৷ পলিটিক্যাল ব্যাকিং ছাড়া ক্যু যে সাকসেসফুল হবে না, তা তারা জানতো৷ তাই খন্দকার মোশতাকের সমর্থন তারা নিশ্চিত করে৷ ক্যুর আগে খন্দকার মোশতাকের সাথে কর্নেল রশীদ (তাঁর আত্মীয়), কর্নেল ফারুক (রশীদের ভায়রা ভাই), মেজর নূর, মেজর ডালিমদের ৩টি মিটিং হয়৷ কুমিল্লার বার্ডে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ মিটিং- এ মোশতাক ছাড়াও ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, বহিস্কৃত প্রতিমন্ত্রী এম. এ মঞ্জুর এবং মাহবুব আলম চাষী, আব্দুর রহিমসহ কিছু সচিব অন্যান্যদের সাথে উপস্থিত ছিল৷ সেখানে ক্যু পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তারা৷”
প্রশ্ন: “খন্দকার মোশতাক ছাড়া আর কোনো মন্ত্রীর সাথে তাদের কোনো গোপন বৈঠক বা যোগাযোগ হয়েছিল কি?”
জনাব আবরার: “না৷ তবে মেজর ডালিম বলেছে যে, সে ১৫ই আগস্ট রাতে ধানমন্ডিতে ৩ নম্বর রোডে ত্রাণমন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান সাহেবের বাড়িতে (দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির মালিকের পরিত্যক্ত বাড়ি) গিয়েছিল৷ রাত তখন সাড়ে নয়টা হবে৷ তার সাথে আর একজন চাকরিচ্যূত সামরিক অফিসার ছিল৷ ডালিম সেখানে গিয়ে দেখে তিনি গানের জলসায় বসে গণ্যমান্য অতিথিসহ শতাধিক লোক নিয়ে গান শুনছেন৷ তিনি খুবই সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং প্রায় জলসা বসাতেন৷ ডালিম সেখানে মন্ত্রীর একজন স্টাফকে বলে, “স্যারকে গিয়ে বলো যে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে জরুরি মেসেজ নিয়ে দু’জন আর্মি অফিসার এসেছে৷ স্যারকে এক্ষুণি আমাদের কাছে আসতে বলো৷ স্যারকে বলো গানের মজলিস থেকে এক্ষুণি উঠে এসে আমাদের কথা শুনতে৷” তার স্টাফ ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে গিয়ে তাদের মেসেজ দিলে তিনি তার স্টাফকে বলে দেন: “ওদেরকে এখানে এনে গান শুনতে বসাও৷” তাঁর স্টাফ গিয়ে মেজর ডালিমকে সে কথা বলামাত্র খুন চেপে থাকা ডালিম তাকে এক দফা গালিগালাজ করে ঐ স্টাফকে আবার মন্ত্রীর কাছে পাঠায় মন্ত্রী সাহেব আবার তাদেরকে গানের আসরে এসে গান শুনতে বলে৷”
প্রশ্ন: “গান শোনার কথা বললে সে কি ক্ষিপ্ত হয়?”
জনাব আবরার: “হ্যাঁ, ডালিম তখন ক্ষিপ্ত হয়ে তার স্টাফকে বলে, আমরা গান শুনতে আসিনি৷ তোর মন্ত্রীর বাচ্চাকে সারা রাত গান শুনতে বল৷ আজ রাত তাদের শেষ রাত৷ আজ রাতে তোর মন্ত্রীরা গোষ্ঠীশুদ্ধ শেষ হবে, বলে দিস৷” মন্ত্রীদের অশিক্ষিত স্টাফরা সাধারণত মন্ত্রীর ক্ষমতায় ক্ষমতাদর্পী হয়ে ওঠে বলে মন্ত্রীর ওই স্টাফ ডালিমকে তাঁর মণিবের মান- সম্মান রক্ষার্থে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে প্রত্যুত্তর দিয়ে বলে ওঠে ‘আপনি কোথাকার কোন… (পিউবিক হেয়ার) অফিসার, আমার স্যারের নামে আজে বাজে কথা বলেন?’ সাথে সাথে ডালিম ওই স্টাফকে এক ঘুষি মেরে গেটের সামনে ফেলে দিয়ে গালি দিতে দিতে জিপ নিয়ে ঝড়ের বেগে চলে যায়৷” (ডালিম সম্ভবত চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর মোশতাকের সাথে কামারুজ্জামানকে একত্রিত করে নতুন সরকার গঠন করাতে৷ ডালিম তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে এমনটা ভেবে তার কাছে গিয়েছিল৷)
প্রশ্ন: “ক্যুর পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে আমেরিকান দূতাবাসের কারো সাথে কি কোনো মিটিং হয়?”
জনাব আবরার: “তারা আমাকে বলেছে যে, ক্যুর আগে আমেরিকান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি, থার্ড সেক্রেটারি লেভেলের অফিসাররা তাদের সাথে লিংক রাখতো৷ ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের নিচের দিকের অফিসাররা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছদ্মনামে পুরা ফ্লোর ভাড়া নেয়া কক্ষসমূহে কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্যুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কো-অর্ডিনেট করে৷”
(ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার বিখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাস গুপ্ত বাবু বঙ্গবন্ধু হত্যায় সি.আই.এ. এবং আমেরিকার সম্পৃক্ততার বিষয়ে বলেছেন যে, “ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের সাথে কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট-এর অফিসার ও গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়ে সার্বক্ষণিক সমন্বয়ের কাজে যুক্ত ছিল৷ হো চি মিন স্মরণীতে অবস্থিত আমেরিকান কনস্যুলেট আগস্টের শুরুতেই হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে নানা ধরনের কুৎসা ও অপপ্রচার শুরু করে৷)
প্রশ্ন : “ক্যু পরিকল্পনা বিষয়ে সরকার কিছু জানতে পারেনি?”
আবরার : “আমি জানি না৷ তবে খুলনায় আমি একদিন ‘৭৪-এর জুন মাসের শেষ দিকে শেখ নাসির ভাইয়ের (বঙ্গবন্ধুর ভাই) দেখা পেলাম৷ বললাম, নাসের ভাই ক্যু হতে যাচ্ছে, জানেন কিছু? শেখ নাসের ভাই আমাকে বললেন, ‘আমিও শুনেছি৷ ভাইকে বলবানি৷”
‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরই ফারুক-রশীদ- ডালিমরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রচার চালায় যে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ ও উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করেছে৷ তারা ট্যাঙ্ক বহর নিয়ে (গোলাবিহীন ট্যাঙ্ক, তবে তাতে যে গোলা নেই তা সবাই জানতো না৷ জানতো তিনজন: আর্মি চিফ- সি.জি.এস এবং ডি.জি, ডি.জি.এফ.আই) সাভারে রক্ষীবাহিনীর মেইন গেটে মাইক লাগিয়ে ঘোষণা করে যে, “সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ এবং উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করেছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে রেডিও-টিভিতে তাঁদের ঘোষণা আপনারা শুনবেন৷ রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সাথে merge (একীভূত) করা হয়েছে৷ এখন থেকে আপনারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য৷ সেনাবাহিনীর ভাই৷ আপনারা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর পক্ষে থাকুন৷ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাবেন না৷ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেলে আপনাদের ওপর দেশপ্রেমিক বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ করবে এবং আপনারা ধ্বংস হয়ে যাবেন৷ আপনারা আমাদের ট্যাঙ্কের গোলার মুখে আছেন৷ আপনারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন৷ রেডিও-টিভিতে তিন বাহিনী প্রধানের ঘোষণা ও ভাষণ শুনতে পাবেন…৷”
বাস্তব ঘটনাও ঘটে সেভাবে৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সৈনিক ও অফিসাররা এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও সেটা প্রত্যক্ষ করে৷ সাভারের রক্ষীবাহিনীর কাছে সে রকম বাস্তব সত্য প্রতিভাত হয়৷ যদিও জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম আমাকে বহুবার বলেছেন যে, “এই ক্যু বঙ্গবন্ধু ও আমার বিরুদ্ধে হয়েছে৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমি একা হয়ে পড়ি৷ আমি সি.জি.এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে এবং ৪৬ ব্রিগেডের কর্নেল জামিলকে ফোর্স নিয়ে হামলাকারীদের ক্রাশ করার আদেশ দেই৷ কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে পার্লামেন্ট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে

পৃষ্ঠা: ৩৫
তারা আমাকে রিপোর্ট করে যে, “Enemy have got superior fire power.” তাদেরকে এ্যাটাক করে defeat দেয়া সম্ভব নয়৷ সেজন্য আমরা ফিরে এসেছি৷” তিনি আরও বললেন:
“বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে উচ্চাভিলাসীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল৷ সেজন্য, আমার হুকুম কেউ তামিল করেনি৷ অথচ, অলঙ্ঘনীয় আর্মি রুলস্ হচ্ছে “Do or die.” সেদিন তারা আমার দেয়া আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে বাংলাদেশের ইতিহাস আজ অন্যরকম হতো৷ রাজাকার-আল বদর- যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশে ক্ষমতা আরোহন করতে পারতো না৷ ”
প্রশ্ন: “সেদিন আপনি একা হয়ে পড়েছিলেন বলেন কেন? সেদিন আপনার আর্মি হেডকোয়ার্টারে কী কী ঘটেছিল?”
জেনারেল শফিউল্লাহ : “বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ওপর আমার নির্দেশ অনুযায়ী কাউন্টার এ্যাটাক করতে গিয়ে ফোর্স যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসলো, তখন আমার ভুল ভাঙলো যে, আমি যাদের বিশ্বাস করছিলাম, তারাও আমার সাথে নেই৷ আমি একা৷ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হয়েছিলেন এক মীর জাফরের জন্য৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন বহু মীর জাফরের জন্যে৷ ১৫ই আগস্টের সকালে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে হুড়মুড় করে আমার কক্ষে ঢুকে পড়ে৷ আমার বুকে মেজর ডালিম সরাসরি অস্ত্র তাক করে৷ আমি তাদের বলি, “I have seen much of it. If you want to use it, use it. Don’t show me. ” কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম যে, বিনা বাধায় আমার আর্মি হেড কোয়ার্টারে এবং আমার কক্ষে তারা ঢুকে পড়লো৷ কেউ কোথাও তাদের বাধা দিল না !”
তারা কী বললো: “ডালিম বললো, আমরা শেখ মুজিবকে খতম করে এসেছি৷ এখন আপনাকে এটা own করতে হবে৷ আমরা যা কিছু করেছি সেনাবাহিনীর জন্য করেছি৷”
প্রশ্ন: আপনাকে তারা কি ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছিল?
উত্তর: “না”৷
প্রশ্ন: তখন আর্মি হেডকোয়ার্টারে আর কে কে ছিল?
জেনারেল শফিউল্লাহ: “জেনারেল জিয়াউর রহমান৷”
প্রশ্ন: “তিনি ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণকারী ঐসব খুনিদের কিছু বলেননি?”
উত্তর: “না”৷
প্রশ্ন: ‘তারপর কী হলো?”
জেনারেল শফিউল্লাহ : “তারা বেরিয়ে গেলে আমি জেনারেল জিয়াকে বললাম যে, এখন সাংবিধানিকভাবে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম হবেন রাষ্ট্রপতি৷ “We are to uphold the constitution and we are promised bound.”
জেনারেল জিয়া: “হ্যাঁ”৷
জেনারেল শফিউল্লাহ: “তাহলে চলুন আমরা এখন মিন্টু রোডের উপ- রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্যারের বাসায় যাই৷”
জেনারেল জিয়া: “চলুন৷”
জেনারেল শফিউল্লাহ: “আমরা আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে বের হবার সময় জেনারেল জিয়া নিজেই আমার গাড়িতে উঠতে চাইলেন৷ যদিও আমাদের দু’জনের দুটি ফ্লাগ গাড়ি রেডি ছিল৷ আমি ও জিয়া আমার গাড়িতে রওয়ানা দিলাম৷ লক্ষ্য করলাম, হেড কোয়ার্টারের বাইরের থেকে আমার গাড়ির আগে পিছে খুনিদের মেশিন গান বসানো পাঁচ-ছয়টি জিপ ও সৈনিক ভর্তি ট্রাক এসে গেছে এবং আমাদেরকে স্কর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে৷ আমার সন্দেহ হলো৷ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এসে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্যারের বাড়িতে যাবার জন্য আমি ড্রাইভারকে বামদিকে মিন্টু রোডের দিকে টার্ন (বাঁক) নিতে বললাম৷ কিন্তু জিয়া বললো, “না আমরা একবার রেডিও অফিস হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্টের বাসায় যাবো৷” বলে সে নিজেই আমার ড্রাইভারকে সোজা রেডিও অফিসে যেতে বললো৷ আমি অন্যরকম বললেও কাজ হতো না৷ কারণ, আমার গাড়ির আগে পিছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মেশিনগান বসানো জিপ ও ট্রাক ছিল৷ এমতাবস্থায়, আমরা রেডিও অফিসে ঢুকে দেখলাম মোশতাক, তাহের উদ্দীন ঠাকুর, জাসদের মেজর তাহেররা আগেই সেখানে অবস্থান করছে৷ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানও আমার পূর্বেই সেখানে পৌঁছে গেছে৷”
তিনি আরও বললেন: “আমরা যাবার সাথে সাথে তাহের উদ্দীন ঠাকুর একটা ঘোষণার কাগজ আমার হাতে ও সেখানে উপস্থিত অন্য দুই বাহিনী প্রধানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো: ‘এই ঘোষণাটা আপনারা তিনজন রেডিওতে এক্ষুণি রেকর্ড করে দিন৷’ তখনই আমি বুঝে গেলাম জেনারেল জিয়া প্ল্যান করে আমাকে এখানে এনেছে৷ আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আমার গাড়িতে উঠেছে এবং আমার গাড়ির আগে-পিছে খুনিদের আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত গাড়ি বহর দিয়ে শাহবাগের রেডিও অফিসে নিয়ে আসার সব পরিকল্পনা জিয়াই করেছে৷ তখন আমি বন্দি অবস্থায় সেটা রেডিওতে পড়ি৷ আমি না পড়লে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আমাকে ওখানেই গুলি করে মেরে ফেলতো৷”
প্রশ্ন: “কিন্তু স্যার, আপনি কি জানেন যে, ১৫ই আগস্টের সকালে আপনিসহ তিন বাহিনী প্রধানের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের ফলে খুনিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ও রক্ষীবাহিনীর দেশপ্রেমিক সৈনিকদের কাউন্টার রিভোল্ট করার কার্যক্রম ব্যর্থ হয়ে যায় এবং খুনিদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়”?
জেনারেল শফিউল্লাহ: “আমি যদি একটু সময় পেতাম এবং ঢাকা সেনানিবাসের সিনিয়র যেসব অফিসারকে আমি অন্তত বিশ্বাস করেছিলাম যে, তারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, তারা যদি থাকতো, তাহলে আমি নিজে কাউন্টার রিভোল্ট করতাম ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে তাদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়ে দিতাম৷ কিন্তু তাদের পক্ষে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ায় ও ভূমিকা রাখায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রত্যাগতরা নেতৃত্ব নিয়ে নেয়৷”
বস্তুত এখানেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের ভুল ও ব্যর্থতা৷ তিনি ইতস্তত করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন ‘যদি একটু সময় পেতাম’৷ একটা দেশের মুক্তিযুদ্ধ করা সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তিনি সর্বোত্তমভাবে জানতেন যে, বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দি গ্রেট-এর রি-ইনফোর্সমেন্ট ওয়াটার লু’র রণাঙ্গনে মাত্র বিশ মিনিট বিলম্বে পৌঁছেছিল বলে (জার্মানীর ফোর্স, বৃটিশ নৌ বাহিনী মাত্র বিশ মিনিট পূর্বে পৌছে ব্রিজ দখলে নিয়ে ওয়াটার লু রণাঙ্গনে ফরাসী সেনাদের পৌঁছানোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়৷ ফলে ফরাসী সেনাবাহিনী নেপোলিয়নের সাহায্যে পৌঁছাতে পারেনি) ওয়াটার লু’র ঐতিহাসিক যুদ্ধে অখ্যাত-অজ্ঞাত বৃটিশ জেনারেল নেলসনের কাছে বিশ্বের বীরদের বীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনানায়ক নেপোলিয়নের পরাজয়ের ঘটনা তার চোখের ওপর ছিল৷ তা সত্ত্বেও, তাঁর wrong calculation এর জন্য তাঁর কমান্ড গড়িয়ে গড়িয়ে খুনিদের সমর্থক জেনারেল জিয়ার হাতে চলে যায়৷ যেমন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর খুনিদের হামলার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু যে কয়জনকে ফোন করতে পেরেছিলেন, তার মধ্যে তাঁর চিফ অব স্টাফ একজন৷ বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন: “কী ব্যাপার শফিউল্লাহ, তোমার আর্মি এখানে গোলাগুলি করছে, আর তুমি কী করছো?” জবাবে জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম বলেছিলেন: “স্যার, আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি৷ আপনি কি কোনোক্রমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন? (বঙ্গবন্ধু কোন দিন, এমনকি ২৫শে মার্চের রাতেও ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পালাননি৷) পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তোয়াক্কা না করে ২৬ মার্চ বাড়িতেই ছিলেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য, আর তার নিজের সেনাবাহিনীর ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাবেন, সে কথা তার জেনারেলরা ভাবলেন কি করে? জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তমের উত্তর শুনে বঙ্গবন্ধু খেদের সাথে বলেছিলেন: “ও, তুইও ওদের সাথে আছিস?”
জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তম তাঁর মর্মবেদনা প্রকাশ করে আমাকে বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে জেনে গেলেন আমিও অকৃতজ্ঞ খুনিদের সাথে আছি৷” বঙ্গবন্ধুর সাথে জেনারেল শফিউল্লাহ বীর উত্তমের রেড ফোনে কথা হয় ৫টা ২৮ অথবা ৫টা ২৯ মিনিটে৷ সেই সময় থেকে তাঁকে খুনিদের প্রহরায় শাহবাগ রেডিও বাংলাদেশের অফিসে যাবার সময় ৮-৪৫ মিনিট পর্যন্ত তিনি ৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় পেয়েছিলেন৷ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট দি গ্রেট ২০ মিনিট সময় পেলে ইউরোপের মানচিত্র ও ইতিহাস বিশ্বের মানবজাতি আজ অন্যভাবে দেখতেন ও পড়তেন৷ যেখানে বাংলাদেশের প্রথম চিফ অব স্টাফ বাংলাদেশের ইতিহাস ও গতি সঠিক পথে রাখার জন্য ৩ ঘণ্টা ১৩ মিনিট সময় পেয়েছিলেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সময়ের মধ্যে সঙ্কটকালীন নেতৃত্ব প্রদর্শনে তিনি চরমভাবে ব্যর্থ হন৷
এই সময়কালের মধ্যে তিনি বিডিআর (বঙ্গবন্ধুর বাড়ির থেকে ৫ মিনিট দূরে অবস্থানরত) চিফ জেনারেল খলিলুর রহমানকে কোন কমান্ড দিতে পারেননি৷ সাভারের রক্ষীবাহিনীকে কোনো কমান্ড দিতে পারেননি৷ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে লন্ডনে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানকে ফোন করতে পারেননি৷ ডি.ডি.জি. ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দীনকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়া বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে (একটা সামরিক exercise দেখার জন্য) ১৪ই আগস্ট পাঠিয়ে দেন৷ তাকে সেখানে আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ যোগাযোগ করে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে এসে কমান্ড নিতে বলতে পারতেন৷ সেটা সম্ভব না হলে এমনকি বগুড়া থেকে টেলিফোনেও কমান্ড দিতে বলতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি কোনটাই করতে পারেননি৷ ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামানের অনুপস্থিতিতে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দীনের ঢাকার বাইরে যাওয়া বা রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার ছেড়ে বাইরে থাকা নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ৷ তা সত্ত্বেও তিনি আগের দিন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে যান এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন৷ তাঁকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে ১৫ই আগস্টের সকাল থেকে কোন যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি৷ বগুড়া ডিভ কমান্ডার তাঁকে সর্বক্ষণ সাথে সাথে রাখেন এবং বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট এক্সচেঞ্জকে বলে দেয় যে, ঢাকা থেকে তার কোনো ফোন আসলে তোতা পাখির মতো বলে দেবে “He is not available”. তাকে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে সামরিক এক্সারসাইজ দেখার জন্য ঢাকা থেকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৪ই আগস্ট ইনস্ট্রাকশন দিয়েছিলেন কেন, সে রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি৷ যদিও তা আজ দেশবাসীর কাছে সূর্যের আলোর ন্যায় পরিস্কার৷
সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা রক্ষীবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের ১৪ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা ছটফট করতে থাকে ঢাকায় এসে ঢাকার খুনিদের খতম করে দেবার জন্য৷ কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে ঢাকা পানে৷ কিন্তু সাভার রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার থেকে বার বার তাদেরকে এই হুঁশিয়ারি বার্তা দেয়া হয় এবং ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়৷ রক্ষীবাহিনীর এসব ইউনিটের অনেকে তাদের ডিজি এবং ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দীনের অনুপস্থিতিতে আর্মির চিফ অব স্টাফ জেনারেল শফিউল্লাহর কাছ থেকে একটা আদেশ/নির্দেশ বা মেসেজ চাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তারা তাও পাননি বলে আমাকে জানিয়েছেন৷ তারা কেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ৩২ নম্বরে এগিয়ে এলেন না, তার কোনো সদুত্তর সেখানকার লিডার বা ডেপুটি লিডাররা দিতে পারেননি৷ বরং সাভারে অবস্থানরত মেজর এ.আর. শরীফ (আর্মি থেকে রক্ষীবাহিনীতে ডেপুটেড) আমাকে বলেছিলেন যে, “বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সংবাদ শোনা মাত্র তার অধীনস্থ রক্ষীবাহিনীর এক জওয়ান আত্মহত্যা করেন৷ এ ঘটনার পর আর যাতে কেউ এমনটা না করে সেজন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্র সিজ করা হয়৷”
জনাব আবরারকে আরো জিজ্ঞেস করেছিলাম, “খুনি চক্রের লোকেরা কি নিশ্চিত ছিল যে, সাধারণ সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর খুন মেনে নেবে?”
জনাব আবরার : “আপনারা জানেন না যে, তাদের কমান্ডের সৈনিকদের তারা কী কথা বলে বিভ্রান্ত করেছিল সেই রাতে? তাদেরকে তারা কুর্মিটোলা নির্মাণাধীন বিমান বন্দরে নিয়ে ডাহা মিথ্যা কথা বলেছিল৷”
প্রশ্ন: “বিমানবন্দরে সমবেত করে কী ধরনের মিথ্যা কথা বলে খুনি রশীদ-ফারুক-ডালিমরা ৩২ নম্বরে যেতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল?”
জনাব আবরার: “কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশীদ জুলাই মাস থেকে গভীর রাতে ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিজ নিজ ফোর্স নিয়মিত “night exercise” এর নামে ঢাকার বিভিন্ন মহাসড়কে বের করে আনতো৷ তাদের মাঝে চাকরিচ্যূত ডালিম, নূর প্রমুখরা এসে মিশে যেতো৷ এর মধ্যে কর্নেল রশীদ নিয়ম মাফিক বগুড়ায় বদলী হয়ে যায়৷ কিন্তু আর্মির ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দেখিয়ে সে বদলি kept in abeyance (আপাতত স্থগিত) করাতে সমর্থ হয়৷ ১৫ই আগস্টের রাত ৩টায় কর্নেল রশীদ (খুনি মোশতাকের আত্মীয়) ও কর্নেল ফারুক গং

পৃষ্ঠা: ৪০
(ফারুক ও রশীদ ভায়রা ভাই) তাদের সকল ফোর্সকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তদানীন্তন নির্মাণাধীন কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে (বর্তমানের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) হাজির করে৷ সেখানে চাকরিচ্যূত বার জন সামরিক অফিসারসহ কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন মহীউদ্দিনদের উপস্থিতিতে কর্নেল রশীদ চিৎকার করে বলে ওঠে: “বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে সেনাবাহিনীর আমাদের সকলকে জীবন দিতে হলেও দিতে হবে৷ আজ শেষ রাতে ইন্ডিয়ান আর্মি হেলিকপ্টারে এসে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে হাইজ্যাক করে তুলে নিয়ে যাবে৷ তারা চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের সীমান্তের কয়েকটি জেলা ভারতের অংশ বলে তার কাছ থেকে লিখে নেবে৷ আসুন, আমরা ছুটে যাই৷ যে কোনো মূল্যে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাই৷ বাংলাদেশকে বাঁচাই৷ আমাদের ওপর, আমাদের আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ এবং ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার এটাই নির্দেশ৷ এখান থেকে সকলে ৩২ নম্বরে ছুটে চলুন৷ কোনো বাধা এলে গুড়িয়ে দেবেন৷ এখন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো ও রক্ষা করা আমাদের সকলের জন্য ফরজ, পবিত্র কর্তব্য৷ বঙ্গবন্ধু না বাঁচলে, দেশ বাঁচবে না৷ ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে যাবে বাংলাদেশ৷ আমরা পৌঁছানোর আগেই সেখানে যদি হেলিকপ্টার যোগে ভারতীয় বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়ে, তাহলে ঐ বাড়ির ওপর attack করে তাদের কব্জা থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবো…৷ এটা জেনারেল শফিউল্লাহ ও জেনারেল জিয়ার Last order. চলুন আমরা ছুটে যাই, বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাই…৷”
এই জলজ্যান্ত মিথ্যা আহবানের মাধ্যমে তারা তাদের ফোর্সকে বিভ্রান্ত করে ও উজ্জীবিত করে৷ কারণ, বঙ্গবন্ধুকে খুন করতে যাচ্ছি বললে তাদের ফোর্স ওই বিমান বন্দরে তাদেরকেই খুন করে ফেলতো৷ তার সর্বোচ্চ প্রমাণ হচ্ছে, ১৫ই আগস্টের সকালে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সবাইকে হত্যা করা হয়, তখন নিস্তব্ধতা নেমে এলে সকাল ছয়-সাতটার দিকে সোবহানবাগ মসজিদের সামনে থেকে আর্মিরা সোবহানবাগের স্টাফ কোয়ার্টারে পানি খেতে বা খাবার খেতে গেলে কোয়ার্টারের লোকজনদের ছাদে যাবার পথ দেখিয়ে দিতে বলে৷ তারা স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দাদের দেয়া পানি ও খাবার খায় ও বার বার ছাদে উঠতে থাকে ও নামতে থাকে৷ আমার ক্লাসমেট সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান জিন্নাহর এক ভাই তখন সোবহানবাগ স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন৷ জনাব মাহবুবুর রহমান ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব৷ জিন্নাহ তখন তার ভাইয়ের ওই বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো৷ আর্মির লোকেরা তাদেরকেও বার বার বলেছে, “আমরা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এসেছি৷ ভারতীয় হেলিকপ্টারে করে ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স তাঁকে যাতে তুলে নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বাংলাদেশ আর্মি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এসেছে৷ আর্মির চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ ও ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার অর্ডারে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে তারা এসেছে৷” কিন্তু কিছু পরে যখন তারা রেডিও’র ঘোষণা শোনে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, তখন তারা সোবহানবাগের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে হুড়মুড় করে নেমে যেতে থাকে৷ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার এ্যাসাইনমেন্ট বিষয়ে তাদের সাথে আগত সাধারণ সৈনিকরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল৷
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনায় ব্যাপক শক্তিভিত্তিক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল৷ এমনকি, বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা কর্মীদের ভিতরে তারা অনুপ্রবেশ ঘটাতে সমর্থ হয়েছিল৷ ডালিম, ফারুক, রশীদরা সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতো৷ খাবার টেবিলে নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করতো৷ তাদের অবাধ যাতায়াত ছিল৷ বেগম মুজিবকে তারা ‘খালাম্মা’ ও ‘আম্মা’ বলে ডাকতো এবং তাঁর হাতে বেড়ে দেয়া খাবার খেতো৷ বেগম মুজিবের পরম স্নেহধন্য হয়ে পড়েছিল তারা সবাই৷ বিস্ময়ের বিস্ময়কর ঘটনা হলো, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালের বিশ্বস্ততম ব্যক্তিগত কর্মচারী আব্দুলসহ তাঁর বাড়ির অনেককে হাত করে ফেলেছিল৷ বঙ্গবন্ধুর কেবিনেট সেক্রেটারিসহ তাঁর অফিসের অনেক স্টাফকেও তাঁরা পক্ষে নিয়ে ফেলেছিল৷ (কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ঘটিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে আরব বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনাঢ্য দেশটি৷ সেই কোটি কোটি টাকার কাছে এরা গরু, ছাগল, ভেড়ার মতো, পশুর মতো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল কি-না সে রহস্যের উন্মোচন হবে আমার পরবর্তী গ্রন্থে৷) আব্দুল ছিল বঙ্গবন্ধুর এক বিশ্বস্ততম চাকর৷ নিজের অজান্তে হলেও বঙ্গবন্ধুর এই দীর্ঘকালীন স্টাফ খুনিদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার তদানীন্তন একান্ত সচিব জনাব সেন্টু জানতেন যে, আমি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী, বিশ্লেষণমূলক গবেষণা কাজে রত আছি৷ তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ১৫ই আগস্টের রাতে আহত বঙ্গবন্ধুর স্টাফ আব্দুলের সাক্ষাৎকার নিতে বলেছিলেন৷ আমি তখন অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে ৬৪ গুলশান এভিনিউ এর ঢাকা হাউসে থাকতাম৷ একদিন শুক্রবার সকালে আব্দুলকে আমার বাসায় লোক দিয়ে আনালাম৷ তার সাথে অনেক কথা বললাম৷ পাতলা, হ্যাংলা চেহারার লম্বা আব্দুলকে দেখে অনুমান করা যায় যে, কিছুটা বুদ্ধিহীন যুবক৷ দুপুরে তাকে খাওয়ালাম৷ বিকেলেও অনেক ফলমূল খাওয়ালাম এবং নানাভাবে কলা-কৌশল করে ১৫ই আগস্টের আগে ও পরের ঘটনার বিষয়ে তার মতামত ও প্রত্যক্ষ বিবরণ সব লিপিবদ্ধ করলাম৷ তার কিছু অংশ এখানে ছাপালাম৷
আব্দুলের পরিচয় হলো, সে বঙ্গবন্ধুর বেড রুম ও বাথরুম পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করার কাজসহ বঙ্গবন্ধুর খাস কাজগুলো সে করতো৷ সকালে বঙ্গবন্ধু গোসল করে বের হবার সময় এই আব্দুল তাকে ফ্রেশ লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, তোয়ালে ইত্যাদি দিতো৷ চিরুনি ও অন্যান্য জিনিস হাতে দিয়ে দিতো৷ বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিব ঘুমিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুর দরজার বাইরে সে বিছানা পেতে ঘুমাতো৷ ভোরে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে তার মুখই প্রথম দেখতো৷ তার নাম ধরে প্রথম ডাকতো৷ সে প্রথম ফ্রেশ লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জায়নামাজ, টুপি ইত্যাদি খুঁজে বঙ্গবন্ধুর হাতে দিয়ে দিতো৷ বঙ্গবন্ধু ফজরের নামাজ পড়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে কবুতরকে খাওয়াতে যেতেন৷ রাতে সব কাজ শেষে বঙ্গবন্ধুকে শুতে যাবার সময় রাতের লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, তোয়ালে, জায়নামাজ, টুথ ব্রাশ, পেস্ট সে এগিয়ে দিতো৷
আমার সাথে সাক্ষাতে আব্দুল বলেছে যে, ৩২ নম্বর রোডের মাথার মনু জেনারেল স্টোরে সন্ধান নিয়ে কিছু লোক (কিলাররা) জেনে নেয় যে, ওই আব্দুল হলো বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালের খাস কর্মচারী৷ অতি বিশ্বস্ত৷ মনু জেনারেল স্টোরের সামনে তাকে মহীউদ্দিনের লোকেরা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তার সাথে জুন মাস থেকে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে৷ মাঝে মধ্যে তাকে ভালো ভালো গিফট দিতে থাকে৷ সহজ সরল মনে সে এসব স্বীকারোক্তি করে গেছে৷ তাকে ওরা এই কথা বলে তার মন জয় করে যে, তাদের জিন্দা পীর সাহেব চট্টগ্রামের এক জঙ্গলে বসে বঙ্গবন্ধুর জন্য দোয়া করছে৷ সেজন্য বঙ্গবন্ধুর চোখের সামনে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির এমন কাউকে পীরের তরফ থেকে ভাল-মন্দ খাওয়াতে হবে ও সেবা করতে হবে৷ এর জন্য আব্দুলকে কোনো কিছুই করতে হবে না৷ তবে তাকে এ বিষয়টি গোপন রাখতে হবে৷ প্রকাশ করলে আব্দুলের অজানা ক্ষতি হবে এবং তার পীরেরও ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে৷ এমনকি তাদের উভয়ের ওপর জ্বীন সওয়ার হয়ে দু’জনকে একসাথে মেরে ফেলবে৷ জুলাই মাসের একদিন বাকি থাকতে তাকে মনু জেনারেল স্টোরের সামনে থেকে ডেকে নিয়ে সোবহানবাগ ওষুধের দোকানের সামনে তার সাথে প্রথম দেখা খুব লম্বা- দোহারা চেহারার রিসালদার মহীউদ্দিনের৷ সে যে আর্মির কেউ তা আব্দুলকে বলেনি৷ মহীউদ্দিন প্রথম সাক্ষাতে পীরের নামে আব্দুলের মাথায় ছোট কয়েক ইঞ্চির কোরআন শরীফ রেখে কসম করায় এবং তাকে কিছু টাকা দেয়৷ সে নিতে চায়নি৷ জোর করে দেয়৷ তাকে শুধু একটা সামান্য কাজ দেয়৷ বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে পড়লে সে এসে মনু জেনারেল স্টোরে তাদের লোককে প্রতি রাতে বলে যাবে৷ এজন্যে প্রতি রাতে তার পীরের তরফ থেকে “দোয়া পড়া লাল কাপড়ের প্যাকেটে” পীরের এনাম আসবে৷ কিন্তু এগুলো সে গোপন রাখবে বলে আল্লাহর নামে তার মাথায় ছোট কোরআন শরীফ রেখে মহীউদ্দিন তাকে কসম করায়৷ জুলাই মাস থেকে প্রতি রাতে বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে পড়লে সে মনু জেনারেল স্টোরে এসে তাদের লোককে বলে যেতে থাকে৷ ১৫ই আগস্ট রাতেও আব্দুল তাদেরকে মনু জেনারেল স্টোরে এসে বলে যায় যে, “বঙ্গবন্ধু এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন৷” এই একটি “ইনফরমেশন” এর মূল্য কিলারদের কাছে এক হাজার কোটি টাকার চেয়ে বেশি, যা তারা পেয়ে যায় বড় জোর কয়েক হাজার টাকার এনাম ফেলে! (বঙ্গবন্ধুর সচিবদের কত কোটি টাকার এনাম দিয়ে কিলাররা হাত করেছিল, সে বিষয়ের অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে আছে৷ আমার পরবর্তী গ্রন্থে সেসব প্রকাশ করার আশা রাখি৷)
১৫ই আগস্ট রাতে যখন সিমারের দল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সিঁড়ির ওপর ফেলে গুলি করতে করতে উপরে উঠে আসে, তখন এই আব্দুলও তাদের গুলিতে উরুতে ও পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়৷ হঠাৎ আব্দুল লক্ষ্য করে যে, গুলি করতে করতে আসছে সেই লোক যার সাথে জুলাই মাস থেকে বহুবার তার দেখা হয়েছে সোবহানবাগ ওষুধের দোকানের সামনে৷ যে তার মাথায় কোরআন শরীফ দিয়ে কসম করিয়েছিল৷ সে তাকে চিৎকার করে ডাক দিয়ে বলে, “মহীউদ্দিন ভাই, আমাকেও গুলি করলেন?” রিসালদার মহীউদ্দিন তার অনুসারী ফোর্সকে বলে, “এ আমাদের লোক৷ একে গাড়িতে তোল৷ একে তাড়াতাড়ি মেডিকেলে পৌঁছে দাও৷” বলা মাত্র আর্মির দুই জন তাকে ঘাড়ে করে একটি জিপে তুলে মেডিকেল কলেজে পৌঁছে দেয়৷ সেজন্য সে বেঁচে যায়৷ খুনি মোশতাক প্রেসিডেন্ট হলে তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির স্টাফ হিসেবে তার সরকারি চাকরি বহাল রাখা হয়৷ তবে তাকে ঢাকা থেকে বদলী করে উত্তরা গণভবন, নাটোরে পোস্টিং দেয়া হয়৷
বঙ্গবন্ধুকে যখন সিঁড়িতে গুলি করা হয়, আব্দুল তখন কোথায় ছিল এবং সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে কী ঘটনা ঘটতে দেখেছে সে প্রশ্ন করলাম৷
আব্দুল: “উঁনি (বঙ্গবন্ধু) একবার নিচে গিয়ে ওপরে উঠে আসেন৷ তখনও তারা বাড়ির ভিতরে ঢোকেনি৷ চারিদিক দিয়ে শত শত গোলাগুলি আসছিলো৷ বঙ্গবন্ধু তাঁর শোবার ঘরে ঢুকে রেড টেলিফোনে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছিলো৷ ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তারা ওপরে উঠে এসে বঙ্গবন্ধুর ঘরে ঢুকে তাঁকে টানাটানি করে বের করে নিয়ে যেতে থাকে৷ ঐ শয়তানরা বঙ্গবন্ধুকে পাঞ্জাবি পরতেও দিচ্ছিল না৷ ৬/৭ জন দু’হাত ধরে টানাটানি করে নিয়ে যাচ্ছিল৷ কোনোক্রমে সে (বঙ্গবন্ধু) পাঞ্জাবিটা পরে নিয়েছিল৷”
প্রশ্ন: “বঙ্গবন্ধু তাদের কিছু বলেননি?”
আব্দুল: “উনি শুধু বার বার বলছিলেন, এই তোরা আমার সাথে বে- আদবী করছিস কেন? বেয়াদবী করিস কেন? আমি কি তোদের জন্য কিছু করিনি? এই দেশের জন্য কিছু করিনি?”
প্রশ্ন: “তারা কোনো উত্তর দেয়নি?”
আব্দুল: “না৷ ওঁনাকে (বঙ্গবন্ধু) ধাক্কাতে ধাক্কাতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে গেল৷ তার কিছু পর ব্রাশ ফায়ার হলো৷ ব্রাশ ফায়ারের পরেও উঁনি (বঙ্গবন্ধু) বেঁচে ছিলেন৷ ওনার মুখ দিয়ে আওয়াজ আসছিল৷’
প্রশ্ন: “বঙ্গবন্ধু কি কলেমা শরীফ পড়েছিলেন?”
আব্দুল: “ঠিক বোঝা যায়নি৷ কলেমা শরীফের মতো হবে৷ ব্রাশ ফায়ারের সাথে সাথে খালাম্মা (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) দৌড়ে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেলেন৷ আবার ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনলাম৷ খালাম্মাকেও ওরা মেরে ফেললো৷”
প্রশ্ন: “তুমি আহত হলে কখন?”
আব্দুল: “ওনাদের দু’জনের ওপর ব্রাশ ফায়ারের পর ব্রাশ ফায়ার করতে করতে ওরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে থাকে৷ বঙ্গবন্ধুর ঘরের দরজার মুখে ওদের গুলি খেয়ে আমি পড়ে যাই৷”
প্রশ্নঃ “অন্যান্যদের ওপর কারা, কোন ঘরে গুলি করে?”
আব্দুল: “আমি দেখিনি৷ তার আগেই মহীউদ্দিন ভাই-এর (রিসালদার মহীউদ্দিন) হুকুমে আমাকে দু’জন ধরে নিচে নিয়ে জিপে তুলে দেয়৷ আমি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যাই৷”
বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর পরিবারের স্নেহ মায়ায় লালিত আব্দুলের কাছে খুনি রিসালদার মহীউদ্দিন “মহীউদ্দিন ভাই” হয়ে যায় (!!!) জুন থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে!! সে তো একটা যৎসামান্য পিওন৷ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী ও সচিবরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা বঙ্গবন্ধুর খুন পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ আড়াই মিলিয়ন ডলারের (আনুমানিক ১৯.৫০ কোটি টাকা) মধ্যে কে কত কোটি টাকার ভাগ পেয়েছেন তার তথ্য সংগ্রহ চলছে৷ আমার পরবর্তী গ্রন্থে বিস্তারিত প্রকাশের আশা রাখি৷ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে ফেলে মন্ত্রী হয়েছে৷ যেসব মন্ত্রী দিবস-রজনী “বঙ্গবন্ধু” “বঙ্গবন্ধু” নাম জপ করতে করতে মুখ দিয়ে ফেনা তুলে ফেলতো, তারা বঙ্গভবনে এসে খুনিদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে৷ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি. ইমাম বঙ্গভবনের শপথ গ্রহণ

পৃষ্ঠা: ৪৫
অনুষ্ঠানের আগেই খুনি মেজর ডালিম-ফারুক-রশীদ-নূরদের পরিচিত করিয়ে ঘোষণা দিতে থাকে, “আমাদের মহান সেনাবাহিনীর পক্ষে এই সূর্যসন্তানেরা আমাদের দেশকে রক্ষা করেছে৷ আমাদের জাতিকে বাঁচিয়েছে৷ তারা আমাদের গর্ব৷” যেসব জেনারেল বা সচিবের দিকে বঙ্গবন্ধু একবার চোখ তুলে তাকালে অথবা তার নাম ধরে একবার “কেমন আছিস” কথাটুকু জিজ্ঞাসা করলে তাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে বলে মন্ত্রণালয়ে ফিরে এসে গর্বের সাথে অফিসারদের কাছে এবং বাড়ি গিয়ে বৌ-ছেলেমেয়েদের কাছে বারংবার উল্লেখ করতো, তারা সামান্য চাকরির লোভে ও পদোন্নতির মোহে খুনি এজিদদের পদলেহন শুরু করে৷ পদলেহনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়৷
এসব বিশ্বাসঘাতক পদলেহনকারীরা কোন সুযোগই পেতো না, যদি বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকারের সচিবদের সুপারিশ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের সরকারকে বাতিল ঘোষণা করে দিতেন৷ ঢাকায় এবং বাংলাদেশব্যাপী প্রশাসনের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের আগুনের পরশমণিতে খাঁটি হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ ও পদায়ন করে নতুন বাংলাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতেন, তাহলে জাতির জনককে হত্যা করে বা সমস্ত মন্ত্রীসভাকে হত্যা করেও ‘৭৫-এর গুটিকয় ঘৃণ্য খুনিরা বাংলাদেশের সচিবালয় ও প্রশাসন তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতো না৷ ভিয়েতনামে এবং কিউবায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে উভয় দেশের সরকার রেডিও’তে দেয়া মাত্র একটি সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে পূর্বের সরকারের সমস্ত সাংগঠনিক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়েছিল৷ নামে নামে কোনো চিঠি- পত্র ইস্যু করেনি উক্ত দেশ দুটির যুদ্ধ বিজয়ী সরকার৷ ফলে উক্ত উভয় দেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নতির শিখরে আরোহন করেছে৷ তাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকারী নেতারা যেমন- ভিয়েতনামের জাতির জনক হো চি মিন-এর অনুসারী নেতারা এবং কিউবার জনক ফিডেল ক্যাস্ট্রো এবং তাঁর অনুসারী নেতারা আজও উক্ত দেশ দুটির নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে৷ ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর মুজিবনগর সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যাকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী-রাও ফরমান আলীর সরকারের পক্ষে যারা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন পরিচালনা করেছে, অস্ত্র যুগিয়েছে, সমরযানের তেল সরবরাহ নিশ্চিত করেছে, তাদের আরাম- আয়েশ মিটিয়েছে৷ তাদেরকে যদি ভিয়েতনাম ও কিউবার মতো ১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর বিদায় করে দেয়া যেতো, তাহলে ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টে গুটিকয়েক খুনিরা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগই পেতো না৷ খুনিদের পদলেহন করা তো দূরের কথা৷ বীর মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গভবন থেকে ঢাকার সচিবালয়সহ সমস্ত বিভাগ ও জেলাসমূহে খুনিদের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতো৷ ঢাকার রাস্তা-ঘাটে খুনিদের কচুকাটা করে তাদের রক্ত-মাংস কুকুর দিয়ে খাওয়ানো হতো৷
এমনকি, ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট ৫০ জন সিএসপি অফিসার সচিবের চেয়ারে না থেকে, যদি আওয়ামী লীগের ৫০ জন পিওন ৫০টি সচিবের চেয়ারে আসীন থাকতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সচিবালয় চালু করে খুনিদের সরকার চালাতে পারতো না৷ আওয়ামী লীগের ৫০ জন পিওন সচিবালয় বন্ধ করে, ওয়াসার পানি বন্ধের আদেশ দিয়ে, তিতাসের গ্যাস বন্ধের আদেশ দিয়ে, টিএন্ডটি’র টেলিফোন বিচ্ছিন্নের আদেশ দিয়ে, বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্নের আদেশ দিয়ে ঢাকা অচল করে দিতো৷ খুনীদের সরকার গঠনের উদ্যোগ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তো৷ ঢাকাবাসী তখন তাদের ধরে কুচি কুচি করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াতো৷
কিন্তু তার পরিবর্তে, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা ও সরকারের সচিবরা খুনি মোশতাক-মাজেদ-ডালিম-ফারুক-রশীদ-নূরদের বাড়িতে বাড়িতে সস্ত্রীক পোলাও-বিরানী ও মিষ্টির হাড়ি হাতে নিয়ে দেখা করতে থাকে৷ তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে যায়৷ কে কার আগে গিয়ে খুনিদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে৷ সেখানে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নমরুদ ফেরাউন পরিবার বলে উল্লেখ করে নমরুদ-ফেরাউনের হাত থেকে “তোমরা বাবারা আমাদের বাঁচিয়েছো” বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে থাকে৷ আওয়ামী লীগের মহিলা নেত্রীরাও পিছে পড়ে থাকতে রাজি ছিল না৷ তারাও এসব খুনি এজিদদের বাড়িতে বাড়িতে শাড়ি হাতে, মিষ্টির হাড়ি হাতে ছুঁটে যেতে থাকে৷ বর্তমান আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেত্রী খুনি ডালিমের স্ত্রী নিম্মির জন্য দু’টি জামদানী শাড়িসহ নিজের বাড়িতে রান্না করা কয়েক হাড়ি বিরানী নিয়ে তার বাসায় যায়৷ ফিরে এসে আনন্দে আটখানা হয়ে বলেছে “ডালিম আমাদের আগের মতো গ্রহণ করেছে৷ আমরাও তাকে আপন করে নিয়েছি৷ দেশ-জাতির জন্য সে যা করেছে, তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷ আমরা তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতাম না৷ জানো না, আমাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না… সেই অবস্থায় পড়েছিলাম আমরা৷” যাদের সামনে তিনি এসব কথা গর্বের, অহঙ্কারের ও আহলাদের সাথে বলেছেন- তাদের অনেকে আজও সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন৷
উপঢৌকনের বহর নিয়ে মিষ্টির হাড়ি হাতে এভাবে তারা একে একে কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর নূরসহ সব খুনিদের বাড়িতে গিয়ে তাদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকে এবং তাদেরকে জাতির “সূর্যসন্তান” বলে “জাতির ত্রাণ-কর্তা” বলে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানাতে থাকে৷ মুজিবনগর সরকারের একজন সচিবের স্ত্রী এর সাক্ষী৷ যাঁর স্বামী পরবর্তীতে এমপি এবং মন্ত্রী হন৷ আরেকজন সাক্ষী হলেন সত্তরের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শীর্ষ ছাত্রলীগ নেত্রী ও সাবেক এমপি৷ যাঁর স্বামী মুজিবনগর সরকারের একজন (সিএসপি) অফিসার, পরবর্তীকালে সচিব৷ বহু সাক্ষীর মধ্যে তাদের দু’জনের নাম উল্লেখ করলাম মাত্র৷
আমেরিকান দূতাবাস কর্তৃক হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পুরো একটি ফ্লোর তাদের দূতাবাসের অফিসার/কর্মচারীদের ছদ্মনামে ভাড়া নেয়া হয়৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদচ্যূত অফিসাররা এবং সে সময়ের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের এক সম্পাদক (যে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পুত্রবৎ স্নেহ- মমতায় ধন্য হয়েছে বহুবার৷) তাদের সাথে বহুবার গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন৷ হোটেলে নৈশভোজের নামে নিচে ভোজ সেরে রাত গভীর হলে এক ফাঁকে দ্রুত লিফট ধরে উক্ত সম্পাদক উঠে যেতো ওপরে৷ আমেরিকান দূতাবাসের অফিসারদের সাথে এই বিশ্বাসঘাতক ছিল খুনি মোশতাকের মেসেঞ্জার ও সেতুবন্ধন৷
যতদূর মনে পড়ে রুহুল কুদ্দুস মামা ১৯৭৫ এর জুলাই মাসে বিদেশিদের সাথে উক্ত সম্পাদকের “mysterious and doubtful movement” এর তথ্য পেয়ে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে লিখিত জানালে তিনি বললেন, “ওর বাবা ওদের দু’ভাইকে আমার হেফাজতে দিয়ে গেছে৷ কামাল-জামালের মতো ওরাও আমার দু’টি সন্তান৷ ওর বাবা বাংলাদেশের জন্য যা করেছে, তার ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না৷ ওরা যা করবে, মনে রেখো, পিতার ভালোর জন্য করবে৷” (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে সেই সন্তান প্রমাণ করেছে, সে তার বাবার সাথে ও বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে৷)
খুনি মোশতাকের হাতে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হবার পর ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে জেনারেল খালেদ মোশাররফ স্যারের নেতৃত্বে কাউন্টার ক্যু হলে, বঙ্গবন্ধুর সেই কথিত সুপুত্র খুনি মোশতাকের জীবন বাঁচাতে আমেরিকায় political asylum পাবার বিষয় নিশ্চিত করতে আমেরিকান দূতাবাসে ইউজিন বোস্টারের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের বুকে ছুরি হেনে-“পিতার ভালোর জন্য মনে রাখার মতো কাজ” করেছিল বঙ্গবন্ধুর পুত্র স্নেহ-মমতায় সিক্ত সেই সম্পাদক৷ (ইউজিন বোস্টার ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা শোয়েকর্ণ সরকারকে উৎখাত করে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের নীল নকশা নিয়ে)৷
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী এসব পশুদের বিপরীতে আমি সেসব মহান আদর্শবান আলোর দিশারীদের নাম উল্লেখ করতে চাই, যাঁদেরকে মোশতাক-মাজেদ-ডালিম-ফারুক-রশীদ-তাহের- নূররা বঙ্গভবনে বন্দি করে এনে প্রধানমন্ত্রীর মুকুট পরানোর জন্য শত চাপাচাপি ও পীড়াপীড়ি এবং শেষমেষ ভয়-ভীতি দেখিয়েও এক বিন্দু টলাতে পারেনি৷ বঙ্গবন্ধুর মহত্তম আদর্শে আদর্শবান তেমন একজন মহান ব্যক্তি এম. মনসুর আলী৷ ১৭ই আগস্ট বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খুনি মোশতাকের কক্ষ থেকে সকল লোভ-লালসা এবং খুনিদের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে লাথি মেরে তিনি যখন বের হয়ে যান, তখন খুনি মোশতাক চিৎকার করে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, “মনসুর ভাই, এবার যারা জেলে ঢুকবে, তারা কেউ আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারবে না৷” সে কক্ষে উপস্থিত খন্দকার মোশতাকের পি.আর.ও. কুমার শংকর হাজরা নিজে এটা বলতে শুনলেন৷
বাঙালি জাতির এই মহান নেতা এম. মনসুর আলী খুনি মোশতাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আল্লাহ আমার জন্য যা করবেন, তাতে আমি রাজি৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্তের সাথে বেঈমানী করা আমি শিখিনি৷ বেঈমানী আমি করবো না৷” খুনিরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাঁকে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলার হুকুম চায়৷ তাঁকে বঙ্গভবন থেকে সরাসরি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষেপ করে৷ খুনিদের সে ওয়াদা দেয় যে, কারাগারে মেরে আসতে কেউ তোমাদের বাধা দেবে না৷ সেখানে ৩রা নভেম্বর তাঁকেসহ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে সেই খুনিরা হত্যা করে প্রমাণ করে যে, ১৭ই আগস্ট খুনি মোশতাক যা বলেছিল, তা তারা কার্যকর করেছিল৷
১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর খুনিরা তড়িঘড়ি করে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর সামনে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেয়৷ সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও দেশবাসীর সামনে তারা দেখাতে চায় যে, বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই বলে বাংলাদেশে কোনো ক্ষমতার বা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের শূন্যতা সৃষ্টি হয়নি৷ ১৫ই আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে খুনি খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু করেন তিনজন- মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি.ইমাম, রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম এবং স্বঘোষিত মূখ্য সচিব মাহবুব-উল-আলম চাষী (ইসলামাবাদে চাকরিকালীন সিআইএ’র চর বলে প্রমাণিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে চাকরিচ্যুত)৷ খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানের ভাব-গাম্ভীর্য বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি. ইমাম এবং রাষ্ট্রপতির সচিব আব্দুর রহিম খুনি মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের সাথে ঘন ঘন বৈঠকে বসেন৷ মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি. ইমাম বঙ্গভবনে বসে রেড টেলিফোন থেকে সকল মন্ত্রীদের ও সচিবদের ফোন করে খুনি রশিদ- ফারুক-ডালিমদের নাম করে ধমকাতে লাগলেন৷ যাতে তারা সবাই খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শপথ নেন এবং সচিবরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের মান-মর্যাদা শ্রীবৃদ্ধি করেন৷ (তাঁর নিজের বইতেও এসব উল্লেখ আছে৷) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যার পর অথবা ভারতের মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর অথবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী অথবা বার্মার জাতির পিতা জেনারেল অং সন-এর হত্যার পর কুখ্যাত খুনিরা এসব দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারেনি৷ কারণ, ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের বিশ্বাসঘাতক সচিব ও জেনারেলরা যেভাবে খুনিদের পদলেহন করেছিল ও তাদের পায়ে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেভাবে আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান ও বার্মার আত্ম-সম্ভ্রমসম্পন্ন সচিব ও জেনারেলরা তা করেনি৷ বরং তৎক্ষণাৎ সেসব দেশের সচিব ও জেনারেলরা সেসব কুখ্যাত খুনিদের রুখে দাঁড়িয়েছিল ও তাদের সকলকে সবংশে নির্মূল করে দিয়েছিল এবং সরকারকে অব্যাহত রেখেছিল৷
বঙ্গভবনের শপথ অনুষ্ঠানে আমি, আমার সহকর্মী রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, কুমার শংকর হাজরা, আলী তারেক, গাজী মনসুর, ফরিদ উদ্দিন আহমদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলাম৷ সেখানে কেবিনেট সেক্রেটারি এইচ.টি. ইমাম হাসিমুখে সানন্দে সকলকে বসাচ্ছিলেন এবং আগত সকলকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন৷ খুনি মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার সময় তিনি তাকে শপথের পূর্বে “মহামান্য” বলে এই খুনির নাম উচ্চারণ করে বলেন, “এখন আমি খন্দকার মোশতাক আহমদকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুরোধ করছি৷” সেখানে উপস্থিত সকলেই দেখলেন যে, তিনি এবং মাহবুব-উল-আলম চাষী মোশতাকের ডানহাত হিসেবে একসাথে চলাচল করছেন এবং একসাথে কাজ করছেন৷ ১৬ই আগস্টের দৈনিক ইত্তেফাকসহ অন্যান্য পত্রিকায় যেসব ছবি বেরিয়েছে তাতে দেখা যায় যে খুনি মোশতাকের ডানদিকে এইচ.টি. ইমাম৷ বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানের ছবিতেও সে ডানদিকে এবং বঙ্গভবনের মসজিদের ১৫ই আগস্ট জুম্মার নামাজের ছবিতেও খুনি মোশতাকের ডানদিকে তাঁকে দেখা যাচ্ছে (১৬ই আগস্টে ইত্তেফাকের ছবি)৷ ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্যার ও তাজউদ্দীন স্যারের নেতৃত্বে পরিচালিত প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে এইচ.টি. ইমাম এবং মাহবুব-উল-আলম চাষী, খন্দকার মোশতাকের পক্ষে অনেক ষড়যন্ত্র-

পৃষ্ঠা: ৫০
চক্রান্তে লিপ্ত ছিল৷ তার প্রমাণ হিসেবে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের প্রতিমন্ত্রী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এডভোকেট রহমত আলী এমপি আমাকেসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাকে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে তাঁর অফিস কক্ষে বসে বলেছেন যে, মুজিবনগরে একদিন তিনি এবং আরও দুই জন এমপি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের কক্ষে বসে কথা বলছিলেন৷ এমন সময় দরজা খুলে এইচ.টি. ইমাম তার কক্ষে প্রবেশের অনুমতি চান৷ কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, “আমি খবর দিলে আসবেন, তাছাড়া কখনো আসবেন না৷” রহমত আলী সাহেব বললেন: “তাজউদ্দীন সাহেবের এমন কঠোর হুকুম শুনে আমরা একটু অবাক হই৷ কিন্তু একটু পরই তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের বললেন যে, ‘এইচ.টি. ইমাম এবং মাহবুব-উল-আলম চাষী মোশতাকের সাথে মিলে সি.আই.এ-র চরদের সঙ্গে নিয়ে মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে যাচ্ছে৷’ সেই খুনি মোশতাকের বিশ্বস্ত চর এইচ.টি. ইমাম এখন বহুরূপী বর্ণচোরা সেজে সকলকে ধোকা দিচ্ছে৷ জাতিকে আরেকটি মহা ট্রাজেডির মধ্যে নিক্ষিপ্ত করার নীল-নকশা হাতে নিয়েছে”৷
বঙ্গভবনে খুনিদের এক দিন পার হলো৷ ১৬ই আগস্ট সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার আমির খসরু থেকে খবর পেয়ে আমি ও কুমার শংকর হাজরা (খুনি মোশতাকের অফিসার) দোতলায় গেলাম খুনিদের মাতলামি করার ঘটনা দেখতে৷ আমরা দু’জন দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই দেখলাম লিফট থেকে ১০/১২ হাত দূরে বঙ্গবন্ধুর এক খুনি রিসালদার মহিউদ্দিনের এক হাতে মদের বোতল, আরেক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র৷ তার সাথে আরও ২০/২৫ জন, তাদের হাতেও মদের বোতল ও স্টেনগান ও শর্ট গান৷ আমাদের দিকে মদের বোতল উঁচু করে মহিউদ্দিন বলছে, “শেখ মুজিবের হারামজাদাদের বলে দে তাদের সব খতম করেছি আরও করবো৷ বাংলাদেশ, বাঙালি সব শালা মাদার…. বাস্টার্ড৷ হারামজাদা শেখ মুজিব শেষ৷ তার কথা যে বলবে, সে শেষ, বাংলাদেশ শেষ৷ রেডিও খোল… “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বল… you go… all are bustards … tell them your father Mujib is dead dog… all… dead… Bangladesh dead… This is Islamic Bangladesh…” তাদের মাতলামি দেখে ঘৃণা ভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমরা লিফট ধরে নেমে এলাম৷ রাতে জানলাম আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ বঙ্গভবনে বন্দি হয়ে আছেন৷ রাত ১১টার পরে খুনিদের ২টি মাইক্রোবাসে সুন্দরী মহিলারা এসে বঙ্গভবনে নামলো৷ তাদেরকে দোতলায় কিলারদের কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো৷ বলা হলো কিলারদের স্ত্রীরা এসেছে৷ অনেকে বিশ্বাস করতে পারলো না৷ তাদের মনোরঞ্জনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদেরকে বঙ্গভবনে পাঠিয়েছে বলে জানলাম৷
১৭ই আগস্ট সকাল নয়-দশটার দিকে বঙ্গভবন থেকে ফোন করে ঢাকার পত্রিকার সম্পাদকদের বঙ্গভবনে আসার ফরমান জারি হলো৷ ঢাকার প্রবীণতম সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সাহেবের নেতৃত্বে দশ-বারোজন সম্পাদক এলেন বঙ্গভবনে৷ বঙ্গভবনের গেট পেরিয়ে আসার পর বঙ্গভবনের সিঁড়িতে তাঁদের আটকে আধা ঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড় করিয়ে রাখলো অস্ত্রধারীরা৷ আমরা তাদেরকে সেখান থেকে আনার জন্য গেলাম৷ কিন্তু অস্ত্রধারী খুনিরা হাতের ইশারায় আমাদেরকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো৷ বাংলাদেশ অবজারভার-এর সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক সবার পক্ষ থেকে অস্ত্রধারীদের বললেন যে, বঙ্গভবনের বৈঠকের জন্য তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে৷ তাঁদের যদি ভেতরে যেতে না দেয়া হয়, তবে তাঁরা চলে যাবেন৷ এ কথা বলামাত্রা মাথায় খুন চেপে থাকা বঙ্গভবনের অস্ত্রধারী খুনিরা তাদের দিকে হিংস্রভাবে তেড়ে এসে তাদের মাথার ও বুকের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে চিৎকার করে বলে উঠলো: “Shut up, shut up you bustards, if you say a word, you are dead, all of you are dead.” সম্পাদকরা সেই রক্তপিপাসু খুনিদের আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ভয়ে আতঙ্কে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর পড়ে যান৷ কেউ কেউ কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ির ওপর বসে পড়েন৷ দেশের গণ্য-মান্য সম্পাদকরা নিজেদের আত্মসম্ভ্রম বাঁচাতে বঙ্গভবনে খুনিদের হাতে তাঁদের লাঞ্ছিত হবার ও নিগৃহীত হবার ঘটনা সেদিন জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি!! (২০শে জুলাই, ২০০৩ হোটেল শেরাটনে দৈনিক ভোরের কাগজের যুগপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন দেশের প্রবীণতম সম্পাদক ৯৮ বছরের বর্ষীয়ান এই বিবেকের কণ্ঠস্বর জনাব ওবায়দুল হক৷) অনুষ্ঠান শেষে আমি তাঁকে জানালাম যে, “৭৫ এর ১৭ই আগস্ট বঙ্গভবনে খুনিরা সম্পাদকদের বুকের ওপর যে আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছিল, সেটা আমি বহুবার ১৫ আগস্টের পত্র- পত্রিকায় লিখেছি৷” তিনি আমার হাত জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে তাঁর পাশে বসালেন৷ তখন সেখানে বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন সাহেবও তাঁর আরেক পাশে ছিলেন৷ তিনি তাঁর পাশে বসিয়ে আমাকে বললেন, “মুসা সাদিক, আপনি ‘খুনিদের মাথার মুকুট’ শিরোণামে দৈনিক জনকণ্ঠে যেটা লিখেছেন, সেটা লেখার সাহস এদেশে আর কেউ দেখাতে পারেনি৷ সেজন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ দেই৷ আপনার অসীম সাহস৷ ‘৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসটা আপনাকে দেখলে চেনা যায়৷ আমি দোয়া করি, আল্লাহতায়ালা যেন আমার চেয়েও আপনার আয়ু বেশি দেয়৷” তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা জিয়ার সময় আইএসপিআর-এর ডাইরেক্টর কে ছিল যেন? ওর নামটা কী ছিল? দেখুন না, বয়স হয়েছে, এখন আর কিছু মনে করতে পারি নে!” আমারও তখন নামটা মনে পড়ছিল না৷ তিনি নামটি মনে করার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জাহিদ৷ আপনার লেখায় জাহিদের একটা কথা লিখে দেবেন যে, জিয়ার সময় জাহিদ ১৯৮১ সালে একদিন অবজারভার অফিসে আমার সাথে দেখা করতে আসে৷ এসে সে বলে যে, “ক’দিন আগের ক্যু’র জন্য আর্মির কয়েক শ’ অফিসার ও র‍্যাঙ্কার্সদের (জওয়ানদের) মৃত্যুদণ্ডের একটি ফাইলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আজ মুচকে হাসিমুখে সই করে দিলেন৷ ফাইল স্বাক্ষরের সময় আমি সেখানে ছিলাম৷ জানেন, এই ফাইল স্বাক্ষরের সময় তার মধ্যে আমি কোনো ভাবান্তর দেখলাম না৷ শুধু একবার মুচকি হাসি দিলেন৷” জাহিদ আমাকে আরও বলল, “তার বিরুদ্ধে এটা নিয়ে আঠার/উনিশটা ক্যু হয়েছে৷’ প্রত্যেক ক্যু-তে শত শত আর্মি অফিসার ও জওয়ানের মৃত্যুদণ্ড হলে জিয়া কত হাজার জওয়ান ও অফিসারের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়, নিজের গদির জন্য, ভেবে দেখুন…৷” (২০০৩ সালের আগস্ট মাসে এ তথ্যসহ আমার এ আর্টিকেল অবজারভার পত্রিকাসহ দেশের অন্যান্য বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় ছাপা হয় শ্রদ্ধেয় ওবায়দুল হক সাহেব বেঁচে থাকতে৷ পরে দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত -শবাসীর অবগতির জন্য এখানে আমি উল্লেখ করছি যে, বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পি.এস. সৈয়দ আমিনুর রহমান আমাকে বহুবার বলেছেন যে, ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যেক ফাইল সই করার পূর্বে জিয়া একবার মুচকি হাসতেন৷ মুচকি হেসে শত শত আর্মি, এয়ার ফোর্সের অফিসার ও জওয়ানদের ফাইল সই করে দিতেন এবং এটা তিনি দেখেছেন৷ যেটা জাহিদও দেখেছেন৷ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রকৃতি ছিল নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা৷ আমরা তার মধ্যে এজিদের চেহারা দেখতাম৷ বঙ্গভবনের অফিসারদের দিকে যখন তাকাতো, পাথরের চোখ, পাথরের মণি সকলে দেখতে পেতো৷ কোনো কোমলতা, মমতার ছিঁটে ফোঁটাও তার দৃষ্টিতে বঙ্গভবনের কোনো অফিসার কোনোদিন দেখেনি৷ অধিকাংশ সময় কালো গগলস পরে তিনি তার পাথরের মণি সাদৃশ্য পাথুরে চোখ জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতেন৷ বঙ্গভবনে খুব কম অফিসার তার গগলস ছাড়া চোখ দেখার সুযোগ পেয়েছেন৷
বঙ্গভবনে খুনিদের দ্বিতীয় দিন পার হলো ঘন ঘন মিটিং করে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের থেকে আনা গাড়ি গাড়ি মদের বোতল ও হোটেল পূর্বানীর রাশি রাশি অন্ন ধ্বংস করে৷ (খুনিরা অস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গাড়ি ভর্তি করে মদ এনে বঙ্গভবনের দোতলায় বোঝাই করে ফেলে৷ এসব মদের কোনো টাকা পরিশোধ করেনি খুনিরা৷ হোটেল পূর্বানীর খাবারের কোনো টাকা দেয়নি তারা৷ উক্ত দুই হোটেল থেকে মদ ও খাবার অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করে আনতো তারা৷ ) বঙ্গভবনের দোতলায় অতিথিদের থাকার রুমের সবগুলোতে খুনিরা থাকতে শুরু করে৷
বঙ্গভবনে ৩য় দিন পার হলো খুনি মোশতাকের কেবিনেট মিটিং করে৷ উক্ত মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয় যে, শেখ মুজিবের অর্থ ও ধন-সম্পদের বিবরণী রেডিও-টিভি এবং পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে৷ বিকেলে সকল ব্যাংকের এম.ডি’দের বঙ্গভবনে ডাকা হলো৷
কর্নেল রশিদ নিজে দরবার হলে তাঁদের সকলকে ১৫-২০ জন জওয়ানের স্টেনগান এবং এসএলআর-এর সামনে দাঁড় করিয়ে বললো, “মীর জাফর শেখ মুজিবের কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে, আপনারা তার বিবরণী নিয়ে এসেছেন?” এক ব্যাংকের এম.ডি. বললেন যে, তাদের কারও ব্যাংকে ওনার (বঙ্গবন্ধুর পূণ্য নাম উচ্চারণের সাহস হারিয়ে ফেলেছে) কোনো একাউন্ট বা টাকা-পয়সা নেই৷ সোনালি ব্যাংকের এম.ডি. বললেন যে, সোনালি ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় ওনার ১১,৭৫৬/- (এগার হাজার সাতশত ছাপ্পান্ন) টাকা আছে৷ তখন কর্নেল রশিদ স্টেনগান এবং এসএলআর তাক করে রাখা সৈনিকদের চিৎকার করে বললেন: “Kill them, they are bustard dogs of Sheikh Mujib” (তারা সব জারজ, শেখ মুজিবের কুত্তা, তাদের গুলি করে মেরে ফেলো৷) একথা শোনা মাত্র এক ব্যাংকের জনৈক এম.ডি. অজ্ঞান হয়ে বঙ্গভবনের দরবার হলের মেঝেতে ধপাস করে পড়ে গেলেন৷ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তখন আরেক ব্যাংকের এম.ডি. বলে উঠলেন: “স্যার, স্যার, মারবেন না৷ স্যার, আমার ব্যাংকে একটা আছে?” কর্নেল রশিদ তার কাছে এগিয়ে গিয়ে টাইসহ তার কোটের কলার চেপে ধরে হুঙ্কার দিলো, “You bustard, now open your mouth.” (তুমি জারজ, এখন তোমার মুখ খোল৷) বলে তাকে তার আরেকজন অফিসারের হাতে তুলে দিলেন৷ তিনি উক্ত এম.ডি’র গালের মধ্যে রিভলভার ঢুকিয়ে দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে৷ উক্ত এম.ডি’র ঠোঁট কেটে দর দর করে রক্ত গড়িয়ে তার সাদা শার্ট ও কোট ভিজে রক্তাক্ত, বিভৎস হয়ে গেল৷ সে ভয়ে কোরবানির জবেহ করা গরুর মতো কাঁপতে লাগলো৷ চোখ দুটো তার বড় বড় হয়ে বের হবার মতো৷ কর্নেলের ইঙ্গিতে উক্ত আর্মি অফিসার তার মুখ থেকে রিভলবার বের করে নিলো৷ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স-এর এম.ডি. তখন বড় বড় দম ফেলতে ফেলতে বললেন: “স্যার, আমি হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের এম.ডি.৷ হাউস বিল্ডিং থেকে উনি (ভয়ে আতঙ্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূণ্যময়, জ্যোতির্ময় নামটাও উচ্চারণে অপারগ) ৩২ নম্বরের বাড়ি করার জন্য ১৯৬২ সালে লোন নিয়েছিলেন৷ সে লোন পরিশোধ করেননি এবং সুদে আসলে তা এখন পাঁচ-ছয় লাখ টাকা (অংকটা ঠিক মনে নেই) হবে৷ এই টাকা ওনার কাছে সরকারের পাওনা আছে৷” খুনি রশীদ হুকুম দিলো: “বাড়ি এক্ষুণি confiscate (জব্দ) করে নিন৷”
এম.ডি. সাহেব বললেন: “স্যার, নিউজ পেপারে একটা নোটিশ দিয়ে দিতে হবে৷” খুনি রশিদ বললো: “এক্ষুণি দিয়ে দিন৷ পত্রিকার লোক কে আছে এখানে?” সবার আগে সেই মার্শাল ল’র ধামাধরা ইবলিশ কুদ্দুস ছুটে এলো৷ সে তৎক্ষণাৎ ড্রাফট করে দিলো “মৃত শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র মৃত শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির ঋণ বাবদ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের কাছে সুদে আসলে পাঁচ-ছয় লাখ টাকা (টাকার উল্লিখিত অংকটি কম-বেশি বলে থাকতে পারেন) অনেক বছর যাবত অপরিশোধ্য থাকার প্রেক্ষিতে উক্ত বাড়ি আগামী পঁয়তাল্লিশ দিনের পরদিন প্রথম কার্যদিবসে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশ্যে নিলামে তোলা হবে৷ আগ্রহী ক্রেতাগণ উক্ত বাড়ির সম্মুখে ডাকা প্রকাশ্য নিলামে অংশ গ্রহণ করতে পারেন৷ নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বাড়িটি বিক্রি করা হবে৷ খুনি মোশতাকের আরেক ডান হাত খ্যাত তাহের উদ্দীন ঠাকুরের নির্দেশে সেখানে উপস্থিত মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব শামসুল হুদার হাতে এই নিলামের নোটিশ এইচ.বি.এফ.সি’র এম.ডি. স্বাক্ষর করে দিয়ে দিলেন৷ ১ দিন পর ১৯শে আগস্ট অথবা ২০শে আগস্ট দৈনিক মর্নিং নিউজের পেছনের পাতায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির নিলামের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়৷ এই হলো খুনি মোশতাক-রশিদ-ডালিম-ফারুক চক্রের জিঘাংসার শিকার বাংলার মুকুটহীন সম্রাটের অর্থ-বিত্ত ও ধন- সম্পদের সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য বিবরণী৷
১৯৭৫-এর ১৭ই আগস্ট কয়েকজন ডিসি’কে বঙ্গভবনে ডাকা হলো৷ প্রেসিডেন্ট মোশতাক তাদের উদ্দেশ্যে নীতি নির্ধারণী ভাষণ দিবেন৷ আমিও ছিলাম সেখানে৷ সেই ঘটনাটি পুনরায় আমাকে ১৭ই আগস্ট, ২০১১ সচিব মোকাম্মেল হক স্যারের বাসায় এক ইফতার পার্টিতে সে সময়ের (১৯৭৫ সালে) ডিসি জনাব হাসনাত আব্দুল হাইকে বলতে শুনলাম৷ তিনি ‘৭৫-এর আগস্টে বললেন, “সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ১৫ জন ডিসি’র সাথে আমাকে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হল৷ প্রেসিডেন্ট

পৃষ্ঠা: ৫৫
মোশতাক আমাদেরকে বললেন, ‘শেখ মুজিবের ৩২ নম্বরের বাড়িতে ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে৷ এগুলো আপনারা অফিসারদের সব জানাবেন৷ এসব অবৈধ সোনা তাঁর দুর্নীতির প্রমাণ৷’ মিটিং শেষে আমার সহকর্মীরা সকলে বলাবলি করলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মাত্র ২০ ভরি সোনা পাওয়া গেছে, তাঁর দুই পুত্র শেখ জামাল ও শেখ কামালের বিয়ে হয়েছে মাত্র কয় মাস আগেই৷ এই ২০ ভরি সোনার গহনার কথা আমাদের অফিসারদের কাছে তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর দুর্নীতি প্রমাণের চেষ্টা করা হলে তাদের কাছে আমাদের আর কোন মান-সম্মান থাকবে না৷ আমার সহকর্মীরা প্রায় কোরাস কণ্ঠে বললেন, খুন-খারাবী করে খুনি মোশতাকের মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ সে তো একটা খুনি ছাড়া আর কিছু না৷ বঙ্গবন্ধুকে খুন করে বাংলাদেশকে সে শেষ করে দিয়ে গেল৷”
সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ১৮ই আগস্ট সোমবার রাতে হঠাৎ কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে বসলে সমগ্র বঙ্গভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রেসিডেন্টের পিএস-২ জনাব আব্দুল মান্নান পরদিন সকালে আমাকে বললেন: “কাল রাত ৯টার দিকে দোতলায় খুনিদের মধ্যে মাতলামো শুরু হয়৷ তারা আকাশে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে “মীর জাফর শেখ মুজিব শেষ, বাংলাদেশ শেষ৷ কোন কুত্তাকা বাচ্চা শেখ মুজিবের বাচ্চার নাম লিয়া তো উস বাস্টার্ড কো খতম কর দেংগে৷ বাংলাদেশ মর গিয়া৷ ইসলামী দেশ হো গিয়া…৷ কোইয়ি, কাহা, কোন্ শালা, হাম লোগোকে রোকেংগে৷ মুজিব কা বাচ্চা কোইয়ি, কাঁহা হ্যাঁয়…৷” মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অটোমেটিক মেশিন গান হাতে উর্দুতে খিস্তি খেউড় করে বঙ্গবন্ধুকে ও বাঙালি জাতিকে তারা গালিগালাজ দিচ্ছিলো৷ বঙ্গভবনের সকল সিভিল অফিসার ও স্টাফরা ভয়ে দূরে দূরে গিয়ে পিলার আড়াল করে তাদের এসব উর্দু অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনছিল৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় টিক্কা-নিয়াজিরা বঙ্গভবনে বসে বাঙালি জাতির মা-বোন তুলে যেভাবে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতো, সেভাবেই তারা আমাদের মা- বোনের জাত তুলে পাক সেনাদের কণ্ঠস্বরে গালিগালাজ করছিল৷”
১৮ই আগস্ট সোমবার প্রথমবারের মতো ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী সমর সেন বঙ্গভবনে আসেন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে৷ ১৫ই আগস্ট ক্যুর সময় তিনি ভারতে ছিলেন৷ ১৭ই আগস্ট বিকেলে তিনি কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন৷ পরদিন দুপুরে আসেন বঙ্গভবনে৷ সমর সেন বঙ্গভবনে প্রবেশের পর সেখানকার সকলে জানতো যে, প্রেসিডেন্ট তাকে ডাকেননি৷ তিনি স্বেচ্ছায় দেখা করতে এসেছেন৷ তখন প্রেসিডেন্টের সহকারী একান্ত সচিব মান্নান সাহেব জানালেন, “আগের রাতে পাকিস্তান ফেরৎ সেনাদের চাপে জেনারেল জিয়া ও খুনি মোশতাক বাংলাদেশকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রের’ ঘোষণা অথবা ‘পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের’ ঘোষণা দেবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
রাষ্ট্রদূত সমর সেন আসার পর প্রেসিডেন্টের কক্ষের চারপাশে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল৷ তখন আমাদের সহকর্মী মোশতাকের অফিসার শ্রী কুমার শংকর হাজরার মুখ থেকে সমর সেনের আগমনের মূল কারণ জানতে পারলাম৷ সে আমাকে বললো: দোস্ত, “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” অথবা ‘পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের” যে কোনো একটি ঘোষণা হলে আমি চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে যাবো৷ জেল হত্যাকাণ্ডের পরই ক্ষুব্ধচিত্তে মুক্তিযোদ্ধা হাজরা সত্যি সত্যি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়৷ বঙ্গভবন ও সচিবালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বীর হাজরার সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য তাকে চিরকাল অভিবাদন জানাবে৷
১৮ই আগস্ট সোমবার কখন কি ঘোষণা হয়!! কী ঘোষণা হয়!! তা জানার জন্য বঙ্গভবনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা উদ্বেলিত চিত্তে সারাক্ষণ একতলা থেকে দোতলা এবং এ কক্ষ থেকে সে কক্ষে ছোটাছুটি করতে লাগলাম৷ আমরা সকলে সারাক্ষণ চোখ কান পেতে রাখলাম৷ খুনি মোশতাককে সমর সেন কী বলে, কী বলে, সারাক্ষণ আমরা জপ করতে থাকলাম৷ জেনারেল জিয়া তখন বঙ্গভবনে৷ জেনারেল শফিউল্লাহ তখন বঙ্গভবনে বন্দি৷ সমর সেন সাক্ষাৎ শেষে চলে গেলেন৷ জিয়া খুনি মোশতাকের বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে (নিরাপত্তার জন্য প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত সামনের কক্ষে না বসিয়ে প্রেসিডেন্টকে তখন খুনিরা বঙ্গভবনের পেছনের কক্ষে বসাতো) ঢুকলেন৷ ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডজন ডজন জেনারেল ও ব্রিগেডিয়াররা এসে তার সাথে যোগ দিলেন৷ সারা বিকেল ও সারা সন্ধ্যা গ্রুপ, গ্রুপে সেনা অফিসাররা মিটিংয়ে পর মিটিং করলো বঙ্গভবনে৷ গাড়ির বহর নিয়ে এক গ্রুপ যায়, গাড়ির বহর নিয়ে আরেক গ্রুপ আসে৷
১৮ই আগস্ট রাত ১১টায় বন্ধু হাজরার মুখ থেকে যখন জানতে পারলাম “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” অথবা “পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন” এর কোনোটাই হবে না- তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আনন্দাশ্রুতে একে অন্যকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম৷ বঙ্গভবনের মাঠে এসে আমরা সকলে মাটি নিয়ে কপালে ছুঁয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বললাম: “জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরিয়সী৷” বুক ভাসিয়ে আমরা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বঙ্গভবন থেকে এক সাথে বের হলাম৷ চোখের ওপর ভেসে উঠলো একাত্তরের রণাঙ্গন ও রণাঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত-সহস্র বীর মুক্তিযোদ্ধার লাশ, আর বাঙালি ভাই-বোনের রক্তে ভেসে যাওয়া কালো পিচ্ছিল দূর্বা ঘাস, মাঠ-ঘাট৷ কুমার শঙ্কর হাজরা অশ্রুসিক্ত নয়নে গেয়ে উঠলো: “মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রুজলে৷”
খুনি মোশতাকের অফিসার বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী কুমার শংকর হাজরা জানালো৷ ১৮ই আগস্ট দুপুরে দিল্লির কঠিন ও কঠোর বার্তা নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হাসি হাসি মুখে খুনি মোশতাকের কক্ষে প্রবেশ করে৷ হাসি হাসি মুখে বিটিভি’র ক্যামেরার সামনে ও ফটোগ্রাফার আমির খসরু’র সামনে পোজ দেয়৷ তারা বের হওয়া মাত্র খুনি মোশতাককে সমর সেন দিল্লির অনুশাসনমূলক প্রথম বার্তাটি জানিয়ে দেন: “Any change of the name of the “People’s Republic of Bangladesh” and any “Confederation” with any country, the Indian Army shall take appropriate measures in accordance with the legal and valid deed, which India possess. But if you abstain form changing the name of ‘the People’s Republic of Bangladesh’ and so called ‘Confederation’ idea, India shall consider what ever had happened since August 15 as your internal matter.” [“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” এর পরিবর্তে “ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ” বা “কোন দেশের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশনের” ঘোষণা দেয়া হলে ভারতের সেনাবাহিনী ‘৭১-এর মিত্রবাহিনীর পরম্পরায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার রাখে এবং এরূপ পদক্ষেপের অনুকূলে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ দলিল ভারত সরকারের কাছে সংরক্ষিত আছে৷ উল্লিখিত ধরনের কোনো কিছু পরিবর্তন করা না হলে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম অব্যাহতভাবে অবিকল ও অপরিবর্তিত থাকলে বাংলাদেশে ইতোমধ্যে যা কিছু ঘটেছে, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে গণ্য করা হবে৷”]
১৮ই আগস্ট বঙ্গভবনে বাজ পড়ার মতো এসে পড়লো দিল্লির হুকুম নামা! মুখ ভোতা করে জিয়ার মদদদাতা পাকিস্তান প্রত্যাগত ব্রিগেডিয়ার- কর্নেল-মেজররা ১৮ই আগস্ট বঙ্গভবনে দলে দলে ভ্যাবাচ্যাকা মুখে হুমড়ি খেয়ে এসে পড়তে লাগলো! অথচ ২৪ ঘণ্টা আগে ১৭ই আগস্ট তারাই দলে দলে এসে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে কোলাকুলি করে বলেছে “সিকিম- ভূটান হবার হাত থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে ‘পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের’ ঘোষণা দিতেই হবে৷ ইহা আমাদের জন্য ফরজ কাজ৷ আর ইহা না করা গেলে “ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” ঘোষণা দেয়াই হবে বাংলাদেশের সকল মমিন-মুসলমানের জন্য ফরজ এবং ফরজ কাজ৷ এটা না করা হলে, ভারতের লাখ লাখ সেনাবাহিনীর সামনে আমরা তুলার মতো উড়ে চলে যাবো৷ আমাদের মুসলমানিত্ব থাকবে না৷ তারা আমাদের হিন্দু বানাবে৷ (‘৭১-এ পাক হানাদাররা যা বলতো হুবহু সেই কথা বলে তারা)৷ ইহা করা না হলে ভারতের পুতুল সরকার ও মুক্তিযোদ্ধারা আবার ক্ষমতায় এসে যাবে৷”
সকল ক্যু ও মার্শাল ল’ ঘোষণার সময় তাদের তস্য দালাল যে সামেরি’র (বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়কে গরুর মূর্তি পূজার পাপে নিমজ্জিতকারী গুনাহগার) ন্যায় সর্বদা প্রস্তুত আইন মন্ত্রণালয়ের পাপিষ্ঠ উপ-সচিব কুদ্দুসকে দেখলাম হাতে কলম ও প্যাড নিয়ে খুনি ডালিম- ফারুকদের সাথে লাটিমের মতো ঘুর ঘুর করছে… বাংলাদেশের নাম পাল্টিয়ে কখন “ইসলামী প্রজাতন্ত্র” বা “পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন” এর ড্রাফট-এ প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর নেয়া যায় সেজন্য!! কিন্তু তখনো বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে, বন্দরে-নগরে ৩০ লাখ বাঙালি ভাই-বোনের সাথে শহীদ হয়ে যাওয়া হাজার হাজার ভারতীয় বীর জওয়ানদের রক্ত শুকায়নি… সেখানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার সম্ভাবনার চেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা অধিক উপলব্ধি করে খুনি মোশতাক-জিয়া ও তাদের অনুসারী পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনারা সেই হটকারী ঘোষণা থেকে বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসে৷ ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত পূণ্যময় বাংলাদেশ সেদিন আল্লাহর অশেষ রহমতে রক্ষা পায়৷ আলহামদুলিল্লাহ৷ আল্লাহু আকবার৷
১৯ আগস্ট ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিবিসি’র সংবাদদাতা বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালির সাথে দেখা করলাম৷ বিবিসি’তে প্রচারের জন্য তাকে news লিখে দিলাম৷ আমার ওপর ‘৭১ সাল থেকে তার অগাধ আস্থা ও ভালবাসার কারণে, আমার লিখে দেয়া সংবাদ সে হুবহু প্রচারের জন্য তৎক্ষণাৎ লন্ডনে বিবিসি অফিসে পাঠিয়ে দিল৷ আমার চোখে ততক্ষণে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়েছে৷ “Mukti Bahini and Mujib Bahini are organising in Dhaka against the killers of Bangabandhu. They will attack them any time in and around Dhaka. The killers of Bangabandhu are Pakistani agents and enemy of Bangladesh. People of Bangladesh shall never accept the killer. The killers shall be hanged by the people at the Race Course of Dhaka very soon. Freedom Fighters are now taking full preparations in and around Dhaka. Resistance will start at any moment. Killers will not be able to escape. People will hang them in race course you will see it.”
১৮ই আগস্ট বিবিসি’র দিল্লি ব্যুরো চিফ মার্ক টালী ঢাকা আসেন৷ এসেই বঙ্গভবনে আমাকে ফোন করে তার হোটেলে আসতে বলেন৷ স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘ওয়ার করেসপন্ডেন্ট’ হিসেবে ‘৭১ সালে রণাঙ্গনের বহু সংবাদ আমি তাঁকে স্বতঃপ্রণোদিত চিত্তে দিয়ে দিয়েছি এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে আমি তাঁকে বহু সার্ভিস দিয়েছি৷ তিনি আমাকে চিনতেন এবং আমার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা ছিল৷ ইতিপূর্বেও এটা লিখেছি৷ পুনরায় এই তথ্য আমি যখন উল্লেখ করছি, I must salute Mr. Mark Tully on behalf of all the Freedom Fighter Officers & Employees of the Republic for his kind favour to broadcast the news over the B.B.C on that evening. The news inspired all the Freedom- Fighters in resisting the killers in Dhaka and all over Bangladesh. মার্ক টালি আমাকে বললেন “মুজিব বাহিনী কোথায় প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে আমাকে নিয়ে চলো৷” সেখানে এক্ষুণি নিয়ে যাওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে বললাম, “তুমি এক্ষুণি বিবিসি থেকে এই নিউজ প্রচার করিয়ে দাও৷ তাহলে পরে তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে৷”
বিবিসি’র মাধ্যমে প্রচারিত সেই প্রথম সংবাদে দেশবাসী রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল৷ বাংলার ঘরে ঘরে ৬৮ হাজার গ্রামে এই সংবাদে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল যে, ঢাকায় মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধরবে এবং ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ফাঁসিতে ঝুলাবে৷ বিবিসি সেদিন মার্ক টালির বরাতে সংবাদ প্রচার করল, “ঢাকার ঘরে ঘরে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে এবং তারা যে কোনো সময় সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখল করে ফেলবে এবং শেখ মুজিব হত্যার প্রতিশোধ নেবে মর্মে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে বলে জানা যায়৷” বিবিসি-তে এই সংবাদ প্রচারের সাথে সাথে বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক ও তার সহযোগী খুনি ডালিম- ফারুকদের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়৷ তাঁরা বি.ডি.আর থেকে অতিরিক্ত ফোর্স আনে বঙ্গভবন গার্ড দেবার জন্য৷
বিবিসি’র এই সংবাদে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বেড়ে যায় এবং মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করতে থাকে৷ ১৯ আগস্ট ফেনীতে মুক্তিযোদ্ধারা রেল লাইন উপড়ে ফেলে৷ পরদিন ২০ আগস্ট খুলনা পোর্টে আগুন ধরায়৷ একই দিনে মিরপুরে এবং আসাদগেটে আর্মির ট্রাকে বোমা পড়ে৷ টাঙ্গাইলে বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের কব্জায় চলে যায় টাঙ্গাইল৷ হালুয়াঘাটে বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কামানের গোলা নিক্ষেপ

পৃষ্ঠা: ৬০
হয়৷ কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা করে “বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান কাদের সিদ্দিকী পিতার খুনিদের রক্তে বাংলাদেশের মাটি সিক্ত না করে মাংস খাবে না”৷ চট্টগ্রামে যুবলীগ নেতা এস.এম. ইউসুফের নেতৃত্বে রেজিস্টেন্স শুরু হয়ে যায় সমগ্র চট্টগ্রামব্যাপী৷ এস. এম. ইউসুফের দাপটে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের সেনারা সন্ধ্যার পূর্বেই ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতো আর সকালের আগে কেউ বেরুবার সাহস পেতো না৷
এ সময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় ড. সেলিমুজ্জামান সাহেবের সাথে ১৯ আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমার সাক্ষাৎ হয়৷ আমি তাঁকে বললাম: “Don’t worry, we will fight them back insha Allah. Resistance has started in Dhaka and all over the country”, তিনি আমাকে বললেন, “তাহের উদ্দীন ঠাকুর আমার ক্ষতি করতে পারে৷ অন্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বলে রেখ৷” তিনি আমাকে আরও বললেন, “বঙ্গবন্ধুর কিলারদের বিরুদ্ধে আমি ধানমন্ডি থানায় জিডি করব৷” আমি তাঁকে আমার বাসার ও বঙ্গভবনের টেলিফোন নম্বর দিলাম এবং তাঁর অফিসের ও বাসার নম্বর নিলাম৷ যদিও তিনি বললেন যে, তিনি তখন বাসায় থাকেন না৷ বিএসএস-এর জেনারেল ম্যানেজার হাজারী ভাই-এর বাসায় লুকিয়ে থাকেন৷ তাঁকে আরও বললাম, “আমরা এখন সিজিএস খালেদ মোশাররফ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি৷ আর্মির সকল মুক্তিযোদ্ধা অফিসার এখন তাঁর সাথে আছে৷ কিছু একটা হতেই হবে৷ তিনি যেন খালেদ মোশাররফ সাহেবের ভাই রাশেদ মোশাররফের কলাবাগানের বাসায় যোগাযোগ রাখেন৷ আমরা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সিভিল অফিসাররা তাঁর সাথে যোগাযোগ রেখে সব কিছু এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ দূতাবাসগুলোর সাথেও আমাদের মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ রক্ষা করছি৷ বঙ্গভবন থেকে খুনিদের ভিতরে বসে আমি তাদের সব মুভমেন্ট খালেদ মোশাররফ স্যারদের দিয়ে যাচ্ছি৷”
সেলিমুজ্জামান সাহেব ছলছল চোখে বললেন, “আমাদের হারাবার আর কিছুই নেই৷ বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা এতিম হয়ে গেছি৷” আমি বললাম: “মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল হারায়নি৷ হিমালয়ের মতো বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে আসবে ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য থেকে৷ ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা ও আমরা শপথ নিয়েছি খুনিদের ওপর আঘাত হানবো৷ মরতে হলে তাদের মেরে মরবো৷ কাদের সিদ্দিকী তার কাদেরীয়া বাহিনী নিয়ে যে কোনো সময় ঢাকায় প্রবেশ করবে৷ সচিবালয় ও বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কাদেরীয়া বাহিনীর ভয়ে মৃগী রুগীর মতো কাঁপছে…৷”
২০ আগস্ট হারেস উদ্দীন সরকার বীর প্রতীকের সাথে দেখা হলো৷ ‘৭১-এ তিস্তার পাড়ের অসীম সাহসী বীর হারেস উদ্দীনের কথা শুনে বুক ভেঙে গেল৷ তিনি বললেন যে, “তাদের মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে৷ প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলীকে জিঞ্জিরা দিয়ে উত্তরবঙ্গে নিয়ে গিয়ে সরকার গঠনের যে পরিকল্পনা তারা নিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হয়ে গেছে৷ সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল দেলওয়ার হোসেন, লে. কর্নেল নওয়াজেশ, লে. কর্নেল ইয়াজদানী, লে. কর্নেল মোসলেম উদ্দীন প্রমুখ বাঙালি জাতির বীরদের নেতৃত্বে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ লে. কর্নেল দেলওয়ারের বনানীর স্টাফ কোয়ার্টারে বসে তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ছাত্র, জনতা ও আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলীর নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে পাল্টা সরকার গড়ে তুলবেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য এই মহান বীর যোদ্ধাদের, সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আওয়ামী লীগের নেতারা সাড়া না দিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলেন৷ “বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরে ফেলেছে, আমাদেরকেও তারা মেরে ফেলবে৷” এই ধুয়া তুলে কাপুরুষের মতো তাঁরা পিছিয়ে গিয়েছিলেন৷” “Coward dies many times, but heroes once”, সেক্সপিয়রের অমর বাণী তাঁরা সেদিন বাস্তবে প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন৷ যদিও ঢাকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন৷ ঢাকাবাসী ও ছাত্র-জনতা, রিক্সাওয়ালা, শ্রমিক, দিনমজুর তখন ক্রোধে রাগে ফুঁসছিল৷ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা কাপুরুষতা না দেখালে খুনিরা ঢাকাবাসীর রুদ্ররোষে কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত৷ কবর দেবার জন্য এই সব ভাড়াটে খুনিদের কারো লাশ পাওয়া যেত না৷ ঢাকার বাতাসে কর্পূরের মিশে যেতো৷
এখানে বিশেষ করে, আমি এক বঙ্গ জননীর কথা গর্বের সাথে উল্লেখ করতে চাই, যিনি লে. কর্নেল দেলওয়ারের স্ত্রী বনানী স্টাফ কোয়ার্টারে আগত ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও মেজর বজলুল হুদাকে প্রবেশ করতে দেখে চিৎকার করে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা, বঙ্গবন্ধুর কিলার, এখানে কী জন্য এসেছো?” মেজর হুদা তাঁকে বলেছিলেন, “ভাবি, চা খেতে এসেছি৷” উত্তরে ময়মনসিংহ মহিলা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপিকা সেই নির্ভীক বেগম নূরজাহান দেলওয়ার বলেছিলেন, “তোমরা এখনই বেরিয়ে যাও৷ তোমাদের মুখ যে দেখবে তার কবরে দোজখের আগুন জ্বলবে৷”
সেখানে উপস্থিত হারেস উদ্দীন সরকার বীর প্রতীকের সামনে এই ঘটনা ঘটে৷ অতঃপর কিলাররা হাসতে হাসতে চলে যায়৷ কিন্তু তারপরেও জাতির এই সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানরা প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলীকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন৷ তাঁরা প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলীকে খুঁজে পাবার আগেই তাঁর সাথে কর্মরত এক সিভিল অফিসার বিশ্বাসঘাতকতা করে (তিনি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার বড় পুরষ্কার পেয়ে পরবর্তীতে সচিব ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূত হয়ে গাড়িতে বাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান৷ যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না) খুনিদের কাছে তাঁর গোপন আস্তানার তথ্য জানিয়ে দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দেয়৷ খুনি মোশতাক এম. মনসুর আলীকে তাঁর অধীনে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন৷
১৯শে আগস্টের সকালে বঙ্গবন্ধুর পরম প্রিয় ও স্নেহধন্য প্রেস সেক্রেটারি জনাব তোয়াব খান (বর্তমানে সম্পাদক, দৈনিক জনকণ্ঠ) বঙ্গভবনে তাঁর অফিসের উদ্দেশ্যে শাহবাগ পর্যন্ত আসলে দেখতে পান যে, এক ট্রাক কালো উর্দি পরা সৈনিক ও পুলিশ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ (তারা পাকিস্তানি না বাঙালি! তিনি বুঝতে পারেননি৷) তিনি বঙ্গভবনে পৌঁছালে তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও রাষ্ট্রপতির সচিব রহিম সাহেব (‘৭১ সালে সমগ্র জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত, তখন জল্লাদ টিক্কা- ইয়াহিয়া খানসহ পাকসেনাদের এই প্রিয়জন তাদের দ্বারা মনোনীত হয়ে পেন্টাগনে যান সিআইএ’র হেড কোয়ার্টারে প্রশিক্ষণ নিতে! বঙ্গবন্ধুর হত্যা ষড়যন্ত্রে সিভিল অফিসারদের মধ্যে যিনি মাহবুব আলম চাষীর সাথে মিলে নেতৃত্ব দেন!!) এক রকম “অনাহুত” করে তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বিদায় করে দেন৷ বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব “৬ দফা”র রচয়িতা ও আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী আমার মামা জনাব রুহুল কুদ্দুসের এবং বঙ্গবন্ধুর বোনের স্বামী সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ হোসেন স্যারের প্রচণ্ড বিরোধীতা ও প্রতিরোধের মুখেও রহিম সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ের সচিব করা হয়৷ খন্দকার মোশতাকসহ তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব মিলে এ নিয়োগ করান৷ তাদের গোপন উদ্দেশ্য কী ছিল তা আজ দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার৷
বঙ্গবন্ধুর পরম আস্থাভাজন ও মুক্তিযোদ্ধা জনাব তোয়াব খানের প্রত্যক্ষ বিবরণ ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এটা নিঃসন্দেহ যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সাথে ছদ্মবেশে পাকিস্তানিরা অংশ নিয়ে থাকতে পারে৷ উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করা হয়, এটা কাকতলীয় হতে পারে না৷ খুনিদের সাথে পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ও পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ১৫ই আগস্টের ঘটনা যে ঘটানো হয়, তা আজ সমগ্র বিশ্ববাসী জানে৷
২১শে আগস্ট বৃহস্পতিবার বঙ্গভবন থেকে প্রথম যেদিন সচিবালয়ে গেলাম সেদিন এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের সমবায় বিভাগের সচিব জনাব খোরশেদ আলম সাহেবের রুমে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়৷ তিনি নিয়মিত আমার মামার বাসায় আসতেন৷ তিনি আমাকে জানতেন যে, আমি মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিবনগর অফিসারদের সংগঠন করি৷ আমাকে দেখে বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে বলতে তিনি কেঁদে ফেললেন৷ তাঁর বিপদ হবে ভেবে আমি তাড়াতাড়ি তাঁর রুমের দরজার নব টিপে বন্ধ করে দিলাম৷ তিনি আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন না করলে পাঞ্জাবি সিএসপি’রা আমাদের দিয়ে তাদের জুতা মোছাতো আর এই সচিবালয়ে টিবয় করে চা আনিয়ে খেত৷ আমাদের বাঙালি সিএসপি এবং ইপিসিএস অফিসারদের এই দশাই হতো৷ বাঙালি জাতি চিরকালের জন্য পাকিস্তানিদের গোলামের জাতি হয়ে যেতো৷ হায়! হায়!! তারা আজ আমাদের হিমালয়ে ফেলে দিয়েছে! আমাদের এখন কী হবে? কী নিয়ে বাঁচবো আমরা?” ওই দিন দুপুরে পিআইডি’র তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তা জনাব মকবুল আহমেদ-এর সামনে সচিবালয়ের মেডিকেল অফিসার উঁচু, লম্বা, কৃষ্ণবর্ণের, স্বাস্থ্যবতী ডা. ফজিলা নবী পিআইডি’র শেডে এসে সজল চোখে বললেন, “দেখুন, আমরা ডাক্তার৷ আমাদের কাছে কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নেই৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আজ সচিবালয়ে আসার পথে শের-ই-বাংলা নগর থেকে আমি যখন আমার মাইক্রোবাসে আসছিলাম, তখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে নির্মম নির্যাতন দেখে এলাম৷ এমন নির্যাতন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না৷ আমার মাইক্রোবাস যখন ৩২ নম্বর রোডের মুখে আসে, তখন দেখলাম সেখানে বয়স্কা মহিলা, কিশোরী ও শিশুরা কিছু ফুল হাতে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর তাদের শ্রদ্ধা জানাতে৷ কিন্তু সেখানে কী বর্বরতা দেখলাম জানেন? ৩২ নম্বর রোডের মুখে পাহারারত আর্মিরা পাঞ্জাবি আর্মির চেয়েও নিষ্ঠুরভাবে তাদের বুট দিয়ে লাথি মারছে এবং রাইফেল-বন্দুকের বাঁট দিয়ে বুকে, ঘাড়ে, পিঠে, মাথায় যে যেভাবে পারছে, মারছে৷ থেতলে দিচ্ছে! সেই মা-বোনদের আর্তনাদ চিৎকার সহ্য করা যায় না! আমাদের মা-বোনরা-শিশুরা সেখানে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে৷ তাদের হাতের সাদা, লাল ফুল পিচের রাস্তার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে৷ এক জননী বাচ্চাদের আগলাতে যাচ্ছে দেখে এক ‘শয়তান’ বুট দিয়ে তার গলায় চেপে দাঁড়িয়ে তার জিভ বের করে ফেলেছে৷ এমন পাপিষ্ঠ, দেখে মনে হয় মাতৃগর্ভে যেন এদের জন্ম হয়নি! পাকসেনাদের মতো এ রকম অত্যাচার যখন চলছিল, তখন গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে আমি এপ্রোন পরা অবস্থায় সচিবালয়ের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে দু’হাত দিয়ে আগলে সেই আহত মা-বোন ও শিশুদের সেখান থেকে সরিয়ে আনি৷ আর আহত কয়েকজনকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে আসি৷”
খুনি মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের শ্বেত সন্ত্রাসে শ্বেত সন্ত্রাসে ও নির্যাতনে সচিবালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মতিঝিল, ব্যাংক, কোর্ট, কর্পোরেশনসহ সমগ্র রাজধানী ঢাকা কম্পমান এবং রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্ক, ঢাকার সকল রেজিস্টেন্স ব্যর্থ প্রায়৷ তখন ঢাকার সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে চট্টগ্রামের যুবলীগের দুর্ধর্ষ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা এস.এম. ইউসুফের যোগাযোগ হয়ে যায়৷ চট্টগ্রামে তিনি খুনিদের বিরুদ্ধে অনেক সফল অপারেশন চালাচ্ছিলেন৷ চট্টগ্রামে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, টাঙ্গাইলে যেমন বঙ্গ বীর কাদের সিদ্দিকীর রেজিস্টেন্স খুনি মোশতাক-ডালিম- ফারুকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছিল৷ টাঙ্গাইল থেকে বীর কাদেরীয়া বাহিনীর এক লিফলেট এসে পৌঁছায় শাহবাগের বিসিএস একাডেমির প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে৷ তার ঠেলায় বঙ্গভবন দুলে ওঠে৷ সচিবালয় কেঁপে ওঠে৷ জেনারেল ওসমানী তখন খুনি মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা৷ তিনি বিডিআর-এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার খলিল সাহেবকে ফোন করে এক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক ট্রাক বিডিআর আনালেন বঙ্গভবনের চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তোলার জন্য৷ বঙ্গভবনে খুনি মোশতাকের পি.আর.ও (‘৭২ সাল থেকে মন্ত্রী মোশতাকের পি.আর.ও পদে কর্মরত ছিল) কুমার শংকর হাজরা ও আমি দেখলাম যে, বঙ্গভবনের ভেতরে কাদের সিদ্দিকীর আতঙ্কে খুনিদের সবার পেশাব-পায়খানা শুরু হয়ে গেছে৷ বঙ্গভবনের সর্বত্র খুনিরা কাদেরীয়া বাহিনীর ভূত দেখছে৷ বঙ্গভবনে গাছের পাতার ফাঁকে পাখি উড়লেও গুলি করছে তারা৷ বঙ্গভবনের পুকুরে মাছ লাফানোর শব্দ হলে কয়েক ডজন সশস্ত্র বিডিআর পুকুরের চারপাশে মোতায়েন করা হলো পানির মধ্যে কাদেরীয়া বাহিনী ডুব মেরে আছে কি-না তা নিষ্পলক চোখে পাহারা দেবার ও গুলি করার জন্য৷ বঙ্গভবনের ছাদেই শুধু না, বঙ্গভবনের ভেতরে বড় বড় আম গাছের ডালে ডালে এস.এল.আর/স্টেনগান হাতে বিডিআর’কে তুলে দেয়া হয়েছে কাদেরীয়া বাহিনীকে খোঁজার ও গুলি করার জন্য৷” এদিকে সচিবালয়ে দৌড়াদৌড়ি ও তল্লাশী শুরু হলো কাদের সিদ্দিকীর লিফলেটের সন্ধানে৷ প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ফটোগ্রাফার আমির খসরু (গভর্নর মোনেম খানের আমল থেকে বঙ্গভবনে নিয়োজিত ) বঙ্গভবনের দোতলা থেকে নেমে এসে এমএসপি’র রুমে আমাকে পেয়ে ডেকে নিয়ে জানালেন যে, “বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ-ফারুক-ডালিমরা কাদেরীয়া বাহিনী ঢাকা প্রবেশ করেছে শুনে বঙ্গভবনের দোতলায় তাদের শয়ন কক্ষে গিয়ে আতঙ্কে সিদ্ধ হয়ে নোংরা-অশ্লীল খিস্তি করছে আর মদের

পৃষ্ঠা: ৬৫
বোতল খুলে ঢক ঢক করে মদ গিলছে৷ নিচে নেমে বিভিন্ন সিভিল অফিসারদের সামনে স্টেনগান, এসএলআর হাতে ধরে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাতলামো করে আর বেহায়াপনা করে বলছে, “সব হারামজাদার মাথা উড়িয়ে দেবো৷ বাঙালি সব শালা বাস্টার্ড-মাদার…, উই উইল ফাক দেম…”৷ ‘৭১ সালে ইয়াহিয়া-টিক্কারা বঙ্গভবনে বসে বাঙালি জাতিকে যে নোংরা অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো, সেই একই ভাষায় সেখানে বসে এরা বাঙালি জাতিকে গালিগালাজ করছে জেনে মনটা বিষিয়ে গেল৷ কাদের সিদ্দিকীর পায়ের ধূলাও আসেনি ঢাকায়, তার লিফলেট ঢাকায় এসে পড়ায় বঙ্গভবন ও সচিবালয়ে সেদিন ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছিল৷ বঙ্গভবনের খুনিদের আতঙ্ক কাটাতে পিপে পিপে মদ গিলতে হয়েছিল৷
১৫ই আগস্টের পর খুনিদের বিষয়ে ঢাকার কোনো প্রেসে তখন হ্যান্ডবিল বা কোনো লিফলেট ছাপা সম্ভব হচ্ছে না৷ সকলেই আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপছে৷ অথচ লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব আমার মামা জনাব রুহুল কুদ্দুস বার বার লিফলেট বিতরণের কথা, বিশেষ করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বিতরণের জন্য আমাকে ফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলেন৷ আমি যখন ঢাকার অবস্থা বললাম৷ তখন তিনি চট্টগ্রাম থেকে লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করে ঢাকায় পাঠান৷ (চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এই লিফলেট ছাপানোর জন্য লন্ডন থেকে জনাব রুহুল কুদ্দুসের নির্দেশ পান৷ তিনি এটা চট্টগ্রামের এক প্রেস থেকে ছাপিয়ে মনি ভাইয়ের বিশ্বস্ত জনাব ইউসুফকে দেন বলে জনাব ইউসুফ আমাকে পরে জানিয়েছেন৷) এই লিফলেট জনাব ইউসুফের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনযোগে ৪ বস্তা (মুখে শাকের আঁটি দিয়ে) ২ রকমের লিফলেট তিনি ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন৷ খুনি মোশতাক-ডালিম-ফারুকের সরকারকে উৎখাত করে মুক্তিযুদ্ধের সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহবান সম্বলিত সেই লিফলেট ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে ঠিকমতো ভেলিভারি হয়েছিল এবং আমার নামে বঙ্গভবনের ঠিকানায় সেই লিফলেটের বস্তা পাঠানোয় কমলাপুর কর্তৃপক্ষ তা না দেখেই ডেলিভারি দিয়ে দেয়৷ (এস.এম. ইউসুফ লিফলেটটি লিখেছিলেন)৷
এই লিফলেট ঢাকায় আসার পর সচিবালয়ের বীর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের প্রধান সিনিয়র সহকারী সচিব রাখাল দা’র কলাবাগানের স্টাফ কোয়ার্টারে আমরা গোপন বৈঠকে বসি৷ সে বৈঠকে হাজির ছিলেন তথ্য অফিসার গাজী মনসুর আলী, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, খুনি মোশতাকের অফিসার কুমার শংকর হাজরা, তাজউদ্দীন স্যারের অফিসার আলী তারেক, নজরুল ইসলাম স্যারের অফিসার আমি এবং শেখ ফজলুল হক মনি ভাইয়ের দুই বিশ্বস্ত অফিসার ফকির আব্দুর রাজ্জাক এবং শফিকুল আজিজ মুকুল (দৈনিক বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেলে সরকারি সিদ্ধান্তে এই দুই সাংবাদিক তথ্য অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন)৷ আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ও বয়োঃজ্যেষ্ঠ রাখাল দা’ সেই গোপন বৈঠকে আমাদেরকে পবিত্র কোরআন শরীফ এবং ত্রিবেদী ও হাজরাকে পবিত্র গীতা ছুঁয়ে এই মর্মে শপথ করান যে, “আমাদের কেউ ধরা পড়লে আমরা ‘৭১-এর বীর শহীদদের ন্যায় আমাদের জীবন দেবো, কিন্তু একে-অন্যের নাম বলবো না৷ এই বৈঠকের কোনো গোপনীয়তা ফাঁস করবো না বা আমাদের সহযোদ্ধাদের কারো নাম প্রকাশ করবো না৷” বৈঠকে ঠিক হয়, এই লিফলেট ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, বঙ্গভবন ও ঢাকার সচিবালয়ে গোপনে গভীর রাতে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ ঠিক হয় বঙ্গভবনে কুমার শংকর হাজরা, সচিবালয়ে আলী তারেক, ত্রিবেদী, রাজ্জাক ও মুকুল এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গাজী মনসুর ও আমি বিতরণ করবো৷ ঢাকা ক্যান্টমেন্টে ২৭ ও ২৮শে আগস্ট আমরা দু’জন একসাথে রেকি করি সুশীলবাবুর জলপাই রংয়ের টয়োটা গাড়ি নিয়ে৷ কিন্তু ২৯শে আগস্ট যখন লিফলেট সামনের ও পেছনের সিটে ভরা হয় তখন জায়গার অভাবে রাখাল দা’ একজনকে যেতে বলেন৷ তখন প্রশ্ন ওঠে- কে সে? রাখাল দা’ মনসুরকে প্রশ্ন করেন তারা কয় ভাই৷ মনসুর বলে তারা দুই ভাই৷ আমাকে প্রশ্ন করলে আমি বলি আমরা ছয় ভাই৷ রাখাল দা’ তখন সিদ্ধান্ত দেন— “মুসা যাবে”৷ আমি তখন জোরে জোরে আয়াতুল কুরসী পড়তে শুরু করি এবং আমার চোখে তখন আমার প্রিয় জননী আমেনার মায়া ভর্তি মুখ ভেসে ওঠে৷
কিন্তু কিছুটা ভুল প্ল্যানিং-এর কারণে ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ঢাকার সর্বত্র সে লিফলেট বিতরণ করা সম্ভব হয়নি৷ প্রথম প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব আমার মামা জনাব রুহুল কুদ্দুসের (তিনি তখন লন্ডনে চিকিৎসাধীন) স্নেহভাজন মতিঝিলের এক হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রী সুশীলবাবুর আর্মির জলপাই রং-এর নতুন টয়োটা গাড়িতে লিফলেট নিয়ে ২৯শে আগস্ট শুক্রবার দিবাগত রাত দশটায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকি৷ ড্রাইভার জানতো না লিফলেটে কী আছে৷ তৎপূর্বে ২ দিন ক্যান্টনমেন্টের ভিতর আমরা রেকি করি৷ দেখা যায় যে, রাত ১০টার পর ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের রাস্তাঘাট ভয়ে-আতঙ্কে জনশূন্য হয়ে যায়৷ অফিসার ও জওয়ানরা যে যার কোয়ার্টারে ঢুকে পড়তো রাত দশটার আগেই৷ তাই পূর্ব পরিকল্পনা মতো রাত ১০টার দিকে আমি ক্যান্টনমেন্টের গেটে সি.জি.এস. ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ স্যারের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্টের নাম করে (খালেদ মোশাররফ স্যারের ‘কড’ (Coordination Officer)-এর দেয়া পাস নিয়ে) স্যুটেড বুটেড হয়ে ঢুকে পড়ি৷ জোরে জোরে “লা ইলাহা ইল্লা আনতা, সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জলেমীন” পড়তে থাকি৷ মনে মনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই৷ মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি…৷ ভাবতে থাকি যে কোনো মুহূর্তে গুলির ঝাঁক এসে পড়বে আমার ওপর এবং এ দুনিয়া ছেড়ে আরেক দুনিয়ায় চলে যেতে হবে…৷ প্রতি নিঃশ্বাসে বেরিয়ে আসে “লা ইলাহা ইল্লা আনতা, সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জলেমীন৷’ ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের জনশূন্য রাস্তায় ড্রাইভারকে ফুল স্পিডে গাড়ি চালাতে বলে পিছনের সিটে বসে আমি দু’হাতে পাগলের মতো লিফলেট দু’দিকে ছুঁড়ে দিতে থাকি৷ খুনি মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের উৎখাতের আহবান সম্বলিত লিফলেট ছড়িয়ে আমি ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে অফিসার কোয়ার্টারের গেটের দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হই৷ (সে গেটটি জেনারেল মাহবুবুর রহমান যখন আর্মির চিফ হন, তখন বন্ধ করে দেয়া হয়৷) ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আমি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হইনি, এটা আমার সৌভাগ্য বলতে হবে৷ তবে তখনকার বাস্তব অবস্থা ছিল এরূপ যে, ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে রাত ১০টার পর রাস্তা জনশূন্য হয়ে যেতো৷ আর্মিরাও ভয়ে ব্যারাক থেকে বের হতো না৷ যত কিছু সিকিউরিটি এ্যাকটিভিটিজ, তখন সবকিছু ছিল বঙ্গভবন ও নাজিমউদ্দিন রোডে বন্দি ৪ জাতীয় নেতাকে নিয়ে৷
দ্বিতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে আগস্ট দিবাগত রাতে সচিবালয়ে ও বঙ্গভবনে উক্ত লিফলেট বিলি করার দায়-দায়িত্ব যাদের ছিল তা তাঁরা পুরোপুরি করতে পারেনি৷ ওই রাতে বঙ্গভবনে লিফলেট বিতরণের দায়িত্ব ছিল কুমার শংকর হাজরার৷ হাজরা সাত-আটশত লিফলেট বঙ্গভবনের নীচতলায় মূখ্য সচিবের পি.এ-এর রুমে ও আশপাশের প্রশাসনিক কয়েকটি রুমে ফেলে রাখতে সমর্থ হয়৷ উল্লিখিত অন্য তিনজন অফিসারের দায়িত্ব ছিল সচিবালয়ে লিফলেট বিতরণের৷ ওই রাতে তারা লিফলেট নিয়ে পিআইডি’র গাড়িতে করে সচিবালয়ের ভিতরে রাত দশটায় ঠিকই ঢুকেছিলেন৷ কিন্তু আগের রাতে ক্যান্টনমেন্টে লিফলেট বিতরণ হওয়ায় সচিবালয়ে এনএসআই এবং এসবি’র অস্বাভাবিক উপস্থিতি টের পেয়ে সচিবালয়ের পেট্রোল পাম্পের ভিতরে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংলগ্ন টিনসেডগুলোর ভিতরে, সচিবালয়ের ১নং দোতলা ভবনের, সচিবালয়ের ২নং নয় তলা ভবনের ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কলাপসিবল গেটের ভিতরে শত শত লিফলেট তারা ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত সচিবালয়ের মসজিদের (তখন বর্তমানের পাকা দোতলা মসজিদ নির্মিত হয়নি) ওজুখানার পাশের টিনের ছোট দরজা দিয়ে প্রেসক্লাবের পিছনের ডোবা দিয়ে পালিয়ে যেতে তাঁরা সমর্থ হন (‘৭৫ সালে সচিবালয়ের মসজিদের পশ্চিমের বর্তমান সচিবালয় লিংক রোড ছিল না এবং প্রেস ক্লাবের পেছনে বড় ডোবা ছিল)৷ কিন্তু সচিবালয়ের এই ব্যর্থতার পরিণতি ভোগ করতে হয় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের মুজিবনগর সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রাখাল ভট্টাচার্য্যকে৷ এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই জেনারেল জিয়ার নির্দেশে আর্মির গোয়েন্দারা রাখাল দা’কে ধরে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে এবং পরবর্তী সময়ে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে৷ কারাগারেও বর্বরভাবে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়৷ কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি৷ We salute him. ক্ষুদিরামের ন্যায় এই মহান দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার রাখাল দা কারাগারের নির্যাতন শেষে হাসপাতালে হস্তান্তরের কয়েকদিনের মধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ আমার মনে পড়ে, ১৮ আগস্ট রাখাল দা’র সাথে টেলিফোনে আমার ও প্রণোদিৎ দা’র কথা হয়েছিল৷ তিনি বলেছিলেন, “মুসা কিছু একটা করো৷ বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলবে, আর আমরা বেঁচে থাকব তা হয় না…”৷ এইটুকু বলে তিনি কাঁদছিলেন৷ তাঁর সেই কান্নার মর্যাদা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন৷ রাখাল দা’র নাম সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কাছে চিরকাল প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবে৷
তাঁর নেতৃত্বে সেদিন বঙ্গভবন ও সচিবালয়ের ক’জন তরুণ বীর, মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রুখতে জীবন বাজি ধরেছিলেন- তার সুদূর প্রসারী পরিণতি হয়েছিল যা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি৷ প্রথমত নিরাপত্তার নিছিদ্র বেড়াজাল ভেদ করে আতঙ্কগ্রস্ত মৃত্যুপুরী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বহিরাগত কেউ সামরিক-বেসামরিক অফিসারদের ও জওয়ানদের পক্ষে আহ্বান সম্বলিত লিফলেট ছড়িয়ে আসতে পারে- কোনো জওয়ান ও অফিসার এমনটা ভাবেনি বা বিশ্বাস করেনি৷ দ্বিতীয়ত উক্ত লিফলেট ৩০শে আগস্ট প্রত্যুষে ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন রাস্তায় পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জওয়ান ও অফিসাররা উক্ত লিফলেট তারা নিজেরা দিয়েছে বলে প্রচার চালায় এবং ঢাকার বাইরের ক্যান্টনমেন্টে তার কপি পাঠিয়ে দেয়৷ তার মূল কারণ, খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার অহঙ্কারে এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠে যে, সৈনিকদের কাছে তাদের স্ব স্ব রেজিমেন্টের সিনিয়র কমান্ডিং অফিসার কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেলদেরকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করে ডাস্টবিনের বস্তুতে পরিণত করে!! সেজন্য মান-সম্মানে আঘাত পড়ায় ভিতরে ভিতরে সিনিয়র সেনা অফিসাররা আগুন হয়েছিল ও টগবগ করে ফুটছিল৷ এমন মাহেন্দ্র ক্ষণে তাদের হাতে পৌঁছে যায় খুনিদের রুখে দাঁড়ানোর আহবান সম্বলিত অগ্নিঝরা লিফলেট৷

আল্লাহু আকবার আল্লাহ আকবার আল্লাহু আকবার
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মহান আল্লাহর নামে এবং পবিত্র কোরআন শরীফে যে খুন হারাম করা হয়েছে সেই পবিত্র কোরআন শরীফের নামে এবং ৩০ লাখ শহীদের নামে উদাত্ত আহবান: “দেশপ্রেমিক সামরিক-বেসামরিক মোমিন-মুসলমান ভাইরা বঙ্গবন্ধুর খুনি সিমারদের রুখে দাঁড়াও৷”
হানাদার পাক সেনাদের দালাল, বাংলাদেশে গণহত্যাকারী ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজীর প্রেতাত্মা এবং তিন লক্ষ বাঙালি মা- বোনের ইজ্জত হরনকারী পাক সেনাদের দোসররা বাঙালি জাতির জনক, তাঁর পূণ্যময়ী স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা দুই সন্তান, নিষ্পাপ রাসেল এবং গর্ভবতী দুই পুত্রবধুর হত্যাকারীরা হযরত ইমাম হোসেনকে স্বপরিবারে হত্যাকারী রক্তপিপাসু সিমারের চেয়েও সিমার৷ তাদের চোখে বঙ্গবন্ধুর অপরাধ হচ্ছে যে, তিনি পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম দিয়ে শত শত বাঙালি ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও জেনারেল তৈরি করেছেন এবং শত শত বাঙালি অফিসার, সচিব ও রাষ্ট্রদূত তৈরি করেছেন৷ পাকিস্তান আমলে আমরা যারা সবাই পাঞ্জাবি ও খান সেনা অফিসারদের বুট পালিশ করতাম ও promotion & posting এর জন্য তাদের বেগম সাহেবদের পায়ে তেল মালিশ করতাম৷ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে এবং বাঙালি জাতির হাত- পায়ের শৃংখল টুটে দিয়ে এবং দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চিত আমাদের বাঙালি সেনা ভাইদের গোলামী থেকে যিনি মুক্তি দিয়ে গেছেন, সেই মহান মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের যেখানে পাও গুলি করো৷ তাদের রক্ত মাংস কুকুর দিয়ে খাওয়াও৷ ৩০ লাখ শহীদের দেশ বাংলার পূতঃপবিত্র মাটিতে তাদের কবর হবে না৷ এই খুনিরা বাংলাদেশের দুশমন৷ ৩০ লাখ শহীদের দুশমন৷ এই রক্ত পিপাসু পাকিস্তানি প্রেতাত্মা-দালালদের যে, যেখানে, যেভাবে পারেন গুলি করুন, খতম করুন৷ ইসলাম ও আল্লাহর কোরআন শরীফের বয়ান অনুযায়ী সিমারের চেয়েও অধিক সিমার এই খুনিদের খুন করা ফরজ৷ ফরজ৷ ফরজ৷ তিন ফরজ৷ আল্লাহর অভিশম্পাত তাদের মাথার ওপর বর্ষিত হচ্ছে৷ যে, যেখানে, যেভাবে পারেন তাদের খুন করে দেশপ্রেমিক সামরিক-বেসামরিক ভাই সব দু’হাত তুলে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলুন: “ফি নারে জাহান্নামা খালেদীনা ফিহা” (জাহান্নামের আগুনে তারা অনন্তকাল জ্বলে পুড়ে ছারখার হোক)৷ আমিন৷ আমিন সুম্মা আমিন৷ আল্লাহ আমাদের সহায় হোন৷
প্রচারে: সামরিক ও বেসামরিক ঈমানদার, মোমিন মুসলমান, দেশপ্রেমিক অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ৷ তারিখ: ১৬ই আগস্ট, ১৯৭৫ ইং সাল৷

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে সেনা অফিসার ও জওয়ানদের হাতে এটা পড়া মাত্র ৩০শে আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে সেখানে আগুনের হুলকা ছড়িয়ে পড়লো৷ খুনিদের ওপর ক্ষুব্ধ সাধারণ সৈনিকরা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক ও অফিসাররা এটা লুফে নিলো৷ সেনাবাহিনীর দেয়া লিফলেট বলে দ্রুত জনমত গড়ে উঠলো৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে লিফলেটটি চলে গেল অন্যান্য সকল ক্যান্টনমেন্টে৷ সকল ক্যান্টনমেন্টে খুনিদের রুখে দাঁড়ানোর আওয়াজ উঠলো এবং চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার দাবি উঠলো৷ বঙ্গভবনে অবস্থানরত রক্তপিপাসু খুনিরা ১৫ই আগস্ট থেকে গত ১৪ দিন অর্থাৎ ২৯শে আগস্ট পর্যন্ত তিন বাহিনীর নামে সম্মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে খুন করেছে বলে যে দাবি করে আসছিল- ৩০শে আগস্ট সকাল থেকে ঢাকাসহ সকল ক্যান্টনমেন্টের মেজরিটি অংশ তা মিথ্যা ও ভুয়া দাবি বলে প্রত্যাখ্যান করে এবং বঙ্গভবনে অবস্থানরত জুনিয়র অফিসারদের স্ব স্ব রেজিমেন্টে ফেরৎ এনে আর্মির চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলো৷ ফলে ৩০শে আগস্ট থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টসহ বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লো৷ যতদিন যেতে লাগলো, খুনিদের পক্ষ ত্যাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো৷ বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল দা’র নেতৃত্বে বঙ্গভবন ও বাংলাদেশ সচিবালয়ের most junior ৭ জন অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুঞ্জয়ী ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৪ দিন পরে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশব্যাপী সকল ক্যান্টনমেন্টে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল৷
বঙ্গভবনে অবস্থানরত খুনি ডালিম-ফারুক-রশিদ গংরা সেনা সদরের হুকুম উপেক্ষা করে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট খুনি মোশতাককে হাতের মুঠোয় রেখে স্বেচ্ছাচারী সরকারি আদেশ-নির্দেশ জারি অব্যাহত রাখায় সেনাবাহিনীর সিনিয়র জেনারেলদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়৷ তাদের সকলে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে খুনি মোশতাকের বিরুদ্ধে ‘৭৫-এর ৩রা

পৃষ্ঠা: ৭১
নভেম্বর অভ্যুত্থান ঘটায়৷ খুনিরা ক্ষমতাচ্যূত হয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়৷ Decisive and aggressive war strategy না নেয়ায় ট্রাজেডির ঘটনা ঘটে এবং পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে৷ জেনারেল খালেদ মোশাররফসহ বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার, কর্নেলসহ অনেক মেধাবী অফিসার ও জওয়ান নিহত হয়৷ যাঁদের অধিকাংশ ছিলেন জাতীয় বীরত্বের খেতাব প্রাপ্ত৷ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী প্রাতঃস্মরণীয় চার জাতীয় নেতা কারাগারে নিহত হন৷ দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি ফুঁসে ওঠে৷ অপরদিকে হালুয়াঘাটে মুক্তিযুদ্ধের অলৌকিক বহু বিজয়ের মহানায়ক কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে তাঁর অধীনস্থ কাদেরীয়া বাহিনী হালুয়াঘাটে জেনারেল জিয়ার অনুগত বাহিনীর ওপর কামানের গোলাবর্ষণ করে৷ ঘরে- বাইরে প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে জেনারেল জিয়াসহ তার অনুসারী পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর জওয়ান ও অফিসাররা ১৫ই আগস্টের পর পরই রাজধানী ঢাকা থেকে ৬৮০০০ গ্রাম পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনুসারী ও সমর্থকদের নির্মূল করার যে নীল নকশা লর্ড ক্লাইভের ন্যায় রচনা করেছিল, তা স্থবির ও স্তব্ধ হয়ে যায়৷ সে কারণে, লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও টিপু সুলতানের আদর্শের অনুসারীদের ও সমর্থকদের এবং আত্মীয়-স্বজনদের, এমনকি, তাদের শাসনামলে যারা বিভিন্ন পেশায় চাকরি করেছে, তাদের সকলকে ভারতবর্ষের কোণে কোণে খুঁজে খুঁজে নির্মূল করেছিল বিধায় তাদের উভয় পরিবারের কেউ আর তাদের রাজ্য ফিরে পায়নি এবং শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি৷
ভারতবর্ষের ব্যাঘ্র হিসেবে খ্যাত টিপু সুলতানের বংশধরেরা বর্তমানে হায়দারাবাদের অলি-গলিতে হাড়ি-পাতিল মেরামতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধরেরা কলকাতার রাস্তায় পানি ও চা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে৷ বাংলাদেশে সেই করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়নি বাঙালি জাতির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের অনুসারীদের ও সমর্থকদের এবং তাঁর পতাকাবাহী মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল ও নিধনের নীল নকশা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রচণ্ড প্রতিরোধে খণ্ড-বিখণ্ড ও দলিত-মথিত করে দিয়েছিল যে মৃত্যুঞ্জয়ী বীরেরা- তাঁদের কথা একদিন ইতিহাসে বাঙ্ময় হয়ে উঠবে৷
রাখাল দা-কে গ্রেফতারের বেশ কিছুদিন পর আমাদেরকে টার্গেট করা হয়৷ কারণ আমরা ক’জন ছিলাম বঙ্গভবন ও সচিবালয়ের নির্ভিক চিত্ত টগবগে মুক্তিযোদ্ধা৷ ১৫ই আগস্টের পরেও সকলে আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলতো, “এদের কোনো ডর ভয় নেই৷ এরা এখনো জুতার ফিতার (ব্যঙ্গ) কথা বলে৷” মাহবুব আলম চাষী অন্যান্য সি.এস.পি’দের সাথে করে ব্যঙ্গ হাসি হেসে আমাকে বঙ্গভবনের এম.এস.পি’র রুমে এ কটুক্তি করেছে৷ অতঃপর ‘৭৫-এর অক্টোবর মাসে তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসার ফকির আবদুর রাজ্জাক, শফিকুল আজিজ মুকুল, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, আলী তারেক এবং আমার চাকরি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে বলা হয় যে, “এরা সন্দেহভাজন৷ প্রজাতন্ত্রে এদের চাকরির আর প্রয়োজন নেই৷ এদেরকে চাকরিচ্যূত করার জন্য তাদের চাকরি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো৷” বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতিরোধ করা বিষয়ক লিফলেট সচিবালয়ে বিতরণের কারণে এইসব অফিসারের বিরুদ্ধে সন্দেহবশত এই পদক্ষেপ নেয় খুনি মোশতাক-জিয়া-তাহের উদ্দীন ঠাকুর৷
প্রজাতন্ত্রের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মূল শক্তি মূখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর অফিসার সমিতির সভাপতি খন্দকার আসাদুজ্জামান ১৫ আগস্ট বন্দি হয়ে পড়ায় প্রতিরোধ পরিকল্পনা জোরদার ও বাস্তবায়ন পর পর ব্যর্থ হচ্ছিল৷ ইতোমধ্যে ১৫ই আগস্টের পর ঢাকাসহ সারাদেশে সংঘটিত এন্টি মোশতাক এক্টিভিটিজ-এর জন্য ১৫ আগস্ট জেলখানায় বন্দি প্রবাসী সরকারের সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানকে এসব তৎপরতার বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে৷ সেখান থেকেও কোন ক্লু উদ্ধার না করতে পারায় ক্ষিপ্ত খুনি মোশতাক-জিয়ার সরকারের ক্রোধের শিকার হয়ে সরকারি গোয়েন্দারা ব্যাপক বদলির শিকার হন৷ এ ঘটনার পর সেক্সপিয়রের ‘One should be prepared for the worst & hope for the best’ চিন্তা করে চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ কমান্ডো যোদ্ধা এস. এম. ইউসুফের প্রেরিত অবশিষ্ট লিফলেট আমি, কুমার শংকর হাজরা ও রাখাল দা’ একদিন গভীর রাতে আমিন বাজারের পেছনে এক ইটের ভাটিতে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলি৷
সরকারি গোয়েন্দা এবং জেনারেল জিয়ার লোকেরা হদিস করে উঠতে পারলো না ১৫ আগস্টের খুনিদের প্রতিরোধ বিষয়ক শত-সহস্র লিফলেট ক্যান্টনমেন্টে কীভাবে প্রবেশ করতে পারলো? কিভাবে বিতরণ হলো? এবং কোন প্রেসে তা ছাপা হলো? জেনারেল জিয়া ও জেনারেল রহিম (ডি.জি., ডি.জি.এফ.আই) এটা জেনে নিতে পারেনি৷ জিয়ার হুকুমে ঢাকায় চিরুনি তল্লাশি হয়৷ চিরুনি তল্লাশি চলতে থাকে৷ ঢাকার কোন প্রেস চিরুনি তল্লাশি থেকে রেহাই পায়নি৷ অবশ্য গোয়েন্দারা আড়াই বছর পরে ১৯৭৭ সালে তথ্য পেয়ে গেল, সেই লিফলেট চট্টগ্রামে ছাপা হয়েছে৷ সেই সূত্র ধরে চিরাচরিত benefit of doubt ফর্মুলায় একটি ক্যু ঘটনায় সম্পৃক্ততা দেখিয়ে আমাকে টার্গেট করা হলো৷ কোনো সূত্রে তারা আমার নাম সম্ভবত পেয়ে যায়৷ ডি.জি.এফ.আই. তুলে নিয়ে যেতে চাইলো আমাকে৷ কিন্তু সে বিষয়ে প্রমাণ খাড়া করার জন্য ১৯৭৭ সালে অক্টোবর মাসে ঢাকায় জাপানি বিমান হাইজ্যাক এবং বিমান বাহিনীর ক্যু’র সূত্রে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশে তদানীন্তন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক আলী আহসান এই মর্মে প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে লিখিত ও স্বাক্ষরিত অভিযোগ পেশ করলো যে, “Mr. Muhammad Musa, a senior officer has said, “Zia is killed. It is a good news. Let us celebrate it…” এ ঘটনার সাথে সাথে প্রেসিডেন্টের মূখ্য সচিব জনাব নূর মোহাম্মদ স্যার আমাকে দ্রুত খুঁজে বের করেন৷ তিনি আমার দুর্নীতি প্রতিরোধী এবং দেশপ্রেমমূলক ভূমিকার জন্য আমাকে খুব স্নেহ-মমতার চোখে দেখতেন৷ তিনি আমার জীবন বাঁচাতে যথাসাধ্য করেন এবং তাঁর একান্ত সাহায্যে আমি ভারতে পলায়ন করি
এরূপ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক সেনা বিদ্রোহের সাথে আমাকে যুক্ত করার পশ্চাতে মূল কারণ ছিল জেনারেল জিয়া ‘৭৫-এর ৩০শে আগস্ট ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জিয়া-মোশতাকের বিরুদ্ধে লিফলেট বিতরণের আঘাত মেনে নিতে পারেননি৷ সেজন্য তারা একটা “মওকা” খুঁজছিল৷ ‘৭৫-এর পর ‘৭৭ সালের অক্টোবরে এসে তাঁরা যখন সেই লিফলেটের সন্ধান চট্টগ্রাম থেকে পেয়ে গেল— তখন চট্টগ্রামের এস. এম. ইউসুফ ও আমাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার জন্য ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে বিমানবাহিনীর ক্যু’র সাথে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে ও তাকে সংশ্লিষ্ট দেখালো৷ চট্টগ্রামে এস.এম. ইউসুফকে তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলো৷ তিনি তাঁর ‘৭১-এর আত্মগোপনে চলে গেলেন৷ তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এই ক্যু’র সুযোগে আমাদের দু’জনকে অভিযুক্ত করে, তথাকথিতভাবে ক্যামেরা ট্রায়াল দিয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে ঘোষণা দিয়ে ফাঁসি দেয়া৷
উক্ত উপদেষ্টার লিখিত রিপোর্ট তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের সাথে সাথে তদানীন্তন ডি.জি, ডি.জি.এফ.আই. তথ্য উপদেষ্টা আকবর কবীরকে জানান যে, উক্ত অফিসারটির অন্তর্ঘাত ও দেশদ্রোহী কাজের জন্য ডিজিএফআই তাকে ইন্টারোগেট করতে চায়৷ আকবর কবীর সাহেবের পি.এস. খান আমির আলী (পরবর্তীকালে সচিব) ও তদন্তকারী কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত উপ- সচিব সুলতান আহমদ সেদিন খুনিদের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করে আমাকে রক্ষায় বেপরোয়া ভূমিকা পালন করেন৷ বস্তুত তাঁরা দু’জন তথ্য উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে আমার সততার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোসহীনতার বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রজাতন্ত্রের স্বার্থে আমাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষার জন্য অনুরোধ করেন৷ বৃটিশ বিরোধী নেত্রী সরজেনু নাইডু’র সাথে আলোচনারত আমার শিক্ষক পিতার একটি বিরল ছবি (কলকাতায় ১৯৪৬ সালে একটি সূধিসমাবেশের আলোচনা) নিয়ে আমার আত্মীয়র আকবর কবির সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন৷ বৃটিশ ভারতের বিখ্যাত হুমায়ুন কবিরের ভাই উপদেষ্টা আকবর কবির এই ছবি দেখার সাথে সাথে বদলে গেলেন এবং বলা যায় আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে স্বতঃপ্রণোদিত চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে ছুটে গেলেন এবং তাঁকে বোঝালেন যে, সচিবালয়ের ও প্রশাসনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কাছে মুসা খুবই জনপ্রিয় এবং তাঁদের সংগঠনের সে নেতা৷ ১৯৭১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, শনিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় সে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাক্ষরিত রিপোর্টটা তিনি নিজে হাতে করে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দেখালেন এবং সেই রিপোর্টের শেষ অংশ পড়ে শোনালেন, যেখানে লেখা ছিল, “মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে জনাব মুসার অপরিসীম অবদান এবং বীর যোদ্ধা ক্যাপ্টেন হুদা যেভাবে পাক সেনাদের গোলা বৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে মুসার জীবন বাঁচিয়েছেন, সে জন্য তাঁদের উভয় জনের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং তাঁদের কাছে জাতির ঋণ স্বীকার করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পক্ষে আমি এখানে স্বাক্ষর করলাম” স্বাক্ষরিত- তাজউদ্দীন আহমদ, তারিখ: ২১/৩/৭২৷
তদুপরি অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত কংগ্রেস নেত্রী সরজেনু নাইডু’র সাথে আমার শিক্ষক পিতার ছবি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে দেখিয়ে বললেন, “এ রকম পরিবারের একজন বে-সামরিক অফিসার সামরিক বাহিনীর ক্যু’তে অংশ নেবার ঘটনা বে-সামরিক টিম দ্বারা তদন্ত না করে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর দ্বারা তদন্ত করা হলে সচিবালয়ে ও প্রশাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে৷ আমি বরং বে-সামরিক তদন্তের কার্যক্রম শুরু করে দেই৷” তাঁর প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্মতি দানে ইতস্তত করলে, তিনি আরও বহু দেন দরবার করে তাঁর সম্মতি আদায় করে নিতে শেষমেষ সমর্থ হন৷
নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ডের ফাঁদ থেকে আকবর কবির সাহেব কীভাবে যে আমাকে উদ্ধার করে আনতে সমর্থ হন, তা একমাত্র মহান আল্লাহ জানেন৷ তাঁর কাছে, তাঁর একান্ত সচিব খান আমির আলীর কাছে এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা জনাব সুলতান আহমদের কাছে আমার জীবন রক্ষার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার, সচিবালয়ের ও বঙ্গভবনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের এত অসীম ঋণ, কোনোদিন শোধ হবে না৷ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মরহুম আকবর কবিরকে বেহেস্ত নসীব করুন৷
ইতোমধ্যে, আমার আত্মীয়ের অধিক, দেশের প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ তদানীন্তন পিজি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক, জাতীয় অধ্যাপক ড.

পৃষ্ঠা: ৭৫
এম. আর. খান তৎকালীন তথ্য সচিব কাজী আজহার আলীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর স্নেহভাজন হিসেবে আমাকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করেন৷ কাজী আজহার আলী তাঁকে বলেন, “ডি.জি.এফ.আই. তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সনাক্ত করেছে৷ তাঁকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব৷ বিশেষ করে, ক্যু, কাউন্টার ক্যু’র পরে এই সিচ্যুয়েশনে আমার পক্ষে যতখানি করা সম্ভব আমি তা সাধ্যমতো করবো৷ যেটা পারব না, জানবেন সেটা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল৷” অধ্যাপক এম.আর. খান তাঁকে বলেন, “ও আমার আত্মীয়৷ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা৷ সে যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে৷ ‘৭১-এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েও শহীদী দরজা থেকে আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে এনেছেন৷ শেষবারের মতো আপনি তার জীবন বাঁচাতে পারেন…৷ ওর বড় অপরাধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুর জন্য দু’একটা লেখা লেখে৷ ও তো অস্ত্র হাতে ক্যু করেনি৷ ও তো একজন সিভিল অফিসার…৷”
তথ্য সচিব কাজী আজহার আলী আমার জন্য সাধ্যের অতীত করেছিলেন৷ কারণ, প্রফেসর এম. আর. খান ও কাজী আজহার আলী ছিলেন একে অন্যের শুভার্থী এবং বহুদিনের পুরনো বন্ধু৷ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তিনি ফাইল নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা আকবর কবীরকে আস্থায় নিয়ে আমার বিরুদ্ধে দ্রুত এ্যাকশনে চলে গেলেন৷ আমাকে সাসপেন্ড করলেন৷ একই দিনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (প্রশাসন) সুলতান আহমদকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ ও শুনানী অনুষ্ঠিত করালেন৷ অপরদিকে উপদেষ্টা আকবর কবীর সাহেব জেনারেল জিয়াকে convince করালেন যে, উক্ত সিভিল অফিসারের বিরুদ্ধে সিভিল রুলে proceedings শুরু হয়ে গেছে৷ এমতাবস্থায়, ডি.এফ.আই-কে দিয়ে তার বিরুদ্ধে অন্য কোনো কার্যক্রম নেয়া হলে তা হবে বিধি বহির্ভুত৷ তথ্য মন্ত্রণালয়ের proceedings শেষে প্রয়োজনে পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করতে পারবে৷
একই সময়ে সেনাবাহিনীর সি.জি.এস. জেনারেল এম. এ. মঞ্জুর, ‘৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যাঁর বীরত্ব গাঁথা আমি বহু বহুবার প্রচার করেছি “রণাঙ্গন ঘুরে এলাম” প্রতিবেদনে, বিশেষ করে, যুদ্ধের শেষ লগ্নে তাঁর “শিরোমণি ট্যাঙ্ক ব্যাটল”-এর অবিশ্বাস্য বিজয় কাহিনী (আমার লেখা ইংরেজি ও বাংলায় “Bangladesh Wins Freedom” বইতে এক অধ্যায় জুড়ে এই ট্যাঙ্ক ব্যাটেল ও তাঁর বীরত্ব গাঁথা বর্ণিত আছে) শুধু স্বাধীন বাংলা বেতারে নয়, মার্ক টালির মাধ্যমে আমি বিবিসি’তেও প্রচার করেছিলাম ‘৭১ এর ১৭ই ডিসেম্বর- সেজন্যে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার, আনুগত্যের ও সহানুভূতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল৷ (সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে আমার সাথে অনুরূপ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় আরেকজন জেনারেল খালেদ মোশাররফ স্যারের সাথে৷ মূলত রণাঙ্গনে তাঁদের উভয়ের রণকৌশল, বীরত্ব, বিক্রম ও নির্ভিক নেতৃত্বের কারণে তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আমি বহু প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম৷ সেই থেকে তাদের দু’জনের সাথে আমার নিবিড় যোগাযোগ ও বিশ্বাসের বন্ধন গড়ে উঠেছিল৷)
জেনারেল এম. এ. মঞ্জুরের COD ছিলেন মেজর হোসেন৷ (জিয়া হত্যাকাণ্ডে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দণ্ডপ্রাপ্ত) ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতা থেকে আমি তাঁকে ফোন করে বিস্তারিত বললাম৷ তিনি মঞ্জুর স্যারের সাথে আমাকে ফোনে মিলিয়ে দিলেন৷ মঞ্জুর স্যার আমার একটা কথাও না শুনে দৃঢ় তীব্র কণ্ঠস্বরে বললেন: ‘Why you will leave the country? This is your country. You are a war hero. Come back right now. I am still alive. I am responsible for your life. “
কিন্তু ২রা জুন, মুক্তিযুদ্ধের এই বীরদের বীর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জেনারেল রোমেলের আল আমিন ট্যাঙ্ক ব্যাটেলের সমতূল্য বাংলার বুকে “শিরোমণি ট্যাঙ্ক ব্যাটেলের” বিজয়ী বীর জেনারেল মঞ্জুরকে যখন তদানীন্তন আর্মি চিফ এরশাদ বঙ্গভবনে এম.এস.পি. ব্রিগেডিয়ার সাদেকুর রহমানের কক্ষ থেকে আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে টেলিফোনে জেনারেল লতিফকে direct order দিয়ে বলে ‘eliminate him’ তখন হতভাগ্য আমি ১৯৭৭ সালের তাঁর মতো দৃঢ় তীব্র কণ্ঠস্বরে বলতে পারিনি ‘…You are a war hero… I am still alive. I am responsible for your life.” সেই ও.সি. কুদ্দুস যে জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে আই.জি’র নির্দেশ অমান্য করে এরশাদের অবৈধ আদেশ (পুলিশ বাহিনীকে যে কোনো আর্মি চিফ-এর আদেশ আইনত অবৈধ৷ সেনাবাহিনীকে কোনো আই.জি’র দেয়া আদেশ অনুরূপভাবে অবৈধ) পালন করে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়া জেনারেল মঞ্জুরকে জেনারেল লতিফের প্রেরিত সেনাবাহিনীর হাতে বে-আইনীভাবে তুলে দেয়- এরশাদের ভোজবাজি ও তেলেসমাতিতে সে এখন দশ হাজার কোটি টাকার মালিক৷ আমার মতো বহু সচিব ও জেনারেল, যারা হক-হালালীর বেতনে রুটি রুজির জীবন-যাপন করেছি, তাঁদের ব্যাংকে যখন একটা পয়সা নেই এবং ঢাকার কোন বস্তিতেও একটি টিনসেডের মতো মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই! অথচ জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হত্যাকান্ডে অংশ নিয়ে ও সহায়তা করে, ওসি কুদ্দুসের মতো লোকেরা এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক- তাঁদের কেউ কেউ অবৈধভাবে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের মসনদ দখল করেছিল এবং পুনরায় দখলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে৷
অতঃপর সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ও প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার সংবাদ আনন্দের সাথে উদযাপনের ডাহা মিথ্যা অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একটি “সতর্ক পত্র” জারির মাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাহার করা হলো- তখন সি.জি.এস. জেনারেল মঞ্জুর স্যারের বাসায় গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালাম৷ তিনি বুকে টেনে নিলেন৷ কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ততক্ষণে অশ্রু ধারায়…৷ মঞ্জুর স্যার বললেন: ‘৭১-এর ২রা ডিসেম্বর একবার ক্যাপ্টেন হুদা তোমাকে লাশের মধ্য থেকে 2nd life দিয়েছে— এবার জিয়া তোমাকে শূলে চড়িয়ে দিয়েছিল- আল্লাহ এবার তোমাকে 3rd life দিলো৷ আগামীকাল শুক্রবার দিনটা রোজা রাখো৷ সদকা হিসেবে তোমার বয়স যত, ততজন এতিমকে খাইয়ে দিও৷” অত্যন্ত পরহেজগার জীবন-যাপনকারী জেনারেল মঞ্জুর স্যারের উপদেশ মতো পরদিন শুক্রবার রোজা রাখলাম আর তখন আমার বয়স ছাব্বিশ বছর হিসেবে ছাব্বিশ জন এতিমের জন্য আজিমপুর এতিমখানায় গিয়ে আমি, আলী তারেক, গাজী মনসুর ও কক্সবাজারের প্রফেসর কাদের ভাই (একাত্তরের মজিবনগরে ওসমানী স্যারের সামনে মেজর জিয়ার সাথে যার মারামারি হয়েছিল) আজিমপুর এতিমখানায় গিয়ে ছাব্বিশ জনের স্থলে ষাট- পঁয়ষট্টি জন এতিমকে মাছ-ভাত খাইয়ে আসি৷
জেনারেল এম.এ. মঞ্জুর এবং তথ্য উপদেষ্টা আকবর কবিরের জন্য আমি নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসি৷ সেই দুঃসময়ে ও দুর্দিনে তাঁদের দু’জনের দৃঢ়চেতা ভূমিকার জন্য বঙ্গভবনের ও সচিবালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাঁদের দু’জনের নাম প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে রবে৷ আমি যতদিন বেঁচে থাকবো শহীদ ব্রিগেডিয়ার নাজমুল হুদা, শহীদ জেনারেল এম.এ. মঞ্জুর এবং আকবর কবির সাহেবকে আমার সকল নামাজ, রোজা, দান-খয়রাত, হজ্ব, যাকাতের সওয়াবের ভাগীদার বলে মানবো ও জানবো৷ আমাকে 2nd life এবং 3rd life দেবার প্রতীক হিসেবে তাঁদের কাছে আমার প্রতিশোধ্য ঋণ পরিশোধের দায় থাকলেও অর্থ- বিত্তহীন আমার সাধ্য নেই৷ মহান আল্লাহর কাছে তাঁদের জন্য কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করার মধ্যে আমি সান্ত্বনা খুঁজি মাত্র৷
জেনারেল জিয়ার সম্মতি এভাবে আদায় করে নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা আকবর কবীর এবং তথ্য সচিব কাজী আজহার আলী সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন৷ সে কথা স্মরণ করে দীর্ঘ ৩৯ বছর পরও আমি এবং প্রশাসনের মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা মরহুম আকবর কবীরের ও কাজী আজহার আলীর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁদের কাছে গভীর ঋণ স্বীকার করছি৷
একথা সত্য বলে আজ দীর্ঘ ৩৯ বছর পর আমি উল্লেখ করছি যে, খুনি মোশতাক-ডালিম-ফারুকদের জনসমর্থনহীন অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে প্রজাতন্ত্রের অফিসারদের অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে সচিবালয়ের মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রথম গোপন বৈঠক রাখাল দার সোবহানবাগ কলোনির বাসায় হয়েছিল৷ সেই বৈঠকে তিনি আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “তোমাদের চেয়ে আমার বয়স বেশি, খুনিদের মারার জন্য যদি মরতে হয়, আমিই আগে মরবো৷ তোমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা৷ আমরা যেন মনে রাখি কাপুরুষেরা বহুবার মরে, কিন্তু বীরেরা মরে একবার৷” প্রয়াত রাখাল দা’র আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রজাতন্ত্রের সকল মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে আমি পূণ্য মনে উচ্চারণ করছি যে, রাখাল দা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা উড্ডীন রাখতে গিয়ে সেদিন যে কথা বলেছিলেন, সেকথা তিনি রেখেছিলেন৷ কিন্তু মরহুম হারেস উদ্দীন সরকার বীর প্রতীক ও সচিবালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন ক্ষোভের সাথে বলেছিলেন যে, সেনাবাহিনীর ও সচিবালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ হাতে নিয়ে সেদিন যেভাবে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা সেভাবে এগিয়ে না আসায় তাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়ী মিশন ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তা না হলে বাংলার ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো৷ নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছে দেয়া কথা তাঁর প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান যদি রাখতেন, তাহলে বাংলার ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো৷
একই ঘটনা আমাকে বলেছিলেন, ১৯৯১ সালে রক্ষীবাহিনীর সুবেদার মেজর গোলাম আলী৷ শের-ই-বাংলা নগরের গণভবনের সাথে সংলগ্ন (বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) অংশে বঙ্গবন্ধুর গার্ড হিসেবে রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা থাকতেন৷ ১৫ই আগস্টে সেখানকার রক্ষীবাহিনী খুনি ডালিম- ফারুকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছিল৷ সে বিষয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের অন্যতম সিকিউরিটি অফিসার গোপালগঞ্জের মুকসেদপুর থানার অধিবাসী সুবেদার মেজর গোলাম আলী৷ সেদিনের বিশ্বাসঘাতকতার কথা উল্লেখ করে ক্রোধান্বিত কণ্ঠস্বরে তিনি আমার কাছে বললেন, “৩২ নম্বরে গিয়ে খুনিদের টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়ানোর শপথ নিয়েছিলাম, আমরা রক্ষীবাহিনীর সকল বীর মুক্তিযোদ্ধারা৷ আজ তাহলে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অধিক পূর্ব পাকিস্তান করার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পেতো না৷ তাহলে ‘৭১-এ যে শিশুকে “অবৈধ” বলে তাকে ভূমিষ্ঠ হতে দিতে চায়নি ‘৭৫ পরবর্তী জিয়ার সময় এবং ১৯৯১ পরবর্তী বেগম জিয়ার সময় শাহ আজিজ-আব্দুর রহমান- আব্দুল আলিম-মতিউর রহমান-আলী আহসান মুজাহিদরা সেই শিশুর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পেয়ে শিশুটিকে ক্ষত-বিক্ষত করে রক্ত ঝরিয়ে তাকে রক্তশূন্য করে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়ে তাদের পাঞ্জাবি প্রভুদের থেকে বাহবা নেবার সুযোগ পেতো না৷”
‘৭১-এ প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকারী গৃহবন্দি (প্রবাসী সরকারের অজ্ঞাতে তিনি নিজে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন-এর গোপন প্রস্তাব ইরানের শাহ পাহলভীকে প্রেরণের দেশদ্রোহীতামূলক অপরাধে) খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর দয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশে পুনরায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার সুযোগ পেয়ে যায়৷ অথচ, ভারতের মাটিতে বসে ভারত সরকার ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্র নীতি লঙ্ঘন করার ভয়ঙ্কর অপরাধে এবং বিদেশের মাটিতে বসে দেশদ্রোহীতা ও ষড়যন্ত্রের অপরাধে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের কর্মসূচিতে অজ্ঞাত ক্রসফায়ারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরি করার সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী ভারত ও বাংলাদেশের শীর্ষতম পর্যায়ে গৃহীত হয়৷ কিন্তু প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ়তায় উক্ত সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়ে যায়৷ তদস্থলে তাজউদ্দীন সাহেবের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে গৃহবন্দি করে রাখতে উভয় সরকার সম্মত হয়৷ ‘৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারী তাজউদ্দীন আহমদের অনুগ্রহে যিনি নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড থেকে জীবন ফিরে পান এবং ‘৭২ এ জাতির জনকের দয়ায় গৃহবন্দিত্ব থেকে যিনি পুনরায় মন্ত্রীর মুকুট মস্তকে পরিধান করার বিরল সুযোগ পেয়ে যান- সেই বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক প্রথম সুযোগেই জাতির জনককে হত্যা করে এবং দ্বিতীয় সুযোগেই তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রবাসী সরকারের চার নেতাকে হত্যা করে তাদের উদারতা ও মহানুভবতার নির্মম প্রতিদান দিয়ে দেয়৷ (প্রবাসী সরকারের মূখ্য সচিব, আমার মামা জনাব রুহুল কুদ্দুস কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য)৷
অথচ দেশি বা বিদেশি শত্রুদের যে কোন আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর হাতে নিশ্চিতভাবে বিকল্প ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল৷ কিন্তু গফুরুর রহিম মহান আল্লাহ তায়ালা সর্বোত্তম জানেন যে, “১৫ই আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন বাঁচাতে কেন বিকল্প ব্যবস্থা বেছে নেননি!” ‘৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ থেকে, এ যাবত বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বহু সংবাদ পরিবেশক বিবিসি’র সাবেক দিল্লি ব্যুরো চিফ মার্ক টালি ‘৭৫ সালের ২৪শে আগস্ট হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করে আমাকে বলেছেন যে,

পৃষ্ঠা: ৮০
“শেখ মুজিবের চিন্তাশক্তির মধ্যে এমন কোনো উপাদান ছিল না যে, তিনি কোনভাবে বিশ্বাস করতে পারেন যে, তার হাতে গড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেউ তাকে অসম্মান বা অপমান করতে পারে৷ কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা অবজ্ঞা ও ঘৃণার জীবন বয়ে বেড়াতো৷ অভিশম্পাৎ ও বদনাম বয়ে বেড়াতো! তদস্থলে, তিনি তাদের বিশ্বব্যাপী বীরের মর্যাদায় ও বীর সেনাবাহিনীর মর্যাদায় ভূষিত করেন৷ সেই তাদের কেউ তাঁকে খুন করবে, এমন কথা তিনি ভুল করেও বিশ্বাস করতেন না৷ ”
আমি মার্ক টালিকে বললাম: “আমার মনে হয়, মৃত্যুকালেও তিনি তার বিশ্বাস হারাননি এবং সে বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি৷” তিনি অবাক বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলেন: “এমন কথা কেমন করে বলতে পারছেন, আপনার ঝুড়িতে কি এমন ঐতিহাসিক তথ্য আছে মি. মুসা?” আমি বললাম: “যুদ্ধের পরপরই আমাদের মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব জনাব আব্দুস সামাদ ও তাঁর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস পেশকৃত প্রতিরক্ষা বিষয়ক “CLASSIFIED & TOP SECRET” রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে এই মর্মে সতর্ক করেছিলেন (রেফারেন্স: জনাব রুহুল কুদ্দুস) যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীতি ও আদর্শের অন্ধ অনুসারী ও সমর্থক বহু বাঙালি অফিসার ও সৈনিক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাক সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ডেপুটেশনে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, জর্দান, আরব আমিরাত, লিবিয়া প্রমুখ দেশের স্বৈরাচার রাজা-বাদশাহ ও এক নায়কদের প্রাসাদ ও জীবন রক্ষার্থে পাকিস্তান সরকারের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অনুগত ও সরকারের সর্বোচ্চ আস্থাভাজন হিসেবে লোভনীয় উচ্চ বেতনে কর্মরত ছিল৷ ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে তাদেরকে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সি. আই.এ. এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. বাংলাদেশের পক্ষে defect (যোগদান) করার গোপন নির্দেশ দেয়৷ নির্দেশ মতো পাকিস্তানের গোড়া সমর্থক ও পাক সেনাবাহিনীর নীতি ও আদর্শের অন্ধ অনুসারী বাঙালি সেনা অফিসাররা সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া, জর্দান ইত্যাদি দেশ থেকে লোভনীয় উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান ও আমেরিকার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ভারতে চলে আসে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে৷ (যদিও মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে পারেনি৷) মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের নিশ্চিত পরাজয় হতে যাচ্ছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে, ‘সি.আই.এ’ এবং ‘আই.এস.আই’ মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাথে বাংলাদেশে অন্তর্ঘাত কার্যক্রম চালানো এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সেক্টর কমান্ডারসহ প্রবাসী সরকারের সকল নেতাসহ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে আঁতুর ঘরেই বাংলাদেশকে DEAD COUNTRY, অর্থাৎ “মৃতদেশে” বা “ব্যর্থ দেশে” পরিণত করার নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করায়৷ ১৫ই আগস্টের খুনিরা সেই সব গুটিকয় বিশ্বাসঘাতক বাঙালি অফিসার, যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ আনুগত্য ও সর্বোচ্চ বিশ্বাস অর্জন করে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে লোভনীয় উচ্চ বেতনে ডেপুটেশনে যোগদানের অকল্পনীয় সুযোগ পায় ও নির্বাচিত হয়৷ যখন পাক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রত্যহ ‘কাপুরুষ’ বলে গালাগালি দেয়া হতো এবং তাদেরকে পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখা হতো, তখন এসব পাকিস্তানীদের চেয়ে অধিক পাকিস্তানীদের মাথায় করে রাখা হতো৷”
আমার মামা রুহুল কুদ্দুসকে ইন্দিরা গান্ধীর মূখ্য সচিব পি.এন. হাকসার বলেছেন যে, ১৫ই আগস্টের সেই কাল রাতে ১০০% সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্য চেয়ে বঙ্গবন্ধু কোনো ফোন করেননি৷ প্রতিবেশী দেশের বঙ্গবন্ধুর এক শুভাকাঙ্ক্ষী ১৯৭২ সালে তাঁর হাতে “Emergency code SOS” প্রেরণের equipment হস্তান্তর করে গেলেও, তিনি তা ব্যবহার করেননি৷ তিনি তা করলে ঢাকা সেনানিবাস ও খুনিদের আস্তানা বঙ্গভবন ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে তামা হয়ে যেতো৷ ধূলি ধূলি হয়ে ধূসরিত হয়ে যেতো৷ মর্মাহত চিত্তে সেই দুঃখ ‘৭৫- এর সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব আমার মামা জনাব রুহুল কুদ্দুসের কাছে প্রকাশ করেছিলেন৷
‘৭৫-এর খুনিদের নীল নকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ‘৭৫-এর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তাঁর মূখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসকে হত্যার উদ্দেশ্যে সচিবালয় থেকে বেরুবার মুখে তাঁর গাড়ির ওপর খাদ্য ভবনের সামনে একটি খাদ্য বোঝাই ঘাতক ট্রাক তুলে দেয়া হয়৷ মূল উদ্দেশ্য প্রশাসনে বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তি ও নিয়ন্ত্রক জনাব রুহুল কুদ্দুকসে হত্যা করা৷ তার গাড়ি ডানদিকে আধা smashed হয়ে গেলেও তিনি আল্লাহর রহমতে প্রাণে বেঁচে যান৷ কিন্তু তাঁর মাথার ওপর আঘাত লাগায় তাঁর ঘুম চলে যায়৷ বঙ্গবন্ধু তাঁকে চিকিৎসার্থে লন্ডনে প্রেরণ করেন৷ অনুরূপভাবে ১৫ই আগস্টের রাত দশটায় বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততম সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷ তিনি গণভবন (রমনা পার্ক সংলগ্ন) থেকে রাত একটায় যখন তার লাল টয়োটা গাড়িতে শের-ই-বাংলা নগরের বাসায় ফিরছিলেন, তখন জাতীয় সংসদের উত্তর দিকের রোডে তার গাড়ির ওপর অজ্ঞাত একটি জিপ তুলে দেবার চেষ্টা করা হয়৷ উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর পরম আস্থাভাজন কর্নেলকে গাড়ি এক্সিডেন্টে হত্যা করা৷ ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিন রুহুল কুদ্দুস সাহেব লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে বেঁচে যান৷ আর খুনিদের হাতে কর্নেল জামিলকে নৃশংসভাবে প্রাণ দিতে হয়৷ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মূখ্য সচিব পি.এন. হাকসার লন্ডন থেকে ‘৭৫-এর সেপ্টেম্বর মাসে রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে দিল্লি নিয়ে যান তাঁকে ব্রিফ করার জন্য৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্ত প্রেরণার উৎস শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সাক্ষাতের প্রথমেই তাঁর কাছে বার বার প্রশ্ন করে জানতে চান যে, “শেখ মুজিব কোন সাহায্য চাননি কেন? সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সাহায্যের জন্য শেখ মুজিব তাঁর কাছে কোন ‘মেসেজ’ দেননি কেন?”
বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস দিল্লিতে ৪ দিন প্রায় ৮ ঘণ্টা শ্রীমতি গান্ধীকে ব্রিফ করেন৷ তিনি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মোগল সম্রাটদের প্যালেসের আদলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তলা দিয়ে একটা গোপন সুড়ঙ্গ (গোপনীয়তার সাথে যে সুড়ঙ্গ করে দেবার কথা ছিল চেকোস্লোভাকিয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও লেবারদের) করার এবং তাঁর বাড়ির আধা কিলোমিটার দূরে আদর্শ কলেজে একটি মিনি রক্ষীবাহিনী ক্যাম্প করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল বলে শ্রীমতি গান্ধীকে জানান৷ ইন্দিরা গান্ধী ‘৭৪ সালে তা জানতেন৷ তিনি আগ্রহের সাথে জানতে চান, সে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়নি কেন? জনাব রুহুল কুদ্দুস জনান যে, উক্ত দুই গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু এই বলে পরিকল্পনাগুলো বাতিল করে দেন যে, “মৃত্যু ভয়ে আমি যদি কাতর হই, তাহলে বীর প্রসবিনী বঙ্গজননীর গর্ভে আর কোন সাহসী বীর সন্তান পয়দা হবে না!”
বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব ৬ দফার রচয়িতা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততম সহচর জনাব রুহুল কুদ্দুসের মুখের বয়ান শেষ না হতেই ভারতরত্ন, বিশ্বের সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেটসম্যান শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দু’হাত এক করে কপালে তুলে বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার প্রতি সশ্রদ্ধ
নমস্কার করেন৷
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ব্রিফিংকালে মামা তাঁকে আরও বলেছিলেন যে, ১৪ই আগস্ট বাংলাদেশ সময় আনুমানিক রাত ১১টা অর্থাৎ ১৫ই আগস্টের আগের রাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই লন্ডনে আমার মামাকে ফোন করেছিলেন৷ মামীর সাথেও কথা বলেছিলেন৷ মামাকে বঙ্গবন্ধু বার বার জলদি চলে আসার জন্য বলছিলেন৷ মামা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি হুকুম দিচ্ছেন, চলে আসবো৷ আপনার হুকুম আমার কাছে সব৷ তবে এতবার বলছেন কেন? “বঙ্গবন্ধু হঠাৎ চুপ করে থাকলেন৷ প্রায় এক মিনিট/দেড় মিনিট সেই long distance call hold করে রাখলেন৷ সেটা চিন্তা করে মামা দু’বার “হ্যালো, হ্যালো, আপনি কি ফোনে আছেন” জিজ্ঞাসা করতেই বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, এতবার বলছি এজন্য, এখানে অনেক কিছু ঘটতে যাচ্ছে৷ তুমি এসে একটু হাল ধরো৷ আমার পাশে থাকো…৷”
মামা তাঁকে চেনেন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের আমল থেকে৷ তাঁকে দেখেছেন হিমালয়ের মতো৷ শুনেছেন বজ্রকণ্ঠস্বর৷ কিন্তু ১৪ই আগস্টের রাতের কণ্ঠস্বর তাঁর কাছে অচেনা মনে হলো৷ তিনি উদ্বিগ্নচিত্তে বলে ফেললেন, “কর্নেল জামিল কি ডি.জি.এফ.আই-এর ডিজি হিসেবে টেকওভার করেছে?” তিনি বললেন: “হ্যাঁ, করেছে৷” মামা বললেন: “জিয়া-শফিউল্লাহ দ্বন্দ্বের এবং তাজউদ্দীন সাহেব ও মোশতাকের দ্বন্দ্বের অবসান না হলে সব সময় আপনাকে টেনশনের মধ্যে থাকতে হবে৷” বঙ্গবন্ধু বললেন, “সব হবে, তুমি কাল-পরশু চলে আসো তো৷ না আসলে আমাকে কিন্তু আর পাবা না!”
মামা বললেন, “আমি যেদিন ঢাকা থেকে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডনে আসি, সে রাতে ৩২ নম্বরে নিচে নেমে এসে আপনি আমার পরিবারের সকলের সামনে আমার নাম ধরে বলেছিলেন, “আর হয় তো দেখা হবে না৷ এটাই শেষ দেখা, ধরে নিও৷ এসব কথা কেন বলেন আপনি?”
বঙ্গবন্ধু বললেন: “এবার সত্যি সত্যি বলছি, তুমি যদি আজকালের মধ্যে না আসো, তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না৷ তুমি আমাকে ভালবেসে অনেক করেছো৷ বাঙালির জন্য অনেক জুলুম সয়েছো৷ তুমি আমার সাথে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছো৷ যদি ভুল ত্রুটি করে থাকি মাফ করে দিও৷” বঙ্গবন্ধুর কথা ধরে এলো৷ মামা অঝোর নয়নে কাঁদলেন৷ লাইন কেটে গেল৷ আরও কিছু পরে আবার বঙ্গবন্ধুর ফোন৷ ধরলেন মামী৷ বঙ্গবন্ধু মামীকে চিনতেন৷ নাম ধরে বললেন: “হামিদা ওকে নিয়ে কালই চলে এসো”৷ মামী বললেন: “ওঁনার শরীরটা এখনো খারাপ৷” বঙ্গবন্ধু বললেন: “ওষুধপত্র নিয়ে চলে এসো৷ এখানে কাউকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না৷”
বঙ্গবন্ধুর ফোন ছেড়ে মামী সব বললেন মামাকে৷ মামা বললেন, “প্রস্তুত হও৷ দুই-এক দিনের মধ্যে চলে যাই৷ যেতে হবে৷ তাজউদ্দীন সাহেব কেবিনেটে না থাকায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা ওয়াক ওভার পেয়ে যাচ্ছে৷ এবার ফিরে, সবার আগে ৩২ নম্বরের আন্ডার গ্রাউন্ড টানেলটা করতে হবে৷”
বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় ফোন আসায় আমার মামা বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ডি.জি.এফ.আই-এর ডি.জি. কর্নেল জামিলকে ফোন করলেন৷ তখন বাংলাদেশ সময় রাত পৌনে বারোটা হবে৷ কর্নেল জামিলকে ফোনে পেয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন: “তুমি ডি.জি.এফ.আই’র পুরো দায়িত্ব বুঝে নিয়েছো?” কর্নেল জামিল উত্তরে বললেন: আজই নিলাম স্যার, তবে কয়েকটি আয়রন সেফের চাবি আমাকে এখনো বুঝিয়ে দেয়া হয়নি৷ তার কথা শুনে মামা বিস্মিত হয়ে গেলেন এবং তাঁকে বললেন: “এগুলো ভালো লক্ষণ না৷ এটা তুমি বুঝতে পারছো না কেন? পরদিন সকালেই অফিসের TOP SECRET সকল ফাইল ও আয়রন সেফের সকল TOP SECRET রিপোর্ট তোমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে৷ এগুলো হস্তগত ও বাস্তবায়িত করে আমাকে ফোন করে জানাবে৷ বঙ্গবন্ধুর সাথে এইমাত্র কথা বলে তোমাকে এই নির্দেশ আমি দিচ্ছি৷ আমি ২/১ দিনের মধ্যে দেশে ফিরে দেখবো চার্জ নিতে তোমার এত দেরি হলো কেন? “something is very abnormal…” কর্নেল জামিল উত্তরে শুধু ছোট করে জানালো, “স্যার কর্নেল রউফ (পাকিস্তান প্রত্যাগত) আমাকে চার্জ দিতে চাচ্ছিল না, time kill করছিল এবং তার delay tactics এ একজন সিনিয়র অফিসার জড়িত আছে৷ আপনি ফিরে এলে স্যার, আপনাকে আমি সামনা- সামনি বলবো৷” (সেই সিনিয়র জেনারেল ছিলেন জেনারেল জিয়া)৷
কিন্তু উক্ত গোপন টানেল গড়ে তোলার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনীহা ও বাতিলের নির্দেশের পরেও মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়ের সচিবরা রুহুল কুদ্দুস মামার সাথে গোপন বৈঠক করে উক্ত টানেল নির্মাণের আবশ্যকতা উপলদ্ধি করেন এবং কাজ এগিয়ে নেন৷ সে কারণে রুহুল কুদ্দস সাহেব টানেল নির্মাণের কার্যক্রম চালু করে দেন৷ চেকোস্লোভাকিয়া থেকে প্রয়োজনীয় আধুনিক খনন সরঞ্জামাদি এবং ইস্পাতের অটো টানেলের বডি ঢাকায় এসে পৌঁছে৷ ‘৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলে মোশতাকের অনুগত পুলিশ সার্ভিসের সাবেক আইজি আব্দুর রহিমকে রাষ্ট্রপতির সচিব পদে নিয়োগ দিলে সব অঘটন ঘটতে থাকে৷ রুহুল কুদ্দুস মামাসহ মুজিবনগর সরকারের সকল সচিব রহিমের নিয়োগের বিরোধীতা করেন৷ কারণ, ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে রহিম সি.আই.এ-র বৃত্তি নিয়ে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে ট্রেনিং করতে যায়৷ সেখান থেকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেনি৷ রহিম প্রমাণ করে যে, সে সি.আই.এ-র চরম ও পরম আস্থাভাজন ও অনুগত৷ কিন্তু মন্ত্রিপরিষদে মোশতাক গ্রুপের প্রস্তাবের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ হোসেন সাহেব সম্মতি দেন৷ ফলে, মামারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন৷ রহিম দুর্দান্ত

পৃষ্ঠা: ৮৫
সাহসিকতার সাথে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ে সচিব পদে যোগদানের সাথে সাথে রাষ্ট্রের “TOP SECRET” ফাইলে তার অনুপ্রবেশ ঘটে৷ তিনি উক্ত টানেলের তথ্য জেনে যান৷ কিন্তু কোন অগ্রগতির বিস্তারিত না জানতে পেরেও তিনি যোগদান করার এক সপ্তাহের মধ্যে বিদেশি দূতদের জানিয়ে দেন যে, “Sheikh Mujib became unpopular and constructing tunnel under his house to flee out of country…” ভিয়েতনাম রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে এ সংবাদ বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছামাত্র বঙ্গবন্ধু ক্রুদ্ধ হন এবং রুহুল কুদ্দুস মামাকে ডেকে তাঁর অসন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেন৷ মামা বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে ব্যর্থ হন৷ কিন্তু তবু বলেন, “আপনি নিহত হলে বাংলাদেশ বিশ্বে এতিম হয়ে যাবে৷ বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশের পশ্চাতে পড়ে যাবে৷ ৩০ লক্ষ শহীদের দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে পাকিস্তান ব্যঙ্গ করে বলবে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে তোমরা বিশ্বের হীন ও নিকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছো৷ আপনাকে বাঁচিয়ে না রাখতে পারলে বাংলাদেশের অপমৃত্যু হবে৷” কিন্তু বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, “কিন্তু টানেলের খবর জানাজানি হবার পর তোমরা যদি টানেল করো তাহলে আমার অপমৃত্যু হবে৷”
বঙ্গবন্ধুর এমন ক্ষুরধার বক্তব্যের মুখে রুহুল কুদ্দুস সাহেব টানেল প্রকল্পের কার্যক্রম বাতিল করে দেন৷ রুমানিয়া থেকে বিমানে আনা সমস্ত সামগ্রী রুমানিয়ায় ফেরত চলে যায়৷ কিন্তু লন্ডনে বসে ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা শুনলেন, তখন তিনি বুঝলেন যে, উক্ত টানেল নির্মাণের প্রকল্প বাতিল করা তার কত বড় ভুল হয়েছিল৷ (১৫ই আগস্টে আক্রমণের সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু যখন সেনা প্রধানকে ফোন করেছিলেন, তখন জেনারেল শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “Can you get out of the house sir…” টানেল থাকলে তিনি বেরিয়ে যেতে পারতেন নিশ্চয়ই৷)
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের মর্মবেদনায় ছটফট করতে করতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক শওকত ওসমান সাহেব কলকাতায় গিয়ে জনমত সৃষ্টি করেন এবং অন্যান্যদের সহায়তায় খুনিদের বিচারের জন্য কলকাতায় আন্তর্জাতিক আদালত বসানোর উদ্যোগ নেন৷ আন্তর্জাতিক জুরি সমন্বয়ে গঠিত উক্ত আদালত খুনিদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে তাদের প্রত্যেকের নামে নামে ফাঁসির দণ্ড ঘোষণা করে৷ সেই শওকত ওসমান সাহেব টিএসসি’র একটি অনুষ্ঠানে আমাকে তাঁর কলম উপহার দিয়ে বলেছিলেন: “মুসা, নবীর মতো নমরুদ-ফেরাউনদের বিনাশে আমার এই কলম মুসা সাদিক দু’ধারি তলোয়ারের মতো তুমি চালাবে৷” তিনি যখন বারডেমে অসুস্থ, তখন দেখতে গেলে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে একটা কথা খুব আফসোস করে তিনি বলেছিলেন, “দেখো বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন পাকিস্তানিদের নির্যাতন, অত্যাচার, হুলিয়া, কারাবাসে কেটে গেল৷ তবু পাকিস্তানিদের গোলামী থেকে মুক্তির আন্দোলন-সংগ্রামে এক দণ্ড তিনি বিশ্রাম নেননি৷ এক দণ্ড ওরা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি৷ ‘৭১-এ পাকিস্তানে তাঁর সেলের পাশে তাঁর কবরও খুড়েছিল ওরা৷ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মতো তাঁর জীবন আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল৷ সেই বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি সিমারেরা কী করে হত্যা করলো! তার ওপর বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর আগে জেনে গেলেন তাঁর আদরের শেখ কামালকে গুলি করে ওরা মেরে নিচে ফেলে রেখেছে!!”
বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা শওকত ওসমান সাহেব এর ক’দিন পরে বারডেম হাসপাতাল থেকে ফোন দিলেন৷ ফোনে তাঁর করুণ আর্তি ও কান্না ভেসে এলো: “মুসা সাদিক, হাসপাতালে আশি হাজার টাকার বিল হয়েছে৷ হাসিনাকে এতবার চিঠি লিখেছি, লোক পাঠাচ্ছি৷ কোনো উত্তর পাচ্ছি না৷ যে লোক পাঠাচ্ছি, সেও তার কাছে পৌঁছাতে পারছে না৷ শুনছি আমার চিঠি সে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়৷ আমার এখন কী উপায়৷ মুসা তুমি আমাকে বাঁচাও৷” আমি তাকে কথা দিলাম৷ ওই দিনেই এ.জি.বি-তে গিয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বলে আমার ভবিষ্য তহবিল থেকে আশি হাজার টাকার ওপেন চেক নিয়ে পরদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের থেকে ভাঙ্গিয়ে বারডেমের সাততলায় গিয়ে ওনার হাতে আশি হাজার টাকা তুলে দিলাম৷ উঁনি আমার দু’হাত তাঁর মুখে নিয়ে চেপে ধরলেন৷ তাঁর অশ্রুতে আমার হাত ভিজে গেল৷ সেখানে বারডেমের এ্যাকাউন্টস-এর লোক এসে বললো যে, ওইদিন রিলিজ হতে হলে তাঁর আরও আট হাজার টাকা লাগবে৷ আমার পকেটে তখন মাত্র দু’শত টাকা৷ বাড়িতেও আমার কোন টাকা নেই৷ ব্যাংক তো শূন্য৷ সে সময় শওকত সাহেব কী হবে, কী হবে, করে কাঁদতে লাগলেন৷ বললেন: “আমার পুত্ররা সব… সন্তান৷” তৎক্ষণাৎ‍ সেখানে এসে হাজির বারডেম-এর প্রতিষ্ঠাতার জামাতা ডা. আজাদ৷ তাঁর কাছে সব কথা বলে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলে ডা. আজাদ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: “স্যার উনি আপনার কী হন?” শওকত সাহেব বললেন: “আমি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে লিখি, সেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কলম ধরে যুদ্ধ করে৷ আমরা দু’জনে একই পথের যাত্রী, আমরা একে অন্যের সমব্যথি৷” উত্তর শুনে ডা. আজাদ বললেন: “স্যার উঁনি আপনার কেউ না হয়ে এত করলেন, বাকি আট হাজার টাকা আমি আপনার ছাত্র হিসেবে দিয়ে দিলাম৷” (ঢাকা কলেজে ওনার ছাত্র ছিলেন ডা. আজাদ৷) শওকত হোসেন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: “বঙ্গবন্ধু লোক চিনতেন, শেখ হাসিনা লোক চিনতে ভুল করেন৷ আমার চিঠিটা পর্যন্ত তাঁর কাছে পৌঁছাতে দেয় না, তার চারপাশে কারা তারা?”
বেদনাদীর্ণ বক্ষে তাঁর উচ্চারিত নির্মম সত্য কথাগুলো শুনতে শুনতে বিদায় নিলাম৷ অসুস্থ শওকত সাহেবের মর্মযাতনা ও মনোকষ্ট আরো বাড়িয়ে দিয়ে উত্তর দিতে পারলাম না যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা এবং ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজরা তাঁকে ঘিরে রেখেছে! তারচেয়ে অধিক সত্য খুনি মোশতাককে বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি!! আর পারেননি বলেই ১৫ই আগস্টের সেই কারবালার ন্যায় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল বাংলাদেশে৷ বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী সব পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো, আর চির জনমের মতো বাঙালি জাতির কপালে কলঙ্কের কালো তিলক এঁকে দিয়ে গেল পাঞ্জাবিদের ঔরসজাত গুটিকয় বিশ্বাসঘাতক৷
রক্ষীবাহিনীর এক মহান বীর যোদ্ধা আমার সামনে অশ্রুসিক্ত নয়নে বার বার চোখ মুছতে মুছতে ১৫ই আগস্টের সেই মর্মান্তিক বেদনাদায়ক রক্তাক্ত অধ্যায়ের যবনিকা উত্তোলন করেছিলেন৷ যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের চিবিয়ে খেতে চেয়েছিলেন৷ তাঁর নাম ৭১-এর রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা লে. কর্নেল (অব:) মো: আলমগীর হাওলাদার৷
১৫ই আগস্টের সেই ট্রাজেডি স্মরণ করে রক্ষীবাহিনীর লে. কর্নেল (অব:) মো: আলমগীর হাওলাদার বললেন, “সে সময় আমি পাবনায় অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর লিডার ছিলাম৷ বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর রেডিওতে প্রচারের সাথে সাথে আমার ফোর্স আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিল৷ আমি পাবনা জেলার কমান্ড নিয়ে নিলাম৷ পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলে নিলাম এবং পাবনার ডি.সি. এবং ডি.এস.পি’র সাথে কনফারেন্স করলাম (এসপি তখন ঢাকায় ছিলেন)৷ বেসামরিক প্রশাসনকে বললাম, আপনারা অপেক্ষা করেন এবং আমার পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত পাবনার প্রশাসন ব্যবস্থা রক্ষীবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে৷ আদেশ-নিষেধ সবকিছু রক্ষীবাহিনীর জেলা কমান্ডার হিসেবে আমার কাছ থেকে নিবেন৷ আমার কমান্ডে ১০৪০ জন রক্ষীবাহিনী ছিল, তাদের নিয়ে ঢাকা মার্চ করার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছালাম৷ সেখানে পৌঁছে ঘাটে অবস্থানরত যে কয়টা ফেরী ছিল, সব রক্ষীবাহিনীর দখলে নিলাম৷”
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঢাকার বাইরে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর লিডাররা ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন বলে তথ্য দিয়ে তিনি বললেন, “এ সময় রাজশাহীতে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর লিডার লুৎফর রহমানের সাথে আমার কথা হলো৷ তিনি ঢাকার খুনিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার আহ্বান জানালেন এবং রাজশাহী রেডিও তিনি দখল করে নিয়েছেন বলে আমাকে জানালেন৷ আমার ন্যায় তিনিও তাঁর অধীনস্থ প্রায় ১ হাজার ফোর্স নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন৷ অপরদিকে, রক্ষীবাহিনীর খুলনা জোনাল হেড কোয়ার্টার থেকে লিডার বেলায়েত হোসেন, লিডার নীতিভূষণ সাহা এবং চট্টগ্রাম থেকে লিডার আকরাম, লিডার লায়েক আলম চন্দন, লিডার রাজ্জাক, রংপুর থেকে লিডার রাখাল চন্দ্র সাহা, ঝিনাইদহ থেকে লিডার মিজানুর রহমান তাঁদের নিজ নিজ ফোর্স নিয়ে ঢাকা অভিমুখে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল৷ বস্তুত ঢাকার বাইরে অবস্থানরত প্রায় ১৪ হাজার রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাংলার মাটিতে জীবন্ত পুঁতে ফেলার জন্য ঢাকা অভিমুখে যার যা অস্ত্র আছে তা নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়৷”
বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল মো: আলমগীর হাওলাদার আরও বললেন, “সে সময় রক্ষীবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ২২ হাজার৷ তারমধ্যে ঢাকায় ছিল ৪ হাজারের মতো৷ সাভার হেড কোয়ার্টারে তখন ডাইরেক্টর (অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দিন, ডাইরেক্টর জেনারেল-এর চার্জে ছিলেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনিও সেদিন ঢাকায় না থেকে বগুড়ায় ছিলেন৷ যেটা সামরিক বিধান অনুযায়ী কখনই তার থাকার কথা ছিল না৷ কারণ, সেদিন রক্ষীবাহিনীর ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ছিলেন লন্ডনে৷ তাঁর অনুপস্থিতিতে ও তাঁর বিদেশে অবস্থানকালে তাঁর পরিবর্তে রক্ষীবাহিনীর সিনিয়র মোস্ট অফিসার ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দিনের ঢাকার বাইরে থাকা সামরিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ছিল৷ ১৫ই আগস্টের সকালে সাভারে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ডেপুটি ডাইরেক্টর আনোয়ারুল আলম শহীদ ও ডেপুটি ডাইরেক্টর সারওয়ার মোল্লা, লিডার লিয়াকত প্রমুখরা৷ তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন রক্ষীবাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশের৷ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দায়িত্ব প্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতার নির্দেশের৷ কিন্তু তিনি সেই নির্দেশ দিতে অস্বীকার করেন৷”
কর্নেল আলমগীর ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বলেছিলেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে খুনিরা৷ রক্ষীবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর কলিজার টুকরা৷ তাঁরা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সন্তান৷ পিতাকে হত্যা করেছে খুনি৷ সেই খুনিকে রুখে দাঁড়াতে কার আদেশ লাগে? কার আদেশের অপেক্ষা করবে সন্তান? ঢাকার বাইরের সমস্ত রক্ষীবাহিনীর লিডাররা রক্ষীবাহিনীর বীর জওয়ানদের নিয়ে ঢাকার দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম৷ কিন্তু আমাদের বার বার নিষেধ করা হলো৷ সাভার হেড কোয়ার্টার থেকে ডেপুটি ডাইরেক্টর (প্রশাসন) মেজর হাসান আমাকে বললো, “Don’t move, wait for further order.” আমি বললাম, “We can’t wait, we will take revenge. We will eat the flesh and drink the blood of the killers of Bangabandhu.” মেজর হাসান বললেন, “Leader Alamgir, you are putting the lives of all the Rakkhi Bahini at risk. Don’t move further, don’t cross your limit. Wait for our order. “
লে. কর্নেল মো: আলমগীর হাওলাদার তাঁর চরম হতাশা ব্যক্ত করে বললেন, “সাভার হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে পরে জানানো হলো যে ডেপুটি ডাইরেক্টর সারওয়ার মোল্লা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিবের কাছ থেকে কোনো নির্দেশ পাচ্ছেন না৷ তিনি কোনো নির্দেশ দিতে রাজি হচ্ছেন না৷ এখন রক্ষীবাহিনী ঢাকায় এসে পৌঁছালে সেনাবাহিনীর সাথে তাদের যুদ্ধ হবে৷ কারণ, তিন বাহিনী প্রধান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পক্ষে রেডিওতে সমর্থন ঘোষণা করেছেন৷ রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডাইরেক্টর সারওয়ার মোল্লা ও আরও একজন ডেপুটি ডাইরেক্টর আনোয়ারুল আলম শহীদও খুনিদের পক্ষে রেডিও’তে সমর্থন ঘোষণা করেছেন৷ ফলে, ঢাকার বাইরে অবস্থানরত ১৮ হাজার রক্ষীবাহিনী যে তাদের সমরাস্ত্র নিয়ে ঢাকার খুনিদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে তাদেরকে এ কথা বলে থামিয়ে দেয়া হয়৷”
তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি রক্ষীবাহিনীর আনুগত্যের নিদর্শন তুলে ধরে বলেছিলেন যে, “তিন-চার দিনের মধ্যে রক্ষীবাহিনী যখন খুনিদের নির্দেশ অনুযায়ী আত্মসমর্পন করে, তখনও সাভারের ও সারা দেশের রক্ষীবাহিনীর ৮০% সৈনিক ও কর্মকর্তা তা মেনে নিতে পারেনি৷ সাভারের হেড কোয়ার্টারে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক এই আত্মসমর্পণের প্রতিবাদ করে আত্মহত্যা করেন৷ নিজেদের অস্ত্রের নল গলায় ঠেকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ট্রিগার টিপে নিজেদের মস্তক উড়িয়ে দেন৷ মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের একজন মহান বীরযোদ্ধা লিখে রেখে গেছেন, “বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কাছে আত্মসমর্পন করে অস্ত্র সংবরণ করার চেয়ে, মৃত্যুবরণ করা অনেক শ্রেয়৷ বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে, বাংলাদেশের জন্ম হতো না৷ বাঙালি জাতি স্বাধীন হতো না৷ বাঙালি জাতি চিরকাল পাকিস্তানিদের দাসী-বান্দি হয়ে থাকতো৷ বঙ্গবন্ধুকে যে দেশের মাটিতে খুন করা হয়েছে, সেই দেশের মাটিতে খুনিদের সাথে আমরা বেঁচে থাকতে চাই না৷”
কর্নেল আলমগীর সেদিনের রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের ঘটনার বিবরণ দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর খুনি

পৃষ্ঠা: ৯০
ডালিমের কণ্ঠে রেডিওতে প্রচার হবার সাথে সাথে সাভার রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে অবস্থানরত বীর জওয়ানরা ৭১-এর ন্যায় শহীদ হয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে৷ যাঁর যাঁর হাতিয়ার তুলে নেয়৷ তাঁদেরকে নিয়ে জুনিয়র অফিসাররা সাভার হেড কোয়ার্টারের সিনিয়র মোস্ট ২ জন ডেপুটি ডাইরেক্টর (অপারেশন) আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সারওয়ার মোল্লার কাছে গিয়ে বলে যে, তাঁরা বৃষ্টির মতো গুলি করতে করতে ৩২ নম্বর দখল করে নেবে৷ যে ৩২ নম্বর থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই ৩২ নম্বরের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সন্তান এই রক্ষীবাহিনী কমান্ড পোস্ট স্থাপন করবে৷ সারা ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের খুঁজে বের করে এনে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে তাদেরকে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে৷ রক্ষীবাহিনীর জুনিয়র অফিসার ও জওয়ানরা যুদ্ধ সাজে প্রস্তুত হয়ে “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগান দিয়ে ১৫ই আগস্টের সকালে সাভার হেড কোয়ার্টার কাঁপিয়ে তুলেছিল৷ কিন্তু রক্ষীবাহিনীর বিদেশে অবস্থানরত ডাইরেক্টর জেনারেল নূরুজ্জামান এবং ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দিনের রহস্যময় বগুড়ায় অবস্থান এবং সাভারে উপস্থিত উক্ত ২ ডেপুটি ডাইরেক্টর- এর কাপুরুষতার কারণে রণসজ্জায় সজ্জিত রক্ষীবাহিনীর বীর জওয়ানরা সাভার থেকে বেরুবার অনুমতি পায়নি৷
অপরদিকে, আরও জঘন্য কাপুরুষতার পরিচয় দেয় বঙ্গবন্ধুর অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা৷ ১৫ই আগস্টের আগে থেকেই শের-ই-বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর লিডার সাহেব আলী ও লিডার পি. কে. রায় ১৫ই আগস্ট ঘটনা ঘটার সাথে সাথে প্রভাতে ধানমন্ডি গিয়ে তার এক রাজনৈতিক নেতাকে শের-ই-বাংলা নগরের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন৷ ১৫ই আগস্টের প্রভাতে সেখানে রক্ষীবাহিনীর অফিসার মেসে এসে তিনি রক্ষীবাহিনীর অশ্রুসজল আকুতি- মিনতির পরেও সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ দিতে রাজি হননি এবং তিনি রক্ষীবাহিনীর গাড়িতে তার ধানমন্ডির বাসায় তাকে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন৷ ফলে, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যখন জানতে পারে যে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেউ রক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করছেন না ও কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না, তখন তারা কর্নেল ফারুকের নেতৃত্বে মাইক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে ও সাভারে এসে ঘোষণা দেয় যে, রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীর সাথে মার্জ (একীভূত) করা হয়েছে৷ জেনারেল জিয়ার নির্দেশে নৌ-বাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম.এইচ. খান এবং জেনারেল জিয়ার অনুগত হেড কোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমেদ খান বীর উত্তম সাভারে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে এসে রক্ষীবাহিনীর সিনিয়র লিডারদের ভবিষ্যতের নানা প্রলোভন দিয়ে হাত করে ফেলে৷ লর্ড ক্লাইভ যেভাবে ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর মীর জাফরসহ অন্যান্য অফিসারদের নানা প্রলোভন দিয়ে হাত করে ফেলেছিল৷ অপরদিকে, আর্মি হেড কোয়ার্টার খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় এবং তিন বাহিনী প্রধান রেডিও’তে খুনিদের সাথে যোগদানের ঘোষণা দেবার ৩ দিনের মাথায় সাভার ও শের-ই-বাংলা নগরের রক্ষীবাহিনী আত্মসমর্পন করে৷ “
আওয়ামী লীগ নেতাদের উপরোক্ত cowardish episode সম্পর্কে তদানীন্তন সাভার হেড কোয়ার্টারে রক্ষীবাহিনীর মেজর এ. আর. শরীফ (পরবর্তী কালে ব্রিগেডিয়ার এবং বেগম জিয়া কর্তৃক চাকরিচ্যূত) কিছুই জানতেন না৷ তাই তিনি আমাকে ইঙ্গিত করেছিলেন যে, ১৫ই আগস্টে আর্মি এইচ. কিউ এবং ডিফেন্স মিনিস্ট্রি কেন collapse করে গিয়েছিল সে রহস্য উদ্ঘাটন করা হলেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয় সুস্পষ্ট হবে৷ তিনি আরও বলেছিলেন যে, মেজর ডালিম-ফারুকদের পক্ষে সকাল আটটার দিকে সাভারের রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরের মুখে ট্যাঙ্ক নিয়ে মহড়া ও মাইকিং করা হয় যে, “রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর সাথে merge করা হয়েছে৷ সেনাবাহিনী বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করেছে৷ তিন বাহিনী প্রধান সম্মিলিতভাবে সেনাবাহিনীর ও বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে৷ সমগ্র দেশকে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে৷ রক্ষীবাহিনীর সকল সদস্য এখন সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য৷ সেনা সদর দপ্তরের নির্দেশ আপনারা পালন করুন এবং স্ব স্ব অবস্থানে অপেক্ষা করুন৷ নির্দেশ অমান্যকারীর ওপর ট্যাঙ্ক বাহিনী, সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী আঘাত করবে…৷ আপনারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন…৷”
তিনি বলেছিলেন: “রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শোনার সাথে সাথে আমার রক্ষীবাহিনীর এক সৈনিক নিজের মাথায় রাইফেলের গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করে৷”
কিন্তু ট্যাঙ্ক যে ভুয়া ট্যাঙ্ক ছিল, তাতে যে কোন গোলা ছিল না, সে তথ্য রক্ষীবাহিনী বা সেনাবাহিনীর কেউ জানতো না৷ জানতেন মাত্র ৪ জন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান, সি.জি.এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ডি.জি.এফ.আই.’ এর ডি.জি. কর্নেল আব্দুর রউফ৷ যাঁদের একজন ব্যতীত সকলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন৷ এমনকি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফোর্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত সি.জি.এস-কে ৩২ নম্বরে অবস্থানরত বিদ্রোহী বাহিনীকে attack করতে আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ যখন অর্ডার দেন, তখন কর্নেল শাফায়াত জামিলকে নিয়ে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ফোর্সসহ সি.জি.এস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ শের-ই-বাংলা নগর ঘুরে এসে বলেছিলেন যে, “তাদেরকে attack করে defeat দেয়া সম্ভব নয়!!” আমি কোড “do or die” কীভাবে তাঁরা ভুলে গেলেন? তাঁরা সংবিধানকে কিভাবে ভুলে গেলেন? সেনাবাহিনীর গৌরবময় অফিসার পদে যোগদানকালে দেশের সংবিধান ও দেশের প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় তারা জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত মর্মে পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে যে শপথ বাক্য উচ্চারণ করেছেন, তা ১৫ আগস্টে তাঁরা বিস্মৃত হয়ে গেলেন?
অপরদিকে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত রুখতে বঙ্গবন্ধুর এম.এস.পি কর্নেল জামিলকে ডি.জি.এফ.আই.’এর ডি.জি. পদে নিয়োগ দান করা হলেও তদানীন্তন ডি.জি. কর্নেল আব্দুর রউফ তাঁকে দায়িত্ব ভার বুঝিয়ে দিতে গড়িমসি করেন ও সময় ক্ষেপণ করে খুনিদের ষড়যন্ত্র- চক্রান্তকে দ্রুত এগিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন৷ এমনকি, কর্নেল জামিলের নতুন পদে যোগদান উপলক্ষে ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাসসমূহে কর্মরত ডিফেন্স এটাচীদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েও সে আমন্ত্রণপত্র কর্নেল জামিল প্রত্যাহার করে নেন৷ কারণ, তখনো সাবেক ডি.জি. আব্দুর রউফ দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিচ্ছেন না৷ তদানীন্তন ডি.জি. কর্নেল আব্দুর রউফ নানা অজুহাতে তাঁর দায়িত্ব হস্তান্তরে কয়েক সপ্তাহ বিলম্ব করেন৷ এক অজুহাত দেখিয়ে তিনি ছুটি নেন এবং বিদেশ গমন করেন৷ তার বিদেশ গমনের ফাইল জেনারেল জিয়াউর রহমান সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে হাতে হাতে অনুমোদন করে নিয়ে যান৷ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত কর্নেল জামিলের কাছে যথাসময়ে, এমনকি নির্মম সেই হত্যার দুই-একদিন পূর্বেও কর্নেল রউফ ডি.জি.এফ.আই-এর দায়িত্ব তুলে দিলে খুনিদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সব ফাঁস হয়ে যেত এবং খুনিরা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তাদের প্রাপ্য পেয়ে যেতো৷ ডি.জি. কর্নেল আব্দুর রউফ নানা টালবাহানা ও ছল-ছুতা করে দুই- তিন সপ্তাহের অধিক তার বদলী আদেশের বাস্তবায়ন বিলম্বিত করেন ও বিদেশে অবস্থান করতে থাকেন৷ এই অস্বাভাবিক বিলম্বিতকরণের প্রেক্ষাপটে ও সুযোগে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র দ্রুততর করার ও এগিয়ে আনার প্রস্তুতিতে কর্নেল রউফ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন৷ অতঃপর যেদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট বিকেলে তিনি যখন ডি.জি.এফ.আই-এর দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত এম.এস.পি কর্নেল জামিলের হাতে হস্তান্তর করেন, তখন কর্নেল রউফ শতভাগ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, কর্নেল জামিল ডি.জি.এফ.আই-এর network of intelligence and counter-intelligence তার হাতের মুঠোয় নেবার সময় পাবেন না৷ পরিণতিতে ১৫ আগস্টের প্রভাত সূর্যের মুখ দেখার পূর্বেই অর্থাৎ তার দায়িত্ব হস্তান্তরের ১০ ঘণ্টার মাথায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হবেন৷ ডি.জি.এফ.আই-এর intelligence এর ৬০ জন এবং counter-intelligence এর ৬০ জন ধুরন্ধর গোয়েন্দা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বাইরে এবং ঢাকার স্পর্শকাতর স্থানে ও অবস্থানে ২৪ ঘণ্টা ধরে তিন ভাগে ডিউটি করে৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৫ আগস্ট রাতে ৬টি ট্যাঙ্ক বেরিয়ে গেল, আর তারা সব চোখে ঠুলি পরেছিল বলে ডি.জি.এফ.আই.’র কোনো গোয়েন্দা অফিসার তা দেখতে পায়নি বললে কোনো অন্ধ ফকিরও তা বিশ্বাস করবে না৷
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদের বদলী আদেশ, বিশেষ করে, ডি.জি., ডি.জি.এফ.আই-এর মতো চরম স্পর্শকাতর পদের বদলী আদেশ নানা ছল-ছুতায় অমান্য করার ও অস্বাভাবিক সময় ক্ষেপণের বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী প্রধান, উপ-প্রধান এবং আর্মি এইচ.কিউ. উদাসীন ছিলেন৷ এভাবে তাদের সকলের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৫ আগস্টের সকালে চিফ অব স্টাফের হেড কোয়ার্টারের কমান্ড ভেঙে পড়ে৷ সি.জি.এস. জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে (যার অধীনে ৩টি ব্যাটালিয়ন নিয়োজিত ছিল) দেয়া আর্মি চিফ-এর ডাইরেক্ট অর্ডার “attack & destroy the killers of the President” তামিল না করে ফিরে আসার সাথে সাথে আর্মি চিফ জেনারেল শফিউল্লাহ কমান্ড নিজের হাতে তুলে নিতে পারতেন৷ কিন্তু তাঁর আদেশ তামিল করার মতো একজন অফিসার বা একজন সৈনিককেও তার চারপাশের কোথাও পাননি৷ এ বিষয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “সেদিন আমি আমার চারপাশের বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলাম৷ বঙ্গবন্ধু নিহত হবার সংবাদ নিশ্চিত হয়ে আমার চারপাশের সকলে খুনিদের পক্ষে ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের পক্ষে চলে যায়৷ তাদের সকলের বিশ্বাসঘাতকতায় Army H.Q. এর ক্ষমতা ceased হয়ে যায়৷ আমি একা হয়ে যাই৷ তার প্রমাণ, আমার ডেপুটি জেনারেল জিয়াসহ অন্যান্য সকল জেনারেল সেনাবাহিনীর চাকরিতে থেকে যান৷ শুধুমাত্র আমি সেনাবাহিনী থেকে অপমানজনকভাবে চাকরিচ্যূত হই৷ এমনকি তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে দেয়া হয়নি৷ ১৫ই আগস্টে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের পর থেকে তাঁকে বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তার পরিবারের থেকে তার লুঙ্গি ও জামা-কাপড় ইত্যাদি বঙ্গভবনে পৌঁছে দেয়া হয়৷ সেখান থেকে তাকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়ে পরিবারসহ বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷”
উপরোক্ত ঘটনা পুরোপুরি সত্য৷ আমি তখন বঙ্গভবনে ছিলাম বলে তার সাথে তখন আমার কথা হয়েছে এবং আমি তাকে বন্দি অবস্থায় বঙ্গভবনে দেখেছি৷ কিন্তু আমি যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, জেনারেল জিয়াকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ করার সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়, যখন এই উপ- মহাদেশের কোন দেশে সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোতে ডেপুটি চিফ অব স্টাফের কোনো পদ নেই৷ তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আমি তো তার মতোই একজন অফিসার৷ আমাদের কাকে কোন পদে নিয়োগ করা হবে, সে বিষয়ে আমাদের কারো কোনো মতামত দেবার সুযোগ ছিল না৷ এই পদ সৃষ্টি করেছিলেন জেনারেল ওসমানী এবং তিনি জিয়াকে উক্ত পদে পদায়নের সুযোগ করে দেন৷
আমি তাকে আরও প্রশ্ন করেছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সাথে আপনি যখন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আপনি জেনারেল জিয়াসহ সকলের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে পড়েছেন, তখন আপনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোনোক্রমে বের হয়ে গিয়ে, যে পরামর্শ আপনি নিজে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর মৃত্যুর আগে দিয়েছিলেন, ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি গুলশান-বনানীর কোনো পরিচিত বাড়িতে গিয়ে তাদের ল্যান্ড ফোনে সাভারে রক্ষীবাহিনীকে এবং ঢাকার বাইরের ক্যান্টনমেন্টগুলোর জি.ও.সি-দের নির্দেশ দেননি কেন? তখনো আপনি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ৷ আপনার নির্দেশ জি ও সি’রা মান্য করতে বাধ্য৷ ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশ মানতে তারা বাধ্য হতো না৷ তদুপরি, রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা আপনার নির্দেশ পেলে উল্কার বেগে ছুটে এসে ৩২ নম্বরের খুনিদের কুচি কুচি করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াতো৷ আপনি এসবের কিছুই করার চিন্তা করেননি কেন? আমার ঝড়ো প্রশ্নের মুখে তিনি নিরুত্তর রয়ে গেলেন৷
বঙ্গবন্ধুর সাথে যারা সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সেই বিশ্বাসঘাতকদের শেষ পরিণতি কী নির্মম হয়েছিল দেশবাসী তা জানেন৷ এটা হয়তো অনেকে জানেন না যে, তাদের একজনের মুণ্ডুবিহীন লাশ কবর দিতে হয়েছে ঢাকায়!!! This is the divine judgment. অথচ, বিশ্বাসঘাতকতা না করে তাঁরা যদি সেদিন সেনাবাহিনী প্রধানের আদেশ তামিল করে খুনিদের ওপর গুলি চালাতো, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র এবং ঢাকার লক্ষ লক্ষ জনতা পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে

পৃষ্ঠা: ৯৫
আসতো৷ খুনিদের তারা পায়ের তলায় দলে— পিষে মারতো, লাখ লাখ ঢাকাবাসী যে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল৷
ঢাকা জেলার কোনো থানা থেকে যদি কোনো একটি পুলিশ রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তো এবং ২/১টি গুলি আকাশের দিকে ফায়ার করতো, তাহলে ঢাকার সকল থানা থেকে ‘৭১ এর ২৬শে মার্চের ন্যায় পুলিশ বাহিনী নেমে পড়তো৷ নেমে পড়তো স্কুল-কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রী৷ তেজগাঁও, টঙ্গী, আদমজীর বীর শ্রমিকরা৷ কিন্তু তদানীন্তন আইজি নুরুল ইসলাম থেকে শুরু করে ঢাকার এসপি মাহবুব পর্যন্ত সর্বোচ্চ কাপুরুষতা প্রদর্শন করায় ঢাকার রাজারবাগ থেকে বা কোন থানা থেকে আকাশের দিকে একটি গুলিও কেউ কোনো ফায়ার করেনি৷ সচিবালয়ের সিএসপি সচিবরা এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জেনারেল এবং পুলিশ বাহিনীর অফিসাররা গুটিকয় বর্বর খুনিদের সম্মুখে সেদিন চরম কাপুরুষতা প্রদর্শন করায় ঢাকার শ্রমিক ও ছাত্র- জনতার প্রতিরোধের উদ্যোগ এভাবে ভেঙে পড়ে৷
১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমরা বঙ্গভবনের অফিসাররা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম৷ আমি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে CGS জেনারেল খালেদ মোশাররফ স্যারের প্রিয় ছিলাম, স্বাধীন বাংলা বেতারে তার নাম বহুবার বলেছি, সে কারণে আমি তাঁকে টেলিফোনে ধরার মুহুর্মুহূ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম৷ প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে তার COD মেজর হোসেন (জিয়া হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) আমাকে টেলিফোনে ধরলেন৷ বললেন, CGS স্যার কথা বলবেন৷ আমি ধরা মাত্র স্যার বললেন, “তোমরা বঙ্গভবন থেকে সব সিভিল অফিসাররা ভেগে যাও৷ যাতে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যাকে প্রেসিডেন্ট করে শপথ অনুষ্ঠান করাবে, সে অনুষ্ঠানে যেন কোন সিভিল অফিসার না থাকে৷ বহির্বিশ্বকে তারা যেন দেখাতে না পারে যে, সিভিল অফিসাররাও খুনিদের সমর্থন করেছে৷” তাঁর সাথে কথা বলা মাত্র আমি বঙ্গভবনে সব অফিসারদের পালাতে বললাম৷ তাদের ভয় দেখানোর জন্য বললাম, এখানে যে কোনো মুহূর্তে গুলি-গোলা আরম্ভ হয়ে যাবে৷ আমার কথা অনুযায়ী কুমার শঙ্কর হাজরা, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গাজী মনসুর সবাই গিয়ে বলতে লাগলো, “চল ভেগে যাও, জান বাঁচাতে চাও তো ভেগে যাও৷” আমাকে এসব বলতে দেখে প্রেসিডেন্টের এপিএস আব্দুল মান্নান (আমাদের উভয়ের পূর্বপুরুষ পশ্চিমবঙ্গের লোক বিধায় তার ও আমার মধ্যে গভীর আস্থার সম্পর্ক ছিল৷) আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে বললেন, “ভাই, আপনি তো মারা পড়বেন৷ প্রেসিডেন্টের এমএসপি’র রুম থেকে রেড টেলিফোনে কেবিনেট সেক্রেটারি এইচ.টি. ইমাম স্যার সকল সচিবকে বঙ্গভবনে আসার জন্য বলছেন৷ তিনি আমাকে বলেছেন যে, কাল রাতেই আর্মিরা তাকে যোগাযোগ করেছিল এবং আজকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য তারা তাকে কাল রাতেই বলে রেখেছিল৷ সে কথা তিনি কোন সচিবকে রেড টেলিফোনে গর্বের সাথে বলছিলেন দেখলাম৷” তারপরেও আমি যেসব সিএসপি সচিবকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, বিশেষ করে, যারা আমার মামা বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস সাহেবের বাসায় এসে চা-চক্রে মিলিত হতেন, তাদেরকে ফোন করে বঙ্গভবনে না আসার জন্য বলে দিলাম৷ মনে পড়ে তাদের মধ্যে খোরশেদ আলম স্যার, মঞ্জুরুল করিম স্যার, বঙ্গবন্ধুর সচিব সাত্তার স্যার, মাহবুবুর রহমান সিএসপি প্রমুখসহ আইজি নূরুল ইসলাম সাহেবকেও ফোন দিয়েছিলাম আমি৷ তাদের সকলকে আমি লন্ডনে অবস্থানরত আমার মামা রুহুল কুদ্দুসের বরাত দিয়ে বলছিলাম৷ (এটা সত্য যে, ১৫ই আগস্টের সকালে আমি মামাকে ফোন দিয়েছিলাম৷ আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক কলের সে সময়ের সুপারভাইজারের নম্বর ছিল ২৪২৭২৯৷ আমি সুপারভাইজারকে প্রেসিডেন্টের সচিব নামে এক মিনিটেই কানেকশন দিতে বললাম এবং পেয়ে গেলাম৷ তিনি বললেন, কোনো সচিব যেন বঙ্গভবনে না আসে৷ সকলকে আমার নাম করে বলে দাও৷ মনে পড়ে তিনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ১৪ই আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার কথা হয়েছিল৷) কিন্তু বিকেলে দেখলাম, সব সচিবরা একে একে বঙ্গভবনে এসে গেলেন৷ খুনি মোশতাকের শপথ গ্রহণের আগেই তিনি খুনি মোশতাককে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলে সম্বোধন করছিলেন৷ সেদিন যদি মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ.টি.ইমাম বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করতেন, তাহলে কোনো সচিবরা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমাকে বলেছিলেন, ভয়-ভীতি দেখিয়ে, এমনকি আর্মি গিয়ে তাদের পরিবারের সকলকে ৩২ নম্বরের মতো করে মেরে আসবে বলে বঙ্গভবনে আসতে বাধ্য করে৷
১৫ই আগস্টের সকালে আমি ঢাকার এস.পি. মাহবুব বীর বিক্রম-এর বাসায় ফোন করে হয়রান হয়ে গেলাম৷ তাঁর ফোনের কানেকশন পেলাম না৷ অন্য এক মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে ফোনে শুনলাম গত রাতে উত্তরায় তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে রাতে সেখানে রয়ে গেছেন৷ তখন স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী আমার বাসায় উপস্থিত প্রণোদিৎ দা’ আমাকে বললেন যে, শেখ কামালের বেডরুমের একটা unclassified টেলিফোন নম্বর তার কাছে আছে৷ কেননা, তিনি দেখছিলেন যে, আমি টেলিফোন গাইড হাতে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার সবগুলো টেলিফোনে ডায়াল করছিলাম৷ আমি তাঁকে বললাম, “আপনি এতক্ষণ ধরে এই নম্বর দিচ্ছেন না কেন? শুধু পাগলের মতো কাঁদলে হবে?” তিনি বললেন, “ভাইরে, মাথা ঠিক নেই৷ ছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির হলে৷ ঘুমের মধ্যে কে যেন বলে উঠল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে৷ শুনেই আমি পাগলের মতো তোমার কাছে দৌড়ে এলাম৷” ততক্ষণে প্রণোদিৎ দা’র দেয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ির শেখ কামালের বেড রুমের সেই unclassified ফোনে আমি ফোন করলাম৷ (খুব দুঃখিত যে, সেই ফোন নম্বরটি এত বছর পরে আর স্মরণ করতে পারছি না৷) তিনবার রিং হতেই শেখ কামালের বেড রুমের টেলিফোনের রিসিভার ধরে অপর প্রান্তে “হ্যালো” বলতেই আমি বললাম, “আমি শেখ কামালের বন্ধু বলছি৷ কামাল কেমন আছে?” টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল: “বহুত আচ্ছা, আপ কৌন?” আমি বললাম: “আমি ওর বন্ধু৷ ওদের বাড়ির দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে কেন তাহলে?” সেই লোকটি পুনরায় চোস্ত উর্দুতে উত্তর দিল: “ও কুছ নেহি৷ বাজি ফুট রাহা হ্যায়৷ উও লোগ খুছিছে খুছি মানা রাহে হ্যায়? আপ কৌন? আপ কাহাছে বোল রাহে হ্যায়? আপ কা ফোন নম্বর বাতাইয়ে৷”
৩২ নম্বরের বাড়িতে ১৫ আগস্ট পৌনে সাতটার দিকে পাক সেনাদের মতো চোস্ত উর্দু কণ্ঠস্বর শুনে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হলো যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যারাই হামলা করুক তাদের মধ্যে পাকসেনারাও রয়েছে৷ রিসিভারে আমার সাথে কান লাগিয়ে প্রণোদিৎ দা’ও বলে উঠলেন, “মুসা, এ তো দেখছি পাকিস্তানি সেনার কণ্ঠস্বর৷” ততক্ষণে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছি এবং ইংরেজিতে তাকে বললাম, “হোয়াই ইউ আর স্পিকিং ইন উর্দু? আর ইউ পাকিস্তানি আর্মি?” বজ্রপাতের মতো চিৎকার করে উত্তর দিলো, “আই এ্যাম ইউর ফাদার, হোয়াট ইজ ইউর এ্যাড্রেস বাস্টার্ড?”
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ১৫ আগস্ট ভোরে খুনিদের মুখে চোস্ত উর্দু শুনে ও “বাস্টার্ড” (৭১-এ বাঙালিদের পাক সেনারা এ নামেই সম্বোধন করতো) গালি শুনে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে, যারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে থাক, তারা পাকসেনাদের সাথে মিলে এটা করেছে৷ তারা একা এ কাজ করেনি৷ তখন মনে প্রশ্ন জাগলো যে, পাকিস্তানি আর্মি ছদ্মবেশে কীভাবে ঢাকায় পৌঁছে গেল? কারণ, আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সামনের গাছে রাত নয়টার দিকে কে বা কারা পাকিস্তানের পতাকা উড্ডীন করে যায়৷ রাতের আঁধারে কেউ তাদের দেখতে পায়নি৷ পাকিস্তানি পতাকা উড্ডীনের পর সাদা ‘চাঁদ তারা’ রাতের আঁধারে অনেকের চোখে পড়লে শেখ কামালকে খবর দেয়া হয় হল থেকে৷ শেখ কামাল ছাত্রদের নিয়ে এসে সে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে৷ আমার আরও মনে পড়ল, আধা ঘণ্টা আগে প্রণোদিৎ দা’ ও আমি বলাকার সামনে সামরিক ও পুলিশের ড্রেস পরা লোকদের ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান শুনে এসেছি৷ আমার চোখের উপর ভেসে উঠল ‘৭১-এর শত শত রক্তাক্ত রণাঙ্গনের দৃশ্য৷
আই.জি. নূরুল ইসলাম সাহেব একদিন আমাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় জিজ্ঞাসা করলেন: “স্যার কেমন আছেন?” রুহুল কুদ্দুস মামার কথা জিজ্ঞেস করায় বললাম “ভালো আছেন”৷ আমি তাঁকে বললাম, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সবাই মেনে নিল? উত্তরে তিনি বললেন: “আই.জি’র হাতে পুলিশ থাকে না৷ এস.পি. মাহবুবের কন্ট্রোলে ঢাকা জেলার থানাগুলো ছিল৷ থানাগুলো রেজিস্টেন্সে ঝাঁপিয়ে পড়লে হয়তো difference কিছু একটা হতো৷ ছাত্র-জনগণ নেমে পড়লেও পড়তে পারতো৷ সে কিছুই করেনি৷ করার চেষ্টাও করেনি৷ অথচ, তার ওপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ছিল৷ বিশ্বাসের মর্যাদা সে রাখেনি৷”
সেদিন বঙ্গ জননীর বীর সন্তানেরা পাক হানাদারদের গোলাবৃষ্টির মধ্যে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” বলে যে লোকটির নাম নিয়ে লাখ লাখ প্রাণ হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়ে গেছে, সেই লোকটিই যখন নেই, তখন বাংলাদেশের এক ট্রাক কালো ড্রেস পরা লোক ও পুলিশের ড্রেস পরা আরেক ট্রাক লোকের মুখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগানে বিস্ময়ের কী আছে৷ এরা হয়ত রণাঙ্গন কোনোদিন দেখেনি৷ এরা হয়ত দেখেনি কোন অকুতোভয় বাঙালি তরুণ “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” বলে পাকিস্তানি গোলার সামনে বুক পেতে দিয়ে কীভাবে চোখের পলকে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে৷ তাদের লাশ আমরা কবরে নামাতে পারিনি৷ পাকিস্তানি গোলায় পোড়া হাড়-মাংসের দলা কাপড়ে পুটলি করে বেঁধে রণাঙ্গনে কবর দিয়ে এসেছে সহযোদ্ধারা৷ বঙ্গবন্ধু যখন নেই, তখন মনে হলো, বোধ হয় খুনিরা পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়বে৷ প্রণোদিৎ দা’ ও আমি রক্ষীবাহিনীতে ফোন করার চেষ্টা করলাম৷
আমি তখন ব্যাচেলর, তরুণ এক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার৷ একাত্তরের রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে বহু দুর্ধর্ষ অপারেশন চালিয়েছি৷ আবার দুর্ধর্ষ হয়ে উঠতে মন সায় দিলো৷ রাগে ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে প্রণোদিৎ দা’কে নিয়ে আবার বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম৷ ভাবলাম কেউ না কেউ বের হবেই৷ তাঁদের সাথে আমাদেরও যেতে হবে৷ নাহলে আমরা কিসের মুক্তিযোদ্ধা? তখন সকাল আটটা হবে৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট জটলা দেখলাম৷ এবার আমরা বলাকার সামনে কোনো পুলিশ দেখলাম না৷ কেউ বাধা দিল না৷ আমরা যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে পৌঁছলাম, দেখলাম, নিউ মার্কেট সংলগ্ন কাঁচাবাজারে ত্রিশ/চল্লিশ জন লোক অসীম সাহসে বুক বেঁধে কাঁদতে কাঁদতে কলাবাগানের দিকে এগুনোর চেষ্টা করছে৷ তাদের মধ্যে কেউই বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর বিশ্বাস করছে না৷ এক দোকানিকে বলতে শুনলাম: “বঙ্গবন্ধুকে যদি মেরে থাকে, তারা আমাকেও মেরে ফেলুক৷ সকল বাঙালি ভাই-বোনকে মেরে ফেলুক৷” দূর থেকে এক তরকারি বিক্রেতাকে দেখলাম তার তরকারির ঝুড়ি রাস্তায় একজনের জিম্মায় রেখে বুকের জামা খুলে বুকের ওপর ঘুষি মারতে মারতে কী যেন বলতে বলতে কলাবাগানের দিকে ছুটে গেল৷ সেখানে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম৷ লোকটি বললো: “ঐ লোক পাগল হয়ে গেছে৷ চিৎকার করে বলছে রাজাকার-আল বদর তোরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি মেরে এটাকে পাকিস্তান বানাবি? মার আমার বুকে মার গুলি৷ দেখি কী করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে পারিস? মার গুলি আমার বুকে, মার আমার বুকে মার…৷” তাদের দেখে, তাদের কণ্ঠে আত্মদানের কথা শুনে বুকে আশার সঞ্চার হলো৷ মনে হলো বঙ্গবন্ধুর বাড়ির খুনিদের বিরুদ্ধে চারদিক থেকে রেজিস্টেন্স আরম্ভ হয়েছে৷ প্রণোদিৎ দা’ ও আমি তাদের সাথে এগিয়ে ৩ নম্বর রোডের ভিতর দিয়ে ধানমন্ডি মাঠের কোণায় গিয়ে পৌঁছলাম৷ আমাদের সাথে আরও পনের/বিশজন ছাত্র-যুবক এগিয়ে এলো৷ ওখানে এক পানওয়ালা অন্য সকলকে ও আমাদেরকে বললো, মেইন রোডে ওরা কাউকে উঠতে দেখলেই গুলি চালাচ্ছে৷ বলতে না বলতেই কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনলাম৷ কালো কালো ড্রেস পরা মেশিনগান হাতে কলাবাগানের ও ধানমন্ডি লেকের চারপাশে শত শত আর্মির লোক শুয়ে মেইন রোড তাক করে আছে বলে বললো সবাই৷ তার পরপরই কালো ড্রেস পরা মেশিনগান ফিট করা দুই জিপ সৈনিককে ৩২ নম্বর থেকে তীব্র বেগে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে যেতে দেখলাম৷
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততম সহযোদ্ধা ও সহকর্মী জনাব রুহুল কুদ্দুস সাহেব বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূল নীল নকশা সি.আই.এ. এবং আই.এস.আই যৌথভাবে প্রস্তুত করে৷ মধ্যপ্রাচ্যের একটি শীর্ষ দেশ উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ যোগান দেয়৷ সে অর্থের পরিমাণ ১৯৭৫ সালে কম-বেশি তিনশত কোটি টাকা, যখন বাংলাদেশের সে সময়ের বাজেট ছিল মাত্র চার হাজার কোটি টাকার৷ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততম সহচর, সহযোগী, আগরতলা মামলার ফাঁসির মঞ্চের আসামী জনাব রুহুল কুদ্দুস সাহেব আমাদের মিত্র একটি দেশের গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরপরই জানতে পারেন৷

পৃষ্ঠা: ১০০
১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ইহুদি হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বভূবন জুড়ে আমেরিকার মুখে যে চুনকালি লাগে এবং সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেও আমেরিকার পরম মিত্র পাকিস্তানি একটি সৈন্যকেও উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়৷ রাশিয়ার পারমাণবিক ডুবো জাহাজ বঙ্গোপসাগরে এসে চ্যালেঞ্জ দেয়ায় বাংলাদেশ ইস্যুতে বিশ্বে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে নিতে আমেরিকা পশ্চাদাপসরণ করতে বাধ্য হয়৷ ক্ষুদ্র একটি বাংলাদেশের জন্ম লাভের ইস্যুতে পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সম্মুখে আমেরিকাকে হাঁটু গেঁড়ে আত্মসমর্পণের পর বিশ্বব্যাপী তার যে সম্ভ্রমহানি ঘটেছিল পাঁচ বছর পরে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট সে তার নির্মম প্রতিশোধ নিয়ে ওয়ারশ প্যাক্ট ও রাশিয়াকে ন্যাটো ও আমেরিকার পক্ষ থেকে bloody message দিয়েছিল৷
এ বিষয়ে ১৫ই আগস্টের পর অজানা কয়েকটি অতিগোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন৷
(১) হেনরি কিসিঞ্জার সস্ত্রীক যখন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন তাঁর স্ত্রীর প্রটোকল অফিসার হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যদিও তখন আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কর্মকর্তা ছিলাম৷ মার্কিন পত্র-পত্রিকায় এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের প্রকাশিত পত্রিকায় তাঁর স্ত্রীর সাথে আমার ছবি প্রকাশিত হয়েছিল৷ আমাকে আমার মামা উক্ত সময়ে তাঁর স্ত্রীর কথোকথন বা মন্তব্য স্মরণে রাখতে বলেছিলেন৷ যাতে আমি তা হুবহু তাঁকে জানাতে পারি৷ আমার সুস্পষ্ট মনে আছে উক্ত ভদ্র মহিলার ডিউটি শেষে আমি মামাকে বলেছিলাম যে, ঢাকার যাদুঘর (পুরাতন) পরিদর্শনকালে যাদুঘরের কোনো একজন কর্মকর্তা ভদ্র মহিলাকে তোষামোদ করে বলছিলেন, “You are too tall and very graceful lady”. (তিনি অবশ্যই অনেক লম্বা সৌন্দর্যমণ্ডিত আকর্ষণীয় ফিগারের মহিলা ছিলেন৷ তবে প্রত্যুত্তরে তাঁর তীর্যক মন্তব্যটি আমি মামাকে অবহিত করেছিলাম৷ তিনি প্রত্যত্তুরে বলেছিলেন, “Your leader is a great leader but too tall for this country”. অপরদিকে, আমার মামার উপস্থিতিতে হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার মাত্র পনের মিনিটে শেষ হয়৷ কারণ, সাক্ষাৎকারের পনের মিনিটে এসে বঙ্গবন্ধু জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বরে যখন উচ্চারণ করেন, “Mr. Kissinger, you can not make Bangladesh second Chili, I assure you. I also assure you fullest cooperation but you are to accept reality in Bangladesh.”
বঙ্গবন্ধুর এই নির্ভিক উচ্চারণের সাথে সাথে কিসিঞ্জার উচ্চস্বরে হেসে উঠেন এবং উঠে পড়েন৷ বঙ্গবন্ধু তার বিদায়ের সাথে সাথে আমার মামাকে বলেছিলেন, “তাজউদ্দীন আর তুমিই তো বলেছো, এই ইহুদি বিশ্বাসঘাতক বাংলাদেশকে ‘৭১-এ ভিয়েতনামের মতো দুই টুকরো করতে চেয়েছিল৷ বাঙালি জাতির মধ্যে কেউ না কেউ তাকে সবক দিবে…৷”
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার শেষলগ্নে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সপ্তম নৌবহরকে আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রা করে দিয়ে হোয়াইট হাউসে নিক্সন-কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে যাচ্ছে বলে পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়৷ তারা যেভাবে ভিয়েতনামকে উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে বিভক্ত করেছিল অর্থাৎ দক্ষিণ ভিয়েতনামের ভূ-খণ্ডে জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্টপন্থি ভিয়েতনামীরা বসবাস করবে এবং উত্তর ভিয়েতনামের ভূ- খণ্ডে আমেরিকার সমর্থনকারী ভিয়েতনামীরা বসবাস করবে৷ পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তারা দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তান ভূ-খণ্ডে ভারতপন্থি উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদী বাঙালিরা বসবাস করবে এবং উত্তর-পূর্ব পাকিস্তান ভূ-খণ্ডে পাকিস্তানপন্থি মুসলমান বাঙালিরা বসবাস করবে৷ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্দের ভালো বিবেচনায় এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়৷ সপ্তম নৌবহর যদি অক্টোবরের প্রথম দিকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যেতে পারতো এবং আমেরিকান সৈন্যবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দরে নেমে পড়তে পারতো, তাহলে ভিয়েতনামের মতো, বাংলাদেশের সেই ভাগ্যবরণ করতে হতো৷ কিন্তু অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা ও সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে উভয় দেশের যে কোনো দেশের ওপর আক্রমণকে নিজ নিজ দেশের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য, প্রতিরোধ ও প্রতি আক্রমণের জন্য উভয় দেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ায় ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পৌঁছানোর পূর্বেই রাশিয়া তার পারমাণবিক মিসাইল সজ্জিত পঁয়তাল্লিশটি ডুবো জাহাজ প্রেরণ করে বঙ্গোপসাগর ঘেরাও করে ফেলে৷ দুই পরাশক্তি তখন নিশ্চিত পরমাণু যুদ্ধের মুখোমুখি৷ ষাটের দশকে কিউবা সংকটের পর সত্তরের দশকে বাংলাদেশ সংকটে দুই পরাশক্তি দ্বিতীয়বারের ন্যায় পরমাণু মিসাইল সজ্জিত আই.সি.বি.এম.এ (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল) বোতামে আঙ্গুল রেখেছিল৷ বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজও আফসোস করেন যে, অতি দ্রুত, মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল বলে বাঙালি জাতি তার স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি পায়নি৷ কিন্তু তারা কেউ টের পায়নি, মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে দুই পরাশক্তি মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের ইচ্ছায় নভোমণ্ডলে রাশিয়ার স্পুটনিকগুলোকে বাংলাদেশের আকাশসীমার কাছাকাছি নামিয়ে আনা হয়, যাতে জেনারেল মানেক শ’র সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের অগ্রাভিযান নিরাপদ ও নিশ্চিত হতে সহায়তা প্রদান করে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তৎক্ষণাৎ ক্ষিপ্র গতিতে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে ঢাকা দখল করে নিতে হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তের যুদ্ধ এককভাবে সমাপ্ত বলে ঘোষণা করতে হয়৷
বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার শেষ মুহূর্তের কলঙ্কিত পরাভূত চেহারা বঙ্গবন্ধু জানতেন বলে সেই চেহারার অন্যতম অপরাধীকে বঙ্গবন্ধু তিরস্কার করতে বিস্মৃত হননি৷ তারা তাঁকে হত্যা করতে পারে, কিন্তু ‘৭১-এর দুই অপরাধী কিসিঞ্জার ও নিক্সনকে বঙ্গবন্ধুর এই তিরস্কারের কথা আমেরিকা বিস্মৃত হবে না৷
(২) ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাথে ফিডেল ক্যাস্ট্রোর একটি গোপন বৈঠক হয়৷ উক্ত বৈঠকের অনেক গোপনীয়তা বঙ্গবন্ধুর এক প্রতিমন্ত্রী সি.আই.এ’র কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল৷ উক্ত বৈঠকে বঙ্গবন্ধু কিউবার কাছে পাট বিক্রির বিষয়ে সম্মত হয়েছিল এবং বাংলাদেশের পাট নিয়ে কিউবায় যখন জাহাজ রওয়ানা হয়ে যায়, তখন মুজিবনগরের প্রবাসী সরকারের সচিবরা আমার মামা রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে সম্মিলিতভাবে জানিয়েছিলেন যে, কিউবার ওপর আমেরিকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ বিদ্যমান৷ বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বলেছিলেন, “আমেরিকার নাকের ডগায় কিউবা যদি survive করতে পারে, বাংলাদেশের ওপর তারা নখের আঁচড়টি বসাতে পারবে না৷ নিক্সন-কিসিঞ্জাররা কি জানে না যে, বাংলার ঘরে ঘরে আমার বীর মুক্তিযোদ্ধারা আছে৷”
(৩) ১৯৭৪ সালে যখন দুর্ভিক্ষ হয়, তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তদানীন্তন ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারকে তাঁর বাড়িতে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমেরিকার সহযোগিতা নিশ্চিতকরণে এবং বাংলাদেশ অভিমুখে আগত প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের বক্ষ থেকে খাদ্যবাহী জাহাজ ফেরানো থেকে আমেরিকাকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন৷ কিন্তু তাতে কোনো কর্ণপাত করেননি৷ কিন্তু ‘৭৫ সালের জুন মাসে হঠাৎ আমার মামা দেখলো গমভর্তি দুই আমেরিকান জাহাজ বাংলাদেশে যাত্রা করেছে মর্মে টেলেক্স পেলেন তার অফিসের টেলেক্স মেশিনে৷ তিনি অবাক হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বললেন, “আমরা না চাইতেই আমেরিকা যে গমভর্তি দুটি জাহাজ রওয়ানা করিয়ে দিয়েছে, সেটা আপনি জানেন কি-না? বঙ্গবন্ধু বলেন, এ বিষয়ে কারও সাথে তার কোনো কথা হয়নি৷ মামা বললেন, “তাহলে এত বিশাল খাদ্য ভাণ্ডার নিজ উদ্যোগে আমেরিকা পাঠাচ্ছে অন্য কারও জন্য?”
বঙ্গবন্ধুর হত্যার সংবাদ মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বরে রেডিও’র মাধ্যমে ইথারে ভেসে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাভারের রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে সাজ সাজ রব পড়ে যায়৷ ‘৭১-এর রণাঙ্গনের সেই মুক্তিবাহিনীর বীর সন্তানরা হুঙ্কার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল৷ তাঁদের লিডার ও ডেপুটি লিডারদের নিয়ে উল্কার বেগে ৩২ নম্বর রোডে ছুটে আসতে চেয়েছিল৷ সকাল ৭টার মধ্যে রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডাইরেক্টর (অপারেশন) ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর এক রাজনৈতিক সহযোগীর বাসায় জিপ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল৷ আমাকে সে কথা বললেন, সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট আখতারুজ্জামান মণ্ডল (বর্তমানে তিনি কুড়িগ্রাম আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি)৷ তিনি বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উক্ত ভাইয়ের দূরসম্পর্কের আত্মীয় জনাব ওয়াদুদসহ আমি তাঁর ধানমন্ডির ১৩ নম্বর রোডের বাসায় গেলাম সকাল নয়টার মধ্যেই৷ সেখানে গেলে ভাবী বললেন, রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি লিডার এসে ওনাকে রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেছে৷ শুনে আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম যে, তিনি রক্ষীবাহিনী নিয়ে যে কোনো মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দখল করে ফেলবে৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শেষ করে ফেলবে৷ আমি ও উক্ত ভাইয়ের আত্মীয় জনাব ওয়াদুদ, (যিনি এখন ঢাকায় আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে অফিসার পদে চাকরি করেন) আমরা দু’জন শুভ সংবাদের আশায় উক্ত ভাইয়ের বাসায় অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ সকাল পৌনে এগারটার দিকে তিনি রক্ষীবাহিনীর জিপে ফিরে আসলেন৷ আমরা তাঁর কাছে ছুটে গেলাম৷ বললাম, ভাই রক্ষীবাহিনীর খবর কী? রক্ষীবাহিনী কখন আসছে?” তিনি হাতের ইশারায় আমাদের দূরে সরে যেতে বললেন৷ আখতারুজ্জামান মন্ডল ছাত্রলীগের দল-বল নিয়ে ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট শেখ শহীদের বাসায় গেলে তার ব্যাংকার শ্বশুর তাদেরকে এই বলে বিদায় করেন যে, শেখ শহীদ আর রাজনীতির মধ্যে নেই, আমার মেয়েকে বিধবা করার জন্য তোমরা এসো না৷ শেখ শহীদ উঁকি দিয়ে এক পলক তাদের দেখে ভেতরে চলে গেল৷ কোনো কথা পর্যন্ত তাদের সাথে বলেনি৷ সেখান থেকে মর্মবেদনায় দগ্ধ হয়ে তারা আব্দুর রাজ্জাকের বাসায় গেলে আব্দুর রাজ্জাককে দেখলো একটা গাড়িতে উঠছে৷ আব্দুর রাজ্জাক তাদেরকে বললো: “আমি কেরানীগঞ্জ মন্টুর ওখানে যাচ্ছি৷ তোরা পরে যোগাযোগ করিস৷”
১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে সুবেদার মেজর গোলাম আলী আমার কাছে ‘৭৫-এর নির্মম ইতিহাসের আরেক অজানা অধ্যায় তুলে ধরেন৷ এ সময় আমার এক সহকর্মী আরেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসার উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি বর্তমানে সরকারি উচ্চ পদে আসীন আছেন বলে তাঁর নাম উল্লেখে বিরত থাকলাম৷ সুবেদার মেজর আলী অনেক আহাজারী করে ইতিহাসের সেই অজানা অধ্যায় উন্মোচন করে বললেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ডিউটি করতাম৷ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিচতলার বাম দিকের ছোট রুমে তাদের এক বেডওয়ালা একটি রেস্ট রুম ছিল৷ রাতে সেই রুমে থেকে আমি ডিউটি করতাম৷ ১৫ আগস্ট রাতে শেখ কামাল আমাকে বলে যে, ‘আঙ্কেল আজ খুলনা থেকে অনেক গেস্ট এসেছে (খুলনা থেকে শেখ নাসেরসহ কয়েকজন আত্মীয় এসেছিল পরিবারের কারও কোনো বিয়ের বিষয়ে আলোচনার জন্য), সেজন্য আপনার রুম যদি ছেড়ে দেন, ভালো হয়৷ আপনি আজ গণভবনের ব্যারাকে থাকলে ভালো হয়৷’ আমি শেখ কামালকে বললাম, ‘তাই হয় নাকি?’ তোমার কথায় প্রেসিডেন্টকে ছেড়ে আমি যেতে পারি নাকি? আমি রাতে থাকবো৷’ কামাল বলল, ‘আব্বা বলেছেন৷’ তখন আমি দোতলায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলে বঙ্গবন্ধুও আমাকে তাই বললেন৷ সে রাতে বঙ্গবন্ধুর জ্বর ছিল৷ আমি নেমে আসার সময় ডাক্তার আসতে দেখলাম৷ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পেয়ে রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছেড়ে গণভবনের রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে আমি ঘুমাতে চলে আসি৷ সকালে ফজরের নামাজের আগে দৌড়াদৌড়ির শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পাই যে, বাইরের থেকে মেজর ডালিম-ফারুকদের ফোর্স আমাদের ঘিরে ফেলেছে৷ মাইক দিয়ে স্যারেন্ডার করতে বলছে৷ মাইকে বলা হচ্ছে, “আপনারা স্যারেন্ডার করুন৷ বিশ্বাসঘাতক শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে৷ আপনাদেরকে বাংলাদেশ আর্মির সাথে merge করা হয়েছে৷ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন সরকার ঘোষণা করা হয়েছে৷ রেডিওতে তিন বাহিনী প্রধানের ঘোষণা কিছুক্ষণের মধ্যে আপনারা শুনতে পাবেন৷ সাভারের রক্ষীবাহিনী স্যারেন্ডার করেছে৷ আপনারা স্যারেন্ডার করুন৷ ট্যাঙ্ক বাহিনী আপনাদের ঘিরে ফেলেছে৷ স্যারেন্ডার না করলে, ট্যাঙ্কের গোলায় ও বিমানের বোমা বর্ষণে আপনারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন…৷”
সুবেদার মেজর আলী বললেন, “এতসব হুমকি ও মৃত্যু পরোয়ানার ঘোষণা মাইকে শুনেও রক্ষীবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্যারেন্ডার করতে রাজি হয়নি৷ আমরা ছিলাম ‘৭১-এ রণাঙ্গনের বীরযোদ্ধা৷ বঙ্গবন্ধুর ডাকে রণাঙ্গনে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম জীবন দিতে৷ বেঁচে থাকার জন্য নয়৷

পৃষ্ঠা: ১০৫
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সেদিন আমরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম৷ আর কারও ডাকে নয়৷ আর কেউ ডাক দিলে আমরা কেউ যেতাম না৷ তাই সেদিন যাঁর ডাকে যুদ্ধে গিয়েছিলাম আজ তাঁর জন্যে প্রয়োজনে আমরা জীবন দিয়ে যাবো৷ আমরা সকলে মিলে আল্লাহর নামে এই কসম খেলাম৷ তাই সবাই বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে এক প্রকার প্রস্তুত হয়ে গেলাম৷ কারণ, আমরা সকলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম যে, বঙ্গবন্ধু ‘৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন না করে ফেললে বাঙালি জাতির দাসত্বের শৃঙ্খল আর ভাঙতো না, বাঙালি মা-বোনদের পাঞ্জাবিদের দাসী-বান্দি হয়ে থাকতে হতো৷ তাই আমরা সব ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ওপর হামলা করে খুনিদের কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুর দিয়ে খাওয়াতে চেয়েছিলাম৷ সেখানকার ৯৮% রক্ষীবাহিনীর জওয়ান ও অফিসাররা স্যারেন্ডারের বিপক্ষে এবং ২% এর মতো কিছু কাপুরুষ স্যারেন্ডারের পক্ষে ছিল৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ওপর আচমকা হামলা চালানোর জন্য এবং প্রয়োজনে জীবন দেবার জন্য যখন আমরা প্রস্তুত হচ্ছিলাম, সে সময় খুনিদের অনুগত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আর্মি অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর এক রাজনৈতিক সহযোগীকে নিয়ে শের-ই- বাংলা নগরের রক্ষীবাহিনীর গণভবনস্থ ব্যারাকে ক্যাম্পে আসে৷ কিন্তু রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে তারা প্রথমে ঢুকতে পারেনি৷ তখন তারা তাদের সামনে বঙ্গবন্ধুর উক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দেখিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তে চায়৷ রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা ও আমরা সকলে অতি পরিচিত ব্যক্তিত্বকে দেখতে পেয়ে আমি ও আমার অন্যান্য ব্যাচমেট ও সকল রক্ষীবাহিনীর অফিসাররা আশান্বিত হয়ে তাঁকে ভিতরে ঢুকতে দেই৷”
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক সুবেদার মেজর গোলাম আলী কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে দিয়ে বললেন, “ট্রয় নগরী ধ্বংসের জন্য যেভাবে ঘোড়ার পেটের মধ্যে শত্রু সৈন্য ঢুকিয়ে ‘ট্রোজান হর্স’ ট্রয় নগরীর মধ্যে ঢুকে ট্রয় নগরী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল, সেভাবে উক্ত রাজনৈতিক সহচরটি আমাদের ব্যারাকে ঢুকেই মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু শেষ করে দেয়৷ তিনি শের-ই-বাংলা নগরের রক্ষীবাহিনীর ব্যারাকে ঢুকেই সকলকে বকাবকি শুরু করলেন৷ বললেন, ‘তোমরা স্যারেন্ডার করো না কেন? বোঝ না দেশের অবস্থা কী? তোমরা মরবে৷ বাংলাদেশের সবাইকে মারবে৷ আর্মি যা বলে তাই করো৷ না হলে, বাংলাদেশ থাকবে না৷ তোমরা সব স্যারেন্ডার করো৷ আর্মির সাথে মিলেমিশে থাকো৷ সব স্যারেন্ডার করো৷ না হলে তোমরা কেউ বাঁচতে পারবা না’৷ তার এ রকম বকাবকির মুখে আমার ব্যাচমেট মেজর রফিকেরা স্যারেন্ডারের পক্ষে অবস্থান নেয়৷ তার সাথে আরও কিছু ফোর্স ঐদিকে চলে যায়৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সমর্থক আশিভাগ রক্ষীবাহিনীর জওয়ান ও অফিসাররা তখনও স্যারেন্ডার করার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে থাকে৷ তখন আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাবার জন্য তিনি আমাদের মধ্যে ভাগ ভাগ করে কথা বলে আমাদেরকে গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত করে ফেলেন৷”
সুবেদার মেজর আলী ক্ষোভ-ক্রোধ-ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমরা যদি আর একটু সময় পেতাম, বঙ্গবন্ধুর ওই লোকটি যদি আর দুই-তিন ঘণ্টা পরে আমাদের ব্যারাকে পৌছাতো, তাহলে আমরা ততক্ষণে আমাদের কমান্ডিং অফিসার ঠিক করে ঘুর্ণিঝড়ের বেগে ৩২ নম্বরে আঘাত হানতাম৷ কিন্তু আমাদের মধ্যে নেতৃত্ব কে দেবে, ট্রুপস কমান্ড করবে কে- এই প্রশ্নের দোদুল্যমানতার মধ্যে সময় পার হয়ে যায়৷ সেই সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর যখন এসে আমাদের ঐক্যে ও বিশ্বাসে আঘাত হানে, তখন ভাঙন ধরে আমাদের মধ্যে! আমাদের মধ্যে গ্রুপ গ্রুপ করে কথা বলে ঘাড়ে— পিঠে হাত বুলিয়ে কথা বলে সে আমাদের পক্ষের লোকদের এক এক করে ভাগিয়ে নেয়৷ তখন এক পর্যায়ে সবাই স্যারেন্ডারের পক্ষে চলে যায়৷ তখন আমরা সবাই চোখের পানিতে বুক ভাসাতে থাকি৷ আমরা স্যারেন্ডার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি হয়ে পড়ি৷ বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু হারিয়ে ফেলি এবং উদ্বাস্ত হয়ে যাই…৷”
আর বলতে পারলেন না সুঠাম দেহী বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার মেজর আলী৷ চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে৷ ঠোঁট দুটো বিড় বিড় করতে থাকে৷ বুঝতে পারি তার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ আর কী যেন বলতে চায়৷ বলতে পারে না৷ বঙ্গবন্ধুর কাছে ‘৭১-এর বীর সন্তানদের হৃদয়ের যে কথা বলার ছিল, তা কি তারা বলতে পেরেছেন কেউ?
টিপু সুলতানের প্রধান সেনাপতি মীর সাদিক ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর তাঁদের স্ব স্ব অন্নদাতা শাসককে নির্মমভাবে হত্যা করিয়ে ভারতকে যেভাবে ইংরেজের হাতে তুলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে শেখ মুজিবের উপ-প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্যরা বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল৷ (দেশবাসী স্মরণে রাখবেন বাংলাদেশ থেকে ফিরে যাওয়া ৯৮ হাজার পাক আর্মির একজনকেও পাকিস্তানি আর্মিতে ঢুকতে দেয়া হয়নি৷ সেটাই বিশ্বের অলঙ্ঘনীয় সামরিক বিধান৷ মহাসাগরের চেয়েও অধিক দয়ার সাগর শেখ মুজিব তা করেননি বলে তার প্রতিদানস্বরূপ তাঁকে নির্মমভাবে ১৫ই আগস্ট জীবন দিতে হয়েছিল৷) আজকের বাংলাদেশের চেহারায় ‘৭১-এর জল্লাদ টিক্কা-নিয়াজী-রাও ফরমান আলীদের পূর্ব পাকিস্তানের চেহারা যে ফুটে উঠেছে, সেই পাপের বীজ ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টে এই বিশ্বাসঘাতকরা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে বপন করেছিল৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিষাক্ত পাপের বীজ সম্পর্কে বাঙালি জাতিকে হুঁশিয়ার করে বহু বছর পূর্বে লিখে রেখে গেছেন যে “পাপের একটি বীজ যেখানে পড়ে, সেখানে দেখিতে দেখিতে গোপনে কেমন করিয়া সহস্র বিষ বৃক্ষ জন্মায়, কেমন করিয়া অল্পে অল্পে সুশোভন মানব সমাজ অরণ্যে পরিণত হইয়া যায় তাহা কেউ জানিতে পারে না৷” ১৯৭১-এর পরাজিত পাক সেনাদের প্রেতাত্মা-রাজাকার- আলবদরদের বিষাক্ত দন্ত-নখরে ক্ষত-বিক্ষত আজকের বাংলাদেশের খুন- খারাবি-ধর্ষণ-পীড়ন-বর্বরতার বীভৎস অরণ্যের চেহারা বিশ্বকবির সেই হুঁশিয়ারী ষোল কোটি বেদনাহত বাঙালি ভাই-বোনকে শোকাহত চিত্তে আজ স্মরণ করিয়ে দেয়৷
রক্ষীবাহিনীর ডিজি ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান এবং ডিডিজি ব্রিগেডিয়ার সাবিহ উদ্দীনের অনুপস্থিতিতে এ বাহিনীর দায়িত্ব ছিল লিডার সারোয়ার ও লিডার শাহেদের উপর৷ বঙ্গবন্ধুর ওপর শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর অফিস বা ৩২ নম্বর বাড়ির ওপর সামান্যতম আঘাত হওয়া মাত্রই উল্কার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্থায়ী আদেশ জারি করা ছিল রক্ষীবাহিনীর ওপর৷ রক্ষীবাহিনীর প্রশাসনিক বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত আমার মামা রুহুল কুদ্দুস, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব (মুজিবনগর সরকারের চীফ সেক্রেটারী এবং আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী), তিনি সে সময় লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন৷ তিনি লন্ডন থেকে ১৫ই আগস্ট সকালে ঢাকায় বঙ্গভবনে আমাকে টেলিফোনে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, যাতে কোন সচিব খুনিদের সাথে সহযোগিতা না করে এবং খুনি মোশতাকের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদান না করে এই মর্মে তাঁর নির্দেশ আমি যেন সকল সচিবকে জানিয়ে দেই৷ তিনি একথাও বলেছিলেন যে, তিনি নিজে সকল সচিবকে ফোন করে একই নির্দেশ দিবেন৷ তিনি আরও বলেছিলেন যে, জেনারেল খালেদ মোশাররফকে তিনি যা নির্দেশ দেবার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন৷ তিনি সুস্পষ্টভাবে রক্ষীবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তারা যেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশব্যাপি total war শুরু করে দেয়৷ কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি মর্মাহত চিত্তে বলেছেন যে, রক্ষীবাহিনীর ডিজি ও ডিডিজি’র অনুপস্থিতিতে যারা সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে সিনিয়র লিডার ছিল তারা তার নির্দেশ অনুসরণ করেনি এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে যখন রক্ষীবাহিনী কিছুই করছে না, তখন ১৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় তিনি লন্ডন থেকে পুণরায় রক্ষীবাহিনীর সাভারে সিনিয়র লিডারদের ফোন করে বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু তোমাদের নাম রেখেছিল রক্ষীবাহিনী৷ কিন্তু সেই বঙ্গবন্ধুকে তোমরা রক্ষা করতে এগিয়ে আসলে না৷ তোমরা শুধু বঙ্গবন্ধুর সাথে বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতা করলে না, তোমরা তোমাদের নামের সাথে বেঈমানী ও গাদ্দারী করলে৷ কেয়ামতের দিনে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবে না৷’
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের যে বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রের গুপ্ত কথা জানতে আমি ‘৯৪ সালে এক সরকারি কাজে চট্টগ্রাম গিয়ে বঙ্গবন্ধুর তদানীন্তন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে ১৫ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার তার ১১৫/বি জামাল খান রোডের বাসায় সাক্ষাৎ করেছিলাম৷ তিনি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকতে ঢাকায় যখন ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তিনি থাকতেন, তখন তাঁর পিএস ‘৭১ সাল থেকে আমার বন্ধু অধ্যাপক সুরঞ্জন সেনের সাথে বহুবার তাঁর বাসায় গিয়েছি৷ জামাল খান রোডের উক্ত সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর ডাক্তার পুত্র ডা. মঈনুল ইসলাম চৌধুরীসহ তাঁদের পরিবারের আরও লোকজন উপস্থিত ছিলেন এবং অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন৷ অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে দেয়া সাক্ষাৎকারে সেই ১৫ই আগস্টের ট্রাজেডির অজানা রহস্যের পর্দা তিনি উন্মোচন করেছিলেন, যা বাঙালি জাতির কাছে শত-সহস্র বছর ধরে কারবালার চেয়েও ভয়াবহ নিষ্ঠুর ট্রাজেডি হিসেবে গণ্য হয়ে আসবে৷ বিষাদ সিন্ধুর কবি মোশাররফ হোসেন অথবা মেঘনাদবধ মহাকাব্যের রচয়িতা কবি মাইকেল মধুসুদন যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁরা ১৫ই আগস্টকে নিয়ে মহাকাব্য রচনা করতেন এবং শত-সহস্র বর্ষ ধরে বিশ্বব্যাপী বাঙালি ভাই-বোনেরা ১৫ আগস্টে বুক চাপড়ে মহররমের ন্যায় মাতম করতেন৷
সাক্ষাৎকারের প্রথমে জনাব চৌধুরী খুব আবেগতাড়িত হয়ে গেলেন৷ তাঁর দুই চোখের কোণ গড়িয়ে অবিরল ধারায় ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়তে লাগলো৷ প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলেন৷ তারপর ধীরে ধীরে উন্মোচন করলেন, ১৫ই আগস্টের সেই খলনায়কদের আসল চেহারা৷ যে চেহারা দেশবাসী কখনো দেখতে পায়নি৷ তিনি প্রথমে বললেন, “অপার স্নেহে বঙ্গবন্ধু আমাকে সকল মন্ত্রণালয়ের চেয়ে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে দিয়েছিলেন, আমার নৈতিক সততার ওপর বিরাট আস্থা রেখে৷” তিনি বার বার বাকরুদ্ধ কণ্ঠে, চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, “বঙ্গবন্ধুকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এর দায়-দায়িত্ব শফিউল্লাহ, সেনাবাহিনী, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীর চেয়ে আমার সবচেয়ে বেশি ছিল৷ কিন্তু আমি একজনের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলাম৷ সব হারিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা যখন সর্বহারা হয়ে গেলাম, তখন বুঝলাম রাষ্ট্রনীতিতে কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে নেই৷ বঙ্গবন্ধু আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এই হুঁশিয়ারী ঠিকই দিয়েছিলেন৷ কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম৷ আমার assessment ভুল হয়েছিল৷ বঙ্গবন্ধুর assessment সঠিক ছিল৷ বঙ্গবন্ধু খবর পাচ্ছিলেন এবং আমিও খবর পাচ্ছিলাম যে, সেনাবাহিনীর ভিতরে বিচ্ছিন্ন কিছু ষড়যন্ত্র চলছে৷ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন এবং তাদের সাথে সেনাবাহিনীর শীর্ষের দু’একজন এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত৷ আমাদের কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের গোয়েন্দারাও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আমাদের বারবার সতর্ক করছিল৷ কিন্তু সন্তানতুল্যরা কেউ যে পিতার প্রাণ বধ করবে, এটা বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসই হতো না৷ বিশ্বাস করতেই পারতেন না তিনি৷ জিয়াউর রহমান আমার সামনে বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় লাগার আগে আমার বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করতে হবে৷’ বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি স্নেহে তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে সন্তানের ন্যায় আদর করতে৷ শেখ কামাল, জামালের ন্যায় আদর করতে৷ আর আজ যখন পিছনের দিকে তাকাই, তখন ভাবি, কত বড় ভুল হয়ে গেছে!! কত বড় বিশ্বাসঘাতক বঙ্গবন্ধুর পুত্র স্নেহের আদর পেয়ে গেছে!! আল্লাহ যেন কখনও তাঁকে মাফ না করে৷ অসুস্থ অবস্থায় আল্লাহর কাছে এই আমার ফরিয়াদ৷”
আমি প্রশ্ন করলাম, “স্যার, পুত্রতুল্যরা পিতৃতুল্যের অধিক ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে বুলেট বিদ্ধ করে হত্যা করেছিল৷ সে ঘটনা তো আপনাদের চোখের সামনে ছিল৷ তাহলে এই ভুল করলেন কেন?” অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বিরাট এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন৷ অঝোর ধারায় তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো৷ বেদনার কষ্টে কাঁপতে লাগলেন তিনি৷ তারপর বেদনাদীর্ণ কণ্ঠে বলল সব লিখে নিন৷ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে জিয়াউর রহমান আমাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন, দেখলেই স্যালুট করতেন৷ আমাকে খুবই ভক্তি করতেন ও সম্মান দেখাতেন৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় সে তার অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে আমার নির্বাচনী এলাকায় এপ্রিল মাসে ছিল৷ তখন থেকেই সে আমার প্রতি খুবই রেসপেক্ট শো করতো৷ আমিও তাঁকে আপনজনের ন্যায় গণ্য করতাম৷ আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হবার পর সে আমার মিন্টো রোডের বাসায় ঘন ঘন যাতায়াত করতো৷ এসব দেখা সাক্ষাতের মধ্যে সে কখনও লুকায়নি যে, সে আর্মির চিফ হতে চায়৷ ভারত-পাকিস্তানসহ এই উপমহাদেশের উদাহরণ দিয়ে সে আমাকে বার বার বলেছে যে, এসব দেশে আর্মির চিফ অব স্টাফ পদে এক টার্মের বেশি থাকার নজির নেই৷ শফিউল্লাহর টার্ম শেষ হলে তাকে যেন চিফ করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে

পৃষ্ঠা: ১১০
শফিউল্লাহ’র টার্ম শেষ হবে৷ তাহলে, স্বাভাবিক নিয়মে জিয়া আর্মির চিফ হতে পারে৷ বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং বাকশালের মেম্বার হবার জন্য আমার কাছে তাঁর বার বার আসা এবং তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ইত্যাদি মনে রেখে আমিও তাতে সায় দিয়েছিলাম৷ আমিও মনে মনে চাইতাম শফিউল্লাহ’র টার্ম শেষ হলে জিয়া হবে আর্মির চিফ৷ আমার মনের কথা তার কাছে প্রকাশও করেছিলাম৷ তাঁর সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় সূত্রে আমাদের উভয়ের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভাল ছিল৷ ভাবতাম সে চিফ হলে আরও সুন্দরভাবে কাজ করতে পারবো৷ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলবো৷ কিন্তু একই সাথে সেনাবাহিনীর দু’একটি নিজস্ব সোর্স থেকে বঙ্গবন্ধু ও আমি তার সম্পর্কে ভিন্ন রকম রিপোর্ট পাচ্ছিলাম৷ সেজন্য আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম৷ তথাপি আমি সেসব তথ্য মন থেকে ঝেড়ে ফেলছিলাম৷ কেননা, তখন আমি মনস্থির করে ফেলেছি যে, জিয়াকে পরবর্তী আর্মি চিফ করা হবে৷”
আগস্টের চার অথবা পাঁচ তারিখে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কার্যালয়ে তদানীন্তন প্রতিরক্ষা সচিবসহ আর্মির ডেপুটি চিফ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে পদাতিক বাহিনীর কাঠামো বিন্যাস (আরেকটি ব্রিগেড গঠন বিষয়ে) সম্পর্কিত একটি মিটিং করছিলেন, সে সময় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে রেড টেলিফোনে একটি টেলিফোন কল পান৷ সে সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের ৩ জনের মিটিং চলাকালে বঙ্গবন্ধু আমাকে রেড ফোনে ফোন করলেন৷ তিনি জানালেন, জেনারেল শফিউল্লাহকে আর্মির চিফ হিসেবে আরও এক টার্ম (অর্থাৎ আরও ৩ বছরের জন্য) নিয়োগের সিদ্ধান্ত দিয়েছি৷ এ সম্পর্কিত গেজেট নোটিফিকেশন আজই ছাপা হবে৷” যেহেতু, আমি মিটিং চলাকালে তাঁদের সামনে টেলিফোন কলটি পেলাম, জেনারেল জিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, “স্যার, এটা কি বঙ্গবন্ধুর কল”? আমি বললাম, “হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর কল ছিল”৷ জেনারেল জিয়া আবার বললেন, “স্যার, এটা কি জেনারেল শফিউল্লাহকে আরেক টার্ম দেবার ডিসিশন দিলেন উনি?” (বঙ্গবন্ধুর ওপর জেনারেল জিয়ার ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের নেটওয়ার্ক কত গভীর ও নিখুঁত ছিল জেনারেল জিয়ার এই প্রশ্ন তার উত্তর৷) বস্তুত ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষের পর থেকে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা ও খুনিরা মিলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এত পাকা পোক্তভাবে করছিল, তারা এমনকি বঙ্গবন্ধুর সকল ফোন গোপনে বাগিং (আড়িপাতা) করতে শুরু করছিল৷ ডি.জি.এফ.আই.-এর ডি.জি. আব্দুর রউফ-এর নেতৃত্বে ডি.জি.এফ.আই থেকে এটা করা হতো৷ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সকল কথাবার্তা, আলোচনা, বৈঠক ও কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে মনিটর করে চলছিল৷ ‘৭৫ এর মার্চে এসে বঙ্গবন্ধুর মূখ্য সচিব জনাব রুহুল কুদ্দুস আকস্মিকভাবে জানতে পারলেন যে, সেনাবাহিনীর একটি চক্র দেশের প্রেসিডেন্টের টেলিফোনে গোপনে আড়ি পাতছে এবং তাঁর সকল কথাবার্তা ও গোপন আদেশ-নিষেধ গোপনে জেনে যাচ্ছে৷ দেশের প্রেসিডেন্টের কার্যক্রমের ওপর গোপন তৎপরতা চালানো দেশদ্রোহিতা ও সংবিধানের মারাত্মক লংঘন৷ এটা জানার পর তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন৷ তিনি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়টি জানতে চাইলেন যে, আর্মির এ তৎপরতার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কি- না৷ অথবা তাঁর কোনো অনুমোদন এতে আছে কি-না? তিনিও বিস্মিত হয়ে গেলেন৷ তখন জনাব রুহুল কুদ্দুস তাঁকে বললেন যে, এ বিষয়ে কোথাও মুখ না খোলার জন্য এবং এ বিষয়ে তিনি যে তাঁর সাথে কথা বলেছেন সে বিষয়েও দ্বিতীয় কারও সাথে আলোচনা না করার জন্য৷ এ বিষয়ে তিনি আমাকে তাঁর স্ত্রী মিসেস হামিদা কুদ্দুস, তাঁর পুত্র জনাব এহসানুল আমিন বাবু এবং সাবেক চিফ জাস্টিস, তাঁর ভায়রা কামাল উদ্দীন হোসেনের সামনে বলেছেন, “অতঃপর আমি বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধুর অফিসে গিয়ে তাঁর কক্ষে উপস্থিত তাহের উদ্দীন ঠাকুর ও অন্যান্যদের সরিয়ে দিয়ে সব ঘটনা বললাম৷ তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে রইলেন৷ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘আপনি কি সেনাবাহিনীকে আপনার টেলিফোন বাগিং (আড়িপাতার) করার জন্য বলেছেন? নাকি তারা আপনার অনুমতি নিয়ে এ কাজ করেছে?” সরলপ্রাণ বঙ্গবন্ধু এবার হেসে বললেন, ‘তোমাদের সব কিছুতে সন্দেহ৷ তারা আমার সন্তান৷ তারা এসব নিশ্চয়ই আমার ভালোর জন্য করেছে৷’ ১৫ আগস্টের সকালে দয়ালু পিতাকে স্বপরিবারে হত্যা করে সিমার সন্তানেরা প্রমাণ করেছে তারা পিতার ভালোর জন্য এসব করেছে৷ প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী পূর্বের সূত্র ধরে বললেন, ‘জিয়া বিষয়টা বুঝে গেছেন বলে তখন আমিও তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের কথাটা বললাম৷ এতে জেনারেল জিয়াকে খুবই বিপর্যস্ত ও ক্ষুব্ধ হতে দেখলাম৷ তিনি আমার কাছ থেকে একটি সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ স্বহস্তে ইংরেজিতে তাঁর পদত্যাগপত্র লিখে আমার কাছে পেশ করলেন এবং চলে যেতে উদ্যত হলেন৷ আমি জিয়াউর রহমানকে ধৈর্য্য ধারণ করার জন্য বললাম এবং তাঁর জন্য কী করতে পারি সেজন্য আমাকে দু’একদিন সময় দেয়ার জন্য বললাম৷ কিছুটা ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ জিয়া আমাকে স্যালুট করে চলে গেলেন৷ আমি তখন জিয়ার মুখ রক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে তার পক্ষে অনেক করে বললাম৷ তারপর আমি যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে জিয়াউর রহমানের পদত্যাগপত্র পেশ করার বিষয়ে বললাম, তৎক্ষণাৎ তিনি পদত্যাগপত্র অনুমোদনের জন্য তাঁর (রাষ্ট্রপতির) কাছে পাঠিয়ে দিতে বললেন৷ তিনি এই প্রথমবারের মতো দৃঢ়স্বরে আমাকে বললেন যে, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কখনও দোটানায় থাকবা না৷ এটা স্মরণে রেখ৷” তখন আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, “আরেকটি ব্রিগেড গঠনের অবকাঠামো বিন্যাসের যে কাজ আমি করছি, সে কাজ শেষ করার জন্য জিয়াকে আমার আরও কিছুদিনের জন্য লাগবে৷ সেজন্য আগস্ট মাস পর্যন্ত সে আমাদের সাথে থাক৷”
জেনারেল জিয়ার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ না করা, জিয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে সুপারিশ করা এবং উক্ত ঔদ্ধত্যের (পদত্যাগের) পর আর্মির ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তাঁকে উক্ত পদে রাখা, কতখানি আত্মঘাতী হয়েছিল, বারবার চোখ মুছে কাঁদতে কাঁদতে এবং দু’হাত দিয়ে মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে সে কথা আমাকে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সরলপ্রাণ প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী৷ (‘৭১ এর পূর্বে চট্টগ্রামের বেসরকারি সিটি কলেজের অর্থনীতির এই অধ্যাপক সমরনীতির রক্ত পিচ্ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাল ধরেছিলেন, যখন সমরনীতির মূলনীতি “In love & war nothing is unfair” তাঁর অর্থনীতি শাস্ত্রে কখনো তিনি পড়েননি ও পড়াননি৷ সেখানেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উক্ত জেনারেল তাঁকে ল্যাং মেরে বসিয়ে দিয়েছে!)
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জেনারেল জিয়ার জন্য সুপারিশ করছেন দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, “তুমি তার পদত্যাগ এখন গ্রহণ করতে চাও না, কিন্তু জানো না সে কত উচ্চাভিলাষী৷ সে এবং তার মতো সকলকে আমি সন্তানের ন্যায় জানি৷ কিন্তু, তারা সন্তান হতে শেখেনি৷ ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে হাত পাকাচ্ছে৷ নিজের স্বার্থ, নিজের পদের জন্য সবকিছু জলাঞ্জলি দেয় এরা৷ এরা কী জন্যে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল? দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র এদের ভালবাসা নেই৷ তুমি বলছো, আমি এ মাসের জন্য রাখছি৷ কিন্তু ১লা সেপ্টেম্বর থেকে তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করে তাকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিও৷ এতে তারও মঙ্গল, সেনাবাহিনীরও মঙ্গল৷ সন্তান অনেক সময় বুঝতে পারে না কিসে তার মঙ্গল, কিন্তু পিতাকে সন্তানের মঙ্গলের জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নিতে হয়৷ অনেক সময় কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে হয়, একথা ভুলে যেও না৷”
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার পরের ঘটনা বললেন, “বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার পর আমি জিয়াকে ডেকে পাঠালাম৷ তাকে ফোন করে আমার অফিসে শীঘ্রই আসতে বললাম৷ সে প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল৷ জিয়া আসলে তাঁকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছি এবং তিনি আমার অনুরোধ রেখেছেন৷ আপনি আমার সাথে এই নতুন ব্রিগেড-এর কাঠামো পুনর্গঠনের কাজে এ মাসটি আমাদের সাথে কাজ করুন৷ এর মধ্যে আমাদের নতুন ব্রিগেড গঠনের কাজ আমরা শেষ করতে পারবো আশা করি৷ ১লা সেপ্টেম্বর আপনার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করবো৷” আমার কথা শুনে জিয়াউর রহমানকে অত্যন্ত আনন্দিত হতে দেখলাম এবং আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ ‘৭১ সালে চট্টগ্রাম থেকে যে জিয়া আমার সাথে ছিল, একজন বড় মুক্তিযোদ্ধা, তাঁকে আমরা অসম্মানের সাথে বিদায় দিতে চাই না৷ তাঁকে আনন্দিত দেখে আমিও আনন্দিত হলাম৷ তাঁকে বললাম, “নিশ্চয়ই আপনার জন্য আরও ভালো কিছু আছে৷ আপনি আমাদের সাথে থাকুন এবং অপেক্ষা করুন৷ বঙ্গবন্ধু আপনাকে পুত্রের ন্যায় স্নেহ করেন এবং খুবই ভাল জানেন৷ আপনার জন্য সম্মানজনক নিশ্চয়ই তিনি কিছু করবেন৷” জেনারেল জিয়া আমার কাছ থেকে একথা শুনে আমার টেবিলের সামনে বসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করে বললেন, “Sir, I am really grateful to you. You have rescued me from the humiliation. Sir, I shall pay you back the debt one day. Please tell Banga Bandhu whether I am in service or not, my service is always at his disposal”. তার কথায় আমি এত মুগ্ধ হলাম যে, তিন-চার দিন পর গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হলে জিয়ার কথাগুলো খুব আন্তরিকভাবে আমি তাঁকে বললাম এবং তাঁর উচ্চ প্রশংসা করলাম৷ তার পক্ষে অনেক কথা, অনেকবার বললাম৷ তিনি বললেন, “Tell him that I love him like my own son. He will be rewarded. আর্মিতে যে সিস্টেম কাজ করে, সে সিস্টেমের কারণে তাকে হয়ত আর্মিতে রাখতে পারলাম না৷ কিন্তু তাকে বলে দিও আমি তাকে deprived করব না৷ বহু দেশ আছে আমি তাকে Ambassador করে দেব৷ আর সে যদি দেশে থাকতে চায়, উঁচু পদমর্যাদায় আমি তাকে place করে দেব৷ সে যদি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়, ডিফেন্স পার্চেজ তাকে দিও৷ সেক্টর কমান্ডার রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, সেটা আমি দেখতে পারব না৷ সেটা আমি কখনো হতে দেব না৷” বঙ্গবন্ধুর এ সকল কথা বলতে বলতে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো এবং তিনি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না৷ অঝোর নয়নে কেঁদে বুক ভাসালেন৷ শরৎচন্দ্রের দেবদাসের নায়িকা পার্বতী যেভাবে কেঁদে কেঁদে অশ্রুজলে বুক ভাসিয়েছিল!! কারও অশ্রুজলের প্রবাহে জগত সংসার যে প্রবাহিত হয় না, সে নির্মম সত্য শরৎচন্দ্রের পার্বতী যেমন জেনে গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর নুরুল ইসলামও তেমন জেনে গিয়েছিলেন…৷
অধ্যাপক ইসলামকে আমি নম্র নত স্বরে বললাম, “Sir, are you feeling uneasy.” আমি চট্টগ্রামে আগামীকালও আছি৷ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আছি৷ আপনার কাছেই পাঁচ মিনিটের দূরত্বে৷ ফোন করে আমি আবার আসবো৷” তিনি বাকরুদ্ধ অবস্থায় বাম হাত তুলে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন৷ কয়েক মিনিট ধরে অনেক চেষ্টা করে তাঁর কান্না রোধ করলেন৷ তারপর নিজের বুকের ওপর হাত রেখে কয়েকটি বড় বড় দম ফেলে বেদনার্ত স্বরে বললেন, “আমার কল্পনাতেই আসেনি যে, যে জিয়া আমার সামনে তার পদত্যাগ গ্রহণ না হওয়ার সংবাদে আনন্দে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করল! সে তখন থেকে সময় গণনা শুরু করেছে…৷”
আমি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে, জেনারেল জিয়া আগস্ট মাসে আপনার কাছে তাঁর পেশ করা পদত্যাগপত্র আপনি গ্রহণ না করার দিন থেকে তিনি সময় গণনা শুরু করলেন?” অধ্যাপক নুরুল ইসলামের কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠলো এবং তাঁর বড় বড় চোখ দুটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার ওপর নিক্ষেপ করে দৃঢ়চেতা কণ্ঠস্বরে বললেন, “দেখুন, খুন সম্পর্কিত বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত আইনী তদন্ত পদ্ধতি হচ্ছে, “When there is a murder, you are to point the finger at the beneficiary of the act.” ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াকে আমি কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, সে involve ছিল কি-না৷ But he was the beneficiary. কারণ, তা ছিল আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় সত্য৷”
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর অধ্যাপক ইসলাম কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে তার বিন্দু বিসর্গ জেনারেল জিয়াকে বুঝতে না দিয়ে, তার কাছে নতজানু হয়ে তার আস্থাভাজন হয়ে, কোনোক্রমে প্রবাসী সরকারের চার নেতাকে দ্রুত জেল থেকে বের করে জাতীয় সরকার গঠনের যে আপ্রাণ চেষ্টা তিনি করেছিলেন, সে বিষয়ে তিনি উল্লেখ করে বলেছিলেন, “তবে সে সরকারে তুরস্কের সরকারের ন্যায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব জিয়া রাখতে চেয়েছিলেন৷ আমি তাঁর প্রস্তাব যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত বলে সমর্থন দিয়েছিলাম৷ যাতে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে জাতীয় নেতাদের তিনি বের করে আনেন, শুধু সেই লক্ষে৷ তারপর যা হয় হতো৷”
১৫ আগস্টের ট্রাজেডির সময় তিনি সরকারি সফরে ভিয়েনায় ছিলেন৷ তাই আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, “ভিয়েনা থেকে ফিরে জিয়ার সাথে আপনার প্রথম দেখা কখন, কিভাবে হয়েছিল?”

পৃষ্ঠা: ১১৫
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বললেন, “কর্নেল অলি আমাকে গাড়িতে করে জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় নিয়ে গিয়েছিল৷ জিয়ার বাসায় যেতে আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম৷ আমি দোয়া ইউনুস পড়ছিলাম৷ কারণ, সে জানে বঙ্গবন্ধু কিলিং কীভাবে হয়েছে এবং সে এও জানে যে, সে যা জানে, আমি তা জানি৷ আমার ব্যর্থতা, আমার দুর্বলতা কী ছিল সে জানে৷ আর আমার ব্যর্থতা ও আমার দুর্বলতার পরিণতি কী হয়েছে, তার বেনিফিট কে পেয়েছে, আমি জানি৷ সূর্যের মতো তা আমার চোখের ওপর ভাসছে৷ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর বাড়িতে যখন পৌঁছলাম, জিয়া আমাকে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে অনেক সাফাই দিল৷ কিন্তু সে বুঝতে পারছিল যে, তাঁর কোন সাফাই আমার কাছে সে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারছিল না৷ ১৫ আগস্ট সম্পর্কেও সে তাঁর অজ্ঞতার কথা বলছিল৷ বলার জন্য বলছিল৷ তবে ১৫ আগস্টের বিষয় সে সবচেয়ে বেশি জানে এবং আমি সবচেয়ে জানি- এটা আমরা দু’জনে যে এত বেশি জানি, সে তা জানতো এবং সেজন্য, আমার ভয় বেশি ছিল!! কারণ, আমার কাছে তার ১৫ আগস্টের conspiracy স্ফটিকের ন্যায় পরিষ্কার৷ আমিই ছিলাম তার বস-এর বস৷ আমি তাকে আর্মিতে 2nd life দিয়েছিলাম বলেই সে আগস্ট মাসের সময় পেয়ে যায়৷ আমিই সেজন্য দায়ী৷ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি আগস্টের ১ম সপ্তাহে তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করলে এই conspirators- দের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়তো এবং এদের সবার এক সাথে ফাঁসি হতো বা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে এদের মারা হতো৷”
তিনি বললেন, “আমি যে প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ১৫ আগস্টের পূর্বের পটভূমি, বিশেষ করে, আমার কক্ষে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মিটিং চলাকালে বঙ্গবন্ধুর কল ও জিয়ার পদত্যাগ এবং জিয়ার জন্য পুরো আগস্ট মাস সময় বরাদ্দ এবং তার দেড় সপ্তাহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার পশ্চাতে মুখোশধারীদের মুখোশের অন্তরালের আসল চেহারা যে আমার জানা, সে বিষয়ে সেও নিশ্চিত ছিল, আমিও নিশ্চিত ছিলাম৷ সে অবস্থায়, আমিও মৃত্যুর জন্য এক রকম প্রস্তুত হয়ে জিয়ার সাথে সাক্ষাতে গিয়েছিলাম৷”
আমি জনাব ইসলামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং তাঁর এ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য ভবিষ্যত বংশধরদের সত্য ইতিহাস জানার জন্য অপরিহার্য হবে- এ মন্তব্য করে উঠে দাঁড়ালাম৷ তিনি আমাকে হাত দিয়ে বসার ইঙ্গিত করে বললেন, “আমার সাক্ষাৎকারের শেষে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমি এই কথা বলে যাই যে, তারা যেন আমার ব্যর্থতার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেয়৷ আপনি লিখবেন, যত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রই হোক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ ফিরে আসবে এই আশা আমি রাখি৷ কারণ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে পারে না৷ মহাত্মা গান্ধী, হো চি মিন, কামাল আতাতুর্কের মতো বঙ্গবন্ধুর নামও বাংলার আকাশে নক্ষত্রের ন্যায় চিরদিন জ্বলজ্বল করে জ্বলবে৷ বঙ্গবন্ধু ‘৭১ সালে বাঙালি জাতির হাত- পায়ের শৃঙ্খল টুটে দিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরতরে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন৷ বাংলাদেশের মতো কোনো ছোট দেশ আর স্বাধীন হতে পারবে না৷ কাশ্মীর বা তিব্বত বা চেচনিয়া যেমন আর কখনো স্বাধীন হতে পারবে না! ইতিহাসের বিচারে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘সময়’ নির্বাচন অর্থাৎ ‘৭১’ সালকে বেছে নেয়া, তার ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ৷ বাঙালি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম একদিন বঙ্গবন্ধুর ‘ঋণ’ শোধ করবেই করবে৷ এই জাতি একদিন হিমালয় পর্বতের ন্যায় অটল হয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে উঠে দাঁড়াবে৷ সেটা হয়ত আমি দেখে যেতে পারলাম না, কেননা আজ আমি মৃত্যুশয্যায়৷ আমি দেখে যেতে পারলাম না বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু আমি এই দৃঢ় বিশ্বাস রাখি যে, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর খুনিদের মতো বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একদিন না একদিন এই দেশে বিচার হবে এবং আইনের দণ্ড তাদের মাথা পেতে নিতে হবে৷ শুধু সেদিনই বাংলাদেশ খুনিদের অভিশাপ মুক্ত হবে৷ তার আগে হবে না৷ এমন খুনিদের ভার বিশ্বের কোনো জাতি বইতে পারে না৷ তা না হলে আমাদের জাতি বিশ্ব মানব জাতির দরবারে কলঙ্কিত ও অভিশপ্ত জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে৷ খুনিদের লালন-পালন করা আমাদের ইসলাম ধর্মেও নিষিদ্ধ৷ খুনিদের অভিশাপমুক্ত না হলে বাংলাদেশে শান্তি ও আল্লাহর রহমত আসবে না৷”
বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী তাঁর যে প্রতিরক্ষা সচিব জনাব মুজিবুল হক সাহেবের কথা উল্লেখ করেছিলেন- সে বিষয়ে জানার জন্য ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর ইন্দিরা রোডের বাসায় গেলাম৷ তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলামের বর্ণিত উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে বললেন: ‘জেনারেল জিয়া তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরিরত তোমার আমার মতো বেতনভুক্ত কর্মকর্তা৷ বৃটিশ গভর্ণমেন্টের সময় হলে লিখতে হতো your most obedient servant. মিটিং চলাকালে সে যেভাবে প্রতিমন্ত্রীর টেবিল থেকে হোয়াইট শিট টেনে নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে চার লাইনের একটি resignation letter লিখে সাবমিট করলো, that was absolutely in sub-ordination-এর পর্যায়ে পড়ে৷ জিয়া পদত্যাগ পত্র প্রতিমন্ত্রীর সামনে রেখে স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল তাঁর কাছ থেকে কোন অনুমতি না নিয়েই৷
তার চলে যাবার সাথে সাথে আমি প্রতিমন্ত্রীকে বললাম: “Sir, I know, he used to enjoy your blessings and support. But you won’t be able to command him in future. He is different material… You are to decide something before it’s too late, Sir.”
প্রশ্ন: প্রতিমন্ত্রী সাহেব কি জিয়ার ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত সম্পর্কে কি কোন তথ্য পাননি?
জনাব মুজিবুল হক: “আমি জানি না৷ হয়তো পেয়েছেন বা পাননি৷ তবে তিনি তার পক্ষে অনেক কথা আমার কাছে বলছিলেন৷ Zia is very loyal to him and they (Zia & Khaleda) used to visit him regularly… They have developed trust and understanding since 1971. তাঁকে ঐ মিটিং-এ আমি শেষ বারের মতো সতর্ক করে বলেছিলাম: “Sir all of us should be guided by the book. If we deviate, we would face serious consequences.”
মুজিবুল হক স্যার বললেন: “একজন প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে আমার সর্বোচ্চ সতর্ক বার্তা তাঁকে দিলাম৷ ঐ বৈঠকে পুনরায় জিয়া এসে যোগদানের পূর্বে আমি তাঁর মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের সর্বোত্তম সুযোগ দিলাম৷ কিন্তু এক/দেড় ঘণ্টা পরে জেনারেল জিয়া এসে মিটিং-এ পুনরায় যোগদান করলে, প্রতিমন্ত্রীকে দেখলাম উঠে দাঁড়িয়ে, গালভর্তি হাসি হেসে তাঁকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানালেন, তা দেখে মনে মনে আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম৷ আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম, যখন দেখলাম প্রতিমন্ত্রী জেনারেল জিয়াকে বলে দিলেন যে, first September আপনার resignation letter accept করার জন্য বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছেন, at that moment I was sure these people are inviting a disaster. তার দশ/বার দিনের মাথায়, বাংলাদেশের হিমালয় যখন ভেঙে পড়লো, তখন আমার চোখের ওপর ভেসে উঠলো শিল্প ভবনে ক’দিন আগে প্রতিমন্ত্রীর গালভরা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে জেনারেল জিয়াকে অভ্যর্থনা জানানোর দৃশ্য! আমি ১৬ই আগস্ট সংস্থাপন সচিবকে বললাম সে যেন আমাকে তৎক্ষণাৎ অন্য যে কোন মন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেয়৷ কারণ, নবাব সিরাজ উদ্দৌলার সেই ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হয়েছে, বাংলাদেশে মীরজাফরের পুনর্জন্ম হয়েছে৷ আমরা দু’জন দু’জনকে চিনি৷ জিয়া যে এই মহা ট্রাজেডির মূল নায়ক—সেটা যে আমার অভিজ্ঞতার ও জ্ঞানের গন্ডির মধ্যে বিদ্যমান এবং একই সাথে সেটা যে জেনারেল জিয়ার উপলদ্ধির মধ্যে বিদ্যমান, সেটা স্মরণ করে তার ও আমার উভয়ের জন্য এক সাথে, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করা শুভ হবে না বলে আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ক’দিনের মধ্যেই স্বেচ্ছায় বদলি হয়ে যাই৷”
প্রশ্ন: প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী এত বড় ভুল কিভাবে করলেন?
জনাব মুজিবুল হক: “তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের একটি প্রাইভেট সিটি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক৷ অর্থনীতির মধ্যে ডিফেন্সের কোন সংজ্ঞা পড়ানো হয় না৷ “In love and war nothing unfair” এর সংজ্ঞা অধ্যাপক নূরুল ইসলামের অজানা ছিল, তাই তাঁর ব্যর্থতায়, বৈকল্যতায়, হঠকারিতায় তাঁর মনিব ১৫ই আগস্টের নির্মম ট্রাজেডির শিকার হলেন৷ বাংলাদেশ ব্লাকহোলের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হলো৷”
বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকেরা তাঁর বাড়ির ভেতরে নিচতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝামাঝি বাঁকে দণ্ডায়মান অবস্থায় মেজর নূর ও রিসালদার মহীউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বুকের ডান দিকের একটু নিচে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে৷ ব্রাশ ফায়ার করার পূর্ব মুহূর্তে কর্নেল রশীদ ও মেজর ডালিমের সাথে তাঁর কথা চলছিল৷ কর্নেল রশীদ তাঁকে বলছিল যে, “আপনাকে আমরা চোখ বেঁধে ও হাত বেঁধে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবো বিচার করার জন্য৷” বঙ্গবন্ধু বলছিলেন: “কোথায় আমাকে নিয়ে যেতে চাস তোরা? সেজন্য আমার চোখ বাঁধবি তোরা? আমার হাত বাঁধবি তোরা? জানিস, ২৫শে মার্চ পাক সেনারা এই বাড়ি থেকে আমাকে সসম্মানে নিয়ে গেছে৷ তারা আমার চোখ বাঁধার কথা বলার সাহস পায়নি৷ পাক সেনাদের মেজর বেলাল আমাকে স্যালুট দিয়ে তার জিপের সামনে বসিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে৷ আর তোরা আমার চোখ, হাত-পা বাঁধতে চাস? কেন রে? আমি কি মৃত্যুকে ভয় পাই?”
বঙ্গবন্ধুর কথা শেষ না হতেই সিঁড়ির নিচে দাঁড়ানো চাকরিচ্যুত মেজর নূর (নূর রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টির সক্রিয় সদস্য হন) বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা কর্নেল রশীদ ও মেজর ডালিমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “Time is running out, time is running out, he is killing time, get aside, get aside.” বলতেই ওরা দু’জন বঙ্গবন্ধুর পাশ থেকে চোখের পলকে সরে যায়৷ সাথে সাথে মেজর নূর ও রিসালদার মহীউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বুকের ওপর স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার চালায়৷ বঙ্গবন্ধু তাঁর ডান হাতের শাহাদাৎ উঁচিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘাতকদের ব্রাশ ফায়ারে তাঁর ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুল ভেঙে যায়৷ যে আঙ্গুলের নির্দেশে লক্ষ লক্ষ হানাদার পাক সেনা ও তাদের জেনারেলরা তাঁর সামনে মাথা নত করেছে, যে অঙ্গুলি হেলনে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় সেনা ঢাকা স্টেডিয়ামে তাঁকে অভিবাদন করে গার্ড অব অনার দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৫ই মার্চ বাংলার মাটি ছেড়ে চলে গেছে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে গত সত্তর বছর ধরে বহু দেশে আমেরিকান সৈন্যরা ইউরোপ ও জাপানে আজও ঘাঁটি করে বসে আছে), বঙ্গবন্ধুর সেই শাহাদাৎ আঙ্গুলে গুলি করে ভেঙে দিয়েছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবিদের ঔরসজাত জারজ সন্তানেরা৷ বাঙালি জাতির চির দুশমন পাঞ্জাবিদের ঔরসজাত বীজ এরা৷ বাঙালি মায়ের গর্ভজাত বটে, কিন্তু বাঙালির জাত দুশমন পাঞ্জাবিদের ঔরসজাত বেজন্মা এরা৷
১৯৮৮ সালে ৩০শে ডিসেম্বর পাকিস্তানের লাহোরে তদানীন্তন পাঞ্জাবের গভর্ণর জেনারেল টিক্কা খান, ২৫শে মার্চ রাতে যে রক্তপিপাসু হায়েনা বাংলাদেশের বুকে গণহত্যার তাণ্ডবলীলা করে ঢাকার বুকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, সে আমাকে সেখানে দেয়া সাক্ষাৎকারে (“Bangladesh Wins Freedom”) খুব আত্মতৃপ্তি ও গর্বের সাথে বলেছে, “২৬শে মার্চ (১৯৭১) আমি নিজে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে আমার ফ্ল্যাগ কারে করে তোমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে তেজগাঁও এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে একজন জাতীয় নেতার মর্যাদায় সসম্মানে তাঁকে আমি করাচিগামী পিআইএ’র বিমানে তুলে দেই৷ তুলে দেবার সময় তাঁকে আমি সামরিক কায়দায় স্যালুট করে বলি: স্যার, আমাকে নিজগুণে মার্জনা করবেন, আমি একজন অনুগত গভর্ণর হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের হুকুম তামিল করেছি মাত্র৷ আমি আশা করি, সেখানে পৌঁছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হবে এবং আপনি আপনার ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবেন৷” (টিক্কা খান হ্যান্ডশেক করার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার দিকে না তাকিয়ে সোজা বিমানে উঠে যান৷)
জেনারেল টিক্কা খান তাঁর সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে আমার উচ্চারিত বার বার গণহত্যা বিষয়ক প্রশ্নে এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালি মা-বোনের ধর্ষণের তীব্র প্রশ্নে বিব্রত ও উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, “Stopped your tall talk. You should be ashamed and condemned in hell for killing your own Father of the nation, when I had sent him to Pakistan alive with full honour and giving him a military salute at Dhaka airport. To take a lesson, you now put my shoes on your head and go to Bangladesh through Asian highways continuously saying to the people on both sides that General Tikka Khan was

পৃষ্ঠা: ১২০
a great man, who kept Sheikh Mujib alive. But it was the Bengalee bustards beasts, who killed him. “
[তোমার বড় বড় বুলি বন্ধ করো৷ তোমাদের জাতির জনককে তোমরা যে খুন করেছো, সেজন্য তোমাদের ঘৃণিত বাঙালি জাতি নিয়ে তোমরা জাহান্নামের মধ্যে পতিত হও৷ যখন আমি তাঁকে ঢাকা বিমান বন্দরে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানে প্রেরণ করেছিলাম৷ এখন তোমার শিক্ষার জন্য, তুমি আমার পাদুকা জোড়া তোমার মাথার শিরোস্ত্রাণ করে এশিয়ান হাইওয়ে ধরে ঢাকা অভিমুখে রওনা দেও এবং মহাসড়কের দু’ধারের সকল পথচারীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে বলতে যাও যে, জেনারেল টিক্কা খান একজন মহামানব, শেখ মুজিবকে যিনি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বাঙালি জারজ সন্তানেরা এত বড় নরাধম যে, তারা শেখ মুজিবকে খুন করেছে”৷]
আমাকে দেয়া জেনারেল টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার পাকিস্তানের বিখ্যাত “দি ডন” এবং “দি মুসলিম” পত্রিকায় প্রকাশের জন্যও আমি দিয়েছিলাম (“দি ডন” পত্রিকায় তা সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপাও হয়) বিধায় বাঙালি জাতিকে মান-অপমান করে ও সম্ভ্রম হানি করে তার উচ্চারিত উপরোক্ত নোংরা বক্তব্যগুলো আমি প্রকাশে বিব্রত বোধ করেছিলাম৷ আমার ইংরেজি ও বাংলায় লেখা “Bangladesh Wins Freedom” বইতেও তার বক্তব্যের উপরোক্ত অংশ প্রকাশ থেকে বিরত ছিলাম৷ কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে টিক্কা খানের বক্তব্যের পরম্পরা বিদ্যমান বিধায় তার উপরোক্ত বক্তব্য এই বইতে প্রকাশের অনিবার্যতা বিবেচনা করে প্রকাশ করলাম৷
মহান বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে গণহত্যাকারী টিক্কা খানের এরূপ মানহানিকর ও সম্ভ্রম হানিকর বক্তব্যে সমগ্র বাঙালির গৌরব মহিমা ম্লান হবে না, বরং খুনি মোশতাক-জিয়াসহ খুনিদের সহায়তাকারী সচিব ও জেনারেল এবং তাদের পক্ষ অবলম্বনকারী রাজনৈতিক নেতাদের কপালে পেরেক বিদ্ধ হবে টিক্কা খানের ক্ষুব্ধ-তীর্যক মন্তব্য: “It was the Bengalee bustards beasts, who killed Sheikh Mujib.”
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ভালোভাবেই জানতো যে, ধানমন্ডিতে ১৫ই আগস্টের সেই কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাড়ির বাইরে এনে তাঁর ওপর গুলি করতে পারতো না, সেজন্য বাড়ির ভিতরে সিঁড়ির বাঁকে তাঁকে গুলি করে৷ বাড়ির বাইরে যেসব সাধারণ সৈনিকরা ছিল, চাকরিচ্যূত অফিসার ও কর্নেল রশীদ- ফারুকরা তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সমবেত করেছিল ভারতীয় আক্রমণকারী সেনারা বঙ্গবন্ধুকে হাইজ্যাক করে যাতে ভারতে নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিরাপদে নিয়ে যাবার কথা বলে৷ বঙ্গবন্ধুকে বাড়ির বাইরে তাদের সামনে এনে তার ওপর একটা গুলি করলে, সাধারণ সৈনিকরা তাদেরকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলতো৷
ফিল্ড মার্শাল এস.এইচ.এফ.জে. মানেক শ’ দিল্লিতে তাঁর বাসায় ২০০৬ সালের জুন মাসে আমাকে দেয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে এশিয়ার মানবগোষ্ঠীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা মর্মন্তুদ ঘটনা এবং বিশ্ব মানবজাতির ভাগ্য উন্নয়নে ভূ-প্রকৃতি বদলে যাবার মতো ভূমিকম্পের আঘাত বলে বর্ণনা করে বলেছিলেন, “পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকরা শেখ মুজিব সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল৷ তাঁর উত্থান সম্পর্কে বোবা ছিল ও তাঁর ক্যারিশম্যাটিক লিডারশীপ সম্পর্কে অন্ধ ছিল৷ একজন অন্ধ, কালা, বোবাকে হিমালয় দেখানো, বোঝানো এবং শোনানো যেমনটা অসম্ভব ও অবাস্তব…ঠিক তেমনই পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী ও আবদ্ধ অবস্থায় বেড়ে ওঠা বাঙালি সৈনিকদের কাছে শেখ মুজিবকে দেখানো, বোঝানো এবং শোনানো অবাস্তব ও অসম্ভব ছিল৷ আমরা দু’জন এখানে যে কথা বলছি, এ সময় আকাশ থেকে আমাদের কাছে যদি অন্য গ্রহের কোনো প্রাণি এসে উপস্থিত হয়, তাহলে সে আগন্তুক প্রাণি যেমন আমাদের কাছে অবোধ্য হবে এবং আমরাও তার কাছে এবং আমাদের ভাষা, আমাদের দেখা এবং আমাদের অনুভূতি তাকে যেমন স্পর্শ করবে না, তেমনি তার ভাষা, তার দৃষ্টি এবং তার অনুভূতি আমাদের কোনো কিছুকেই আকর্ষণ করবে না৷ শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চতা ও কারিশমা নিরীক্ষণে পাকিস্তান প্রত্যাগত বাঙালি সৈনিকদের অনুরূপ দৃষ্টির, অনুভূতির এবং চেতনার বৈকল্য ও বৈপীরত্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কারণ, তারা দীর্ঘকাল পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে সীমিত অক্সিজেনে বিকলাঙ্গ হয়ে বেড়ে উঠেছিল৷ পাকিস্তানি মতাদর্শ ভেঙে একটি স্বাধীন বাঙালি জাতির উত্থানের এক কণাও তাদের রক্ত কণিকায়, হাড়ে, মজ্জায় ও চিন্তা-চেতনায় ধারণ করতে অপারগ ছিল এবং মগজে নিষিদ্ধ ছিল৷ পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে, এমনকি পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পত্রিকা “দৈনিক জং” পড়তে দেয়া হলেও, কখনো কখনো তার দু-একটি কপিও সেন্সর করা হতো৷ পাকিস্তানের মোটামুটি নিরপেক্ষ সংবাদপত্র “ ডেইলি ডন” (মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রতিষ্ঠিত) পাকিস্তানের কোন ক্যান্টনমেন্টে পড়তে দেয়া হতো না৷ তাদের ক্যান্টনমেন্টে এক ব্যান্ড রেডিও সবাইকে শুনতে দেয়া হতো, যাতে শুধু রেডিও পাকিস্তান ছাড়া আর কোনো রেডিও ধরা যেতো না৷ বাঙালি জাত্যাভিমানের বিকিরণে বিকশিত হতে পারেনি তাদের বিবেক৷”
তিনি আরও বলেছিলেন: “সুতরাং পাকিস্তানের পূর্ব অংশে, যা বৃটিশ ভারতে এবং তৎপূর্বে পূর্ব বাংলা নামে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল, সেখানকার নির্যাতিত, অবহেলিত, বঞ্চিত বাঙালি নামক জাতিগোষ্ঠীর হৃদয় ভেদ করে ঈশ্বর যে তাদের জন্য একজন মুক্তিদূতের জন্ম দিচ্ছেন এবং শত-সহস্র বর্ষব্যাপী বাঙালির রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের ভূমিতে যে একজন মহামানবের উত্থান ঘটছে, যার উচ্চতা হিমালয়েরও উচ্চে অধিক এবং যার কারিশমা সূর্যের শক্তির অপেক্ষা অধিক- তা পাকিস্তান প্রত্যাগত সৈনিকদের দৃষ্টিশক্তির অন্ধত্ব, অনুভূতি শক্তির আড়ষ্টতা এবং চেতনাশক্তিতে ভোতা মরচে পড়ার কারণে ধারণ করতে ও অনুধাবন করতে পারেনি৷ বেলুচিস্তানে ঈদগাহে ধর্ম-বর্ণের মহামিলনের ঈদের দিন টিক্কা খানের হুকুমে বোমা বর্ষণ করতে ও নামাজিদের ওপর গোলাগুলি চালাতে যেমন তাদের বোবা বিবেকে বাধে না, তেমনি ঢাকার বুকে বিংশ শতাব্দীর এক মহামানবের ওপর গোলাগুলি বর্ষণ করতে তাদের বোবা বিবেকে বাধে না৷ কারণ, তারা ত্রিশ লক্ষ শহীদের দেশ বাংলাদেশে ভিন গ্রহ থেকে, মঙ্গল গ্রহ বা চন্দ্র থেকে আগত অজানা, অচেনা প্রাণি সম, যারা ভুল করে শেখ মুজিবের বাংলাদেশে তাদের অজান্তে, অনিচ্ছায় নেমে পড়েছে৷ তারা ঐদিন শেখ মুজিবের পরিবারের সকলের সাথে ঢাকার সকল নর-নারীকে হত্যা করলেও বিশ্ববাসী ও আমি বিস্মিত হতাম না৷ কারণ, তারা ভিনগ্রহের জীব, বোবা, কালা, অন্ধ৷ তাদের সাথে তোমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ এবং তোমাদের ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মদানের পূণ্যময় চেতনার এক ভগ্নাংশ পরিমাণ সংযোগ ঘটেনি৷ তোমাদের বাংলাদেশ যে ত্রিশ লক্ষ শহীদের পূণ্য রক্তস্নাত একটি মন্দির- তাদের চেতনা তা স্পর্শ করতে ব্যর্থ৷ তোমাদের শেখ মুজিবের নাম যে, তোমাদের জাতিকে অতিক্রম করে বিশ্ব মানবজাতির পরম অরাধ্য প্রাতঃস্মরণীয় নাম হয়ে উঠেছে- সে গৌরব গাঁথা, তাদের হৃদয়ে অনুরণন তুলতে ব্যর্থ৷ দিল্লিসহ ভারতবর্ষের বহু বাড়ির পূজার ঘরে শেখ মুজিবের ছবি রেখে তাকে দেবতারূপে আমি পূজা করতে দেখেছি৷ শুনেছি, লন্ডনসহ বহির্বিশ্বের যেসব দেশে বাঙালিরা আছেন, সেখানে বাঙালিরা তাঁকে পূজার ঘরে রেখে অনুরূপভাবে পূজা করেন৷ ভিনগ্রহের জীবেরা এই পূজার মাহাত্ম্য ও হৃদয় নিংড়ানো ঐশ্বরিক ভালবাসার উৎসের সন্ধান পায়নি৷ তারা বড় দুর্ভাগা৷ বাঙালি জাতির সাথে বা বিশ্ব মানব জাতির সাথে তাদের কোনো সংযোগ হয়নি বলেই ১৫ই আগস্টে মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় এই মহামানবকেও আমরা হারালাম৷ তাঁর কাছে মানব জাতির অনেক কিছু পাবার ছিল৷”
বেদনাদীর্ণ বক্ষে অনুরূপ আফসোস ব্যক্ত করেছিলেন মুসলিম বিশ্বের সর্বজন শ্রদ্ধেয় এক মহান রাষ্ট্রনায়ক এবং আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার ড. মাহাথির মোহাম্মদ৷ ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন৷ তাঁর ঢাকা আগমনের পূর্বেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক আমার লেখা ১০০০ পৃষ্ঠা সম্বলিত বই “Bangladesh Wins Freedom” লেখকের উপহার স্বরূপ কুয়ালালামপুরে তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়েছিল৷ সেই সূত্রে তাঁর অফিসের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং আমার সাথে ঢাকায় তাঁর সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারিত হয়৷ সে মোতাবেক হোটেল সোনারগাঁও-এ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার বইটি তাঁর হাতে তুলে দেই৷ তিনি আমার বইটি হাতে নিয়ে বললেন, “তোমার বই পুরোটা আমি পড়ে এসেছি৷ কিন্তু আক্ষেপ আমার, স্বাধীন বাংলাদেশ যাঁর সৃষ্টি, তাঁর সাথে আমার দেখা হলো না৷ অথচ, তাঁর বয়স আমার বয়স কাছাকাছি ছিল৷ তাঁর কাছ থেকে আমার মতো লোকদের শিক্ষা নেবার, দীক্ষা নেবার অনেক কিছু ছিল৷ বাংলাদেশে যতবার আসি, সেই আফসোস ও মর্মবেদনা নিয়ে ফিরে যেতে হয়৷ আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবকে অসময়ে হারানো- বিশ্ব মানবজাতির জন্য বিরাট পরাজয়৷ নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়ে তোমাদের শেখ মুজিবের কৃতিত্ব অনেক বড়৷ কিন্তু তাঁর অবর্তমানে বাংলাদেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ও এতিমের মতো অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্যে অগ্রসর হচ্ছে৷ জন্মের পরপরই বাংলাদেশ অভিভাবকহীন ও স্বাধীনতার অন্যান্য রূপকারদের নেতৃত্বহারা হওয়ায় এই দেশটির যে বিশাল সম্ভাবনা ও শক্তিশালী হবার সুযোগ ছিল, তা অনেকটা থেমে যায়৷ তোমাদের জাতির ভাগ্যে এমন বড় একটা ট্রাজেডি দেখে খুব অনুতাপ হয়৷ আফসোস হয়৷” (ডঃ মাহাথির মোহাম্মদের উপরোক্ত বক্তব্যসহ তাঁর হাতে আমার বই দেবার ছবি ২৪ ও ২৫শে ডিসেম্বর, ২০০৪ তারিখে বাংলাদেশের অধিকাংশ সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল৷)
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক মহান মানুষের কণ্ঠে আমাদের জাতির জনক সম্পর্কে এমন আন্তরিক বিশ্লেষণ আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল৷ আবেগে আমার কণ্ঠস্বর বুজে এলো এবং আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো৷ আমি কোনক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে হ্যান্ডসেক করলাম এবং মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পক্ষ থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলাম৷
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ অভিভাবক ইন্দিরা গান্ধী, জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ (রেফারেন্স: “Bangladesh Wins Freedom”), মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ- ভারত যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ এবং বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদসহ ১৯৭১ সাল থেকে বিশ্বের দেশে দেশে মানব জাতির দিক নির্দেশক শ্রেষ্ঠ নক্ষত্ররা বঙ্গবন্ধুর জন্য অসীম আফসোস ও মর্মবেদনা নিয়ে যা উচ্চারণ করে গেছেন, মাহাথির মোহাম্মদের কণ্ঠস্বরে তা ২০০৪ সালে ঢাকায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল: “ …আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিবকে অসময়ে হারানো বিশ্ব মানবজাতির জন্য বিরাট পরাজয়৷ ”
মানবজাতির সেই পরাজয়ের বেদনা অশ্রুসিক্ত বক্ষে রক্তক্ষরিত হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর বীর বাঙালি জাতি হিমালয়ের শক্তিতে পুনঃউত্থিত হচ্ছে—কবি নজরুল ইসলামের কণ্ঠস্বরে বীর বাঙালি জাতির কণ্ঠে ইস্পাত কঠিন শপথ পুনরায় উচ্চারিত হচ্ছে, “বল বীর চির উন্নত মম শির”- আকাশ বাতাস ধ্বনিত মথিত করে ৫৪০০০ বর্গমাইলব্যাপি বাংলাদেশে ‘৭১-এর ন্যায় আবার মুখরিত হয়ে উঠেছে রণাঙ্গনের রণধ্বনি “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”৷
বিশ্বের কোটি কোটি বঙ্গজননী, বিশ্বের যিনি যেথায় আছেন, প্রতিদিনের সূর্যোদয়ের পূণ্য প্রভাতে আপনার কোলের শিশুর কপালে পরিয়ে দিন বাঙালির বীরত্বের জয়টিকা, বিজয় টিকা৷ বিশ্বের ত্রিশ কোটি বাঙালি যে, যেখানে আছেন, বিশ্বের দিকে দিকে উড়িয়ে দিন বাঙালির বিজয় পতাকা, আর তাতে স্বর্ণাক্ষরে লিখে দিন, “বাঙালি বীরের জাতি, বাঙালি ত্রিশ লাখ শহীদের জাতি৷ বাঙালি শ্রেষ্ঠ জাতি, বাঙালি অমর জাতি৷ বাঙালি জাতির অমর প্রাণ, সুর্যের নামে নাম, শেখ মুজিবুর রহমান৷ আকাশে যতদিন সূর্য উদ্ভাসিত হবে এবং পৃথিবীর বুকে সূর্য কিরণ ছড়িয়ে পড়বে, ততদিন সূর্যের পাশে বীর বাঙালি জাতি উদ্ভাসিত হবে এবং সূর্যের ন্যায় পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি পূণ্য কিরণ ছড়িয়ে দেবে৷ সেই কিরণে উদ্ভাসিত হবে মানবজাতি৷ উদ্ভাসিত হবে পূণ্যালোকে, শুভকর্মে৷ বিশ্ব ভূবন জুড়ে বাঙালি জাতির জয়গান উঠবে- জয় হোক বাঙালির৷ জয়তু বাঙালি৷

———X———