You dont have javascript enabled! Please enable it! ডেমরা গণহত্যা | পাবনা - সংগ্রামের নোটবুক

ডেমরা গণহত্যা, পাবনা

হিন্দু সম্প্রদায় প্রধান এলাকা ডেমরা বাজারে জুন মাসের একদিন নেমে এসেছিল পাক পিশাচদের পাশবিকতা। ডেমরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তথা এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর পূর্ব যোগাযোগের মাধ্যমে বাঘাবাড়ি ক্যাম্প থেকে পাকবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল ডেমরা বাজারে। তারা শেষ রাতের দিকে সমস্ত গ্রাম ঘিরে ফেলে। যারা বাইরে বেরিয়েছিল পাক পশুদের বুলেটে ঝাঁঝরা হলো তাদের বুক, মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ ছুটে পালাতে লাগল ঘটনার আকস্মিকতায়। কিন্তু তখন সমস্ত গ্রাম ঘিরে যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাক পশুরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলল হত্যাকাণ্ড। নিমেষে সমস্ত এলাকায় জমে গেল লাশের পাহাড়। রেহাই পেল না কোনো মানুষই। ঘরে ঘরে হানা দিয়ে পাক পশুরা হত্যা করল নারী ও শিশুদের। সকল কাকুতি-মিনতি উপেক্ষা করে অবশিষ্ট গ্রামবাসীকে লাইন করে দাঁড় করানো হলো একটি খাদের ধারে। তারপর গুলি চালানো হলো নৃশংসভাবে। লাশগুলো একের পর এক লুটিয়ে পড়তে লাগল খাদের ভেতরে। আর সেই সাথে মৃত্যুপথযাত্রীদের আর্তনাদে ছেয়ে গেল সমস্ত ডেমরা গ্রাম।
হত্যার সে কী অভিনব পদ্ধতি, যা স্মরণ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী আইনুল হক সাহেব আজও শিউরে ওঠেন। নিরীহ গ্রামবাসী বলাই রায় ও তার ভাইকে ধরে এনে দুজনকে বাঁধা হলো দড়ি দিয়ে। তারপর তাদের সমস্ত শরীর কেরোসিন দিয়ে ভিজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে জীবন্ত পোড়ানো হলো দু ভাইকে একসঙ্গে। আর সেই মৃত্যুপথযাত্রীদের আর্তনাদ শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল পাক পশুরা। ডেমরা স্কুলের সেক্রেটারি ও নিঃস্বার্থ সমাজসেবক বারাম কুণ্ডু ও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ধীরেন্দ্র নাথ কুণ্ডুকেও মারা হয়েছিল একইভাবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন যুবতীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী আইনুল হক সাহেবের দুটো চোখ বারবার অশ্রুসজল হয়ে পড়ছিল। নববিবাহিত স্বামীকে নিয়ে এতটুকু নিরাপত্তার আশায় ঐ যুবতী এই হত্যাযজ্ঞের আগের রাতে ডেমরায় এসেছিল উল্লাপাড়া থেকে। তাকে ধরে আনা হলো স্বামীর সম্মুখে, পাক পশুরা তাকে দু’হাতে ধরে রেখে চোখের সামনেই বেয়োনেটের খোঁচায় হত্যা করে তার স্বামীকে। এরপর পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে হত্যা করা হয় সেই যুবতীকেও।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কোলাহলপূর্ণ একটি গ্রাম বিরান অঞ্চলে পরিণত হলো। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের বাড়িই সেদিন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। পাক বর্বর ও তার দোসররা লুট করেছিল বাজারের সবগুলো দোকান। পোড়া ঘর- বাড়ির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে শুধু লাশের স্তূপ পড়ে থাকে বেশকিছু দিন ধরে। সৎকার করার মতো লোকও সেদিন অবশিষ্ট ছিল না। যারা বেঁচেবর্তে ছিলেন তারা সেই নরক থেকে সেদিন আহতাবস্থায় ছুটে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রাম খাগুরিয়া, ডাকবাড়িয়া ও সাটপাড়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। এতেও সেদিন পাক পশুদের পাশবিকতার পরিতৃপ্তি ঘটেনি। ডেমরা বাজারের ঐতিহ্যবাহী কালীমন্দিরে প্রবেশ করে তারা কালী মূর্তিটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে এবং মন্দিরে ধরিয়ে দেয় আগুন। সেদিন ডেমরা বাজারে পাক পিশাচরা হত্যা করেছিল ৩ থেকে ৪ শত নর-নারী- যুবক-বৃদ্ধ-শিশুকে।
[১৭] আবুল কালাম আজাদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত