You dont have javascript enabled! Please enable it! জৈন্তাপুর উপজেলা গণহত্যা | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

জৈন্তাপুর উপজেলা গণহত্যা, সিলেট

সিলেট জেলার পূর্ব প্রান্তের একটি উপজেলা জৈন্তাপুর। সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে সারি নদী বাহিত মূল্যবান বালু আর নুড়িসমৃদ্ধ এই স্থানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও লীলাভূমি। এখান থেকে বিপুল অর্থের পাথর, কমলা, তেজপাতা, পান ও লেবু ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন অংশে চালান হয়ে থাকে। সিলেট জেলা শহর থেকে ২৬ মাইল দূরবর্তী এই ছোট উপজেলাটির গুরুত্ব তাই অত্যধিক। কিন্তু এই এলাকার গুরুত্ব কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচারেও এর ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঘটনাবহুল।
মে মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী জনৈক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে জৈন্তায় প্রবেশ করে কিছু দেশদ্রোহীর সহায়তায়। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজবাড়ি আর জৈন্তা বাজারকে কেন্দ্র করে স্থাপন করে তাদের ডরা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি জৈন্তাকে পরিণত করে একটি বিরানভূমিতে। উপজেলার অধিকাংশ এলাকাই পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, যাতে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আত্মগোপন করতে না পারে।
গ্রাম থেকে গ্রামে পাকবাহিনী এদেশীয় সহযোগীদের সাথে নিয়ে সংঘটিত করতে লাগল একের পর এক জঘন্য পাপকর্ম। আর তাদের এ জাতীয় তৎপরতার প্রথম শিকার হলেন নিজপাট গ্রামের আলতাফ হোসেন ও রাসিক আলী। আলতাফ হোসেনের ভাই সিরাজ উদ্দিন ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের বহু আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন ভারতে। সেই অপরাধে পাকবাহিনী তাদের এ দেশীয় কিছু সহযোগী সহচরসহ ধরতে গেল আলতাফ হোসেনকে। সংবাদ পেয়ে আলতাফ হোসেন ও রাসিক আলী বাড়ি ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করেন; কিন্তু সক্ষম হননি। স্থানীয় দালালরাই ওই দুজনকে ধরে সোপর্দ করে পাক হানাদারদের হাতে। ধরা পড়ার প্রায় সাথে সাথেই তাঁদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁদের লাশ দুটো অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে বেশ কয়েক দিন ধরে। তারপর কিছু লোক সাহস করে বাজারের দক্ষিণে তাঁদের গলিত লাশ দাফন করে।
পাকবাহিনীর পরবর্তী শিকার হলেন একই গ্রামের মনই মিয়া। তাঁকেও বাড়ি থেকে ধরে এনে গুলি করা হয়। রাজা ফতে খাঁর খননকৃত পুকুরে পানি পান করতে নামে এক রাখাল। কিন্তু অঞ্জলি ভরে পানি মুখে দেয়ার আগেই তাঁর বুকে বিদ্ধ হলো পাকবাহিনীর ছুড়ে দেয়া গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সেও হয়ে গেল স্বাধীনতার বলি। ওই একই দিনে হত্যা করা হয় বিড়াখাই গ্রামের ফরমান আলীকে।
এবার নরখাদক হামিদ হানা ছিল রূপচেং গ্রামে। সেখানকার মতচ্ছির আলী এবং তাঁর আর এক সহযোগী তখন আহার গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু আহারপর্ব শেষ করার আগেই তাঁদের প্রাণ দিতে হলো জল্লাদদের হাতে। স্থানীয় মন্দিরের ভেতরে উপাসনারত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে তারা রাইচরণ বৈষ্ণবকে। নিজপাটের ময়না খাসিয়াকেও আক্রমণ করে তাঁর ঘরে ঢুকে। কোনো বাক্যব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গুলি করে। আর সাথে সাথে মারা যান তিনি।
অপারেশন চলল বিড়াখাইয়ে। ধর্মের তথাকথিত ধ্বজাধারী, ইসলাম ও মানবতার দুশমন ইয়াহিয়া-টিক্কার লেলিয়ে দেয়া পশুরা এ এলাকায় ঢুকে প্রথমেই হত্যা করে হাজী কনু মিয়াকে। তারপর হাজী কনু মিয়ার ভাই ফরমান মিয়াকে। আস্কন্দর আলী ও হকছন আলীকে তারা কনু মিয়া ও ফরমান মিয়ার লাশের ওপর দিয়ে নিয়ে যায় দরবস্তে। সেখানে নিয়ে এসে হত্যা করা হয় এই নিরস্ত্র দুজনকে। কন্যাকেইয়ের দুজন দরিদ্র জেলে জীবিকার তাগিদে মাছ ধরছিল হাওরে। সেখানকার কিছু দালালের প্ররোচনায় এঁরাও বিনা কারণে শহীদ হলেন পাক জল্লাদদের হাতে।
হেলিরাই গ্রামের আবদুর রহিম ও তাঁর ছেলে সিরাজ উদ্দিনকে একদিন ধরে নিয়ে যায় একদল নরপিশাচ। উভয়কে নিয়ে দাঁড় করানো হয় সারি স্কুলের উত্তর পাশে। একই বুলেটে পিতা-পুত্র দুজনকেই হত্যা করে পাকিস্তানি পশুরা। তারপর জাঙ্গালহাটির শামসুল হককেও একইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর শেষ পরিণতি সম্পর্কে পরে আর কিছু জানা যায়নি। কেউ বলেন, সারি নদীর তীরে নিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কেউ বলেন, সুরমা দিয়ে ভেসে গেছে তাঁর লাশ।
পাকিস্তানি হায়েনারা হেলিরাই গ্রামে হানা দিয়ে এখানকার বাইগন মিয়া এবং খলা গামের ইছাক মিয়াকে তারা হত্যা করে। ধীরে ধীরে স্থানীয় নারী-পুরুষ উপর্যুপরি তাদের নিধনযজ্ঞের শিকার হতে থাকে। সেখানকার এক ফল বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ী মাহমুদ হোসেনকে একদিন ধরে নিয়ে যায় পাক পশুরা। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। দিঘারাই গ্রামের মিঠাই মিয়ার বাবাকেও তারা হত্যা করে নৃশংসভাবে।
আসামপাড়ায় তারা হত্যা করে আবদুল হালিম, সুন্দর আলী ও মালু মিয়াকে। লক্ষ্মীপুর এলাকায় হত্যা করে ওয়াদ আলী, সমেদ আলী ও ছিপত আলীকে। বাউরবাগের আবদুস শুকুরসহ বেশ কয়েকজন এবং তেলিয়ার একজন স্বর্ণকারকে হত্যা করে তারা একই কায়দায়।
এছাড়া পাকাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন নিজপাটের আবুল হোসেন, মিছিয়া বিবি, আবদুল লতিফ, মনোরঞ্জন ও বাচ্চু মিয়া, রামপ্রসাদের আরজান আলী, পূর্ব সরুখেলের হরাই মিয়া, আসামপাড়ার মদরিছ আলী, বিড়াখেইয়ের মবশ্বর আলী, মুছা মিয়া, বিনিখেলের অহেদ আলী, আমানউদ্দিন, নয়াখেলের আবদুছ ছালাম, রূপচেংয়ের মতই, নিজামউদ্দিন, তজই মিয়া নামের এক ব্যক্তির স্ত্রী, গৌরী শঙ্করের আবদুর রহমান এবং শামসুল হকের মেয়ে ও নাতি এবং নিজপাটের আবদুর রশিদ প্রমুখ। শেলিংয়ে মারা যান কাওসার কাদের তালুকদার (রতন), হরু, হরুর স্ত্রী এবং তাদের ২ সন্তান এবং নূর ড্রাইভারের এক ভাই। আহত হন কবির খান, মনিরুজ্জামান খন্দকার ও মকসুদ চৌধুরী প্রমুখ। হয়রানির শিকার হয়েছেন যাঁরা, হাবিবুর রহমান চৌধুরী, রফিকুল মুরছালিন, হাতিম আলী মিস্ত্রি, মুহিবুর রহমান চৌধুরী, আলাউর রহমান চৌধুরী ও সেলিম আহমদসহ অসংখ্য লোক। লুতমহাইল গ্রামের আখলাকুর রহমান আকল ও তাঁর পুত্র সিরাজুল হক সিরাজকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাপ্টেন বসারত। নির্যাতন করার পর তাঁদের হত্যা করা হয়। দুর্গাপুরের কৃতী ফুটবলার আবদুর রকীব, সিলেটের কুইঘাট থেকে ধরে নিয়ে তাঁকে হত্যা করে পাকসেনারা। আর দরবস্তে হত্যা করে ডেমার পোদ্দারকে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত