You dont have javascript enabled! Please enable it! গোয়াইনঘাট গণহত্যা | সিলেট - সংগ্রামের নোটবুক

গোয়াইনঘাট গণহত্যা, সিলেট

সিলেট জেলা সদর থেকে সারিঘাট হয়ে গোয়াইনঘাটের দূরত্ব ৩২ মাইল। বলা যায়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক প্রত্যন্ত পাড়া-গাঁ। সেখানেও একদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হলো। এছাড়া থানার রাধানগর, সারিঘাট ও কাইরাই প্রভৃতি স্থানেও ক্যাম্প ও বধ্যভূমি গড়ে তোলা হয়। এই বধ্যভূমিতে প্রাণ দিতে হয় অসংখ্য লোককে। প্রতিটি ক্যাম্পেও প্রাণ দিয়েছেন শত শত পুরুষ এবং সম্ভ্রম খুইয়েছেন অসংখ্য মা-বোন।
পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুছ ছামাদ। পাকিস্তানি পশুরা খুঁজতে থাকে তাঁকে। অবশেষে একদিন তারা তাঁর বাড়িতে লাগিয়ে দেয় আগুন। মুহূর্তে কয়েকের মধ্যে ভস্মীভূত হয়ে যায় আবদুছ ছামাদের বাড়ি। একই দিনে তারা হত্যা করে বাউরভাগ গ্রামের আবদুল খালিককে। তারপর তাঁরই নীরব-নিথর দেহের ওপর দিয়ে বুট পায়ে হেঁটে অগ্রসর হয় হায়েনারা তাদের পশুবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য। ইক্ষু ব্যবসায়ী ছাদই মিয়াকে হত্যা করে জাফলংয়ে। আর অন্য কোথাও হত্যা করে তাঁর শ্বশুর হুসেন আলীকে।
সেপ্টেম্বর মাসের এক সুন্দর সকাল। গোয়াইনঘাট বাজার ও আশপাশের লোকজন প্রত্যক্ষ করলেন এক জঘন্য ঘটনা। পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ৭ জন অজ্ঞাত পরিচয় লোককে ধরে নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে গোয়াইন তীরের একটি নির্দিষ্ট বধ্যভূমির দিকে। এসব অসহায় আদম সন্তানের আহাজারিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ার উপক্রম হলেও ঘাতকদের মনে কোনো দয়ামায়ার উদ্রেক হয়নি। গোয়াইন নদীর তীরে অবস্থিত সেই বধ্যভূমির কাছে এসে অজ্ঞাত পরিচয় ৭ ব্যক্তিকে একই কাতারে দাঁড় করানো হয় এবং কালবিলম্ব না করে তাঁদের হত্যা করে পাকবাহিনী। পরে শহীদদের মৃতদেহগুলো নদীর তীরে তারা মাটিচাপা দিয়ে রাখে। সেই গণকবরটির আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। অক্টোবর মাসের কোনো একদিন শিমুলতলা গ্রামের খুরশেদ আলীকে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁরও প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়। একই দিন এই গ্রামের জনৈক আবদুল মান্নানের বোনকে ধরে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পাকবাহিনী। লাবু গ্রামের হাসমত আলীকে ধরে আনে তার বাড়ি থেকে। বন্দি করে রাখে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। এ সময় হাসমত আলীর মাথার ওপর এক বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ ঢেলে তাঁকে চরমভাবে নির্যাতন করত। অবশেষে একদিন তাঁকেও বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। কৌশলগত কারণে শান্তি কমিটির অন্তর্ভুক্ত হন বশিরুল হক। অথচ পাক হায়েনাদের আদেশ পালন না করায় তাকেও অপমান করে তারা।
নভেম্বর মাসের দিকে পাকবাহিনী গোয়াইন গ্রামে অপারেশন চালায়। এর শিকার হন মাহমুদ আলী ও তৈয়ব আলী। এই দুই ব্যক্তিকে তারা বাড়ি থেকে ধরে এনে সেই বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। শহীদদের লাশগুলো অবশ্য গ্রামবাসীরা পরে সেখান থেকে তুলে এনে ধর্মীয় বিধানমতো দাফন করেন। একই দিনে পাকবাহিনী ও এ দেশীয় দোসররা নিজের বাড়ি থেকে ধরে আনে তাদের ক্যাম্পে। পিরিজপুরের অনেককে তারপর নির্যাতনের পর নির্যাতন শেষে তাঁদের গুলি করে হতা করা হয়। আহত হয়ে কোনো রকমে প্রাণ রক্ষা করেন ফতু গ্রামের হাজী কেরামত আলী, হাজী ফজল মিয়া এবং শনির গ্রামের আবদুছ ছোবহান। অজ্ঞাত স্থান থেকে দুজন যুবককে আর একদিন ধরে আনে পাকবাহিনী। ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ক্যাম্পে আটক রাখার পর স্থানীয় হানাদার প্রধান কাপ্টেন বসারতের নির্দেশে দুজনকেই প্রাণ দিতে হয় পাক পশুদের হাতে। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অন্যান্য স্থান থেকে এনে গোয়াইন নদীর তীরে হত্যা করেছে ৫০ জনের বেশি লোককে।
[৪৬] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (দ্বিতীয় খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত