চারগ্রাম গণহত্যা, সিলেট
চারগ্রাম সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম। এখানে রয়েছে ছোট একটি বাজার। জকিগঞ্জ দখল করার পর এই বাজারে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে পাকবাহিনী। পাশাপাশি পাকবাহিনীর সাহায্যে অনতিবিলম্বেই এগিয়ে আসে তাদের এ দেশীয় দোসররা। নাম লেখায় তারা রাজাকার বাহিনীতে। রাজাকাররা সেতু ইত্যাদি পাহারা দিত। আর আলবদর, আল শামস বাহিনী পালন করত হত্যাযজ্ঞের দায়িত্ব। প্রতিটি বাহিনীর জন্য তৈরি করা হলো আলাদা আলাদা ডেরা। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ করা হলো পৃথক পৃথক নির্যাতন কক্ষ। সেই সাথে সকল বাহিনীরই থাকল আলাদা রঙমহল। এ অঞ্চল শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত চলে অবাধে লুটপাট, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।
চারগ্রামের ছইদ আলী নামে একজন গাড়িচালক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের গাড়িতে করে বহন করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাত্রীবেশে পৌঁছে দিতেন মুক্তিবাহিনীর জোয়ানদের। সময়-সুযোগমতো এঁরা আক্রমণ চালাত পাকবাহিনীর ওপর। এ সংবাদ অবগত হয় পাকসেনারা সাথে সাথে ছইদ আলীর বাড়ি আক্রমণ করে। পালাতে পারলেন না দেশপ্রেমিক ছইদ আলী। জকিগঞ্জের এক খালের পাড়ে পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে। সেই বধ্যভূমিতে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে হত্যা করা হলো বীর ছইদ আলীকে। একই গ্রামের লালু মিয়ার বয়স তখন ৭০ বছর। তাঁর তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় তাঁকে। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানের উদ্দেশে। এরপর তাঁর আর কোনো সংবাদ জানা যায়নি। মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করার অপরাধে চারগামের আবদুল বারীকেও বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। অন্য একটি অভিযোগে পাকবাহিনী ধরে আনে ছওয়াব আলীকে। সামরিক যানে করে তাঁকে তারা নিয়ে যায় জকিগঞ্জ। তারপর সেই বধ্যভূমিতে রাজাকার মস্তু মিয়া হত্যা করে তাঁকে। আত্মীয়স্বজনরা বহু চেষ্টা করেও ছওয়াব আলীর লাশের সন্ধান পায়নি।
ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে বাড়ি থেকে ধরে আনা হয় রায়গ্রামের ফুরকান উদ্দিনকে। বন্দি হন ফুরকান উদ্দিন। পরে হাত-পা বেঁধে তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হলো একটি পরিচিত গাড়িতে। গাড়িটি এগুতে লাগল জকিগঞ্জের দিকে। অবশেষে সেই কুখ্যাত ‘মস্তু মিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন বধ্যভূমিতে আনা হলো তাঁকে। জল্লাদ মস্তু মিয়া কার্যকর করল ফুরকান উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড। চারগ্রামের আমরুজ আলীকে তাঁর নিজ বাড়ির আঙিনায় গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী।
তৈয়ব আলী চৌকিদারের ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়াতে তাঁকেও নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করে একাত্তরের নাৎসিরা। এমনকি দশ বছরের মেয়ে হাওয়ারুনও রেহাই পায়নি পশুদের হাত থেকে। নিতান্ত খেলাচ্ছলেই হাওয়ারুনকে রাস্তার ওপর হত্যা করে পাকবাহিনী। এভাবে এই অঞ্চলে তারা হত্যা করেছে বিভিন্ন বয়সী প্রায় ২৫ জনকে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত