নৈইনগাঁও গণহত্যা, সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা সদর থেকে সাত মাইল পশ্চিমে নৈইনগাঁও। সুরমা নদী বয়ে গেছে গ্রামটির দক্ষিণ পাশ দিয়ে। এ অঞ্চল বর্তমানে দোয়ারা বাজার থানার অন্তর্ভুক্ত। টেংরাটিলা থেকে পাইপলাইনের সাহায্যে যে গ্যাস ছাতক সিমেন্ট কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়, তা নৈইনগাঁওয়ের ভেতর দিয়েই চলে গেছে। তাই একাত্তরের যুদ্ধের সময় গ্রামটির গুরুত্ব উভয় পক্ষের কাছে ছিল অপরিসীম।
নৈইনগাঁওয়ের পাশে বেতুরা গ্রাম। সেই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গঠন করে রাজাকার বাহিনী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, খুন ও রাহাজানি চালিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে।
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত অভিযানের সংবাদ পাকবাহিনীকে অবহিত করে। আটক করে সুনামগঞ্জ-ছাতক রুটে চলাচলকারী একটি লঞ্চ। তারপর সৈন্য আর অস্ত্র দিয়ে বোঝাই করে লঞ্চটি। ১৮ আগস্ট রাতের শেষ প্রহরে লঞ্চটি রওনা হয় নৈইনগাঁও অভিমুখে। পাকবাহিনীর নেতৃত্বদানকারী কমান্ডারের পাশে চাটুকারটিই ছিল বাঙালি নামের কলঙ্ক সেই দালান। তরতর করে পানি কেটে লঞ্চটি অগ্রসর হচ্ছিল। তার নির্দেশমতো নোঙর করা হয় লঞ্চ। বেরিয়ে আসে হায়েনার দল।
বেলা তখন আটটা। গ্রামবাসীর অনেকে মাঠে কাজ করছেন। হালচাষ, আউশ ধান কাটা, কিংবা আমন ধান রোপণ করছেন তাদের কেউ কেউ। গ্রামের মা এবং গৃহবধূরাও ব্যস্ত। আগস্টের রোদ তখন একটু একটু করে চড়তে শুরু করেছে। মাথার ঘাম পা পর্যন্ত গড়াচ্ছে ক্ষেতমজুরদের। এ সময়ই নৈইনগাঁওয়ের পূর্বভাগ জুড়ে হৈ-হুল্লা আর আর্তচিৎকার শুরু হয়ে যায়। পাকসেনারা প্রবেশ করেছে গ্রামে। ছুটতে শুরু করেছে যে-যেদিকে পারে সেদিকে, মসজিদে আশ্রয় নিচ্ছে ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে। এদিকে দেখতে দেখতে গ্রামটির আকাশ ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক ইদ্রিছ আলীর বাড়ি তখন সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে আটক করেছে তারা ইদ্রিছ আলীকে। বাড়িতে, পথেঘাটে, পুকুরে, দাওয়ায় যেখানে যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে আনতে থাকে। এভাবে ধৃত সবাইকে একত্র করে তারা। সেই সাথে পূর্ব পাড়ার বাকি ২৫-৩০টি বাড়ির সব কটাতেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি চলে লুটতরাজ। লাখ লাখ টাকার সম্পদ মুহূর্তে হয়ে যায় লোপাট। অত্যাচারে জর্জরিত হয় অসংখ্য মানুষ। ধর্ষিত হয় বহু মা ও বোন।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত